শিশু গৃহকর্মী- কিছু কথা, কিছু জিজ্ঞাসা

মাসুমা বিল্লাহ
Published : 8 Dec 2011, 08:25 AM
Updated : 11 Oct 2018, 11:40 AM

এবারের কন্যা শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য 'থাকলে কন্যা সুরক্ষিত, দেশ হবে আলোকিত' । আমরা কোন কন্যাদের সুরক্ষিত রাখার কথা বলছি? কেউ বাদ পড়ছে না তো? আধাআধি সুরক্ষা আধাআধি আলো দিবে … এখনই  সময় পূর্ণ সুরক্ষার কথা ভাববার ।

বাংলাদেশ মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে পরিগণিত হবে অল্প কিছু বছরের মধ্যেই । মধ্য আয়ের অনুষঙ্গ হিসেবে অনিবার্যভাবেই বাড়ছে নগর জীবনের পরিসর । আর এই নগর পরিসরে কোথায় কি হচ্ছে তা গ্রাম-নির্ভর সামাজিক জীবন থেকে আলাদা । তাই নগরের নিয়ম হবার কথা স্পষ্ট, জোরালো এবং সর্বজনীন । এটাও স্বীকার্য যে কিছু কিছু সংবেদনশীল বিষয় কেবল নিয়ম কানুন দিয়েই আটকানো যায় না, সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা এবং সামাজিক প্রতিরোধ নিয়ম কানুনের নিয়ামক হিসেবে কাজ করে ।

কন্যা শিশু নিয়ে আলোকপাতের এই পর্যায়ে আমি ভাবছি সেই সব কন্যা শিশুদের নিয়ে যারা তাদের শিশুকালের একটা বড় সময় অন্যের বাড়ীতে 'আশ্রিত' হয়ে জীবন কাটায়। এরা কি আশ্রিত? নাকি এরা শ্রমিক ? এরা মূলত স্বল্প মজুরির শিশু-শ্রমিক, কোন কোন ক্ষেত্রে চুক্তিভুক্ত শ্রমিক (bonded labour), কখনো কখনো ক্রীতদাস। এরা অতি সস্তায় শ্রম বেঁচে, আর এই শ্রম আমি-আমরা নাগরিক মধ্যবিত্ত/উচ্চবিত্ত কিনে নেই নামমাত্র মূল্যে । আমি-আপনি কি আমাদের নিজেদের বাসায়, চারপাশে, আত্মীয় পরিজন বন্ধু বান্ধবের নিপাট বসত বাড়িতে এমন কন্যা শিশুদের প্রতিনিয়তই দেখি না ? দেখি, প্রতিদিনই দেখি । এই শ্রম যারা কিনছে তারা কিসের বিনিময়ে এই শ্রম কিনছে ? মাস কাবারি কিছু টাকা দিয়ে ? শিশুটি কি তার এই আশ্রিত শৈশবে ভাত পাওয়ার অধিকার ছাড়া আর কোন অধিকার পায়? সে আসলে দৈনিক কত ঘণ্টা কাজ করে? যে কাজগুলো সে করে তা শিশুটির বয়সের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ? সে কি শিক্ষা এবং বিকাশের অধিকার পায়? তার দৈনন্দিন জীবন জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের ৪টি মূলনীতি – বৈষম্যহীনতা, সর্বোত্তম স্বার্থ, বেঁচে থাকা ও বিকাশ … এগুলোকে কি প্রতিনিয়ত বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায় না?

এবার যদি আসি নিরাপত্তার প্রসঙ্গে, শিশুটি তার তথাকথিত 'আশ্রিত' পরিবারে শারিরিক ও মানসিকভাবে কি নিরাপদ? উত্তর নিষ্প্রয়োজন, প্রতিদিনের খবরের কাগজ পাতা ভরাবার জন্য তবে এত এত খবর পত্রিকা মালিকরা কোথায় পেত? এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, শারিরীক ও যৌন নির্যাতনের কিয়দংশ খবর আমরা পাই (the tip of the iceberg), আর মানসিক নির্যাতনের খবর হারিয়ে যায় নিরবতায় ।

এবার আসি ভোক্তা প্রসঙ্গে, কে বা কারা এই শিশু শ্রমের ভোক্তা? আমি-আপনি-আমরা নাগরিক মধ্যবিত্ত। একাধারে আমরা মা, শিশুশ্রমিকের মালিক এবং ক্ষেত্র বিশেষে শিশু নির্যাতনকারী । আমরা কি ভেবেছি এই শিশুটিকে গৃহের সকল কাজে ব্যাপ্ত করে আমরা কোন আইনগত অপরাধ করছি কি না? অন্য একটি শিশুর বিকাশকে থামিয়ে দিয়ে নিজের সন্তানের বিকাশের পথকে কি আসলেই প্রসারিত করা যায়? এই গৃহকর্মী শিশুটির প্রতি আমার-আপনার-সমাজের-রাষ্ট্রের দায় কতটুকু? দু'বেলা ভাতের বিনিময়ে তাকে সময়ে অসময়ে নির্যাতনের অধিকার কি কেউ রাখে?

যদি আপনি ভোক্তা না হয়ে থাকেন, তবে দর্শক বা অবজারভার হিসেবে আপনার দায়িত্ব কি? আমি-আপনি কি আমাদের চারপাশে এমন অনেক ছোট্ট মেয়ে শিশুকে প্রায়ই দেখি না মুখ শুকনো করে নিরবে কাজ করে যেতে ? একবারও কি পরিপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে শিশুটির দিকে তাকিয়েছি? ভেবেছি কখনো যে এই মেয়েটির তো অক্ষরজ্ঞান হলো না, এই মেয়েটি তো আদর-স্নেহ-ভালোবাসা বঞ্চিত হয়ে শিশুবেলাটা কাটিয়ে দিল। ভেবেছি কখনো মেয়েটা কি ঠিকমতো খাবার পায় কিনা ? ওর কি একটু খেলতে ইইছা হয় না । ও যখন ছোট্ট একটা অপরাধে বকুনি খায়, চড় থাপ্পড় খায় তখন কি ওর বাড়ির কথা, মা বাবা ভাই বোনের কথা মনে পড়ে ? নিজের আরাম আয়েশের জন্য যারা একটা শিশুর শিশুবেলাটা নামে মাত্র মূল্যে কিনে নিল তাদের কে কি কোনও জবাবদিহিতার প্যাঁচে বাঁধা যায় না? নাকি আপনি- আমি কেবল নীরব দর্শক? আমি দেখেছি এমন অনেক শিশুকে, আমাকে অতিথি ঘরে গরম চায়ের কাপ এনে দিয়েছে বা শুকনো মুখে ঘর মুছে যাচ্ছে । আমি তো দেখেছি এমন দৃশ্য, বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে সবাই শিশু মেয়েটিকে ঘরে তালাবদ্ধ করে, মেয়েটি জানালার গরাদ ধরে উদাস চোখে তাকিয়ে আছে যেন সে জেলখানার গারদে বন্দি । আপনি দেখেননি মেয়েটির গালে চড়ের দাগ, তীব্র ধমকে কেঁপে উঠা ছোট্ট শরীর, চোখে রাজ্যের হতাশা। আপনি কি আপনার পাশের জানালায় কান পেতে কোন বোবা কান্না কখনো শুনেন নি ? আমি দেখেছি, শুনেছি, কষ্ট পেয়েছি, এড়িয়ে গিয়েছি- কিছুই করতে পারি নি। আমরা খুব ভালো করেই জানি, শহরাঞ্চলে পাশাপাশি ফ্ল্যাটগুলো অনেকটা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং সীমিত প্রবেশাধিকার সম্পন্ন, তাই দীর্ঘদিন পর্যন্ত কোনও শিশু গৃহকর্মী নির্যাতিত হতে থাকলেও হস্তক্ষেপ করার কেউ থাকে না ।

এবার আসি নৈতিকতার প্রসঙ্গে । আমি শিশু গৃহকর্মী রাখা অনেক মানুষকে বলতে শুনেছি, আহা আমরা যদি ওদের আমাদের ঘরে কাজ না দেই তবে এরা কী খেয়ে বাঁচবে, প্রকারান্তরে তো আমি উপকার করছি । এটা খুব অসুস্থ আর খোঁড়া যুক্তি বই আর কিছুই নয় । আপনি একজনের দারিদ্রের সুযোগে চারটা ভাত কাপড়ের বিনিময়ে তার শৈশব কিনে নিবেন আর যা খুশি অত্যাচার করবেন এটা কোন যুক্তিতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না । আপনি যদি মনে করেন সাহায্য করবেন, তবে মেয়েটির ভরণ-পোষণ লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়ে নিন, তাকে তার শৈশব দিয়ে আপনার দানের দাম মিটাতে হবে কেন? আর কখনো কি ভেবে দেখেছেন, যে মেয়েটিকে দিয়ে আপনি উদয়াস্ত পরিশ্রম করাচ্ছেন, তার বয়সী আপনার নিজের মেয়ের মনোজগতে এর কতখানি প্রভাব পড়ছে? মানবিকতার বোধ আর শক্তি আপনার সন্তান কোথা থেকে পাবে, কেবল পাঠ্য থেকে? একটা নির্যাতন পরিবেষ্টিত পরিবেশে আপনার নিজের সন্তানের মানসিক-মানবিক বৃদ্ধি বিনষ্ট হচ্ছে কিনা সেটা ভেবে দেখা কিন্তু জরুরি। আপনি কি আপনার সন্তানের কাছেই একটা ভণ্ড-মিথ্যুক-শঠ চরিত্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছেন কিনা সেটাও ভেবে দেখতে হবে সতর্কতার সাথে ।

এখানে রাষ্ট্র এবং আইন কি বলে? শিশুশ্রম কি আইনত দণ্ডনীয়? এসব শিশু নির্যাতনের খবর এবং অভিযোগ কোথায় দিতে হবে? কে এই অভিযোগ খতিয়ে দেখবে? রাষ্ট্র কিভাবে এসব দরিদ্র শিশুদের রক্ষা করবে? অন্যান্য দেশ বিশেষ করে উন্নত দেশ কিভাবে এই পরিস্থিতিকে আইনের আওতায় সমাধান করছে? সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে আমি আপনি কিভাবে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াবো ?

এখন আসুন খতিয়ে দেখি, নিজেদের কথা বলি … আমার-আপনার বাড়িতে কি কোন শিশু গৃহ কর্মী আছে? থেকে থাকলে আমি-আপনি কি তার নির্যাতনবিহীন জীবন নিশ্চিত করছি? আমি শারিরীক ও মানসিক দুটো নির্যাতনের কথাই বলছি । আমরা কি তাকে তার শৈশব ফিরিয়ে দিতে পারি না, একটি ছোট মেয়ের উদয়াস্ত সেবা ছাড়া কি আমাদের জীবন আসলেই অচল?

আপনি-আমি সামাজিক পরিমণ্ডলে যে সকল বাসায় যাই, যাদের সাথে আমাদের সামাজিকতা- আত্মীয়, বন্ধু, কলিগ, মেয়ের বন্ধু, ছেলের বন্ধু, জামাইয়ের বন্ধু, বউয়ের বন্ধু, পাশের বাসা … সে সব বাসাগুলোতে কি খেয়াল করেন শিশু গৃহকর্মী আছে কি না? খেয়াল না করে থাকলে এবার করুন, আপনার সামনে তো আর নির্যাতন হবে না, তবুও লক্ষ্য করুন, শিশু গৃহ কর্মীটির দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকান, তার পোশাক-আষাক দেখুন, পরিবার এর কর্তা-কর্ত্রীটি শিশু গৃহ কর্মীটির সাথে কেমন ব্যবহার করছে খেয়াল করুন, এমন কি ওই পরিবারের শিশুটিও গৃহকর্মীর সাথে কেমন ব্যবহার করছে খেয়াল করুন, কারণ শিশুটি কিন্তু তার বাবা মায়ের মত চালাকি করা এখনও শিখে উঠে নি, আপনার দৃষ্টিকে গভীর করতে বলছি …না… আমি গোয়েন্দাগিরি করতে বলছি না, আমি কেবল আপনাকে সামাজিক দায়িত্ব পালন করতে বলছি, আপনার সোশ্যাল পুলিসিং একটা নিরপরাধ শিশুকে মানবেতর জীবন থেকে উদ্ধার করতে পারে ।

এবার ধরুন, আপনি জানলেন, টের পেলেন, কিছু না কিছু ঘটে, কী করবেন আপনি? আপনার চেনা একজন কেউ বউ পেটায়, কী করেছেন আপনি, কিছুই করেন নি, ভেবেছেন যার বউ সে পেটায়, আমার কি? এবার ও কি তাই ভাববেন, ওরা খাওয়ায় পড়ায় ওরা পেটায়, আমি কি বা করতে পারি, অনেক সময় তথাকথিত ভদ্রতার খাতিরেও কি আমরা চুপ থাকি না? আমি জানি আমরা চুপ থাকি, ছিলাম, আছি …

না আর চুপ না… আসুন কি করা যায় ভাবি। উন্নত দেশে সোশ্যাল পুলিশ মনিটর করে, আর আমাদের পুলিশ তো খুন খারাবি-ই সামলাতে পারে না, তবে কী করা? আমরা কি ওই শিশুগুলোকে কিছু অসভ্য অমানুষ পারভারটদের হাতেই ছেড়ে দিব আর বক্তৃতা বিবৃতিতে বলেই যেতে থাকবো- শিশুরাই জাতির আগামী… ওরাই আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারি … ব্লা ব্লা ব্লা!

না, আসুন প্রস্তাব করি- শিশু নির্যাতনে একটা অ্যাকটিভ সেল করা হোক, আপনার সন্দেহভাজন পরিবারগুলোর কথা রিপোর্ট করুন, সেল থেকে টার্গেটেড সোশ্যাল পুলিসিং করার প্রস্তাব করুন। আমি হলফ করে বলতে পারি, এই সেল কল আর অভিযোগ নিয়ে কুলাতে পারবে না। আমি জনসংখ্যা নিয়ে কাজ করি, গবেষণা আমার কাজের হাতিয়ার, আশা রাখি এ বিষয়ে গবেষণা হবে, দাবি রাখি গবেষণা আর এভিডেন্সের প্রয়োজনীয়তার ।

আসুন আমরা এমন একটা সমাজের কথা ভাবি এবং গড়তে উদ্যোগী হই যেখানে শিশুগৃহ কর্মী রাখাকে সামাজিক ভাবে নিকৃষ্ট নিন্দনীয় কাজ হিসেবে গণ্য করা হবে । আসুন আমরা এমন একটা সমাজের কথা ভাবি যে সমাজে সকল নাগরিককে সকল ফর্মাল নথিতে (যেমন কাজ বা চাকরিতে, লোন পেতে, সরকারি ভাতা তুলতে, কোন সংগঠনের সদস্য হতে, সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে, বাড়ি ভাড়া পেতে ইত্যাদি) লিখতে হবে (requires written undertaken) যে তার গৃহে কোনও শিশু গৃহকর্মী নেই । জাতীয় কন্যা শিশু দিবসে আসুন এসব ঠেকাতে আমরা আশাবাদী হই, কারণ দেশটা আমাদের, ওই সব বাচ্চাগুলোও আমাদেরই, একটা শিশুকে বিকশিত হতে না দেয়া মানে একটা সম্ভাবনাকে মেরে ফেলা … ওরাও আমাদের ভবিষ্যৎ ।

সাধু সাবধান: আপনার মেয়ে স্কুলে যাবার পথে ঠ্যাং উঁচা করলে আপনার মেয়ের বয়সী আরেকটা মেয়ে তার পায়ে অতি যত্নে জুতা মোজা পরিয়ে দেয়, তারপর টানতে টানতে তার ব্যাগটা নেয়, তার উচ্ছিষ্ট খায়, আপনার অতিশয় দুষ্টু ছেলে ওকে পেটে লাথি মারতে অনেক মজা পায় আর আপনারাও খিলখিলিয়ে হাসেন ছেলের মজা দেখে! সাবধান, জীবনের নিয়মে জীবন কিন্তু প্রতিশোধ নিবেই !

বিগত বছরগুলোতে জাতীয় কন্যা শিশু দিবসগুলোর প্রতিপাদ্য ছিল-