আদর্শিক রাজনীতির এক অনন্য ব্যক্তিত্ব কমরেড ফরহাদ

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 8 Dec 2011, 03:20 AM
Updated : 9 Oct 2018, 04:26 AM

বাংলাদেশে সত্যিকার অর্থে ত্যাগ আর বিপ্লবের আদর্শ নিয়ে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন যারা তাদের মধ্যে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ অনন্য। এদেশে বাম ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা। তার ব্যাপক পরিচিতি ছিল 'কমরেড ফরহাদ' হিসেবে। মেধা আর অধ্যাবসায়ের জোরে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হয়েও তিনি জাতীয় নেতায় পরিণত হয়েছিলেন। নির্বাচিত হয়েছিলেন জাতীয় সংসদ সদস্য।

এই ব্যক্তিটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে কতটা মহীরুহে পরিণত হয়েছিলেন তা অনেকের কাছেই অজানা। বিশেষত বর্তমান প্রজন্মের কাছে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ এক অচেনা নাম। বই-পুস্তকে, পত্রিকায়, টেলিভিশনে, রাজনৈতিক আলোচনায় কোথাও আর এই নামটি উচ্চারিত হয় না। কমরেড ফরহাদ যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন-বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবি-সেই দলটিও এখন আর আগের মত সুসংগঠিত নেই। অথচ এই আশির দশকে দলটির কাণ্ডারি যখন ছিলেন কমরেড ফরহাদ, তখন অন্যরকম পরিস্থিতি ছিল। বলা চলে কমরেড ফরহাদের জীবদ্দশায় এটি ছিল দেশের অত্যন্ত সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল একটি দল। এই দলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে বাংলাদেশে অজস্র প্রগতিশীল ধারার ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, ক্ষেতমজুর আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সর্বোপরি জাতীয় আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই দলটি ছিল বাংলাদেশর মুক্তিকামী মানুষের সাহসী ঠিকানা। আর এর সিংহভাগ কৃতিত্ব কমরেড ফরহাদের। উল্লেখ্য, কমরেড ফরহাদের মৃত্যুর পর নেতৃত্বের সংকট আর সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের বিপর্যয়ে দলটি আগের সেই অবস্থান আর ধরে রাখতে পারেনি। সেটা অবশ্য ভিন্ন প্রসঙ্গ।

নির্লোভ, নিরহঙ্কার মানুষ ছিলেন কমরেড ফরহাদ। সাদা পজামা-পাঞ্জাবী পরতেন। তার প্রিয় খাবার ছিল সাদাভাত, আলু আর টাকি মাছের ভর্তা। বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য তিনি যখন নিজ এলাকা পঞ্চগড় জেলার বোদায় যেতেন তখন তিনি নিজ মুখেই এই মেনুর কথা জানিয়ে দিতেন। তিনি মাঝে মাঝে ধূমপান করতেন-ফিল্টারহীন স্টার সিগারেট। সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা পড়তে পড়তে চিনি কম এক কাপ আর একটা স্টার সিগারেটই ছিল তার নিত্যদিনের একমাত্র 'বিলাসিতা'। তিনি অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপন করতেন। ছোটখাটো গড়নের এই মানুষটি কথা বলতেন আস্তে আস্তে, অত্যন্ত সাজিয়ে-গুছিয়ে। তিনি জনসভায়ও কখনও জ্বালাময়ী ভাষণ দিতেন না। কথা বলতেন যুক্তি দিয়ে, শ্রোতাদের সঙ্গে কথা বলতেন, এক ধরনের বোঝাপোড়া করতেন। তার বক্তব্য শুনে গ্রামের নিরক্ষর মানুষও উজ্জীবিত হতো। তিনি কখনো উত্তেজিত হতেন না। সবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, বলতেন সবার পরে। সব সময় ছিলেন ধীর-স্থির, সংযত। সহজেই আরেকজনকে জয় করে নিতে পারতেন। যতবড়ো ডাকসাইটে ব্যক্তিই হন না কেন, কমরেড ফরহাদের প্রখর ব্যক্তিত্বের সামনে সবাইকেই ম্রিয়মান মনে হতো। তাইতো প্রতিপক্ষের কাছেও তিনি ছিলেন সম্মানিত। বড়োরাও তাকে শ্রদ্ধা করতেন, সম্মান জানাতেন।

তিনি সারা জীবন জেল-জুলুম-হুলিয়া মাথায় নিয়ে রাজনীতি করেছেন। কোনো প্রলোভন বা প্রাপ্তির মোহ কখনো তাকে আচ্ছন্ন করেনি। কোনো হুমকি ও নির্যাতন তাকে আদর্শ থেকে এক চুলও বিচ্যুত করতে পারেনি। তার মত উদার, সৎ, প্রকৃত দেশপ্রেমিক রাজনীতিক বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড়ো বেশি দেখা যায়নি। একজন রাজনৈতিক নেতার মধ্যে কমরেড ফরহাদের মতো এতসব দুর্লভ গুণাবলি আমাদের দেশে সত্যিই বিরল। আদর্শ, সততা, মানুষের প্রতি গভীর অনুরাগ, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা, মেধা, শ্রম, অনুশীলন, ধী-শক্তি- সকল গুণের সমাহার ছিলেন তিনি। আর এসব দুর্লভ গুণের সম্মিলনের কারণেই তিনি বাংলাদেশের মত অশিক্ষা-কুশিক্ষা-কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মভীরু মানুষের দেশেও কমিউনিস্ট পার্টিকে গণ-মানুষের পার্টিতে পরিণত করতে পেরেছিলেন। 'নাস্তিক', 'রাশিয়ার দালাল' ইত্যাদি কঠিন অপবাদ-অপপ্রচারের মধ্যেও দলটি দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়েছিল। এই কৃতিত্বও নিঃসন্দেহে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের। নিজগুণেই তিনি দলের পরিচয়কে ছাপিয়ে জাতীয় নেতার মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। দলকে পরিণত করেছিলেন জাতীয় রাজনৈতিক দলে।

১৯৩৮ সালের ৫ জুলাই পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার জমাদারপাড়া গ্রামে এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। তার কৈশোর কেটেছে দিনাজপুরে। সেখানেই তার রাজনীতির হাতেখড়ি। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। নেতৃত্ব দেন বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে। দিনাজপুরে কলেজ জীবন শেষ করে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর ক্রমেই তিনি পরিণত হন পাকিস্তানের স্বৈরশাসন বিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামের প্রাণ-পুরুষে।

বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় সংঘটিত বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধ – প্রতিটি ক্ষেত্রে কমরেড ফরহাদ ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। কখনও জেলে, কখনও আত্মগোপনে, কখনও সংগ্রামী মানুষের সঙ্গে  থেকে তিনি আন্দোলন-সংগ্রাম সংগঠিত করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি কমিউনিস্ট পার্টি বিস্তারের জন্য কাজ করেছেন। বিভিন্ন সময়ে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ায় সমমনা দলের মধ্যে থেকে কাজ করেছেন। আন্দোলনের জোট গড়েছেন। দল ও জোটের রণনীতি ঠিক করেছেন। নির্ধারণ করেছেন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা। এভাবে তিনি সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। আমৃত্যু। ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশকে বিসর্জন দিয়ে তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে।

প্রথাগত রাজনৈতিক দল ও রাজনীতি দিয়ে দেশ ও দেশের গরিব-মেহনতি মানুষের প্রকৃত মুক্তি সম্ভব নয়, এ জন্য প্রয়োজন গণমানুষের পক্ষের সাচ্চা দেশ প্রেমিকদের সংগঠন- এই উপলব্ধি থেকে স্বাধীনতার পর তিনি দলগড়ার কাজে মনোনিবেশ করেছেন। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে বহুমুখী সংকট ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের এক কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়। এ সময় দেশের কল্যাণে সঠিক ভূমিকা নির্ধারণ বেশ জটিল এক বিষয়ে পরিণত হয়।

জাতীয় জীবনের এই চরম সংকটকালে তিনি অত্যন্ত ধীর-স্থিরভাবে দলের করণীয় নির্ধারণ করেছেন। সে সময় উগ্রবাম ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের হঠকারী কর্মকাণ্ডের মধ্যে কমিউনিস্ট পার্টি দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে বঙ্গবন্ধু সরকারকে সমর্থন করার নীতি গ্রহণ করে। কিন্তু শাসক দলের অূরদর্শিতা, কঠোর ও যথাযোগ্য ভূমিকা পালনে ব্যর্থতা এবং দেশের ভেতর ও বাইরের সাম্রাজ্যবাদী প্রতিক্রিয়াশীল অপশক্তির ষড়যন্ত্রে সকল ব্যবস্থাই অকার্যকর হয়ে যায়। সামরিক লেবাসে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি ক্ষমতা কুক্ষিগত করে বসে। স্বাধীন দেশে জারি হয় সামরিক শাসন। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর দেশপ্রেমিক শক্তির ওপর নেমে আসে সীমাহীন দমন-পীড়ন নির্যাতন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের কারণে কমিউনিস্টদের আবার আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। ১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমানের রাষ্ট্রপতি হওয়ার আস্থা গণভোটে 'হ্যাঁ' ভোট প্রদান এবং 'খাল কাটার' আন্দোলনে যোগ দেওয়ার 'কৌশলগত সিদ্ধান্ত' গ্রহণ করে কমরেড ফরহাদের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি। যদিও এই দুটি সিদ্ধান্ত পরবর্তীকালে ব্যাপক সমালোচিত হয়। শত প্রতিকূলতার মধ্যেও কমরেড ফরহাদ তার জাদুকরী সাংগঠনিক শক্তি দিয়ে রাজনৈতিক শক্তিকে আবারও সংগঠিত করার চেষ্টা চালান। তার ঐকান্তিক চেষ্টায় দেশের গণতান্ত্রিক ধারার রাজনৈতিক দলগুলোই শুধু ঐক্যবদ্ধ হয়নি, কমিউনিস্ট পার্টিও শক্তি সঞ্চয় করে। কিন্তু সামরিক জান্তা জিয়াউর রহমান কমরেড ফরহাদের এই তৎপরতাকে মেনে নিতে পারেনি। তিনি কমরেড ফরহাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যে অভিযোগ এনে তাকে জেলে নিক্ষেপ করেন। শক্তি দিয়ে কমরেড ফরহাদকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করেন। যদিও সামরিক শাসক জিয়ার এই উদ্যোগ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। জাতীয়-আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করে এক সময় কমরেড ফরহাদকে বেকসুর খালাস দিতে তিনি বাধ্য হন।

এরপর ক্ষমতার পালাবদলে আরেক সামরিক শাসক এরশাদের আবির্ভাব ঘটে। দমন-পীড়নের সঙ্গে  সঙ্গে নানা রকম কূটবুদ্ধি দিয়ে তিনি রাজনৈতিক শক্তিকে ঘায়েল করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। এ সময় কমরেড ফরহাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিস্ময়কর সাফল্য দেখান। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দল গঠন ও গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে তোলার কাজটি সুচারুভাবে সম্পন্ন করেন। কৃষক, ক্ষেতমজুর, নারী, ছাত্র-যুবদের নিয়ে তাদের নিজস্ব দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে গড়ে তোলেন একের পর এক নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। শাসকদের জন্য কমিউনিস্ট পার্টি ও কমরেড ফরহাদ এক ভীতিকর নাম হিসেবে দেখা দেয়। এ সময় কমিউনিস্ট পার্টি অত্যন্ত দ্রুত গতিতে বিকশিত হতে থাকে। পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য গড়ে উঠে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। জাতীয় রাজনীতিতে মোহাম্মদ ফরহাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো, নব্বইয়ের দশকে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনকে একটি সুস্পষ্ট অবয়ব দান। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫-দলীয় জোট ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭-দলীয় জোটকে ঐক্যবদ্ধভাবে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে তাঁর উদ্যোগী ভূমিকা বিশেষভাবে স্মর্তব্য। সে সময় আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে এরশাদ আকস্মিকভাবে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করে। তার ধারণা ছিল বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করবে, আর এই সুযোগে তিনি কিছু অনুগত দলকে সঙ্গে নিয়ে একটা পাতানো নির্বাচন করে বাজিমাৎ করবে। কিন্তু কমরেড ফরহাদ শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করে সামরিক শাসন প্রত্যাহারের শর্তে তাৎক্ষণিকভাবে এই নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেন। সংসদের প্রার্থিতা মনোনয়নে দুই নেত্রীর মাঝে তার ৫০-৫০ আসন ভাগের প্রস্তাব সে সময় ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করে। সম্ভাব্য বিপদের আশঙ্কায় এরশাদ তড়িঘড়ি করে আইন সংশোধন করে এক ব্যক্তি ৫টির বেশি আসনে নির্বাচন করতে পারবেন না-এমন বিধান চালু করে গদি রক্ষা করেন।

কমরেড ফরহাদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকে 'আন্দোলনের অংশ' ঘোষণা করে একইসঙ্গে চমক এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক নতুন ইতিবাচক ধারা সৃষ্টি করেন। কমরেড ফরহাদের দূরদৃষ্টি, কৌশলের কাছে সামরিক শাসক এরশাদের রাজনীতি প্রচণ্ড মার খায়। ১৯৮৬ সালে ঐক্যবদ্ধভাবে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে উন্মোচিত হয় সামরিক শাসক এরশাদের প্রকৃত চরিত্র। ভোট-ডাকাতি, কারচুপি, মিডিয়া ক্যু করে শেষ পর্যন্ত এরশাদ আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টিসহ আটদলীয় জোটের বিজয় ঠেকিয়ে দেয়। কিন্তু এতে করে এরশাদ আরো বেশি কোনঠাসা হয়ে পড়েন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ, কমরেড ফরহাদের নেতৃত্বধীন কমিউনিস্ট পার্টিসহ আটদলীয় জোট সংসদে গিয়ে সরকারের সমালোচনায় সোচ্চার হন। অন্যদিকে চলতে থাকে রাজপথের আন্দোলন। 'সংসদের ভেতরে-বাইরে' সরব হওয়ার এই রাজনীতির কাছে এরশাদের জনসমর্থন ক্রমেই কমতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নে চিকিৎসারত অবস্থায় কমরেড ফরহাদ মারা যান। থেমে যায় বাংলাদেশের রাজনীতির এক বিস্ময়কর প্রবাদপুরুষের কর্মযজ্ঞ।

কমরেড ফরহাদ যে দলের হয়ে রাজনীতি করেছেন, যে স্বপ্ন ও আদর্শ বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে রাজনীতি করেছেন তা বর্তমানে অনেকের কাছেই হয়তো 'অলীক' মনে হতে পারে। সমাজ পরিবর্তনের স্লোগান বর্তমানে বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির বিলবোর্ড ও বিজ্ঞাপনের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সমাজ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা, নিজেকে 'বিপ্লবী' মনে করা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার সেই বিপ্লবের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার কথা খুব সম্ভবত এখন পাগলামী হিসেবেই সমাজে পরিগণিত হবে। অথচ মাত্র তিনদশক আগে কমরেড ফরহাদের জীবদ্দশায় এটা ছিল দেশের লাখ লাখ তরুণের একান্তই স্বাভাবিক ও সঙ্গত স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন দেখার এবং দেখানোর মানুষ ছিলেন কমরেড ফরহাদ।

বইয়ের ভাষায় সর্বহারা একনায়কত্ব, সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদী ব্যবস্থা কায়েমের প্রশ্নটি হয়তো বাস্তব কারণেই ফিকে হয়ে গেছে। মার্কস-লেনিন যেভাবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, কমরেড ফরহাদ আমৃত্যু যে চেতনা ধারন করেছিলেন, বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় তা অনুসরণ করা হয়তো পুরোপুরি সম্ভব নয়। জ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর বর্তমান মানুষের জীবনাচরণে বিস্ময়কর পরিবর্তন ঘটেছে। সমাজ, রাষ্ট্র বিন্যাস ও রাষ্ট্র পরিচালনার মূল নীতিগুলোর দুর্বলতা কিন্তু এখনও রয়েই গেছে। সমাজে ধনী-গরিবের মধ্যে ধনের বৈষম্য দিন দিন দিন বাড়ছেই। অল্প কিছু মানুষ সমাজের সব সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে। অথচ সমাজে বেশিরভাগ মানুষ গরিব। তারা শ্রম দেয়, কিন্তু শ্রমের ন্যায্য মজুরি পায় না। সমাজের সব সুযোগ-সুবিধা-অধিকার অল্প কয়েকজন মানুষের দখলে। তারাই আইন প্রণেতা। তারাই শাসক। তাদের স্বার্থেই সব কিছু পরিচালিত হয়। তারাই নানা ফিকিরে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যায়। তারাই প্রভু। তারাই দেবতা। বাকিরা তাদের সেবাদাস। যে সমাজে শোষণ-বঞ্চনা-মানবাধিকার লঙ্ঘন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা, সে সমাজে কমরেড ফরহাদের আদর্শ, তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রশ্নটি অনেক বেশি জরুরি।

কমরেড ফরহাদ একটি শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য গরিব মানুষসহ সমাজের সব মানুষের মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই করেছেন। সকলের কল্যাণের জন্য তিনি মানুষকে সচেতন ও সংগঠিত করেছেন। পারিবারিক জীবনে স্ত্রী রীনা ফরহাদ, মেয়ে নন্দিতা ও ছেলে সুমিতকে বঞ্চিত করে প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন নিপীড়িত মানুষের কল্যাণে, মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। এটাকে তিনি জীবনের একমাত্র ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। গরিব মানুষের স্বার্থ ও অধিকার প্রতিষ্ঠার বুলি, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার আওয়াজ এখনও হামেশাই উচ্চারিত হয়। কিন্তু তা নিছকই বুলি বা আওয়াজ। গোষ্ঠী স্বার্থ ও দলীয় স্বার্থের ঘেরাটোপে আবদ্ধ আমাদের রাজনীতি মানুষকে ক্রমেই শৃঙ্খলিত করছে। করছে নিঃস্ব। ক্ষুদ্র একদল মানুষ সব কিছু লুটেপুটে খাচ্ছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ প্রতিনিয়ত তাদের দ্বারা প্রতারিত হচ্ছে। অথচ এর কোনো প্রতিকার মিলছে না। মুখে সবাই জনদরদী গরিবের বন্ধু সাজলেও বাস্তবে সবাই দল ও গোষ্ঠী স্বার্থের কাছে নিজের বুদ্ধি-বিবেচনা-বিবেক সবকিছুই যেন বিসর্জন দিয়ে বসে আছে। বঞ্চিত প্রতারিত মানুষের ক্ষোভের আগুনকে সমন্বিত শক্তিতে পরিণত করার মত সংগঠন, তেমন রাজনীতি, ব্যক্তিত্ব- কোনো কিছুই আপাতত দেখা যাচ্ছে না।

অনেকের মধ্যে শাসক বদল কিংবা নেতা বদলের মরিয়া চেষ্টা লক্ষ করা যাচ্ছে। নানা স্বার্থ ও সুবিধার ধান্দায় অনেকে অনেক রকম জোটও গড়ে তুলছেন। কিন্তু নীতি বা ব্যবস্থা বদলের কোনো অঙ্গীকার কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

এই বাস্তবতায় কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের তিরোধান দিবসে তার অভাব বড় বেশি অনুভূত হচ্ছে!