আয় কম তাই খায় কম

কিউ আর ইসলাম
Published : 11 June 2012, 09:04 AM
Updated : 11 June 2012, 09:04 AM

গত ২০১০ সালের জরিপভিত্তিক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী একজন বাংলাদেশী প্রতিদিন গড়ে এক হাজার গ্রাম খাবার খেয়ে থাকে। তবে দরিদ্রদের ভাগে পড়ে ৮ শত ১৬ গ্রাম আর অদরিদ্রদের ভাগে ১ হাজার ৮৫ গ্রাম। অর্থাৎ অদরিদ্র জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াশ বেশী খাচ্ছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ভাগ্যে সব ধরণের খাদ্যই কম হচ্ছে। ভাত খাওয়ার ক্ষেত্রে পার্থক্যটা ৪ শতাংশ কম হলেও ডাল ও ভোজ্য তেল যথাক্রমে ৬০ শতাংশ ও ৬৫ শতাংশ কম খেতে হচ্ছে। মাংশ খাওয়ার ক্ষেত্রে পার্থক্যটা আরও প্রকট। একজন অদরিদ্র ব্যক্তি সারা বছরে ৯ কেজি ২ শত গ্রাম মাংশ খেতে পেলেও একজন দরিদ্র ব্যক্তি ২ কেজি ১ শত গ্রাম অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ৪ ভাগের ১ ভাগ খেতে পাচ্ছে। একজন দরিদ্র ব্যক্তি বছরে আধাকেজির মত গরুর মাংশ খেয়ে থাকে। অন্যদিকে অদরিদ্র ব্যক্তি খাচ্ছেন সোয়া ৩ কেজি। মাছ খাওয়ার ক্ষেত্রে পার্থক্য হল প্রায় আধাআধি। এমনি ভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী ডিম প্রায় ৩ ভাগের ১ ভাগ, দুধ ও দুধজাত খাদ্য প্রায় ৪ ভাগের ১ ভাগ এবং চিনি বা গুড় ৩ ভাগের ১ ভাগ কম খাচ্ছে। শুধু তাই নয় ২০০৫ সালের জরিপের সঙ্গে ২০১০ সালের জরিপ তুলনা করলে দেখা যায় অদরিদ্র জনগোষ্ঠী ২০১০ সালে বেশী খাচ্ছে। অন্যদিকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ৫ বছর আগের তুলনায় প্রতি দিন গম ৮ গ্রাম বেশী খেতে পেলেও অন্য সব খাবার কম খেতে পাচ্ছে। সবদিক থেকেই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দৈনিক খাদ্য গ্রহণ হ্রাস পেয়েছে।

দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বেশীর ভাগ গ্রামে বাস করে। পরিসংখ্যান বুরোর তথ্য অনুযায়ী গ্রামে পরিবার প্রতি গড় মাসিক আায় ২০০৫ সালে ছিল ৬,০৯৬ টাকা এবং ২০১০ সালে বৃদ্ধি পেয়ে ৯,৬৪৮ টাকা হয়। চালের গড় মূল্যের ভিত্তিতে ২০০৫ সালের বার্ষিক আয় দিয়ে কেজি প্রতি ১৪.৪৭ টাকা দরে ৪২১ কেজি এবং ২০১০ সালে কেজি প্রতি ২৭.০৭ টাকা দরে ৩৫৬ কেজি চাল কেনা যেত। সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানের চাল কিনলেও ২০১০ সালে কেজি প্রতি ২২.২৬ টাকা দরে ৪৩৩ কেজি পাওয়া যেত। গত দু'বছরে অর্থাৎ ২০১০ সাল থেকে গ্রামে পরিবার পিছু মাসিক আয় শতকরা ২০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১১,৫৭৮ টাকা হলেও সরকার নির্ধারিত কেজি প্রতি ২৮ টাকা দরে ৪১৩ কেজি চাল কেনা যাবে। প্রকৃতপক্ষে দেশের সবকিছূর দাম বৃদ্ধি পেলেও গ্রামে পারিবারিক আয়ে কোন উন্নতি হয়নি। ফলে ক্রয় ক্ষমতা কমে আসছে।

একই সময়ে শহরে পরিবার প্রতি গড় মাসিক আয় প্রায় সাড়ে ১০ হাজার টাকা থেকে ৬ হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়ে সাড়ে ১৬ হাজার টাকা হযেছে। এই আয় থেকে খাদ্যপানীয় বাবদ মাসে ৮ হাজার টাকা এবং ছেলেমেযেদের শিক্ষার জন্য ১ হাজার ৪ শত টাকা ব্যয় হয়। অন্যদিকে গ্রামে পরিবার পিছু খাদ্যপানীয় বাবদ ৫ হাজার ৭ শত টাকা এবং ছেলেমেযেদের শিক্ষার জন্য ৪ শত টাকা ব্যয় হয়। চিকিৎসা, কাপড়চোপড় বাবদও গ্রামে পরিবার পিছু শহরের তুলনায় খরচের পরিমাণ অর্ধেক থেকে এক-তৃতীয়াংশ কম।

দুঃখের ব্যপার সাম্প্রতিক ঘোষিত জাতীয় বাজেটে গ্রামে বসবাবসকারী দেশের এই বিশাল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবন যাত্রার মান উন্নয়নে তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। তবে সান্ত্বনা এই যে এবার উল্টো কিছু নেই। বাজেট ঘোষণার মাস খানেক আগে অবশ্য ধান চালের দাম নির্ধারণ করে দেয়ায় কৃষকদের মসিবত বেড়ে গেছে। এমনিতেই আগের বছর সারের, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে একদিকে ফসল উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় অন্যদিকে ফসলের দাম কমে যাওয়ায় গ্রামীণ মানুষের দুর্ভোগ বেড়েছে। পাট, আলু, পেয়াঁজ, হলুদ সহ প্রায় সবরকম ক্যাশ (অর্থকরী) ফসলের দাম কমে গেছে।

অন্যদিকে ইউরিয়া সারের দাম প্রথমে এক দফা তারপর আর এক দফা বৃদ্ধি করায় এখন কেজি প্রতি ২০ থেকে ২২ টাকায় কিনতে হচ্ছে। টিএসপি ও এমপি সারের দাম কমিয়ে ব্যাপক প্রচার করা হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে ইউরিয়া সারের দাম বৃদ্ধি করে সরকারের আয় বৃদ্ধির সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। সারা দেশে বছরে গড়পরতা ২৭ লক্ষ টন ইউরিয়া সার ব্যবহার করা হয়। কেজি প্রতি ১৫ টাকা বৃদ্ধির ফলে ৪ হাজার কোটি টাকার উপরে সাশ্রয় হয়েছে। অন্যদিকে টিএসপি ও এমপি সার ব্যবহারের পরিমাণ ৭ লক্ষ টন। এই সারগুলোর দাম গড়পরতা কেজি প্রতি ২৫ টাকা কমালেও সরকারের ভর্তুকি বৃদ্ধি হয়েছে ১ হাজার ৭ শত ৫০ কোটি টাকার মত। আবার ডিজেলের দাম বৃদ্ধি করা হল শতকরা ৫০ ভাগের বেশী। সবধরণের ফসলেই অন্য সার ব্যবহার হোক বা না হোক ইউরিয়া সার প্রয়োগ করতে হয়। সারা দেশে শতকরা ৮০ ভাগ সেচ পাম্প চলে ডিজেলে। সুতরাং সরকারীভাবে কৃষি উপকরণের দামে পরিবর্তনের ফলে কৃষকের ফসল উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে কৃষি পণ্যের দাম নির্ধারণের ফলে কৃষি পরিবারের আয় কমেছে।

দেশের গ্রামে বসবাবসকারী মোট কৃষি পরিবারের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এদের শতকরা ৭০ ভাগ ১ শতক থেকে ৯৯ শতক বা তিন বিঘা জমি চাষ করে। এ ধরণের কৃষি পরিবারের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিন বিঘা জমিতে এ বছর বোরো ধান আবাদে গড়পরতা খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা আর ফলন হয়েছে ৭০ মণ। বর্তমান দরে এই ধান বিক্রি করে পাওয়া যাবে ৩৫ থেকে ৩৬ হাজার টাকা। ধান উৎপাদনে প্রয়োজনীয় যাবতীয় শ্রম যদি কৃষি পরিবার থেকে দেয়া হয় তাহলে ১৯ হাজার টাকা আয় হবে। যদি ঘরের বীজ ব্যবহার করা হয় এবং নিজের হালের বলদ থাকে তাহলে হাজার তিনেক টাকা বেশী আয় হবে। বাকী টাকা সার, ডিজেল, কীটনাশক ক্রয় বাবদ খরচ হবে। কৃষকের জমি যদি দুই ফসলি হয় এবং অপর ফসলও ধান হলে পরিবারের সারা বছরের খোরাক হিসেবে রেখে দিলে মোটামোটি বোরো ফসল বিক্রি বাবদ আয় থেকে সারা বছর চলতে হবে। এই ধরণের কৃষি পরিবারকে নিজস্ব সামান্য পুঁজি ও শ্রম বিনিয়োগ এবং ধারদেনা করে ফসল লাগিয়ে সারা বছরের খোরাক জোটাতে এবং সাংসারিক প্রয়োজন মেটাতে হয। উচ্চ মূল্যে উপকরণ কিনে এবং নিম্ন মুল্যে ফসল বিক্রি করে দারিদ্র আর দূর হয় না। যদি পারিবারিক জমির পরিমাণ তিন বিঘার কম হয় বা এক ফসলি হয় তাহলে জীবন যাপন আরো কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। কোন কোন পরিবার গরুছাগল ও হাঁসমুরগী পালন ও শাকসব্জি ফলমূলের চাষ করে বাড়তি আয়ের চেষ্টা করে। ছোটখাট ব্যবসা করেও থাকে। এরপরেও গ্রামের ভূমিহীনসহ ছোট বড় অনেক কৃষি পরিবারের জীবন ধারণ দুষ্কর হয়ে পড়ছে।

ময়মনসিংহ এর নান্দাইল উপজেলার ৭০ শতক জমির মালিক এক কৃষি পরিবারের প্রধানের সাথে আলাপ হল। আক্ষেপ করে বললেন, এক কেজি ধান বিক্রি করে একখান কচুও কেনা যায়না। এক কেজি কচুর ছড়া কিনতেও তিন কেজি ধান লাগে। একটা চাষের পাঙ্গাশের পোনা কিনতে ১০ কেজি আর পোল্ট্রির (ফার্মের মুরগীর) একটা ছা' কিনতে ১৫ কেজি ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। কিছুদিন আগে এক কেজি ধান বিক্রি করে ৪/৫ কেজি ইউরিয়া পাওয়া গেছে। এখন উল্টো, ১ কেজি ইউরিয়া কিনতে দুই কেজি ধান বিক্রি করতে হচ্ছে। এক পোয়া দুধের দাম ১২ টাকা। একটা ডিমের দাম ১০ টাকা, পাকা কলা একটা ৫ টাকা। এগুলো কেনার মত পয়সা আমাদের নেই। নিজের ঘরে উৎপাদন করেও কেউ খাওয়াতো দূরের কথা ছুঁয়েও দেখতে পারে না। সব বিক্রি করে দেয়া হয়। ব্যাপারীরা এসে সেধে নিয়ে যায়। নতুন নতুন রাস্তা হওয়ায় সকাল বিকেল ব্যাপারীরা ধর্ণা দেয়। কেউ কেউ বেশী দামের আশায় নছিমনে চড়ে কাছাকাছি হাট বাজারে নিয়ে যায়। বিক্রি করে তেল, লবন, সাবান কিনতে হয়।

একই জেলাধীন ফুলপুর উপজেলার একটি গ্রামে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যের বাড়ীতে যেতে হল। ব্যস্ততার কথা বলেও রেহাই পাওয়া গেল না। জানা গেল তিনি ২৫ একর জমির মালিক। বছরে আড়াই হাজার মণ ধান আসে ঘরে। উঠানে বোরো ধান মাড়াই করতে দেখা গেল। মেশিনে ফ্যান লাগিয়ে ঝাড়াইয়ের ব্যবস্থা করে হয়েছে। বাড়ীর পাশে নদীর পাড়ে চেয়ার টেবিল পেতে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সামনে বিলের চারিদিকে আবাদি জমি। একজন বয়স্ক কৃষক আঙ্গুল উঁচু করে বললেন বিল ভরে যাওয়ায় এখন আর পানি থাকে না, জমিতে সেচ বেশী লাগে। সেচ ও সার বেশী দেয়ার ফলে মাটি নরম হয়ে পড়ছে। ফলনও আগের মত পাওয়া যায় না। দশ পনের বছর পরে জমিতে আর ফসল হবে না বলে আশংকা প্রকাশ করলেন। একটু পরেই ঘরের ভিতরে ডাক পড়ল খেতে। প্রথমে ভাতের থালায় ভাজা মাছ পরিবেশন করা হল। বাড়ির মালিক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নিজেই পরিবেশন করছেন। একজন কি মাছ জিগ্যেস করতেই বললেন চাষের ছোট নলা মাছ। সামনের বিল দেখিয়ে বললেন আগে অনেক মাছ পাওয়া যেত। এখন বর্ষাকালে দু'একটা পাওয়া যায়। বর্ষাকাল পার হতেই বিল শুকিয়ে যায়। তাই চাষের মাছ কিনে খেতে হয়। এরপর এলো চালকুমড়োর ঝোলের সাথে চাষের পুঁটি। পরিবেশন করেই গৃহকর্তা বললেন দেশী মুরগী আছে। দেশী মুরগীর দু'টুকরা নিতে ডাল এলো। খাওয়া শেষে কৃতজ্ঞতা জানালাম। খুশী হলাম ২৫ একর জমির মালিক একটি কৃষি পরিবারের সদস্যদের কি ধরণের খাবার খেয়ে থাকেন সে সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়ে। অন্য কোন মেহমান এলেও গৃহকর্তার এর চেয়ে বেশী খাওয়ানোর সামর্থ্য হয়ত হবে না। এত জমির মালিক হয়েও তার সারা বছরে দু'ফসল মিলে বর্তমান হারে ধান বিক্রি করে একর প্রতি ৫/৭ হাজার টাকার বেশী আয় হবে না। সার, বীজ, সেচ ও শ্রমিকদের মজুরি বাবদই খরচ হবে একর প্রতি বোরে ফসলে কমপক্ষে ৩০ হাজার টাকা আর পরবর্তী ফসল আমন ধান হলে ২০ হাজার টাকা। দু'ফসল মিলে একর প্রতি ফলন হবে সর্বোচ্চ ১১০ মণ। বর্তমান ধরে বিক্রি করে মোট লাভ হতে পারে সোয়া থেকে দেড় লক্ষ টাকা। চিন্তায় পড়ে গেলাম সাধারণ কৃষকদের আয় কত হতে পারে? তাদের বাড়ীতে দৈনন্দিন খাদ্যের মান কী হতে পারে?
দেশের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে কৃষিতে ভর্তুকি তুলে নিলে কারও আপত্তি নাও থাকতে পারে। কিন্তু ভর্তুকি তুলে নিয়ে ফসলের দাম কমিয়ে দিলে গ্রামের প্রায় আড়াই কোটি পরিবারের ১১ কোটি মানুষের অধিকাংশেরই দূর্দশা বৃদ্ধি পাবে।

কিউ আর ইসলাম: কৃষি, পানি ও পল্লীউন্নয়ন বিশ্লেষক।