নারীবাদীদের চোখে দেবী দুর্গা

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 16 Oct 2018, 12:31 PM
Updated : 16 Oct 2018, 12:31 PM

পুরাণে দেবী দুর্গা হচ্ছেন মহাতেজা, যুদ্ধরতা, অসুরবিনাশিনী, যার হুহুঙ্কারে পৃথিবী প্রকম্পিত। অথচ দেবীর এই রূপটির সঙ্গে মনু সংহিতার আদর্শ ভারতীয় নারীর কোমল রূপটির কোন মিল নেই কেন? দেবীর সৃষ্টি হয়েছিল এক পরমা আদিশক্তি হিসেবে, অন্যান্য দেবীদের মতো কোনও দেবতার স্ত্রী বা divine consort হিসেবে নয় কেন? যুদ্ধই যদি, তবে এমন সাজসজ্জাই বা কেন? নারীবাদীরা দেবী দুর্গাকে নিয়ে এমন নানা প্রশ্ন করছেন। দুর্গা দেবীকে ঘিরে নারীবাদীদের এসব প্রশ্ন বা মত-মন্তব্য উপেক্ষণীয় নয় মোটেই।

নারীবাদীরা বলেন, পুরুষরা সমস্ত ক্ষমতা যন্ত্র নিজেদের হাতে রেখে একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। অর্থনীতি, রাজনীতি, রাষ্ট্র সবকিছু পুরুষের অধীনস্ত। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সব থেকে বড় আবিষ্কার হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা (concept of God)। পুরুষের আদলে গড়ে তোলা হয়েছে ঈশ্বরকে। আজ থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীক কবি জেনোফিনিস বলেছিলেন, 'ষাঁড়ের যদি মানুষের মতো হাত ও ক্ষমতা থাকত তাহলে তারা দেবদেবীর আকার, রূপ, চরিত্র ষাঁড়ের মতো করেই তৈরি করতো। পৃথিবীর প্রতিটি ধর্মে লক্ষ-কোটি 'ঈশ্বরের প্রেরিত পুরুষ' বা অবতার এসেছেন যাদের মধ্যে কেউ-ই নারী নন। নারীদেরকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের ফতোয়া দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, থামিয়ে রাখা হয়েছে তাদের মানসিক উন্নয়নকে।

শুধু ধর্মেই নয়, বিভিন্ন গল্প-উপন্যাসের নায়িকাদের যে রূপের বর্ণণা দেওয়া হয়েছে তাতে তাদের মানুষ ভাবতে কষ্ট হয়। আদর্শ নারী মানেই রূপবতী। রূপ না থাকলে সে আবার নারী কেন! নজরুল তার কবিতায় বলেছেন, আমি হতে চাই না একা নারী কারো; এরা দেবী, এরা লোভী…(পূজারিনী)''। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা।' তিনি আরও বলেছেন, 'পুরুষ আধিপত্য ছেড়ে দিলেই মেয়ে আধিপত্য শুরু করবে। দুর্বলের আধিপত্য অতি ভয়ঙ্কর (শেষের কবিতা)।' রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় রানী এলিজাবেথের কথা ভুলে গিয়েছিলেন।

পৃথিবীর অন্যতম সেরা সাহিত্যিক টলস্টয়ের সাহিত্যেও একই দৃশ্য ফুটে উঠেছে। তার স্ত্রী সোফিয়া তেরটি সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। জমিদারি দেখাশোনাসহ টলস্টয়কে পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত ও প্রকাশনায় সহায়তা করেন। তবুও নারী জাতি সম্পর্কে টলস্টয়ের স্বীকারোক্তি হচ্ছে, 'মেয়েদের সান্নিধ্য সমাজ জীবনের একটি প্রয়োজনীয় অপ্রীতিকর ব্যাপার, যতটুকু সম্ভব এদেরকে এড়িয়ে চল।' জাঁ জ্যাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮) তার এমিলি উপন্যাসের নায়িকাকে বলেছেন, 'যখন এমিলি তোমার (সোফিয়া) স্বামী হবে, তখন সে তোমার প্রভু। প্রকৃতির অভিলাষ হচ্ছে যে তুমি তার অনুগত থাকবে।' রুশো আরও বলেছেন, 'প্রকৃতির বিধান হচ্ছে নারী অনুগত থাকবে পুরুষের।' রুশো ব্যক্তি জীবনে অনেক নারীর সাহচর্যে এসেছেন, জন্ম দিয়েছেন 'অবৈধ' সন্তান আবার নিজেই বলেছেন যে- 'স্বামীদের নিশ্চিত হতে হবে তাদের স্ত্রীদের সতীত্বে; যাতে তাদের সন্তানেরা আসলেই হয় তাদের নিজেদের সন্তান।'

মোট কথা, পুরুষরা সবকালেই নারীর ছবি এঁকেছেন নিজেদের কল্পনা মিশিয়ে। অনেক ক্ষেত্রেই স্বার্থ-সুবিধা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিমূর্তি হিসেবে। এমনকি যে দেবী দুর্গাকে 'নারীত্বের প্রতিমূর্তি' মনে করা হয়, তাই বা কতটুকু নারীর প্রতিনিধিত্ব করে? হালের নারীবাদীরা তো সরাসরি প্রশ্ন করেছেন, পৌরাণিক দুর্গা কি আদৌ নারী? নাকি যুদ্ধরত দুই গোষ্ঠীর পুরুষের মধ্যে একজনের তরফে বানানো একটি স্ট্যাট্রেজি? এক নারীরূপী যুদ্ধযন্ত্র? বারবার দেবতারা অসুরদের জন্য বাছাই করা দেবীদের পাঠাচ্ছেন। শুধু দেবতাদের তাড়িয়ে দিয়ে স্বর্গ-দখল-করা মহিষাসুরকে বধ করতে দুর্গাকে পাঠানো নয়। এ ছাড়াও আছে সুন্দর-উপসুন্দর জন্য তিলোত্তমা নির্মাণ, ধূম্রালোচনের জন্য কৌশিকী, চণ্ড-মুণ্ড-রক্তবীজদের জন্য চামুণ্ডা, শুম্ভ-নিশুম্ভের জন্য চণ্ডিকা। এ সবই করছেন এবং পাঠাচ্ছেন কিন্তু পুরুষরাই। রাজ্যপাট সামলাতে অক্ষম দেবতারা আর যজ্ঞস্থল আগলাতে হিমসিম ঋষিরা। এ কি দেবপত্নীদের জন্য অসুরদের দুর্বলতা জানার জন্য? না কি মিছিলে লাঠি-গুলি চলার সম্ভাবনা থাকলে মেয়েদের ঢাল হিসাবে ব্যবহার করার রণকৌশল?

শ্রীশ্রীচণ্ডীর দুর্গার বর্ণনা বলছে, বিষ্ণু-ব্রহ্মা-শিব-ইন্দ্র প্রমুখ দেবতার মুখ বা শরীরনিঃসৃত মহাতেজরাশি এক অনুপম নারীর মূর্তি নিচ্ছে। কিন্তু এই নারীর শরীরের অনুপুঙ্খ সমস্ত অঙ্গই কোনও না কোনও পুরুষের অবদান। এমনকী তাঁর স্তনও চন্দ্রতেজে নির্মিত। যোনির কোনও উল্লেখ দেখা যায় না। শুধু সন্ধ্যাদেবীদের তেজে তার ভ্রূযুগল এসেছে।

দুর্গার অস্ত্র-শস্ত্র-বাহন সব কিছুই দিয়েছেন পুরুষ দেবতারাই। শূল, চক্র, বজ্র, শঙ্খ, ধনু-তূণীর, দণ্ড, পাশ, খড়গ, কুঠার, ঢাল থেকে সিংহ। এমনকী মালা-কমণ্ডলুও। অঙ্গের সমস্ত বসন-আভূষণ দিয়েছেন তারাই। এ তো যন্ত্রকেই সাজানো। আচরণেও কোথায় নারীত্ব? বা এমনকি দেবত্ব? সমস্ত সাজ-গোজ হয়ে যাবার পর দেবীর অট্টহাস্যে আর হুঙ্কারে, 'অতি মহান ঘোর গর্জনে' কেঁপে উঠছে চতুর্দশ ভুবন, সাত সমুদ্র, পৃথিবী আর পাহাড়েরা। শ্লোকে লিঙ্গ পরিবর্তন করে দিলেই তো তা মহিষাসুরের বর্ণনাও হতে পারত! আর দেবীকে কুবের দিয়েছিলেন 'সদা সুরাপূর্ণ এক পানপাত্র'। সেটির সদ্ব্যবহারও হচ্ছে। মহিষাসুরের সঙ্গে যুদ্ধের প্রায় শেষ দিকে 'অসুরকর্তৃক নিক্ষিপ্ত পর্বতসকল শরদ্বারা চূর্ণ করিতে করিতে মদ্যপানে অতিশয় রক্তবদনা চণ্ডিকাদেবী বিজড়িত স্বরে মহিষাসুরকে বলিলেন, রে মূঢ়! যতক্ষণ আমি মধুপান করি, ততক্ষণ তুই গর্জন কর'। লিঙ্গ সাম্যের এ রকম উদাহরণ সত্যিই বিরল।

সেই সময় দেবতারা আর ঋষিরা কী করছেন? গ্যালারিতে বসে নিরাপদ দূরত্ব থেকে খেলা দেখার মতো চারদিক থেকে দেবীর স্তব করে যাচ্ছেন। আর মেলে ধরছেন এক অন্তহীন 'দাও-দাও'-এর তালিকা। রাজ্যপাট দাও, শাসনক্ষমতা দাও, ব্রহ্মবিদ্যা দাও, যশ দাও, শ্রী দাও, রূপ দাও, আমার মনোবৃত্তির অনুসারিণী মনোরমা ভার্যা দাও, এমনকী আমার শত্রুদেরও মেরে দাও যাতে আমাকে কোনও খাটুনিই না করতে হয়!

পরবর্তী শ্লোকসমূহে দেবীকেই আবার চূড়ান্ত শক্তির অধিশ্বরী, ব্রহ্মা-রুদ্র-বিষ্ণু, এমনকী তাঁদের স্ত্রী, যথাক্রমে সরস্বতী, গৌরী আর শ্রীর স্রষ্টা বলা হচ্ছে। বলা হচ্ছে তিনি একাধারে 'কালরাত্রি (যাহাতে ব্রহ্মার লয় হয়), মহারাত্রি (যাহাতে জগতের লয় হয়), মোহরাত্রি (যাহাতে জীবের নিত্য লয় হয়)'। তখন দেবীর প্রতি, নারীর প্রতি পুরাণকারদের মনে কতটা সদর্থক ভাবনা ছিল, আদৌ ছিল কি না, সে সমস্ত প্রশ্ন তো থেকেই যায়।

আর এই পৌরাণিক দেবীই আহূত হন মহালয়ায়, পূজিত হন সর্বজনীন পূজার মণ্ডপে। সে তো পুরুষের পূজা। ক্ষমতার জন্য পূজা। মেয়েদের পূজা তো এত সাড়ম্বরে, পূজক আর পূজিতের মধ্যে এত দূরত্ব দিয়ে সূচিত নয়। তার মধ্যে নেই রাজ্যপাটের দাবি। শাসনক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা। পূজক আর পূজিতের মধ্যে সে এক অন্তর্লীন, অন্তরঙ্গ যাত্রা। তাই দুর্গাপূজার সর্বজনীনতা আসলে এক নারীকে কেন্দ্র করে পুরুষদের সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের আর এক প্রকাশ, নারীর নিজের উপস্থিতি সেখানে প্রতীকীমাত্র।

আচার-অনুষ্ঠানের দিকে তাকালেও পুরুষাধিপত্যই দেখা যায়। দেবী দুর্গা নারী। কিন্তু সেখানে নেতা (পুরোহিত) হলেন পুরুষ। নারীর ভূমিকা এখানে শুধু যোগালদারের, ভৃত্যের! মেয়েদের পূজো হল ব্রত। ঘরের কোণে, সবার চোখের আড়ালে অনাড়ম্বর আয়োজন। সংসারের সব কাজ গুছিয়ে পুজোর জোগাড়। সহায়ক আরও নারী। শামিল শিশুরাও। সন্তানের মঙ্গলকামনায় আর পুত্রসন্তানের জন্য বারো মাসে তেরো ষষ্ঠী। এই জন্মে বা পরজন্মে ভাল বরের জন্য পুণ্যিপুকুর, সেঁজুতি, দশ-পুতুল, তুঁষ-তুষুলী, শিবরাত্রি। অক্ষয়-সিঁদুর আর এয়ো-সংক্রান্তি, সৌভাগ্য-চতুর্থী— চিরায়ুষ্মতী হতে। সংসারের মঙ্গল আর সাচ্ছল্যের জন্য মঙ্গলচণ্ডী, বিপত্তারিণী, জয় মঙ্গলবার, লক্ষ্মীপুজো আর অধুনা সন্তোষী-মা। ফসলের প্রাচুর্যের জন্য পৌষলক্ষ্মী আর ইতু।

সধবা, বিধবা বা কুমারী— চাওয়ার পরিধিটা প্রায়শই এক। সাবিত্রী-সমান হব। স্বামী-আদরিণী হব। রামের মতো পতি, দশরথের মতো শ্বশুর, কৌশল্যার মতো শাশুড়ি আর লক্ষ্মণের মতো দেবর পাবো। দ্রৌপদীর মতো রাঁধুনি হবো। পৃথিবীর মতো ভার সইবো। রাজ্যেশ্বর ভাই পাবো। দরবার-জোড়া ব্যাটা পাবো। সভা-উজ্জ্বল জামাই পাবো। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া আর বাড়িভরা দাস-দাসী— কিন্তু সে সবই শ্বশুর, বাবা, ভাই বা স্বামীর জন্য। নিজের জন্য চাহিদা খুবই সামান্য।

নিজেদের জন্য মেয়েরা চায় সাত ভাইয়ের এক বোন হতে। চায় শাঁখার আগে সুবর্ণের খাড়ু। চায় রাজার ঝি বা রানি হতে। বছর-অন্তর একবার বাপের বাড়ি আসতে। আর সবচেয়ে বেশি করে চায়, পতির উপর নিঃসপত্ন অধিকার। বহু ব্রতর কামনা সতীনের বিনাশ— সতীন কেটে আলতা পরি, সতীনের শ্রাদ্ধের কুটনো কুটি, সতীন মরে বসে দেখি। কেউ এর মধ্যে 'মেয়েরাই মেয়েদের শত্রু' গল্পেরই মশলা পাবেন। কিন্তু এ তো আসলে মধ্যযুগের ভয়াবহ কৌলিন্য প্রথার শিকার মেয়েদের তীব্র আতঙ্কেরই প্রকাশ। মেয়েদের সব চাওয়া-পাওয়া কোনও না কোনও পুরুষের জন্য চাওয়া। অর্থাৎ তার লক্ষ্য একটাই— সবাই মিলেই একটু ভাল থাকা।

ভাস্কর শিল্পী মারলিন স্টোন তার বই When God was a Woman বইতে বলেছেন, এক সময় নারীই যে ঈশ্বর ছিলেন, খ্রিস্টপূর্ব ২৫ হাজার বছর আগের নারী মূর্তিগুলো তারই নিদর্শন। এছাড়াও, ঐ বই থেকে জানা যায়, ঈশ্বরের লিঙ্গ পরিবর্তন হয়েছে ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। এবং এই ক্ষমতা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভব হয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের, বৃহদার্থে নতুন একটি সভ্যতার। পুরুষকেন্দ্রিক এই সভ্যতা অনেকাংশে হয়ে উঠল যুদ্ধ ও ধর্মকেন্দ্রিক সভ্যতা। ভোগের সভ্যতা বললেও ভুল হবে না। নারী উঠে গেল ভোগ্য পণ্যের তালিকার শীর্ষস্থানে। সভ্যতার যাতে আর পালাবদল না ঘটে সে ব্যবস্থা নিশ্চিতে তৎপর হয়ে উঠল পুরুষশাসিত সমাজ। এক্ষেত্রে ধর্ম বিশ্বাসটাকে আগে নিজেদের মধ্যে ভালো করে রপ্ত করে তারপর ঘুমের ঔষধের মত করে নারীদের খাইয়ে দেয়া হল। বিষয়টিকে সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন শরৎচন্দ্র- 'পুরুষেরা যাহা ইচ্ছা করে, যাহা ধর্ম বলিয়া প্রচার করে, নারী তাহাই বিশ্বাস করে এবং পুরুষের ইচ্ছাকে নিজেদের ইচ্ছা বলিয়া ভুল করে এবং ভুল করিয়া সুখী হয়।'

দুর্গাই বলি, অন্য দেবীদের কথাই বলি সব দেবী উপাসনার পেছনেই ছিল পুরুষের ছল। পূজা করে নারীদের ভোলানোর চেষ্টা করা হয়েছে, কখনওবা দেবী বানিয়ে দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছে। ভারতবর্ষ তো দীর্ঘকাল ধরে দেবী পূজার উর্বর ভূমি। বিভিন্ন দেবীর পূজা করেছে যে পুরুষেরা তারা কিন্তু নারীর সম্পত্তির অধিকারটুকু দেয় নি। কালী, সরস্বতী, লক্ষ্মীর পূজা সেরে পাড়ায় বা বাড়িতে ফিরে নারী দেবতার ঐ পুরুষ পূজারীরা কি অসহায় বিধবাকে জোর করে মৃত স্বামীর চিতার আগুনে পুড়িয়ে মারত না? এখন যেমন চালানো হয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন!

পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন। তিনি ছিলেন দ্রোহী নারী। তাই সনাতন সংস্কৃতি ও ধর্মীয় শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে মুক্তকণ্ঠে তিনি বলতে পারেন এই কথা- 'আমাদিগকে অন্ধকারে রাখিবার জন্য পুরুষগণ ওই ধর্মগ্রন্থগুলোকে ঈশ্বরের আদেশপত্র বলিয়া প্রকাশ করিয়াছেন। ধর্ম শেষে আমাদের দাসত্বের বন্ধন দৃঢ় হইতে দৃঢ়তর করিয়াছে; ধর্মের দোহাই দিয়া পুরুষ এখন রমণীর উপর প্রভুত্ব করিতেছেন।' পদ্মরাগ উপন্যাসে পণপথার বিরুদ্ধে রোকেয়া উচ্চারণ করেছেন এই তীব্র ক্ষোভ-'বিবাহ যেন সম্পত্তি ও অলংকারের জন্য না হয়। কন্যা পণ্যদ্রব্য নহে যে তাহার সঙ্গে মোটরগাড়ি ও তেতলা বাড়ি ফাউ দিতে হইবে।' তবে কেবল পুরুষতন্ত্রই নয়, তিনি আক্রমণ করেছেন পুরুষতন্ত্রে মুগ্ধ ও বশীভুত নারীসমাজকেও। তার মতে নারীর চেতনাতেও বাসা বেঁধেছে পুরুষতন্ত্রের ভুত। এই ভূত তাড়ানোর জন্য তীব্র ভাষায় তিনি আক্রমণ করেন নারীর সনাতন মানসিকতাকে-'আমরা দুর্বলভুজা, মূর্খ, হীনবুদ্ধি নারী। সে দোষ কাহার? আমাদের। আমরা বুদ্ধিবৃত্তির অনুশীলন করি না বলিয়া তাহা হীনতেজ হইয়াছে।'

রোকেয়া কথিত এই 'হীনতেজ' নারীদের নিয়েই পুরুষতন্ত্র রচনা করেছে নানা প্রশংসাগাঁথা। নারীকে তারা দেবীত্বের আসনে বসিয়ে মূলত বন্দি করে রাখতে চেয়েছে গৃহকোণে!