নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান এবং ভুলে যাওয়া একজন জেহাদ

জহিরুল হক মজুমদার
Published : 12 Oct 2018, 12:47 PM
Updated : 12 Oct 2018, 12:47 PM

আমাদের জীবনের মূল্যবান অভিজ্ঞতাগুলোর একটি হচ্ছে সামরিক স্বৈরাচার-বিরোধী নব্বইয়ের গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করা। নেতৃত্বে ছিল 'সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য'। স্বৈরাচারী হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ এর ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে শুরু হওয়া  স্বৈরাচার বিরোধী ধারাবাহিক আন্দোলনের শেষ পর্যায় ছিল ১৯৯০ এর গণঅভ্যুত্থান। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ছেলে শহীদ জেহাদ এর লাশ সামনে রেখে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে গঠিত হয়েছিল 'সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য'। দিনটি ছিল ১৯৯০ এর ১০ অক্টোবর।

তবে জেহাদকেও ভুলে গিয়েছিল অনেকেই। জেহাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর আলোচনা অনুষ্ঠান হয়েছিল বাংলাদেশ শিশু একাডেমি মিলনায়তনে। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য সেদিনের সেই আলোচনা অনুষ্ঠানে জাতীয়ভাবে পরিচিত কোন বড় রাজনৈতিক নেতাই হাজির ছিলেন না। জেহাদ ছাত্রদল কর্মী ছিলেন বলে তার পরিবারের দিক থেকে বিএনপির সব বড় বড় নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু ইতিমধ্যে তারা অনেকেই 'মন্ত্রী' হয়ে গিয়েছিলেন। আর ওইদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিদেশ সফরে যাচ্ছিলেন। তাই তারা সবাই ছিলেন বিমানবন্দরে। জেহাদ এর বোন চামেলী মাহমুদ বারবার বলছিলেন আর আমরাও তার কথায় আশ্বস্ত হচ্ছিলাম যে এই বুঝি তারা প্রধানমন্ত্রীকে বিদায় দিয়ে এসে পড়লেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা আসেন নি। আমাদের সামনে এই অবহেলার অপমানে আর দুঃখে অঝোর ধারায় কাঁদলেন জিহাদের বোন চামেলী।

উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন দু'জন নেতা। একজন অতি পরিচিত বর্তমান মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন। আর অপরজন তখনও তরুণ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে তখনও কম পরিচিত মোশারেফা মিশু। মেনন ভাই এর বক্তৃতা ছিল আবেগ আর বিশ্লেষণের ভারসাম্যপূর্ণ প্রকাশ। তিনি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা থেকে ব্যাখ্যা করেছিলেন কেন জেহাদ গুরুত্বপূর্ণ এবং ভিন্ন রাজনৈতিক মতাবলম্বী হয়েও কেন তিনি আজ জেহাদের জন্য উপস্থিত হয়েছেন। মোশারেফা মিশু এর বক্তৃতায় ছিল তার স্বভাবসুলভ ঝাঁঝালো কণ্ঠের অনুরণন আর নেতাদের অনুপস্থিতি সম্পর্কে জোরোলো অভিযোগ।

কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে উঠেছিল জেহাদ এর বোন চামেলী এর কান্না। এই কান্না বোবা করে দেয়, অসহায় করে দেয়। প্রতিটি গণআন্দোলনের পর, প্রতিটি যুদ্ধের পর জয়ী যোদ্ধারা অধোবদনে দাঁড়িয়ে থাকে তার হারানো সহযোদ্ধার মায়ের সামনে, বাবার কিংবা বোনের সামনে। আমরাও সেরকম অপরাধবোধ নিয়ে মাথা নিচু করে ছিলাম এক 'অ্যান্টিগোনে' এর কান্নার সামনে। সময় আমাদেরকে শাস্তি দিতে থাকে। আমাদের চারপাশের নীরবতা আমাদের শাস্তি দিতে থাকে।

কোনও কোনও কান্নার জবাব কান্নাতেও হয়না। তাই আমরা নিশ্চুপ থাকি। একজন বোনের কান্না মহাকাব্যিক ট্রাজেডিতে ভরা। ক্ষমতা বিলাসে এক ভাইয়ের স্মৃতি হারিয়ে যাওয়ায় এক বোনের কান্না। এর কোন জবাব আমাদের কারও কাছেই ছিলনা।

জেহাদ জন্মেছিলেন ১৯৬৯ সালে ৬ সেপ্টেম্বর উল্লাপাড়া উপজেলার নবগ্রাম গ্রামে। পড়াশোনা করছিলেন উল্লাপাড়া'র আকবর আলী কলেজে। বাসিরুন্নেসা এবং কে এম মাহমুদ এর দশ ছেলে-মেয়ের মধ্যে তিনি নবম। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিতে আরও অনেক তরুণকে সংগঠিত করে তাদের সাথে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। পল্টন এলাকায় পুলিশের লাঠিচার্জ এবং এক পর্যায়ে গুলিতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন জেহাদ।

জেহাদ এর লাশ ঢাকা  মেডিক্যাল কলেজ থেকে একটি ট্রলিতে করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সে করে প্রথমে আনা হয় সূর্যসেন হলের সামনে। তারপর সেখান থেকে নেওয়া হয় অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে। জেহাদের লাশ সামনে রেখে সব ছাত্র সংগঠন এক জোট হয়ে গঠন করে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য। সময়টি ছিল সন্ধ্যার কিছু পর। অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে যেন তরুণদের বজ্রকণ্ঠের আওয়াজে আগুনের ফুলকি ছুটতে থাকে। আমরা সবাই বুঝতে পারি এক দিনের সূচনা হতে যাচ্ছে।