ব্যারিস্টার, দয়া করে শিখুন শিষ্টাচার

কবির য়াহমদ
Published : 22 Oct 2018, 10:19 AM
Updated : 22 Oct 2018, 10:19 AM

ওয়ান-ইলেভেনের সময়ের 'মাইনাস টু' ফর্মুলা বাস্তবায়নের অন্যতম প্রধান কুশীলব ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন দীর্ঘদিন প্রচারের আলোর বাইরে থাকার পর ফের আলোর মুখ দেখেছেন। দেশকে বিরাজনীতিকরণের ষড়যন্ত্র শেষে এবার রাজনীতির নামেই হাজিরা দিচ্ছেন, সওয়ার হয়েছেন 'জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে'

আলোচনায় একই সঙ্গে লেখক ও সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টির প্রতি অশিষ্ট মন্তব্য করে।   বিরাজনীতিকরণের এই কুশীলব রাজনীতির খোলসে কিংবা সরকার পরিবর্তনের জোটে নামার পর তার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে আলোচনার দাবি রাখে। তবে যথারীতি শুরুটা করেছেন বিতর্কিতভাবে, এবং সেটা মাসুদা ভাট্টিকে অপমানের মাধ্যমে।

মাসুদা ভাট্টির অপরাধ ছিল জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন কী ভূমিকায় আছেন, কার প্রতিনিধিত্ব করছেন সে প্রশ্ন। এ প্রশ্ন রাজনীতি সচেতন কারও কাছে আপত্তিকর মনে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু মইনুল হোসেন যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন সেটা যেকোনো সুস্থ মানুষের কাছে কাঙ্ক্ষিত নয়। যেকোনো সুস্থ মানুষের কাছ থেকে এমন প্রতিক্রিয়াও কাঙ্ক্ষিত নয়। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো মইনুল হোসেন সেটাই করেছেন, এবং অনুমিত সংখ্যার লক্ষাধিক  দর্শকও সেটা দেখেছেন। তিনি মাসুদা ভাট্টিকে 'চরিত্রহীন' শব্দ উল্লেখে অপমান করেছেন। একই সঙ্গে 'একজন ভদ্রমহিলা' হিসেবে সেভাবে প্রশ্ন করার অনুরোধও জানিয়েছেন।

এখানে লক্ষ্যণীয় যে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন মাসুদা ভাট্টিকে 'ভদ্রমহিলা' হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। 'মহিলা' শব্দের আগে 'ভদ্র' শব্দের উপমা ব্যবহার করে প্রকৃত তিনি কৌশলের আশ্রয় নিয়ে আদতে মাসুদা ভাট্টিকে স্রেফ একজন মহিলা বলছেন, পেশাগত সাংবাদিক পরিচয়টা উহ্য কিংবা অস্বীকার করতে চেয়েছেন স্বভাবজাত কৌশলে। এই 'মহিলা' শব্দে ছিল লৈঙ্গিক প্রসঙ্গ উপস্থাপনে আপত্তিকর ইঙ্গিত। যা তিনি তার পুরো বক্তব্যে প্রমাণ করেছেন। সে বক্তব্যে দম্ভের প্রকাশ ছিল আগাগোড়া। গণমাধ্যমে এসে এক অতিথি অন্য অতিথির প্রতি এমন আক্রমণাত্মক ঢঙ আর দম্ভের প্রকাশ সুবিবেচনার নয়, প্রত্যাশিতও নয়।

একাত্তর টেলিভিশনের সেই আলোচনায় মাসুদা ভাট্টির প্রশ্ন ছিল মইনুল হোসেনের কাছে,'জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে আপনি যে হিসেবে উপস্থিত থাকেন- আপনি বলেছেন আপনি নাগরিক হিসেবে উপস্থিত থাকেন।  কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই বলছেন, আপনি জামায়াতের প্রতিনিধি হয়ে সেখানে উপস্থিত থাকেন'। জবাবে মইনুল হোসেন বলেন, 'আপনার দুঃসাহসের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনি চরিত্রহীন বলে আমি মনে করতে চাই। আমার সঙ্গে জামায়াতের কানেকশনের কোনো প্রশ্নই নেই।  আপনি যে প্রশ্ন করেছেন তা আমার জন্য অত্যন্ত বিব্রতকর'

এরপর মাসুদা ভাট্টি বলেন, 'আপনি শিবিরের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং আপনি সেই অনুষ্ঠানে বলেছেন যে আপনার সঙ্গে শিবিরের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। সেই বক্তব্য এখন সব জায়গায় দেখানো হচ্ছে।  এ কারণে মানুষ এই প্রশ্ন করছে যে আপনি জামায়াতের হয়ে এখানে উপস্থিত থাকছেন কি না'। তখন মইনুল হোসেন বলেন, 'আমাকে বাদ দেন।  আচ্ছা, ঠিক আছে আপনি কার পক্ষ হিসেবে আসছেন?' তখন মাসুদা ভাট্টি বলেন,'আমি কোনো দলের নই, বরং সাংবাদিক হিসেবে এসেছি'

টেলিভিশন আলোচনায় আলোচকদের মধ্যে সাম্প্রতিক বিষয় ও আলোচনাযোগ্য বিষয়ে আলোচনা হওয়াটা স্বাভাবিক। অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে একজন সাংবাদিক এধরনের প্রশ্ন করতেই পারেন। বলা যায় এধরনের প্রশ্ন করার জন্যেই তার বা তাদের অনুষ্ঠানে উপস্থিতি। 'জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের' মঞ্চে থাকার মত একজন ব্যক্তি যখন আলোচনায় উপস্থিত তখন উদ্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে এধরনের প্রশ্ন না আসলে সেটাই হতো অস্বাভাবিক, তাই মইনুল হোসেনের কাছে মাসুদা ভাট্টি যে প্রশ্ন করেছেন সেটা কোনোভাবেই অনুষ্ঠানের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক নয়।

এছাড়া মাসুদা ভাট্টির এই প্রশ্নটা জরুরি ছিল খুব কারণ জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতৃত্ব পর্যায়ের যারা আছেন তাদের মধ্যে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন এবং ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীই কেবল সরাসরি কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হন। এর মধ্যে আবার জাফরুল্লাহ চৌধুরীকেও বাদ দেওয়া সম্ভব কারণ তিনি সরাসরি বিএনপির সঙ্গে যুক্ত না হলেও বিএনপিপন্থী পেশাজীবী নেতা। এবং গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিক ভাবে তিনি বিএনপির পক্ষে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে আসছেন, বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের আলোচনা অনুষ্ঠানেও বিএনপির পক্ষে বলে আসছেন। তবে মইনুল হোসেনের এই ধরনের কোন পরিচয় নাই। উলটো তার পরিচয় হচ্ছে ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপি থেকে শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়াকে 'মাইনাস' করতে তিনি সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার সেই অপচেষ্টা শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। এবং ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলের শেষে তাকেও প্রচারের বাইরে চলে যেতে হয়েছিল।

সেনা-সমর্থিত সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে মইনুল হোসেনের বিভিন্ন বক্তব্য এবং পদক্ষেপ ছিল সরকার ব্যবস্থাকেই রাজনীতিবিদ-বিযুক্তিকরণের। রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের প্রতি তীব্র দ্বেষ ফুটে ওঠেছিল তার সেই সব বক্তৃতা ও নানা ভূমিকায়। এমন চরিত্র ও বিশ্বাসের একজন যখন দীর্ঘ প্রায় এক দশকের বিরতি দিয়ে ফের সক্রিয় হন তখন এনিয়ে প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। এছাড়াও তার প্রতি সন্দেহ আরও বেশি পোক্ত হয় যখন তিনি কোন দলের প্রতিনিধি হিসেবে ঘোষণা না দিয়েও রাজনীতিবিরোধি হয়েও রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হন।  

জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে যোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে ড. কামাল হোসেনের রাজনৈতিক দল আছে, মাহমুদুর রহমান মান্নারও দল আছে, আ স ম আব্দুর রবেরও জাসদ নামের একটা দলের একটা অংশের নেতৃত্ব আছে, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বিএনপিপন্থী পেশাজীবী নেতা পরিচয় আছে, কিন্তু ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের এমন কোনও পরিচয় নাই। তার যে পরিচয় ও ভূমিকা আছে সেটা মাত্র এক দশক আগের বাংলাদেশের রাজনীতিকে রাজনীতিবিদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রের। ওই সময় আবার যে ভূমিকা সেটা ছিল বাংলাদেশবিরোধি অপশক্তি জামায়াতে ইসলামিকে পুনর্বাসন। সেদিন সম্ভব হয়নি রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও দেশের মানুষের কারণেই।

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনরা ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে পরাজিত হয়েছিলেন। এরপর দীর্ঘদিন গা ঢাকা দিয়েছিলেন। তবে অদ্য ফিরে এসেছেন অন্য ভূমিকায়। এবার তিনি সওয়ার হয়েছেন যেখানে সেখানে বিএনপি মূলত প্রধান দল। অথচ এই বিএনপিই নাস্তানাবুদ হয়েছিল মইনুলদের সময়ে। বেগম খালেদা জিয়ার কারাগারে যাওয়ার মামলা মইনুল হোসেনদের আমলের। বিএনপি ওই সময়ে এতখানি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল যে সে সময়ও খালেদা জিয়া-তারেক রহমান কারাগারে গিয়েছিলেন, এবং তখন এম সাইফুর রহমানের নেতৃত্বে বিএনপিরও পৃথক কমিটি হয়েছিল।

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন বঙ্গবন্ধুর ছিলেন, খুনি মোশতাকের ছিলেন, ওয়ান-ইলেভেনের ছিলেন, রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার কুশীলব ছিলেন, বিএনপির বিরোধি ছিলেন, তবে এখন বিএনপির কাছাকাছি এসেছেন। একের মাঝে এমন বহুমুখী চরিত্রের সন্নিবেশ হালের রাজনীতিবিদ না হয়েও তিনি রাজনীতির মাঠের একটা পক্ষকে এগিয়ে দেওয়ার পক্ষে। তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়ে জামায়াত পুনর্বাসনে কাজ করলেও নিজেকে জামায়াত বলে পরিচয় দেন না। এবং জামায়াত-শিবিরের অনুষ্ঠানে গিয়ে শিবিরের প্রশংসা করেন কিন্তু তাকে সেই কথা বললে অশিষ্ট আচরণে প্রশ্নকর্তাকেই অপমান করে নিজে 'বিব্রত' বলেও দাবি করেন। তার এই চরিত্রকে তবে কী নামে আখ্যা দেওয়া যায়? বর্ণচোরা!

সাংবাদিক মাসুদা ভাট্টিকে কদর্য ইঙ্গিতে আক্রমণাত্মক ভাষায় কটূক্তি করা মইনুল হোসেন আইন বিষয়ে লেখাপড়া জানা লোক, ব্যারিস্টার পদবিও। আইন পাসে ব্যারিস্টার হয়েছেন তিনি এ তার পদবি থেকে স্পষ্ট, কিন্তু শিষ্টাচার শিখেছেন কতখানি এনিয়ে সন্দেহ প্রবল। পৃথিবীর কোন মক্তব-মাদরাসা-স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় শিষ্টাচারের জন্যে ডিগ্রি দেয় না, কিন্তু এটা মানুষের প্রতি মানুষের আচরণে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, কখনও লক্ষ্যে, কখনওবা অলক্ষ্যে। মইনুল হোসেনের টেলিভিশনে দেওয়া বক্তব্যে সেটা আরও বেশি পরিস্কার হয়ে গেল যখন তিনি মাসুদা ভাট্টিকে 'চরিত্রহীন' বলে কটূক্তি করলেন।

অথচ ব্যারিস্টারি পাস করে, আইন সহ অন্যান্য বিষয়ে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থাকা তার মত লোকের জানা উচিত ছিল টেলিভিশন অনুষ্ঠানে বা অন্য কোন মাধ্যমে যখন প্রশ্নকর্তার(দের) সেই সুযোগ এবং অধিকার আছে কারও ভূমিকা ও পরিচিতি জানার। এটা গণতান্ত্রিক রীতিও। এখানে মতের ভিন্নতা থাকা অস্বাভাবিক নয়। তিনি কী ভূমিকায় 'জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে' এটা জানার অধিকার সকলের।

মাসুদা ভাট্টি ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের ভূমিকা ও সাম্প্রতিক পরিচয় নিয়ে প্রশ্নের পর অপমানিত হওয়ার পর ধিক্কার ওঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, বিভিন্ন গণমাধ্যমের লেখালেখি ও বিভিন্ন আলোচনায়। অবস্থা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যেখানে দেশের একাধিক বিশিষ্টজন সহ শতাধিক পেশাজীবী গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে এর নিন্দা, প্রতিবাদ জানান, একই সঙ্গে প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানান তার প্রতি। সুস্থ চিন্তার মানুষদের এমন প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ফোন করে দুঃখপ্রকাশ করলে জবাবে মাসুদা ভাট্টি জানিয়েছেন এভাবে ব্যক্তিগতভাবে দুঃখপ্রকাশ না করে যেভাবে অন-এয়ারে অপমান করেছেন সেভাবেই তাকে ক্ষমা চাইতে হবে। তখন মইনুল জানিয়েছেন সুযোগ পেলে তিনি সেটা করবেন। এই টেলিকথনের বাইরে তিনি একাত্তর টেলিভিশনে প্রেরিত এক লিখিত বার্তায় তার সেই ভুলের জন্যে দুঃখপ্রকাশ করেছেন।

সরাসরি সম্প্রচারিত টেলিভিশন অনুষ্ঠানের পর ফোন করে কেবল দুঃখপ্রকাশে মাসুদা ভাট্টি সন্তুষ্ট নন, সন্তুষ্ট নন কেউই; এবং সেটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে দাবি অনুযায়ি প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনাই কাঙ্ক্ষিত। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে কেবল মাসুদা ভাট্টি নন অন্যদের ক্ষেত্রেও এমন আচরণ করবেন না সে  অঙ্গিকারও করা উচিত তার। কারণ তার রাজনৈতিক কিংবা চারিত্রিক ইতিহাস বলে সময় ও সুযোগে তার মত করে প্রতিশোধে পিছপা হবেন না হয়ত তিনি।

ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের শিষ্টাচার বহির্ভুত আচরণে আমরা ক্ষুব্ধ। অশিষ্ট আচরণে তিনি ধারাবাহিক। তার দীর্ঘ জীবন এমন শিষ্টাচারহীনতায় পূর্ণ। এ অবস্থার অবসান হওয়ার দরকার। তিনি আইন শিখেছেন, চর্চাও করছেন; এবার শিষ্টাচার শিখতে এবং সে চর্চার দাবিও আমরা করতে পারি। প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা এবং অঙ্গিকারের পাশাপাশি এটাও হতে পারে তার কাছে বড় চাওয়া আমাদের।