সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ: স্বপ্নের শুরু এবং পরবর্তী ভাবনা

মোহাম্মদ আব্দুল বাছিত
Published : 19 Oct 2018, 04:26 AM
Updated : 19 Oct 2018, 04:26 AM

বিদেশের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পরপর দেশে ফিরবে নাকি বিদেশে কোথাও ক্যারিয়ার শুরু করবে এই নিয়ে অনেকেই কমবেশি দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েন। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।

২০১১ সালের প্রথম দিকে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি থিসিস জমা দেবার সময়ে ড্রেসডেন, জার্মানির একটি রিসার্চ ইন্সটিটিউট থেকে ইলেকট্রন মাইক্রসকোপিস্ট (রিসার্চ)  হিসেবে চাকরির প্রস্তাব পেলাম। । ওই ইন্সটিটিউটের একটি গ্রুপের সাথে আমাদের রিসার্চ কোলাবরেশন থাকার সুবাদে আগে থেকে যাওয়া-আসা ছিল এবং তাদের গবেষণা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা ছিল। আমার সামনে দুটি রাস্তা ছিল, হয় ড্রেসডেনে গিয়ে চাকরিতে যোগ দেওয়া, না হয় দেশে ফিরে বুয়েটে লেকচারার হিসেবে শিক্ষকতা চালিয়ে যাওয়া।

আমরা যারা এক্সপেরিমেন্টাল গবেষণা করি তাদের কাছে সবচেয়ে লোভনীয় কাজের একটি হচ্ছে ট্রান্সমিশন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ নিয়ে কাজ করা। পিএইচডি ছাত্রাবস্থায় প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুই-তিন দিন এই যন্ত্রটি ব্যবহারের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। তাই ড্রেসডেনের চাকরির প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করা কিছুটা কঠিন ছিল। তবু ২০১১ সালের মে মাসের আলো ঝলমল এক সুন্দর সকালে ঢাকার উদ্দেশে গ্লাসগো থেকে এমিরেটস-এর একটি প্লেনে চড়ে বসলাম।

বাংলাদেশে ২০১১-২০১২ সালের দিনগুলি অনেক দুশ্চিন্তা আর অনিশ্চয়তায় ভরপুর ছিল। পিএইচডি করার সময় আমার সুপাভাইজার আর গ্রুপের অন্য সদস্যদের সান্নিধ্যে বুঝতে পেরেছিলাম এই ডিগ্রির উদ্দেশ্য হচ্ছে- নতুন একজন গবেষককে যথেষ্ট প্রশিক্ষণ দিয়ে ভবিষ্যতের একজন স্বাধীন গবেষক তৈরি করা। ভবিষ্যতের ওই গবেষক নতুন আইডিয়া সৃষ্টি করে তা বাস্তবায়ন করবে, প্রজেক্ট প্রপোজাল লিখে গ্রান্ট সংগ্রহ করবে, শিক্ষার্থী সুপারভাইজ করে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলবে, দেশের শিল্প-কারখানায় বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করবে। কাজেই পিএইচডি অর্জনের পরেই সত্যিকার অর্থে একজন ডিগ্রিধারীর ক্যারিয়ার শুরু হয়।

যাই হোক, বুয়েটে যোগ দেওয়ার পর স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কিছু কোর্স পড়ানোর সুযোগ পেলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় তো শুধু কিছু কোর্স পড়ানোর জায়গা না, অর্জিত জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি নতুন জ্ঞান সৃষ্টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল উদ্দেশ্য। পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের সময় আমি অভিজ্ঞতা লাভ করেছি এক্সপেরিমেন্টাল (ব্যবহারিক) গবেষণায়, দিনের পর দিন চেষ্টা করেছি বিভিন্ন এক্সপেরিমেন্টাল টেকনিক শিখতে। এই কথা অনস্বীকার্য যে, এক্সপেরিমেন্টাল গবেষণার জন্য প্রয়োজন উন্নত গবেষণা ল্যাবরেটরি এবং যন্ত্রপাতি। তাই ঢাকার কোথায় কি ধরনের গবেষণা সুবিধা রয়েছে তার খোঁজ নিতে শুরু করলাম। একটি গবেষণা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে প্রাথমিক আলাপ আলোচনা থেকে বুঝতে পারলাম ওই সংস্থার যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হলে কিছু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার ভিতর দিয়ে যেতে হবে, একজন গবেষকের জন্য এটি সুখকর নয়। তবু কিছু কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। তবে প্রতিটি এক্সপেরিমেন্ট-এর জন্য একটি ফি দিতে হবে শুনে আমি সত্যি হোঁচট খেলাম। তাই খুব ছোট পরিসরে হলেও, নিজে কিছু একটি গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করলাম।

২০১৩ সালে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে গবেষণা প্রকল্প আহ্বান করা হল। সিদ্ধান্ত নিলাম একটি গবেষণা প্রকল্পের অনুদানের জন্য আবেদন করবো । কয়েক মাস পরেই মঞ্জুরি কমিশন থেকে আমার গবেষণা প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে এই মর্মে চিঠি পেলাম । এক লাখ ছত্রিশ হাজার টাকার এই গবেষণা অনুদান আমাকে অনেক আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। প্রায় একই সময়ে বুয়েটের উন্নয়ন প্রকল্প থেকে আরও কিছু টাকা পেলাম। খুব চিন্তাভাবনা করে, আসছে দিনগুলোতে কী ধরনের গবেষণা করতে পারবো মাথায় রেখে কয়েকটি ছোটখাটো যন্ত্রপাতি কিনে ফেললাম।

এবার পড়লাম আরেক বিপত্তিতে, এই যন্ত্রপাতিগুলো রাখবো কোথায়? বুয়েটের স্পেস যথেষ্ট সীমিত এবং বিশেষ করে পুরাতন একাডেমিক ভবন, যেখানে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, সেখানে খালি জায়গা নাই বললেই চলে। তারপরেও বারবার বিভাগীয় প্রধানের কাছে একটি রুম বরাদ্দের জন্য বলতে থাকি। ২০১৪ সালের প্রথম দিকে বিভাগের স্টোর রুমটি ল্যাবরেটরি হিসাবে উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য আমাকে অনুমতি দেয়া হয়। এই অল্প কিছু ফান্ড এবং প্রাথমিক লেভেলের কিছু যন্ত্রপাতি নিয়ে গড়ে তুলতে শুরু করলাম 'ন্যানোটেকনোলজি রিসার্চ ল্যাবরেটরি'।

২০১৪ সালে আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ফিজিকস-এর 'জার্নাল অব অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স' এবং রয়াল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রির জার্নাল 'ন্যানোস্কেল' – এ আমাদের দুটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ হয়। এই দুটি প্রবন্ধ পরে আরও কিছু গবেষণা ফান্ড পেতে বিশেষভাবে সাহায্য করে। আমি ২০১৪-২০১৫ সালে একে একে কয়েকটি গবেষণা ফান্ড পেয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন ছাড়াও দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাকাডেমি অব সাইন্স, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড এবং বুয়েট থেকে প্রায় দুই কোটি টাকার ফান্ড পাই। শিক্ষার্থী, সহকর্মী, বুয়েট প্রশাসন সবার সহযোগিতায় ধীরে ধীরে গড়ে তুলি এই ন্যানোটেকনোলজি রিসার্চ ল্যাবরেটরি। ২০১৭ সালের মে মাসে উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্প (হেকেপ) এর আওতায় একটি উপ-প্রকল্প থেকে আরও এক কোটি নব্বই লাখ টাকা গ্রান্ট পাই; যার একটি বড় অংশ ব্যবহৃত হয়েছে ন্যানোটেকনোলজি রিসার্চ ল্যাবরেটরির জন্য যন্ত্রপাতি কিনতে।

২০১৩ সালে প্রায় শূন্য থেকে এই মানের একটি ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করা কেবল একটি স্বপ্ন ছিল । আমি এখনো সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটছি। মাত্র চারশ' বর্গফুটের একটি ল্যাবে রয়েছে বিভিন্ন টেকনিকে ম্যাটেরিয়ালস সিনথেসিসের প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, ভালো মানের দুইটা ফার্নেস, স্পিন কোটার, ফেরোইলেকট্রিক লুপ ট্রেসার, ডিআই ওয়াটার প্লান্ট, ফিউম হুড, ইউ-ভি ভিজিবল স্পেকট্রসকপি, ফ্লুরেসেন্স স্পেকট্রসকপি, হাই পাওয়ার জেনন ল্যাম্প এজ সোলার সিমুলেটর, ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল ওয়ার্ক স্টেশন উইথ ইম্পিড্যান্স স্পেকট্রসকপি, ম্যাগনোটোরেজিস্ট্যান্স মেজারম্যানট সেট আপ, গ্যাস ক্রমোট্রগ্রাফি, হাইড্রলিক প্রেস, অটো ক্লেভ, সেন্ট্রি ফিউজ মেশিন ইত্যাদি। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে, খুব বেশি দামের, খুব বড় কোনও যন্ত্র ল্যাবে নেই। আগামী কয়েক বছর কী ধরণের গবেষণা করা হবে, ওই গবেষণার জন্য একদম প্রাথমিকভাবে যেসব যন্ত্র প্রয়োজন সেগুলোই কেনা হয়েছে। একটি একটি করে যন্ত্র  কেনা হয়েছে এবং তার সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য এক্সপার্টাইজ গড়ে তোলা হয়েছে। পরবর্তীকালে ওইটার জন্য অন্য আনুষঙ্গিক যন্ত্র কেনা হয়েছে, কখনো কখনো কাস্টমাইজ করা হয়েছে।

শুরুর দিকে পঞ্চাশ লাখ টাকা দিয়ে একটি যন্ত্র কেনার চেয়ে প্রয়োজনীয় পাঁচটি যন্ত্র কিনতে আমার আগ্রহ বেশি ছিল। এই 'বটম আপ অ্যাপ্রোচ' খুব ভালো কাজে এসেছে বলে আমার বিশ্বাস।

গত সাড়ে চার বছরে ল্যাবের শিক্ষার্থীরা মানসম্মত বিশটি গবেষণাপত্র প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন পাবলিশারের জার্নাল, যেমন- আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স, ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্স ইউকে, নেচার পাবলিশিং গ্রুপ, রয়্যাল সোসাইটি অব কেমিস্ট্রি ইত্যাদিতে প্রকাশ করেছে। এই ল্যাবের শিক্ষার্থীরা বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। ইতিমধ্যে অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের পিএইচডি ডিগ্রির জন্য গবেষণা শুরু করেছেন। এখন পর্যন্ত পদার্থ বিজ্ঞান ছাড়াও বুয়েটের ইলেক্ট্রিক্যাল, মেকানিক্যাল, ম্যাটালারজি, রসায়ন, আইপিই, সিভিলসহ বিভিন্ন বিভাগের ছাত্ররা তাদের গবেষণার জন্য ল্যাবটি ব্যবহার করেছেন এবং করছেন।

মাত্র চারশ বর্গফুট জায়গা নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সংস্থা থেকে প্রাপ্ত প্রায় তিন কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ল্যাবটির সফলতা বিচারের সময় এখনো আসেনি, আগামী দি্নগুলিতে এর যথাযথ ব্যবহার সাফল্যের মাপকাঠি নির্ধারণ করবে। তবে একজন গবেষক হিসেবে আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে চাই, ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ছোট স্কেলের এইসব ল্যাবরেটরি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে যদি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি করে 'সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি' প্রতিষ্ঠা করা যায়।

কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্র রয়েছে যেগুলো প্রায় সব বিষয়ের গবেষণায় ব্যবহৃত হয়, ওই যন্ত্রগুলি যেমন ব্যয়বহুল তেমনি ওগুলোকে ব্যবহার-উপযোগী রাখার জন্য দরকার প্রশিক্ষিত জনবল। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ট্রান্সমিশন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের কথা। এই যন্ত্রটি প্রায় সব শাখার এক্সপেরিমেন্টে, বিশেষ করে ন্যানোমিটার স্কেলে বস্তুর গুণাবলী গবেষণা, নিয়ন্ত্রণ এবং মানবকল্যাণে ব্যবহারের কার্যকর প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিশেষ প্রয়োজনীয়। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কোনও ল্যাবের পক্ষে একটি ট্রান্সমিশন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ কেনা যতটা কষ্টসাধ্য, তার চেয়ে বেশি কঠিন এটিকে মেইনটেইন করা, সহজ বাংলায় বাঁচিয়ে রাখা।

এই ধরনের যন্ত্রপাতি থাকতে পারে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার অব এক্সিলেন্সে এবং তা চাহিদা মোতাবেক ব্যবহার করতে পারবেন বিভিন্ন বিভাগের গবেষকরা। ইন্টারডিসিপ্লিনারি গবেষণার জন্য এবং একই সাথে বিশেষ করে ইলেক্ট্রনিক, কেমিক্যাল, বায়োলজিক্যাল এরকম শিল্পকে সাপোর্ট দিতে 'ক্লিন রুম' থাকাটা অপরিহার্য । এই মুহূর্তে আমাদের দেশে 'ক্লিন রুম' বলে কিছু নেই। কিছু বিষয়ে বিশেষ করে ডিভাইস ফেব্রিকেশনের জন্য 'ক্লিন রুম' থাকতেই হবে এবং এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও একক বিভাগে গড়ে তোলার চেয়ে সেন্টার অব এক্সিলেন্সে একটি ভালো মানের 'ক্লিন রুম' তৈরি করা অনেক যুক্তিযুক্ত।

ত্রুটিমুক্ত এক্সপেরিমেন্টাল গবেষণার জন্য তাত্ত্বিক গবেষণা অপরিহার্য। অনেক ক্ষেত্রে তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য খুবই উন্নত মানের কম্পুটেসনাল ফ্যাসিলিটি থাকা অত্যাবশ্যকীয় । সেন্টার অব এক্সিলেন্সে পর্যাপ্ত এক্সপেরিমেন্টাল ফ্যাসিলিটি সরবরাহ করার পাশাপাশি একটি উইং অবশ্যই তাত্ত্বিক গবেষণার জন্য উপযোগী করে গড়ে তোলা জরুরি।

বাংলাদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিভিন্ন মেগা প্রজেক্ট সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করা হচ্ছে। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা গবেষণায় উন্নত এ রকম অনেক দেশের চেয়ে শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। প্রথম ধাপে দেশের অন্তত বিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশটি সেন্টার অব এক্সিলেন্স গড়ে তুলতে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি খরচ হবে না। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সাফল্য বিবেচনা করলে এই টাকা তেমন কিছুই না। প্রতিটি সেন্টার অব এক্সিলেন্সের জন্য প্রাথমিক বাজেট হতে পারে তিনশ কোটি টাকা। এরমধ্যে যন্ত্রপাতি বাবদ দুই শত কোটি, বিল্ডিং নির্মাণ, ফার্নিচার এবং আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র বাবদ বিশ কোটি, গবেষক /স্টাফদের বেতন এবং অন্যান্য খরচ বাবদ আশি কোটি টাকা।

এই প্রজেক্ট বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে সম্পন্ন করা যেতে পারে। তবে পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার জন্য দেশে বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি গবেষণায় বিগত পাঁচ বছরে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন এমন দশজন সদস্য নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। একই সাথে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় পাঁচ-ছয় সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করবে। প্রয়োজনীয় লোকবল, বিল্ডিং স্ট্রাকচার, ক্লিনরুম ফ্যাসিলিটি, কমন যন্ত্রপাতির স্পেসিফিকেশন, কম্পুটেসনাল ফ্যাসিলিটিসহ সমস্ত কিছুর রূপরেখা এই বিশেষ কমিটি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রদত্ত কমিটির সাথে আলোচনার মাধ্যমে প্রস্তাব করবে । প্রাথমিক ধাপে বিশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত সেন্টার অব এক্সিলেন্সের কার্যক্রম পাঁচ বছর মনিটর করে দ্বিতীয় ধাপে অপেক্ষাকৃত নতুন বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুরূপ সেন্টার অব এক্সিলেন্সে গড়ে তুলতে হবে। আমার ধারণা পরবর্তী পাঁচ বছরে অপেক্ষাকৃত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পিএইচডি ডিগ্রিধারী অনেক শিক্ষক যোগ দিবেন এবং তারা গবেষণা কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবেন সেন্টার অব এক্সিলেন্স-এর সুবাদে। দুই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিমধ্যে বিজ্ঞান গবেষণায় একটি করে সেন্টার অব এক্সিলেন্স গড়ে উঠেছে, এইগুলোকে আরও উন্নত করার, তাদের কার্যক্রম আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু একটি সেন্টার অব এক্সিলেন্স গড়ে তুললেই হবে না, বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি গবেষণায় উৎকর্ষ সাধনের জন্য নতুন গবেষক তৈরি করতে হবে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে আমাদের শিক্ষার্থীরা। প্রতি বছর বিদেশে পিএইচডি করার জন্য অনেক স্কলারশিপ দেওয়া হয়, বিশেষ করে কিছু পশ্চিমা দেশে পিএইচডি করার জন্য অনেক টাকা টিউশন ফি দিতে হয়। আমি মনে করি এই ধরনের স্কলারশিপের একটি বড় অংশ দেয়া যেতে পারে দেশে পিএইচডি অধ্যয়নরতদের। যোগ্যতম প্রার্থী বাছাই করে মাসে একজন পিএইচডি স্কলারকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হলেই গবেষণায় এক ভিন্ন মাত্রা যোগ হবে। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, আমরা যদি মোটামুটি ভালো একাগ্রতাসম্পন্ন মেধাবী ও পরিশ্রমী  পিএইচডি শিক্ষার্থী পাই, তাহলে বিশ্বমানের গবেষণা আমাদের দেশ থেকেই সম্ভব।

দেশের টাকায় বিদেশে গবেষণা করতে পাঠাতে হলে দেশের কোনও ল্যাব থেকে কাউকে ছয় মাস কিংবা এক বছরের জন্য পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে বিশেষ কোনো গবেষণায় অভিজ্ঞতা লাভের জন্য পাঠানো যায়, যাতে ওই গবেষক দেশে ফিরে সংশ্লিষ্ট ল্যাবে এই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সফলভাবে গবেষণা সম্পন্ন করতে পারেন ।

আরও একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, সেন্টার অব এক্সিলেন্স প্রতিষ্ঠিত হলেও এখনকার মতো হেকেপ প্রজেক্ট, কিংবা বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে ছোট স্কেলে যে গবেষণা প্রকল্প দেওয়া হয় তা অব্যাহত রাখতে হবে। এসব ফান্ড দিয়েই ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হবে, ল্যাবের নিত্যদিনের গবেষণা খরচ এসব ফান্ডের মাধ্যমে চালানো হবে। ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ল্যাব এবং সেন্টার অব এক্সিলেন্স-এর সমন্বয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে যত সুদৃঢ় হবে ওখান থেকে গবেষণায়ও প্রত্যাশিত ভালো ফলাফল পাওয়া যাবে।

আমাদের দেশে ইদানিং অনেক হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ এবং বিশ্বমানের ওষুধ কোম্পানি হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে সেন্টার অব এক্সিলেন্সে আরও একটি উইং খুলে বড় স্কেলে বাণিজ্যিকভাবে শিল্প কারখানার জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উৎপাদন করা যেতে পারে। এসব কাঁচামালের বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়, ভবিষ্যতে তা সেন্টার অব এক্সিলেন্সের ওই বিশেষ উইং থেকেই সরবরাহ করা যেতে পারে । বহুজাত কোম্পানিগুলো তখন স্বভাবতই গবেষণায় বিনিয়োগ করতে আগ্রহী হবে। এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারবে। ইউরোপ-আমেরিকার কথা বাদ দিলাম, ভারতেই এই ধরনের একাধিক গবেষণা সেন্টার রয়েছে। এক বেঙ্গালুরেই রয়েছে বিশ্বমানের কয়েকটি গবেষণা সেন্টার, যেমন- Jawaharlal Nehru Centre for Advanced Scientific Research, Centre for Nano Science and Engineering, CSIR Centre for Mathematical Modelling and Computer Simulation । এসব সেন্টারের যে কোনো একটি উদাহরণ হিসেবে নেয়া যেতে পারে।

অনেকেই বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষাদানের জন্য। এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা, শুধু স্নাতক পর্যায়ে শিক্ষা দিতে দেশে শত-শত কলেজ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় একটি পরিপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। এখানে স্নাতক, স্নাতকোত্তর পড়াশোনা, গবেষণা ও জাতীয় ইস্যুতে বিশেষজ্ঞ সহায়তা দেওয়াসহ সবকিছুই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আর স্নাতক ক্লাসে শিক্ষাদানের কথা বললেও একটি কথা বলা যায়, একজন অধ্যাপক যিনি গবেষণা করেন, গবেষণা অভিজ্ঞতার আলোকে একটি টপিক ক্লাসে পড়ান, যিনি অধুনা সৃষ্ট বিষয়ে ওয়াকিবহাল থাকেন, ক্লাসে তার আত্মবিশ্বাস, তার উপস্থাপনা, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তার জ্ঞানের গভীরতা, যিনি শুধু বই পড়ে ক্লাসে পড়ান তার থেকে শ্রেয়তর হবেই। কাজেই আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলেও ভালো মানের শিক্ষাদানের জন্য পোস্ট গ্রাজুয়েশন লেভেলে গবেষণায় উৎকর্ষ সাধন প্রয়োজন।

আবারো বলতে চাই, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন দেশে-বিদেশে সর্বমহলে প্রশংসিত হচ্ছে, ধারাবাহিকভাবে গত কয়েক বছর ধরে সাত শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে কৃষিখাতে বাংলাদেশের উন্নয়ন ঈর্ষণীয়। কিছু বিশেষ উদ্যোগ নিলে কৃষির মতো বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি খাতে সাফল্য আসবেই। বাংলাদেশে এখন নিয়মিত হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। উচ্চশিক্ষায় একটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি করে 'সেন্টার অব এক্সিলেন্স ফর এডভান্সড রিসার্চ ইন সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি' প্রতিষ্ঠিত হোক। পাঁচ-দশ  হাজার হাজার কোটি টাকার এই মেগা প্রজেক্ট এই মুহূর্তে অলাভজনক মনে হলেও ভবিষ্যতের জন্য এটি হবে নি:সন্দেহে খুবই ফলপ্রসূ একটি বিনিয়োগ।

ছবি: ন্যানোটেকনোলজি রিসার্চ ল্যাবরেটরি, বুয়েট।

ছবি কৃতজ্ঞতা: লেখক