কী হবে তখন!

মামুন আল মাহতাব
Published : 8 Oct 2018, 01:56 PM
Updated : 8 Oct 2018, 01:56 PM

সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটি রাজনৈতিক দলের উদ্যোগে বেশ কিছুদিনের ব্যবধানে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হলো। 'মহা' না হলেও সমাবেশটি নিয়ে উৎসাহ আর সন্দেহ ছিল যথেষ্টই। কারণ আর কিছু না, কারণটা হলো বহুদিন পর আবারো 'মাঠে' ওই রাজনৈতিক দলটি।

আমরা যতই বিস্মৃতিপরায়ণ হই না কেন, ২০১৮'র শেষে আবারো একটি জাতীয় নির্বাচন আর আবারো আন্দোলনের হুমকি-ধামকির মুখে ২০১৪'র জাতীয় নির্বাচনের আগে পরের ভয়াবহ স্মৃতি আমরা ভুলে বসে আছি এমনটাও প্রত্যাশা করা অনুচিত। আমরা অনেক কিছুই ভুলে গেছি। ভুলে গেছি '৭১-এর রাজাকারদের কথা আর তাদের সাথে ওই দলটির সখ্যও। ২০১৪-ও ভুলে যাবো। আরেকটু সময় লাগবে। হয়তো বা ভুলে যেতামও এই ক'দিনেই। কিন্তু হাজার হোক ডিজিটাল যুগ। ভুলতে চাইলেও ভোলা যায় না। আর কেউ না হোক মনে করিয়ে দেয় ফেইসবুক। কাজেই সমাবেশের দিন দুপুর থেকেই ঢাকার রাজপথে ট্রাফিক যে হাওয়া হয়ে যাবে এমনটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। মানুষ তো ভয় পেতেই পারে। এটি তাদের অধিকার।

ভাল কথা যে, সেদিন সেরকম কিছুই হয়নি। অক্টোবরের শুরু থেকেই আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে রাখলেও ৩০ তারিখে তার কোনও মহড়া দেখায়নি রাজনৈতিক দলটি এবং তার সহযোগিরা। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছেও এমনটাই ছিল প্রত্যাশিত। আন্দোলনে সত্যি সত্যি আগ্রহী হলে ২২ শর্তে নাকে খত দিয়ে নিশ্চয়ই সমাবেশ করায় সম্মত হত না দলটি। তাও আবার চব্বিশ ঘণ্টারও কম নোটিসে। আমার কাছে মনে হয়েছে এই সমাবেশে তাদের অর্জনের চেয়ে বিসর্জন বেশি। আর যদি এই সমাবেশ থেকে কারো কিছু অর্জিত হয়ে থাকে তবে তার বেশিরভাগই সরকারের। কারণ বিরোধীদের দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের তিন মাস আগে এমন একটি নিয়ন্ত্রিত সমাবেশ আয়োজন করানোর মধ্যে দিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সরকারের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব আর পাশপাশি বিরোধীদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব।

যাহোক আমি ওই রাজনৈতিক দলটির কেউ নই। অতএব তাদের ভালো তারাই বুঝবেন, আমি না। আমার যে কারণে খারাপ লেগেছে, তা হলো দীর্ঘদিন পরে যখন রাজনৈতিক দলটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন আবারও তাদের ঘাড়ে সওয়ার জামাত-শিবিরের ভূত।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওই সমাবেশে স্বাধীনতা বিরোধীদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখযোগ্য। মূলস্রোতের মিডিয়া আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে এসেছে সে কথা। এর মাধ্যমে তারা আবারও ওই দলটিকে বোঝাতে পেরেছে, 'আমরা নেই তো, নেই তোমরাও'। সম্প্রতি দেশের ভেতরে-বাইরে, এমনকি দলের ভেতরেও জামায়াত সংশ্লিষ্টতার কারণে বিরোধী রাজনৈতিক দলটি কিছুটা হলেও চাপের মুখে। তাদের ঘরানার বুদ্ধিজীবীরাও এই বিষয়ে একটু একটু মুখ খুলছিলেন। এসব অবশ্য আমাকে কখনোই আশান্বিত করেনি। তারা কখনো জামায়াতকে তাদের পকেট থেকে বের করে নিয়ে আসবে এমনটি আমি প্রত্যাশা করি না।

আর যে সমস্ত বুদ্ধিজীবী জামায়াতের পৃষ্ঠপোষক কোনও সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন তাদের বুদ্ধি-সুদ্ধির স্বচ্ছতা নিয়েও আমার প্রশ্ন আছে। কারণ আমার বিশ্বাস যার ঘটে সামান্যতম সুস্থ ঘিলু আছে তিনি কোনদিনও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জামায়াত তোষণকারী হতে পারেন না। তবে সমাবেশটি আপাত সফল করায় জামায়াতের এই প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ওই বিরোধীদলটির জামায়াত সমর্থক বৃহদাংশের জন্য স্বস্তির। কারণ তারা এখন তাদের জামায়াতবিরোধী ক্ষুদ্রাংশকে এবং বিশেষ করে দেশের ভেতরে-বাইরে তাদের সহমর্মীদের আরেকবার বোঝাতে পারবে, 'ওরা আছে বলেই তো আমরা – অতএব কিসের ডিভোর্স'? আমার বিবেচনায় সমাবেশ পরবর্তী দলটির জামায়াতপ্রীতি আরো বাড়বে বৈ, কমবে না। এতে অবশ্য আমার কিছু এসেও যায় না কারণ আমার বিবেচনায় ঐ বিশেষ দলটি এদেশের রাজনৈতিক জঞ্জালদের ভাগাড় বৈ অন্য কিছু না।

আমার খারাপ লাগার জায়গাটা হচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রকাশ্য দিবালোকে আরো একবার জামায়াতের হাতে 'বিএনপি বধ' মঞ্চায়িত হতে দেখলাম। সেই খারাপ লাগাটাও খুব বেশি না। শুরু থেকে ভুলের পথে যাদের অবিরাম ছুটে চলা তাদের অনিবার্য পরিণতি এমনটাই হতে বাধ্য, তা সে যে যাই বলুক না কেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আর তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্য আর পাশাপাশি হাজারো মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের রক্তে রঞ্জিত যারা তাদের জন্য এর চেয়ে ভাল আর কোনও পরিণতি আমি প্রত্যাশাও করি না।

আমার মনের গভীরে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে সমাবেশটি আয়োজনে আর সমাবেশটিতে কিছু সংখ্যক সংশ্লিষ্টতা। আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় না তারা মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু করতে হয়। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করে তারা ভূয়া মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু পারি না। ইতিহাস বদলে দেই কীভাবে? জাতির জনকের আদর্শ আর জননেত্রীর প্রতি অবিচল আস্থা আমাদের তো সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দীক্ষিত করেনি যে, আমরা চাইলেই ঘোষণাপত্রের পাঠককে ঘোষক বানিয়ে দিব কিংবা বাজারে ছেড়ে দিব 'দ্য সুটকেস অ্যান্ড টি-শার্ট থিওরি' অথবা ছাপিয়ে দেব 'ভাঙ্গা ড্রিমের উপাখ্যান'।

আমার প্রিয় বন্ধু একসময়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের তুখোড় নেতা আর এখন অস্ট্রেলিয়া প্রবাসে স্বাধীনতার পক্ষের সোচ্চার কণ্ঠ ডা. ইকরামুল হক চৌধুরী প্রায়ই বলতো, 'যে একবার রাজাকার সে সারাজীবনই রাজাকার, কিন্তু যে একবার মুক্তিযোদ্ধা তিনি সারাজীবনই মুক্তিযোদ্ধা নন।' ইকরামের যুক্তি ছিল যে একবার রাজাকার সে ভাল কাজ পরবর্তীতে যাই করুক, আর যতই করুক না কেন তাতে তার পাপের এতটুকুও মোচন হয় না।

কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধার পরর্তীতে কোনও বড় স্খলন তাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে কখনোই ইমিউনিটি দেয় না। আমি ইকরামের সাথে আংশিক একমত ছিলাম। ইকরাম তো অস্ট্রেলিয়া গিয়ে বেঁচে গেছে, কিন্তু আমরা যারা বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা-রাজাকারের অদ্ভুত যত রসায়নে আমাদের তো নাভিশ্বাস ওঠার যোগাড়। যতবারই এধরনের কোনও সমাবেশ, টেলিভিশনের কোনও টকশোতে কোনও রাজনৈতিক জোটের নীতিনির্ধারণী সভায় কোনও মুক্তিযোদ্ধাকে জামায়াত তোষণ করতে দেখি, তখন বারবার অন্তর্দহন হয়, মনে প্রশ্ন জাগে কিসের জন্য, কেন এই পদস্খলন? কেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের কারো কারো আজকে এই বিভ্রান্তি? তাদের জায়গাতো এদিকে, ওদিকে নয়।

এদিকের কোনও ক্রিয়া-বিক্রিয়া যদি তাদের অসন্তোষের কারণ হয় তবে তাদেরইতো দায়িত্ব আমাদের পিছনে নিয়ে সেগুলো সংশোধনে নেতৃত্ব দেয়া। তাই বলে রাজাকার তোষণ তো কোনও সমাধান নয়। তাদের অবশ্যই স্বাধীনতার স্বপক্ষে দাঁড়াতে হবে। আর তা যদি না হয়, একদিন জীবন বাজি রেখে তারা যে দেশটিকে স্বাধীন করেছিলেন সাধের সে স্বাধীন দেশে তারা যে দ্রুতই অপাক্তেয় হয়ে যাবেন তখন কী হবে!