লিখিত মাফ চাইলেই কি মাফ করা হয়ে যাবে?

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 19 Oct 2018, 11:55 AM
Updated : 19 Oct 2018, 11:55 AM

খবরে দেখলাম মইনুল হোসেন লিখিত ভাবে মাফ চেয়েছেন। একেই বলে ফাঁন্দে পড়িয়া বগা…। কিন্তু ফাঁদ যখন উঠে যাবে, যদি দেশের রাজনীতি বদলে যায়, যদি আবার সুযোগ মেলে- ব্যরিস্টার সাহেব কী এই ঘটনার শোধ তুলবেন না? কে দেবে তার গ্যারান্টি? কে দেবে তার নিশ্চয়তা? আর এটাও কি মানতে হবে যার যখন খুশি নারীদের অপমান করে, তারপর মাফ চাইলেই সব দোষ খতম বা জায়েজ হয়ে যাবে?

সমাজে, রাষ্ট্রে কত ধরনের যে দানব থাকে! সবাইকে আপনি সনাক্তও করতে পারবেন না। কিন্তু একটা সময় তারা নিজের আচরণে- প্রকৃতির নিয়মে ধরা খায়। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তেমনই একজন। তার দানব আচরণের কারণ জানলেও বলা যায়না! কারণ তিনি মানিক মিয়ার পুত্র। পিতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কাছের মানুষ। ইত্তেফাক ছিলো মুক্তিযুদ্ধের আশা জাগানিয়া খবরের কাগজ।

কথিত আছে, মানিক মিয়ার মৃত্যুর পর ঢাকায় লাশ দাফনে পাকিস্তানি সরকারের গড়িমসি ও জায়গা না দেওয়ার কারণে বঙ্গবন্ধু নাকি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন একদিন দেশ স্বাধীন হলে, ঢাকার বড় রাস্তার নামকরণ করা হবে মানিক মিয়ার নামে। হয়েছেও তাই। অথচ মইনুল হোসেন ঘোর আওয়ামীবিরোধী। তাও এখন থেকে না, সেই চুয়াত্তর থেকে। অভিযোগ রয়েছে, সেসময় একগাদা রাজাকার আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাংবাদিককে জায়গা দিয়েছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় গুঁড়িয়ে দেওয়ার ভয়াবহ স্মৃতি ভুলে তৎকালীন ইত্তেফাক হয়ে উঠেছিলো বঙ্গবন্ধুবিরোধী আস্তানা।

মাছ ধরার জাল পরিহিত বাসন্তির ছবি ছেপে প্রমাণ করতে চেয়েছিল দেশে মানুষের কাপড় পর্যন্ত নেই। পরে তথ্য-প্রমাণসহ বাস্তবতা বলে দিয়েছে যে সময় দরিদ্র বাসন্তীকে ঠকিয়ে এমন ছবি ছাপানো হয়, তখন কাপড়ের দাম ছিলো মাছ ধরার জালের চাইতে কম।

এই মানুষটি তার জীবনের ব্রত হিসেবে আওয়ামী লীগের বিরোধিতাকে বেছে নিয়েছেন। নিন্দুকেরা বলে ছোট ভাইয়ের সাফল্য ও ঈর্ষার কারণেই নাকি এমনটা। তাকে কে জায়গা দেবে দলে? পঁচাত্তরের পর তিনি গিয়েছিলেন মোশতাকের সাথে। খন্দকার মোশতাককে প্রমোট করার নামে ইত্তেফাক তখন বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডসহ সবকিছু জায়েজ করতো।

এই লোকের আচরণেও এক ধরনের উগ্রতা আছে বলে সবসময় মনে হয়েছে। যখন তিনি ইত্তেফাকের দায়িত্বে ছিলেন তখন পত্রিকাটির মালিকানা ও নানা দ্বন্দ্বে গুলিবিনিময়ে মানুষ খুনের ঘটনা ঘটার পরও তিনি বারবার বেঁচে যেতেন।  যে অশুভ আঁতাত বা কানেকশান তাকে বাঁচাতো, এখন তিনি তাদের দালালী করতে মাঠে নেমেছেন কি? মুশকিল হলো মইনুল হোসেন ভুলে গেছেন আগের কাল আর আজকের যুগে অনেক তফাৎ।  এখন এইসব মানুষের আস্ফালনের মূল্য নাই। আর যা খুশি করে পদ-পদবীর জোরে পার হবার দিনও বিগত।

কথাগুলো বললাম এই কারণে যে, ব্যারিস্টার সাহেব ৭১ টিভির টকশোতে এসে এমন কথা বলেছেন, যা আমাদের মা-বোন তো বটেই, যেকোনও নারীর জন্য অপমানের। এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধের পর্যায়ে পড়া এই বক্তব্য এখন মানুষকে উদ্বিগ্ন ও শঙ্কাকূল করে তুলেছে। সে টক শোতে ছিলেন মাসুদা ভাট্টি।

লন্ডন থেকে দেশে ফিরে সাংবাদিকতা ও লেখালেখি করা মাসুদ ভাট্টির সাথে যে দুই-একবার কথা হয়েছে, তাতে আমি এটা নিশ্চিত তিনি মিতভাষী। উগ্রতা বলে কিছু নেই তার কথায় ও আচরণে। মাসুদা ভাট্টির দুটো নিরীহ প্রশ্নের উত্তর দিতে অসমর্থ হওয়ায়, মইনুল তাকে 'চরিত্রহীন' বলে মিডিয়ায় যে ঘোষণা দিলেন যেকোনও সভ্য দেশ হলে মইনুলের আর করে খেতে হতো না।

যে দেশ থেকে ব্যারিস্টারি ডিগ্রি নিয়ে এসে ছড়ি ঘোরান সেদেশে হলে, তার খবর ছিলো। তিনি জামায়াতের প্রতিনিধি হয়ে নতুন জোটে আছেন বা যাতায়াত করেন কিনা, এই সাধারণ প্রশ্নের উত্তরে তিনি 'হ্যাঁ' বা 'না' যেকোনও একটা বলতে পারতেন।

সেটা না করে তার যে উগ্র স্বভাবের চেহারা দেখালেন, তাতে এটা স্পষ্ট এই মানুষগুলো আর যাই হোক আমাদের সমাজ ও দেশের মঙ্গলে আসার মতো মানুষ নন। এটা আমি আ স ম রবের বেলায়ও দেখেছি। সাধারণ মামুলী প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে নিজের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য হুমকি দিতে থাকেন। এরা আসলে হতাশ । এদের জীবনের এই পর্যায়ে তারা বুঝে গেছেন, তাদের আর কিছু দেবার কোনও সামর্থ্য নাই। তাই নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য জোট বাঁধেন আর চেহারা বেরিয়ে আসলেই এমন সব আবোল-তাবোল কথা বলেন।

মাসুদা তো ঠিক কথাই বলেছিলেন। ওয়ান-ইলেভেনের সময় তিনি যে মামলা দায়ের করেছিলেন, তার কারণেই খালেদা জিয়া এখন কারাগারে। সে দায় অস্বীকার করার জন্য মাসুদা ভাট্টিকে 'চরিত্রহীন' বলা কতটা যুক্তিসঙ্গত? মইনুল হোসেন এমনই একজন লোক যিনি প্রয়োজনে খালেদা জিয়াকে ফাঁসিয়ে দিতে পারেন, প্রয়োজনে জামায়াতের সাথে যেতে পারেন ।

এমন বহুমুখি সাপের হাতে কতটা নিরাপদ সমাজ? রাজনীতিই বা কতটা নিরাপদ? আমি চ্যালেঞ্জ করে বলছি, কেউ আমাকে তিনটা কারণও দেখাতে পারবেন না, যেসব কারণে রাজনীতিতে মইনুল হোসেনকে সাথে নেওয়া যেতে পারে। তিনি যখন যার সাথে গেছেন তার ভরাডুবি নিশ্চিত করেছেন।

যে সময়ের কথা বলছি তখন ঢাকাসহ সারাদেশে এক অরাজক পরিস্থিতি। খন্দকার মোশতাক ও অলি আহাদের সাথে জোট বাঁধা মইনুল হোসেন পরিবেশ উত্তপ্ত করার কাজ করলেও, নিজে কিন্তু ঝামেলায় জড়াতেন না। এমন কি এক-এগারোর সময় তাকে সরকারে নেওয়া হলেও টিকতে পারেননি। স্বভাবসুলভ ঝগড়া বাঁধিয়ে কেটে পড়েন। এখন ইনি নতুন গড়া জোটে ঢোকার জন্য মরিয়া। বলাবাহুল্য তিনি একাই একশ' এই জোটকে ডুবিয়ে দিতে।

খেয়াল করবেন কখনোই স্বাভাবিক মন মননে থাকেন না ইনি। সবসময় উগ্র আর রগচটা। বাংলাদেশে এমনতিতে নানা কারণে উত্তেজনার কমতি নাই। বাড়তি এই ঝুট ঝামেলা নেবার আদৌ কোনও কারণ নাই জাতির।

কিন্তু এখন বিষয় আরেক। তিনি তার আসল চেহারা বের করে এনেছেন তাও মিডিয়ায়। একজন নারীকে অপমান করার আগে মইনুলের বোঝা উচিৎ ছিল, এখন দেশে নারীরা তাদের আপন মহিমায় উদ্ভাসিত। তাদের সাথে যা খুশি তা করে পার পাবার দিন শেষ। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধী নেত্রী, কারাবন্দি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী- সবাই নারী। এই দেশে তিনি যদি বিনা বিচারে, বিনা বাঁধায় পার হয়ে যেতে পারেন, তাহলে সময় বা সভ্যতা কোনওটাই আমাদের মাফ করবেনা।

মইনুল হোসেন হয়তো জানেনই না, দেশে বা সমাজে তিনি কতটা ঘৃণিত। তাকে ধন্যবাদ জানাই একটি কারণে। এই হট হেডেড বা মাথা গরম করার কারণে তার আসল চেহারা দেখার সুযোগ পেল জাতি। সাথে বেরিয়ে এলো মানুষের মনের ঘৃণা। ধিক্কার জানানোরও ভাষা নাই তাদের।

মইনুল হোসেন কি পার পেয়ে যাবেন এবারও? আমাদের সমাজে কি 'নারী মানে পুরুষের ভাষা ও আচরণগত লালসার শিকার'- এটাই সত্য হবে? ইত্তেফাকের সুনাম, মানিক মিয়ার সুনাম, এমন কী সমাজের সুনাম নষ্ট করা এই অভদ্র মানুষটি যেন আর দাঁতমুখ খিঁচিয়ে চোখ গোল গোল করে শাসাতে না পারে, তার একটা বিহিত হওয়া দরকার।

সমাজ যে এগিয়েছে, মানুষ যে আধুনিক হয়েছে, নারীর অধিকার ও সম্মান যে এখন নিরাপদ, তার প্রমাণ চাই আমরা। শুধু মাফ চেয়ে পার পাওয়ার সময় নাই এখন। দেশ ও জাতির আশা এমন একটা ব্যবস্থা নেওয়া হোক যাতে মইনুল হোসেনের মত মানুষেরা কোনদিন ভাবতে না পারে, তারা যা খুশি তা বলে বা করে পার পাবেন। আর একটা বিষয় আমাদের মা-বোনেরা, নারীরা যে নিরাপদ তারও গ্যারান্টি চায় জাতি। নতুন জোটের নেতারা যদি এবিষয়ে নীরব থাকেন তাহলে তাদের দুর্ভোগেরও অন্ত থাকবে না।

সময় ও সবাই মিলেই এমন দানবের মোকাবেলা করা জরুরি।