প্রসঙ্গ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট

আনিসুর রহমান
Published : 14 Oct 2018, 01:19 PM
Updated : 14 Oct 2018, 01:19 PM

আমাদের জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ৮৮ বছর বয়সে ২০১১ সালে মারা যান। মৃত্যুর আগে তার মনে কী হয়েছিল কে জানে? তিনি তার ইচ্ছের কথা কাগজে লিখে গেলেন। বলে গেলেন- তার মৃতদেহ যেন শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য না নেওয়া হয়।

কবীর চৌধুরী কী মনে করে এমন একটা কথা বলে গেলেন? এই প্রশ্নটা ঘুরেফিরে আমার মাঝে আসে যখন আমাদের দেশের বিখ্যাত কেউ মারা গেলে, তার মৃতদেহ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আন্তরিক প্রযোজনায় শহীদ মিনারে আনা হয়। কয়েকদিন ধরে অন্য একটি কারণে একই প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।

চিত্রশিল্পী ও কবি মুর্তজা বশীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে জানালেন, তিনি তার মেয়েদের বলে গেছেন, তার মৃতদেহ যেন শহীদ মিনারে নেওয়া না হয়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটকে এরকম সুযোগ তিনি দিতে চান না।

সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ টেনে আমার এক বয়োজ্যেষ্ঠ চিত্রশিল্পী ও অধ্যাপককে জিজ্ঞেস করলাম, শহীদ মিনারে আমাদের বিখ্যাত মানুষদের মৃতদেহ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যে মঞ্চ নির্মাণ, ব্যানার টানানো, মাইক লাগানোসহ মৃতদেহকে ঘিরে প্রযোজনা ছাড়া আমাদের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আর কাজ কী? উনি বললেন- "এটা অনেকটা আমাদের ঢাকা শহরের বড় বড় মানুষদের জন্যে এক ধরনের আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম।" আমি বললাম- মানে?

উনি বলে চললেন, "এই যে শহীদ মিনারে আয়োজন করে মৃতদেহ প্রদর্শনের এরকম রেওয়াজের দরকার কী? বেছে বেছে সেরকম মানুষের মৃতদেহ তারা মঞ্চ সাজিয়ে প্রদর্শন করে যাদের সংবাদ গুরুত্ব আছে, টেলিভিশন পত্রিকার যথেষ্ট ক্যামেরা এসে হাজির হবে, একই সঙ্গে ওই মৃত মানুষটির পরিবারের প্রতিষ্ঠিত আত্মীয়স্বজনের নেক নজরে আসার একটা সুযোগ তৈরি হবে। পরে এই উছিলায় ব্যবসা, ঠিকাদারির কাজে আসতেও পারে।"

এই আলাপচারিতার পরে আমি একা একাই ভাবছি আমাদের এই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ইতিহাস কী? এর তাৎপর্য কি? এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কী? এই প্রশ্নগুলোর কোন কূল-কিনারা করতে পারলাম না। ঘেঁটেঘুঁটে জানতে পারলাম এর প্রতিষ্ঠা ১৯৮৫ সালে। আজ ২০১৮ সাল গুণে গুণে ৩৩ বছর।

এই সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এরকম দুই একজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি এটা মূলত সংস্কৃতি অঙ্গনের নানা সংগঠনের একটা মোর্চা। অর্থাৎ বলাই যায় এটা লেখক, অভিনেতা, গায়ক আবৃত্তিকার, চিত্রশিল্পী, চলচ্চিত্রনির্মাতা, নায়ক নির্দেশক, আলোকচিত্রী, নৃত্যশিল্পীসহ সকল সাংস্কৃতিক পেশাজীবীদের একটা সম্মিলিত প্লাটফর্ম।

এখন প্রশ্ন হলো, সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পেশার স্বার্থে এই জোটের কী কোনও ভূমিকা আছে? আমার জানা নাই। তাহলে এই জোট থাকার অর্থ কী? অর্থ হলো নানা জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এর কুশীলবরা শহীদ মিনারের পাদদেশে মাইক টাঙিয়ে মতবিনিময় আর আলোচনা সভার আয়োজন করে; নানা জাতীয় দিবস সম্মিলিতভাবে উদযাপন করে। বেশ! প্রশ্ন হলো এই জোট না থাকলে কী এই উদযাপন, এই অনুষ্ঠান থেমে থাকত? অবশ্যই না।

আমাদের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট নিয়ে আরও বিশদ আলোচনার পূর্বে বিদেশে এরকম জোটগুলোর ভূমিকা কী সে বিষয়ে আলোকপাত করতে চাই। অন্যান্য দেশে এরকম জোটের মূল কাজ হলো সরকার, আঞ্চলিক কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সংস্কৃতি অঙ্গনের নানা পেশার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়াদি নিয়ে দেন দরবার করা, সংস্কৃতির জন্যে বরাদ্দ বাড়ানোর পক্ষে সম্মিলিত মতামত কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছে দেয়া। প্রয়োজনে গণমাধ্যমে এ নিয়ে বিতর্কের আয়োজন করা।

এবার ফিরে আসি আমাদের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট প্রসঙ্গে। আমাদের সাংস্কৃতিক জোট এ সংক্রান্ত কোন কাজটি করেছে? একটি কথা মনে পড়ে সংগঠন যদি কারও ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহৃত হয়, তাহলে সর্বনাশ। আমরা এরকম সর্বনাশা সময় পার করছি।

১৯৮৫ সালে জন্ম নেওয়া সংগঠনটিতে ঘুরে ফিরে গুটিকয়েক লোকজন হর্তাকর্তা হয়েছেন। ঘুরেফিরে বছর বছর এর কমিটি নড়েচড়ে। আদতে তা থোড় বড়ি খাঁড়া, খাঁড়া বড়ি থোড়। এরা কেউ সংস্কৃতিজন, কেউ নাট্যজন, কেউ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী; দুই একজন ব্যতিক্রম ছাড়া। সংস্কৃতি অঙ্গনে এদের দেবার কিছু নাই, দেবার বয়সও নাই। এই জোটকে আশ্রয় করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেয়। আর এই জানান দেয়ার ছলে নিজেদের ব্যবসা ঠিকাদারি, তদবিরে সুবিধা করে নেয়।

১৯৮৫ সালে এর জন্মলগ্ন সময়টা ছিল সামরিক শাসনের কাল। বোঝা যায় ওই সময়ে এই সংগঠনের একটা উপযোগিতা ছিল। ১৯৮৫ সালের সেই উপযোগিতা আর ২০১৮ সালের উপযোগিতা এক হতে পারে না। এখন শেখ হাসিনা টানা প্রায় দশ বছর যাবৎ প্রধানমন্ত্রী। এই সময়ে এসে আমাদের অর্থনীতি আর জীবনযাত্রার খোল নলচেই রীতিমত বদলে গেছে। আর আমাদের সাংস্কৃতিক অঙ্গন পড়ে আছে ১৯৮৫ সালের সেই মডেল ধরে। এর কারণ হল আমাদের সংস্কৃতির বুড়ো মোড়লরা তাদের জায়গা ছাড়তে নারাজ। তাই জোটের খোলনলচেও বদলাতে তারা চান না অথবা সেই হিম্মত তাদের নাই।

আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনে হাজারটা বিষয় সংস্কার করা যায়। আমরা তার কিছুই করলাম না। ২০০৭-২০০৮ সালে আমাদের জাদুঘরের সম্পদ বিদেশে পাচারের উদ্যোগ নেয়া হল। আমাদের সাংস্কৃতিক জোট চুপচাপ থাকল। কারণ জোটের দুই একজন কুশীলব প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই পাচারের পক্ষে ছিল। বিএনপি-জামাত শাসনামলে আমাদের যাত্রাশিল্প প্রায় ধ্বংস করার আয়োজন করা হল, অথচ আমাদের জোট চুপটি মেরে বসেছিল।

আমাদের ৭৫টি আদিবাসীর সংস্কৃতি, ভাষা ও সাহিত্য হুমকির মুখে। এ নিয়ে জোটের কোন পরিষ্কার বক্তব্য, কার্যক্রম ও অবস্থান নাই। ২০১০ সালে সরকারি এক সিদ্ধান্তে কেবল ২৭টি আদিবাসীকে স্বীকৃতি দেয়া হল। বাকি ৪৮টি আদিবাসীর কী হবে? এ বিষয়ে জোটের কী ভূমিকা? আমার জানা নাই। তারা রীতিমত চুপ। চুপ থাকার কারণ হল এসবে কোন ঠিকাদারি নাই।

এই জোটের এবং জোটভুক্ত সংগঠনগুলোর খোলনলচে পাল্টানো দরকার। সে পরিবর্তিত কাঠামো হওয়া দরকার নিতান্তই পেশাদারির ভিত্তিতে। কে কোন কালে কোন একটা কাজ করেছিল আর সেটা ধরে তিনি সংস্কৃতিব্যক্তিত্ব নাট্য ব্যক্তিত্ব, নৃত্যব্যক্তিত্ব বলে নিজেকে উপস্থাপন করবেন আর আড়ালে বিজ্ঞাপন আর ঠিকাদারি ব্যবসা করে যাবেন, তা হবে না। আমাদের এর থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সংস্কৃতির অঙ্গনের সংগঠনগুলোকে ট্রেড ইউনিয়নের আদলে সংস্কার করা দরকার, সেই সঙ্গে একটা দাবি জোরালো করা দরকার স্থানীয় এবং জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে শতকরা একভাগ বরাদ্দ রাখা দরকার।

সেই সঙ্গে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে শিল্পকলা একাডেমির পাশাপাশি আলাদা সংস্কৃতি অধিদপ্তর দরকার। এই অধিদপ্তর সংস্কৃতির প্রতিটি বিষয় যেমন সাহিত্য, চিত্রকলা, নাটক, নাচ, চলচ্চিত্র, সঙ্গীতসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের জন্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত আলাদা বিভাগ থাকা দরকার। আর এসব বিভাগের কাজ হবে দেশব্যাপী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের প্রচার প্রসার ও উৎকর্ষ সাধনের নিমেত্তে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ, বৃত্তি ও অনুদানের ব্যবস্থা করা। আর এই দাবিগুলো যারা তুলে ধরবেন তারাই সাংস্কৃতিক জোটের হাল ধরবেন। অন্যথায় এই জোট থাকলেও যা, না থাকলেও তা, এর ঠিকাদারিটুকুই সার।

এই ঠিকাদারি ব্যবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসার এখনই সময়।