ডক্টর বনাম ডাক্তার : বাংলাদেশ তুমি সাক্ষী থেকো

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 8 Dec 2011, 04:07 PM
Updated : 15 Oct 2018, 03:28 PM
ডক্টর কামাল হোসেন এবং ডাক্তার বি চৌধুরী আর মিলতে পারলেন না। মিলনের ভান করলেও শেষ অব্দি তাদের বিচ্ছেদই হলো। এ কারণেই বলা হয়, 'বংশ, অতীত আর বর্তমান মিলিয়ে সম্পর্ক ঠিক করতে হয়।'
বি চৌধুরী সাহেব হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন- যে যারা নব্য খ্রিস্টান তাদের অনেকেই পোপের চেয়েও নিজেকে বড় খ্রিস্টান মনে করেন। ডক্টর কামাল সম্প্রতি আসল চেহারায় বেরিয়ে আসলেন। ফলে তার দালালী আর বিশ্বাসঘাতকতার চমকটা বেশি হবে। এবং বিএনপি হাঁটুভাঙা দলে পরিণত হয়েছে বলে তার কাঁধে ভর রেখেই উঠে দাঁড়াতে চাইবে। সেখানে বি চৌধুরী তাদের বাতিল মাল। পুরনো নেতা, পুরনো ধাওয়া খাওয়া রাষ্ট্রপতি। সেই জায়গায় আগ্রহ কম হবে সেটাই কি স্বাভাবিক না?
শুরুতে আমরা জাতির কাছে নতুন কিছু করে দেখানোর জন্য মরিয়া এসব নেতা ও তাদের কর্মকাণ্ড একটু বুঝে নেই। বেশিদিনের না গত দু'তিনদিনের ঘটনাই বলে দিচ্ছে আমাদের কপালে কী আছে। এতোদিন ধরে তারা এতোকিছু করার পর এই দুইদিনেই ডক্টর এবং ডাক্তার সাহেব আগের মতো দুটি সংবাদ সম্মেলন আর পরষ্পরবিরোধী কথাবার্তা বললেন। আমরা এদের আগে থেকেই জানি এবং এটাই হবার কথা ছিল। কেউ কাউকে ছাড় দেবেন না, এই কথাটা ভুলে গেলে চলবে কি করে?

ওই যে 'রাষ্ট্রপতি' পদটা, সেখানেই যত গ্যাঞ্জাম। একটাই পদ।  সে মুলা ঝুলিয়ে বিচারপতি এস কে সিনহাকে বশে আনার পর বেচারা দেশ ছেড়ে আমেরিকা গিয়ে আশ্রয় চাইতে চাইতে মুখে ফেনা উঠছে তার। বি চৌধুরীকে এই মুলা ঝুলালেও তিনি এর স্বাদ-বিস্বাদ দুটোই জানেন। তাকে মুলা গেলানো একটু কঠিন বৈকি! তিনি নিশ্চয়ই রেললাইন ধরে পালিয়ে যাবার ঘটনা ভোলেননি। তাকে নতুন করে তারেক বা খালেদা জিয়াকে চেনানোরও দরকার নাই। এদিক থেকে ডক্টর কামাল তলে তলে যাই করুক প্রকাশ্যে তিনি এখন বিএনপির নতুন পার্টনার। এই নতুন পার্টনারের জন্য আবেগ-দরদ আর রাষ্ট্রপতির মুলাটার রং একটু অধিক বৈকি। আর একটা কারণও অস্বীকার করা যাবে না। এক চেয়ারে দুজন বসার যখন জায়গা নাই, তারা একে অন্যকে ল্যাং মারবেন এটাই নিয়ম। সেই নিয়মে বি চৌধুরী ল্যাং খেয়ে এই জোট জোট খেলায় আপাতত পিছু হটলেন কিনা সেটা বুঝতে আরো কিছুদিন  সময় লাগবে আমাদের।

যাই হোক না কেন, এটা নিশ্চিত এই জোটের ভবিষ্যত ভালো কিছু না। বিএনপিকে বৈতরণী পার করানো আর ব্যক্তিগত রাগ আক্রোশ চরিতার্থ করার জন্য যারা এখানে নাম লিখিয়ে নেতা হয়েছেন তাদের জনগণ খুব ভালো চেনে। আ স ম রব, মান্না বা ডক্টর কামাল কেউই মূলত বিশ্বস্ত নন। আমি একশ র্পাসেন্ট গ্যারান্টি দিচ্ছি এরপর যিনি জোট থেকে বের হবেন তার নাম আ স ম রব। এবং সেই নিষ্ক্রমণ হবে সাংঘাতিক। নেতা থেকে দালালী, দালালী থেকে মন্ত্রী, মন্ত্রী থেকে রাগী এক হতাশ মানুষে পরিণত এই ভদ্রলোক যেদিন বেরুবেন সেদিনই শুনবেন নানা গুজব আর গল্প। একটু সবুরের দরকার এই যা। মান্না মিয়া তো অলরেডি আর একবার অডিও টেপবন্দি। ফলে এই জোটের ভবিষ্যত কি তা বুঝিয়ে বলার দরকার পড়েনা।
ডক্টর কামাল হোসেন কোনদিনও মেরুদণ্ড সোজা করা রাজনীতিবিদ ছিলেন না। বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য হবার কারণে তিনি এদেশের ইতিহাসে জায়গা করে নিতে পেরেছিলেন বটে, কিন্তু আজ  এমন সব বিষয় সামনে চলে আসছে যার দায় তিনি এড়াতে পারেননা। বাম নেতাদের নেতা হবার পর আওয়ামী বিরোধিতার নামে তিনি যা করতেন তার সবটাই ছিলো তলে তলে আওয়ামী বিরোধিতা। সেটা করতেই পারেন। কিন্তু আজ যে অবস্থান আর ভূমিকা তাতে তিনি প্রমাণ করলেন তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র আর আঁতাতের কথা বেঠিক কিছু না।
কেন তিনি এই ফাঁদে পা দিলেন? তিনি তো তার জীবদ্দশাতেই যা পাবার পেয়ে গেছেন। সংবিধান রচনা থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এতকিছুর পরও বাকি জীবনে খালি একটা চেয়ারের লোভে তিনি এমন করলেন, এটা মানা যায়না। আমাদের দুর্ভাগ্য হয়তো মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত অনেক বড় বড় মানুষেরাই পথ হারিয়ে সঙ বা ভাঁড়ে পরিণত হন। ডক্টর কামাল হোসেন কেন পাকিস্তানে গিয়েছিলেন আর কেনই বা বঙ্গবন্ধুর সাথে ফিরেছিলেন, আজ তার আর কোন ব্যাখ্যার দরকার নাই। তিনি নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছেন কোনও কোনও লেজ জীবনেও সোজা হয় না। এই বয়সে তার এই ভুল বা পথ বদলানো পথ হারানো তার কাছে কেমন লাগছে জানি না। আমরা লজ্জিত ও অনুতপ্ত। একবার ভাবুন তিনি সরকারে থেকে কি করতে পারতেন বা কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের বারোটা বাজাতে পারতেন!

ডক্টর কামাল হোসেন ব্যক্তি হিসেবে, আইনজীবী হিসেবে সারাজীবন যা কুড়িয়েছিলেন, আজ মনে হচ্ছে তার সবটাই তিনি বিসর্জন দিলেন। যাদের সাথে জোট বাঁধলেন তাদের পরমমিত্র জামাত এদেশের ইতিহাস ও চেতনাবিরোধী। তাদের সহযোগিতা ছাড়া বিএনপি কোনদিনও সরকার গঠন করতে পারতো না। পারবেও না। কিন্তু তাদের মাথার ওপর থাকবেন তিনি? এখন তো এটা পরিষ্কার কামাল হোসেনের ছদ্মবেশ খুলে গেছে। অচিরেই আমরা তার আসল রূপ দেখতে পাবো। যার ভেতরে হয়তো আছে পাকি প্রেম, যার মূল উদ্দেশ্য শেখ হাসিনাকে সরানো। পথের কাঁটা সরানোর জন্য তিনি এমনটা করলেন, এটা না ভেবে রাজনীতিকে দেখুন। বাংলাদেশের ক্রান্তিলগ্নে খন্দকার মোশতাকের দেওয়া ঘোষণার মত একটা ঘোষণাপত্র পাঠ করেছেন তারা। যার সবগুলো পয়েন্টই মূলত এদেশের প্রগতি আর অগ্রযাত্রাবিরোধী। এই সংঘাতময় ঘোষণাই বলে দেয় আসল এজেন্ডা কী।

একটা বিষয় বলতে চাই শুধু। আমাদের ইতিহাসের এই কলঙ্ক বা দু:সময় কী কোনদিন শেষ হবেনা? খালেদা জিয়ার মুক্তি চাওয়া অন্যায়, তা বলছি না। কিন্তু তার মুক্তি চাইতে গিয়ে তার দলের সাথে আঁতাত করে আমাদের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সাথে পাকিস্তানের কারাগার থেকে একসাথে ফিরে আসা মানুষটি যা করছেন তার নাম বিশ্বাসঘাতকতা। ডক্টর কামাল আমাদের যৌবনে জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে নেতা হতে চেয়েছিলেন। তাকে সামনে রেখে, আমরা দেখেছি  গণ ঐক্যজোট করে সামরিক শাসনের আন্দোলনে তিনি কীভাবে লেজ তুলে পালাতেন। তখনো তাকে রাষ্ট্রপতি বানানোর চিন্তা করা হয়েছিল, অথচ ঢাকার লোকাল মাস্তান আবুল হাসনাতের ধমকেই তিনি চলে গিয়েছিলেন দেশ ছেড়ে। রহস্যময় ডক্টর কামাল হোসেন মাঝখানে বামনেতাদের নেতা হয়ে ছিলেন। লজ্জা আর কাকে বলে। বামাতী নামে পরিচিত এরা নাকি ত্যাগী। এরা সবাই মিলে গণফোরাম নামের যে গণফোঁড়া তৈরি করে তাকে নেতা বানিয়েছিলেন তারা আজ কি বলবেন?

ভেবে খারাপ লাগছে অচিরেই হয়তো ডক্টর কামাল হোসেন বলবেন, মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে আর তাকে পরারাষ্ট্রমন্ত্রী বানিয়েছিল বিএনপি।

পাকি-বিএনপি-জামাতী আর বিদেশি লবিং আমাদের আর কতো বায়োস্কোপ দেখাবে কে জানে। এটা নিশ্চিত করে বলি এই জোট টিকুক আর না টিকুক, ভালো হোক আর মন্দ হোক ডক্টর কামাল হোসেনের বারোটা বেজে গেছে। একটু চোখ মেলে তাকালেই বুঝতে পারতেন কাদের সিদ্দিকী কিংবা বি চৌধুরী কেউ দায় নেননি। যে মোহে যে উস্কানিতে তিনি এই কাজ করলেন তার পরিণাম একটাই , আস্তাকুঁড়ে নিপতিত হওয়া।

হায় হোসেন ! হায় হোসেন ! কামাল সাহেব ইতিহাস আপনাকে মার্জনা করবেনা জনাব।

আমাদের রাজনীতি বা রাজনৈতিক জগত দেখলে সেলুকাসও মূর্চ্ছা যেতেন। কেউ কোনদিন ভেবেছিলেন মির্জা ফখরুল হাসি হাসি মুখে বসে আছেন, আর পাশে বসে গম্ভীর মুখে ডক্টর কামাল হোসেন বলছেন, তিনি বা তারা কার মুক্তি চান বা কীভাবে সরকার হটাবেন! তাও শেখ হাসিনার সরকার? যারা এদেশের মাটি, রক্ত, শহীদ ও বীরাঙ্গণাদের সাথে বেইমানি করেছে ইতিহাস কোনদিন তাদের মাফ করেনি। এবারো তার ব্যতিক্রম হবে না। হলেও সময় যে মার্জনা করবেনা সেটাই জানি আমরা।
আপাতত তারা যা করছেন তাতে আমাদের মুক্তি তো নাই, বরং শঙ্কার কারণ আছে। কোনদিকে প্রবাহিত হবে এই জোটের ধারা ? মানুষ এর কী জবাব দেবেন তা দেখার জন্য সময়ের কাছেই হাত পাততে হবে। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই ভুল করবে না। কারণ তার আসল শক্তি মুক্তিযুদ্ধ। সেখানে নেতা আসে নেতা যায় মাত্র।