৬ অক্টোবর মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন আনুষ্ঠানে বক্তৃতার সময় বর্তমানে রাজনীতিতে বিভিন্ন পেশাজীবীদের যখন-তখন অনুপ্রবেশ নিয়ে কথা বলেছেন। এই সংবাদটি দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রথম পাতায় ছোট্ট আকারে সংবাদ হিসেবে ছাপা হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য পত্রিকায় বিভিন্ন শিরোনামে প্রকাশ হয়েছে।
তিনি ব্যঙ্গ করে কিশোরগঞ্জের আঞ্চলিক ভাষায় কথাটি বলেছেন। যার অর্থ হলো- 'গরীবের বউ সবারই ভাবি।' গ্রাম এলাকায় একটি চিত্র প্রায়ই দেখা যায়, সেটি হলো ভাবিকে ডাকতে ডাকতে সবাই বাসায় ঢুকে পড়ে। তিনি আরও বলেছেন, এখন চাইলেই তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্সের লেকচারার হিসেবে নেওয়া হবে না, হাসপাতালের ডাক্তার হতে পারবেন না, বা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি পাবেন না। সেই অর্থে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী সকলেই রাজনীতিবিদ হচ্ছেন বা সাংসদ হচ্ছেন, কিন্তু রাজনীতিবিদরা অন্য পেশায় যেতে পারেন না। এই যে অন্য পেশা থেকে রাজনীতিতে আসছেন, বিষয়টি দেশের জন্য কতটা উপকার বয়ে নিয়ে আসছে? সত্যিই ভাবার বিষয়।
আমি কয়েকদিন আগে নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হতে ছাত্রদের ভাইভা শেষে ঢাকা ফেরার বাসে উঠেছি। এক পত্রিকাওয়ালা এসে বলল, "সে প্রতিবন্ধি , হয় পত্রিকা কিনতে হবে, না হয় এমনি টাকা দিতে হবে।" ইদানিং এ বিষয়টি রাস্তায় বাসে, ট্রেনে খুবই সাধারণ ঘটনা। হয় চকলেট কিনতে হয়, না হয় টাকা দিতে হয়। যাইহোক, মূল বিষয়টা বলি। কাজ নেই তো খই ভাজ। পত্রিকাটি পড়তে শুরু করলাম। সব পত্রিকায় একটি বিনোদন পাতা থাকে। আমি বিনোদনের পাতা খুব মন দিয়ে পড়ি। হঠাৎ অবাক হয়ে দেখি ছবি বা নাটকের কথা না লিখে এই পত্রিকায় বিনোদনের পাতায় লেখা- কোন শিল্পী কুশলী কোন দল করেন এবং তারা নমিনেশন চান। এসব শিল্পীরা দলের প্রতি কতটা আস্থাভাজন, মনোনয়ন না পেলেও দলের পক্ষে থাকবেন ইত্যাদিও সেখানে লেখা রয়েছে। সবার নাম মনে নেই। আসাদুজ্জামান নূর, তারানা হালিম, কবরী, মাহফুজ, রুবেল, ফারুক, শমী কায়সার, ইলিয়াস কাঞ্চন, মাসুদ রানা বিশেষ করে বয়ষ্ক শিল্পীরা বেশি। তাই মহামান্য এর এই কথায় অবাক হইনি।
এর আগে আমার বিভাগের বামপন্থী এক শিক্ষকের সাথে আমার একদিন ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের রাজনীতিতে আগমনের বিষয়ে কথা হচ্ছিল। তাকে আমি অনেক স্নেহ করি। নির্লোভ মানুষ। আমি তখন অতটা গুরুত্ব দেইনি। মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলাতে আমি একটি কলাম লিখে ফেললাম।
সত্যিই গরীবের বউ কি সকলের ভাউজ? বিষয়টির সত্যতা জানার জন্য ইন্টারনেটের সাহায্য নিলাম। দেখলাম, ২০১২ সালের সিপিডি কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রথম সংসদে ব্যবসায়ী, অবসর প্রাপ্ত সরকারি ও সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, আইন ব্যবসায়ী, অন্য চাকুরীজীবী ও রাজনীতিবিদ ছিল যথাক্রমে ২৪, ০, ২৭, ১৫, ও ১৩ যা ৯ম সংসদে হয়েছে ৫৬, ১০, ১৫, ৭, ৫। অর্থাৎ বাস্তবতা হচ্ছে ব্যবসায়ী বেড়েছে দ্বিগুন, অন্যান্য পেশাজীবী কমে গেছে এবং প্রকৃত রাজনীতিবিদও সময়ের তুলনায় বাড়ে নাই। কিন্তু নতুন করে যোগ হয়েছে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি ও সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। কিন্তু কেন? এর সদুত্তর দিবে কে?
দলগুলো এদের মনোনয়ন দিতে বাধ্য হচ্ছে কি অর্থনৈতিক কারণে? নাকি ক্ষমতার কারণে? যাতে করে ইলেকশনে পাশ করা যায়! এরপর ১০ম সংসদের সাংসদরা কে কোন পেশার তা দেখতে বাংলাদেশের র্পালামেন্টের ওয়েবসাইটে ঢুকে দেখলাম। পার্লামেন্টের ওয়েবসাইটের তথ্য হিসাব করলাম। অনেকেই পেশা উল্লেখ করেন নাই। অনেকে একাধিক পেশা উল্লেখ করেছেন। তবে অনেক সাংসদ নিজেকে সরাসরি ঠিকাদার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যাইহোক, গড়পড়তা হিসেবে যা পেলাম তাতে সর্বমোট ১৬২ জন তাদের পেশা হিসেবে ব্যবসা উল্লেখ করেছেন। এমনকি আসাদুজ্জামান নূর, শাহারিয়ার আলম, মাহাবুবুল আলম হানিফ, শেখ হেলাল উদ্দিন, তোফায়েল আহমেদ নানক, নারায়ন চন্দ্র চন্দ, সৈয়দ আশরাফ তাদের পেশা হিসেবে ব্যবসা উল্লেখ করেছেন। আইন পেশার সাথে যুক্ত এমন ৩৪ জন ব্যক্তি সাংসদ হিসেবে আছেন। রাজনীতি পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ২৩ জন সাংসদ। অধ্যাপক আছেন ৮ জন ও ডাক্তার আছেন ৭ জন। কৃষিকে পেশা হিসেবে ব্যবহার করেছেন ১৫ জন। উনারা আদৌ কি ধরনের কৃষি কাজ করেন সেটাই আমার মাথায় ঢোকে নাই। নতুন একটা পেশা পেলাম সমাজসেবা। এটি করে কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করা যায় সেটিও বোধগম্য হয় না। আমি স্যালুট জানাই যারা রাজনীতিকে পেশা বলতে পেরেছেন।
কারণ রাজনীতি অবশ্যই একটি সম্মানজনক পেশা এবং সমাজ এগিয়ে নিবে রাজনীতিবিদরাই যদি প্রকৃত রাজনীতিবিদ হয়। এই হিসেবে দেখতে গেলে, মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে কথাটি বলেছেন, সেটি একটি যথার্থ কথা। কিন্তু একটু পরিবর্তনযোগ্য। গরীবের বউ বড়লোকের ভাউজ- কারণ ব্যবসায়ীরা বেশি। প্রথম সংসদ থেকে তাদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে অথবা এমন হতে পারে সাংসদ হওয়ার পরে ব্যবসা শুরু করেছেন তখন পেশা পরিবর্তন হয়ে গেছে। নাকি রাজনীতি যে একটা সম্মানজনক পেশা সেটি বলতে আমাদের সামাজিক অবস্থান দুর্বল হয়? নাকি এমনও হতে পারে ব্যবসায়ীরা অর্থের বিনিময়ে সহজে সাংসদ হচ্ছেন? আমাদের সমাজ কি অর্থের বিনিময়ে ভোট দিচ্ছে? এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারব না। এরজন্য আছেন সমাজবিজ্ঞানী বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা। আমি সাধারণ একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক।
আমার এক ঘণিষ্ঠ সাংবাদিক বন্ধু আমাকে রাজনীতি নিয়ে লিখতে নিষেধ করেছিলেন। তারপরও মহামান্য রাষ্ট্রপতির ভাষণটি মনের ভেতর নাড়া দেওয়ায় লিখে ফেললাম।
উপসংহারে বলতে ইচ্ছা করছে – হয় গরীবের বিয়ে করার শখ থাকতে নেই বা থাকলেও, ধরে নিতে হবে তা বড়লোকের ভাউজ হবেই। মানে গরীবের জন্য রাজার নীতি নয় বা রাজনীতি করলে ব্যবসায়ী হতে হবে। না হলে এ সমাজে বেঁচে থাকা বড় কঠিন। এখন সকল দলকে ঠিক করতে হবে শুধু সাংসদ নমিনেশন নয়, অন্য জায়গায় ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদে কাদের দিবেন? কারা সত্যিকারে জনগণের কাজে আসবে? একই সাথে জনগনের দায়িত্ব সঠিক নেতৃত্ব বাছাই করা।