পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের দৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রাম

মোহাম্মদ সেলিম
Published : 8 Dec 2011, 02:03 AM
Updated : 7 Oct 2018, 01:54 PM

পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম এবং ভাঙনের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম, ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করেছেন, অন্যদিকে সেই রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যাচার-নিপীড়ন, মৃত্যুঝুঁকি, দীর্ঘকাল রাষ্ট্রীয় প্রতিহিংসার শিকার হয়ে কারাভোগসহ নানারকম শারীরিক মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। মাত্র ২৮ বছর বয়সে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু করেন, যা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সফল পরিণতি লাভ করে।

পাকিস্তান সরকার শত্রু চিনতে ভুল করেনি। পূর্ব পাকিস্তানে খ্যাতিমান, প্রভাবশালী অনেক নেতা তখন ছিলেন। যেমন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, খান আতাউর রহমান প্রমুখ। কিন্তু পাকিস্তান সরকারের কাছে তরুণ নেতা মুজিবের ন্যায় অন্যরা এত 'বিপজ্জনক' ছিল না।

১৯৪৮ সাল থেকেই শেখ মুজিবকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যে কারণে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সকল কর্মকাণ্ড পাকিস্তানের গোয়েন্দা শাখার (ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ) কঠোর নজরদারির মধ্যে ছিল। প্রতিদিন তার রাজনৈতিক তৎপরতা সম্পর্কে প্রতিবেদন তৈরি করা হতো। এভাবে পাকিস্তান আমলে ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক তৎপরতা সম্পর্কে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের মোট ৪৭টি ফাইল পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে এই গোয়েন্দা প্রতিবেদনগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিবেদন/দলিলসমূহ ১৪ খণ্ডে বিন্যস্ত করে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছে 'জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেমোরিয়াল ট্রাস্ট'। ১৯৪৮-১৯৫০ সালের গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রথম খণ্ড 'সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান' প্রকাশ হয়েছে। সম্পাদনা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রথম প্রকাশ সেপ্টেম্বর, ২০১৮; প্রকাশ করেছে হাক্কানী পাবলিশার্স, মূল্য ৯০০ টাকা, পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৮২।

গ্রন্থের প্রারম্ভে 'মুখবন্ধ'-এ তথ্যসমৃদ্ধ সংক্ষিপ্ত আলোচনায় বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবন এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদনের গুরুত্ব ও সীমাবদ্ধতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কীভাবে বাঙালির ইতিহাসের মূল্যবান উৎসের সন্ধান পেলেন, দলিলপত্র সংগ্রহ করলেন এবং প্রকাশ করলেন- এর বস্তুনিষ্ঠ বর্ণনা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রথম তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের বহু জানা-অজানা ঘটনার নথিপত্র, বঙ্গবন্ধুর লেখা চিঠি, তার নিকট লেখা আত্মীয়-স্বজন, নেতা-কর্মীদের চিঠি, বিভিন্ন জনসভায় দেওয়া ভাষণ, আত্মপক্ষ সমর্থনে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য, বিভিন্ন গোয়েন্দা প্রতিবেদন ইত্যাদি সংকলিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে ২৪টি, ১৯৪৯ সালে ১৩৫টি এবং ১৯৫০ সালে ১৬২টি প্রতিবেদন সন্নিবেশিত হয়েছে। সঙ্গত কারণে অনুমান করা যায় যে, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে পাকিস্তানের গোয়েন্দা শাখার নজরদারি এবং নথিপত্র।

'স্বপ্নে'র পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরপর রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। উল্লেখ্য, ১৯৪৬ সালের বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে গ্রামাঞ্চলে মুসলিম লীগ প্রায় ৯৪ শতাংশ ভোট লাভ করে। এই নির্বাচনে তরুণ ছাত্রনেতা শেখ মুজিব মুসলিম লীগ প্রার্থীদের জয় লাভে, সামগ্রিকভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের মাত্র চার মাস পরে, পাকিস্তান আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ বা পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন হলো ভাষা আন্দোলন ও বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন, খাদ্য সংকট, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা, কর্ডন প্রথা, জনসাধারণের জন্য সামরিক প্রশিক্ষণ ইত্যাদি। তবে ১৯৪৮ সাল থেকেই গোপন নথিপত্রে পাকিস্তান সরকারের হিন্দুদের প্রতি সাম্প্রদায়িক নীতি এবং ভারত-বিদ্বেষ লক্ষ্য করা যায়।

ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা কেউ কেউ স্বীকার করতে চান না। যারা একটু চালাক তারা বলেন, এটা আওয়ামী প্রচারণা মাত্র। এমন কী ভাষা সংগ্রামীদের স্মৃতিকথায় বঙ্গবন্ধুর অবদানের উল্লেখ নেই। অথচ পাকিস্তানি গোয়েন্দাদের বহু প্রতিবেদনে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানের উল্লেখ পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে একটি প্রতিবেদন উদ্ধৃত করা যেতে পারে-

"Secret information was received on 12.3.48 that the subject (Bangabandhu) along with others took part in the discussions held at Fazlul Haq Hall on 10.3.48 and gave opinion in favour of violating section 144 cr.p.c. on 11.3.48. On this decision, small batches of Hindu and Muslim students were sent out on 11.3.48 to picket the G.P.O., the secretariat and other important Govt. offices. The subject (Bangabandhu) was arrested on 11.3.48 for violating the orders." (P. 36)

পুলিশি গোয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সচিবালয় এবং জিপিও এর সামনে ধর্মঘটে ছাত্র-জনতাকে সংগঠিত করেন ও নিজে অংশ নেন। সচিবালয়ের সামনের রাস্তা থেকে বঙ্গবন্ধুকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে সভা-সমাবেশ করেছেন। প্রচারপত্র, লিফলেট বিতরণের ব্যবস্থা করেছেন। নিজে বহু পুস্তিকা প্রকাশ করেছেন। এগুলো গোপন তৎপরতা ছিল না। লিফলেট এবং পুস্তিকায় বঙ্গবন্ধুর নাম মুদ্রিত ছিল। তিনি আরবি হরফে বাংলা লেখার তীব্র সমালোচনা করেন। উল্লেখ্য, গোয়েন্দা প্রতিবেদনে রাষ্ট্র ভাষার আন্দোলনকে ভাষা বিতর্ক (Language Controversy) বলা হয়েছে।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপর জমিদারি প্রথা বাতিলের দাবি বেশ গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। এটা ছিল পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ কৃষিজীবী মানুষের প্রাণের দাবি। ১৯৪৬ সালের মুসলিম লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও অঙ্গীকার ছিল জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের। তারপরও পাকিস্তান অর্জনের পরপর শাসকগোষ্ঠী এ বিষয়ে শ্রেণি স্বার্থে খুব একটা আগ্রহ দেখায় নি। বঙ্গবন্ধু জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পক্ষে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলেন। গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে,

"He (Bangabandhu) advised the people to create public opinion in favour of abolition of the Zamindar system without any compensation." (P. 96)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালে সম্পূর্ণ মানবিক কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হতদরিদ্র নিম্ন বেতনভোগী চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জীবন-জীবিকার যৌক্তিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। অসহায় কর্মচারীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য তাকে বেশ চড়া মূল্য দিতে হয়। তারপরও সারাজীবন নীতি-আদর্শ মূল্যবোধের সঙ্গে আপস করেন নি। কর্মচারীদের আন্দোলনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন-

"পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেসিডেন্সিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এখন এটাই পূর্ব বাংলার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কর্মচারীদের সংখ্যা বাড়ে নাই। তাদের সারাদিন ডিউটি করতে হয়। পূর্বে বাসা ছিল, এখন তাদের বাসা প্রায় নিয়েই যাওয়া হয়েছে, কারণ নতুন রাজধানী হয়েছে, ঘরবাড়ির অভাব। এরা পোশাক পেত, পাকিস্তান হওয়ার পরে কাউকেই পোশাক দেওয়া হয় নাই। চাউলের দাম ও অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। চাকরির কোনো নিশ্চয়তাও ছিল না। ইচ্ছামত তাড়িয়ে দিত, ইচ্ছামত চাকরি দিত।" (পৃ. ১৯২)

সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরাও কর্মচারীদের আন্দোলনে সংহতি জানায়। এবং ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করে। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অচল অবস্থা সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু অন্যান্য ছাত্রনেতাদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং কর্মচারীদের বিরোধ মীমাংসার একাধিক উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে উপাচার্যের বাসভবন থেকেই পুলিশ বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে।

বঙ্গবন্ধু লিখেছেন-

"আমরা তাঁকে (উপাচার্য) বোঝাতে চেষ্টা করলাম, তিনি বুঝেও বুঝলেন না। এর কারণ ছিল সরকারের চাপ।… একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার ও শিক্ষাবিদ সরকারের চাপে এই রকম একটা কথার মারপ্যাঁচ করতে পারে এটা আমার ভাবতেও কষ্ট হয়েছিল।" (পৃ. ১১৩)

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুলিশ ব্যবহার করে ছাত্রদের আবাসিক হল ত্যাগ করতে বাধ্য করে। বঙ্গবন্ধুসহ ২৭ জন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তবে অনেকে মুচলেকা এবং জরিমানা দিয়ে ছাত্রত্ব ফিরে পায়। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সুস্পষ্ট বক্তব্য হলো-

"আমি কোনো অন্যায় দাবি করি নাই, অত্যন্ত ন্যায়সঙ্গত দাবি করেছি। মুচলেকা ও জরিমানা দেওয়ার অর্থ হলো দোষ স্বীকার করে নেওয়া, আমি তা করব না।" (পৃ. VII)

উপাচার্য দুজন প্রাধ্যক্ষকে দায়িত্ব দেন বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্য ছাত্রনেতার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য। এ ১৭ এপ্রিল ১৯৪৯ সালের গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে,

"SK. Majibar (Mujibur) Rahman and others refused any relaxation unless the University withdraws the punishment from the students unconditionally." (P. 121)

কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধু আইন বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিতে অনুমতি প্রার্থনা করেছিলেন। এ বিষয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষের সঙ্গে ২৮ জুন ১৯৫০ তারিখে কারাগারে নিরাপত্তা বন্দি বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ হয়। তিনি প্রাধ্যক্ষকে অনুরোধ করেন তার ওপর আরোপিত শাস্তি (১৫ টাকার জরিমানা) রহিত করে, পরীক্ষায় অংশ নিতে অনুমতি দেওয়ার জন্য।

শেষ পর্যন্ত জরিমানা না দেওয়ায় বঙ্গবন্ধু তার ছাত্রত্ব ফিরে পাননি। অবশ্য কয়েক বছর পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া শাস্তি প্রত্যাহার করেছে। আমার মত হচ্ছে, অন্যায় আদেশ প্রত্যাহার না করে ঐদিনটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ সামগ্রিক অবদান নিয়ে আলোচনা, সেমিনার, র‌্যালি, আলোকচিত্র প্রদর্শনী ইত্যাদি আয়োজন করা যেত। এমনি আয়োজনের মধ্য দিয়ে নবীন ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে জাতির পিতার আদর্শ, দর্শন ও মূল্যবোধ সঞ্চারিত করার কার্যকর সুযোগ সৃষ্টি করা যেত।

পূর্ববঙ্গের সাধারণ মানুষের নিকট পাকিস্তান আন্দোলন ছিল প্রকৃতপক্ষে আর্থ-সামাজিক মুক্তির সোপান। কিন্তু বহু কাঙ্খিত 'আজাদী' লাভের পরও পূর্ববঙ্গের জনগণের অবস্থা আরও অবনতি হতে থাকে। বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চলে কাপড়ের সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায় মানুষ কাপড় কিনতে পারছে না, কালোবাজারে অধিক মূল্যে কাপড় বিক্রি হচ্ছে, খাদ্যাভাব দেখা দিচ্ছে। বঙ্গবন্ধু অভিযোগ করেন, খাদ্যশস্যে উদ্বৃত্ত বরিশালেও চালের মণ ৪০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তার ওপর বাড়তি কর, দুর্নীতি মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। ১৯৪৮ সালে ১৭ মে নারায়ণগঞ্জে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু আরও বলেন-

"When we point these out and demand their remedy and also eradication of corruption and injustice, we are damned as traitors, fifth columnists etc., we declare that we have worked to achieve Pakistan and we shall fight to defend it, if necessary." (P. 19)

বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন জনসভায় খাদ্য ঘাটতি নিয়ে বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, সরকারের ভ্রান্ত খাদ্যনীতির কারণে দেশের শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ অনাহারে আছে (পৃ. ২৮১)। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। ১৯৪৮ সাল থেকেই তিনি সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার দাবি তোলেন। তিনি তরুণদের রাজনৈতিক সচেতনতার পাশাপাশি প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করেন। কেবল পাঠ্যপুস্তকে সীমাবদ্ধ না থেকে পাঠচক্র এবং বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে উৎসাহিত করেন (পৃ. ২৬৯)।

পাকিস্তানের প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে এক বিবৃতি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের তীব্র সমালোচনা করে বলেন,

"১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট আমরা যে 'আজাদী' লাভ করিয়াছি, সেটা যে গণ আজাদী নয়, তা' গত একটি বছরে সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হইয়াছে। 'জাতীয় মন্ত্রিসভা' দীর্ঘ একটি বছরে জনগণের দুইশ' বছরের পুঞ্জিভুত দুঃখ-দুর্দ্দশা মোচনের কোন চেষ্টা করেনই নাই, বরঞ্চ সেই বোঝার উপর অসংখ্য শাকের আঁটি চাপাইয়াছেন।" (পৃ. ৪৪)

কৈশোর থেকেই বঙ্গবন্ধুর মনোজগতে এদেশের অবহেলিত-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ মনোযোগ-দরদ লক্ষ্য করা যায়। সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নত করার ব্রত তাকে জনমানুষের একজনে পরিণত করেছে আবার নিঃস্ব, দরিদ্র জনগোষ্ঠী তাকে নিজেদের একজন বলে বিশ্বাস করত। এই সময়ে বক্তৃতা-বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু 'কর্ডন প্রথা'র বিরুদ্ধে অনেক বক্তব্য দিয়েছেন। কর্ডন প্রথার মাধ্যমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক জেলা থেকে অন্য জেলায় খাদ্যশস্য পরিবহনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান আমলেও তা অব্যাহত ছিল। কর্ডন প্রথার জন্য অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষক ও দরিদ্র মানুষ। কারণ খাদ্যশস্যের অভাব এবং মূল্যবৃদ্ধির জন্য কর্ডন প্রথাকে দায়ী করা হয়। তাই যৌক্তিক কারণেই বঙ্গবন্ধু তথাকথিত কর্ডন প্রথার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছিলেন। চাপে পড়ে সরকার বাধ্য হয় নিপীড়নমূলক এই প্রথা বাতিল করতে। ১৯৪৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর এক পত্রে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন,

"… perhaps you remember that I told you. 'Be united the cordon system will be withdrawn.' The ministers got frightened and abolished the cordon system. If we are united, everything will be alright." (P. 274)

আশ্চর্য হবার কিছু নেই যে, গোপন নথিপত্রে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে নানারকম অপমানজনক, আপত্তিকর, অসত্য বিশেষণ ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবেদনগুলো রচনা করেছেন নিম্নপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাগণ প্রতিবেদন পাঠে মনে হচ্ছে স্ব-স্ব বড়কর্তার মনোরঞ্জন এবং সন্তুষ্টি অর্জন করাও প্রতিবেদনকারীদের উদ্দেশ্য ছিল। যা হোক পাকিস্তান সরকার শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্য হুমকি, পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে প্রচারণা চালায়। ১৯৪৮-১৯৫০ এই তিন বছরের বহু প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু, ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকে দেশদ্রোহী বাহিনী (fifth columnist) বলা হয়েছে। ব্যক্তি বঙ্গবন্ধুকে চিহ্নিত করা হয়েছে অত্যন্ত নির্দয় (ruthless), চরম যুদ্ধংদেহী, কমিউনিস্ট, পাকিস্তানের জন্য ক্ষতিকর। এই সব ছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কায়েমী স্বার্থে আঘাতের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রহননের হীন ষড়যন্ত্র মাত্র।

দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেওয়া পাকিস্তান শুরু থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি সন্দেহপ্রবণ ছিল। ১৯৪৮ সালের এপ্রিলের ৪ তারিখে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, দুই বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে শরৎ বোস এবং কলকাতার হিন্দুরা প্রচুর অর্থ দিচ্ছে।

ফরিদপুরে ওই একই সালের ২৯ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গবন্ধুর জনসভা সম্পর্কে গোপন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, জনসভায় প্রায় ১০০০ মানুষ সমবেত হয়, যার দুই-তৃতীয়াংশ ছিল হিন্দু। লক্ষ্য করা যায় বিভিন্ন জনসভা ও ছাত্র সমাবেশের প্রতিবেদনে হিন্দুদের উপস্থিতি গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা হয়েছে। পুরো পাকিস্তান আমলে এই ধারা অব্যাহত ছিল। উল্লেখ্য, পূর্ব বাংলার সকল আন্দোলন-সংগ্রামের জন্য হিন্দু সম্প্রদায় এবং ভারতকে দায়ী করা হতো।

বলার অপেক্ষা রাখে না বঙ্গবন্ধু আপাতমস্তকে একজন নির্ভীক ও আদর্শবাদী মানুষ ছিলেন।তাই একজন সৎ মানুষ যে আদর্শবাদী রাজনীতিক হবেন এটাই স্বাভাবিক। নানারকম দুঃখ, কষ্ট, বেদনা, অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করা আবার ক্ষমতা, মোহ, প্রলোভন উপেক্ষা করে লক্ষ্যে অবিচল থাকা- সবার পক্ষে সম্ভব না। প্রখর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন, অকুতোভয় বঙ্গবন্ধু কোনো রক্তচক্ষুকে পরোয়া করতেন না। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিরাপত্তা বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের মনোভাব সম্পর্কে গোয়েন্দা কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন যে,

"He (Bangabandhu) preferred to remain and die in jail than to be released conditionally. From the above it appears that he has not changed his political views and his attitude is stiff." (P. 451)

বঙ্গবন্ধু সারাজীবন তার দেশ এবং জনগণের কল্যাণকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এক গভীর জীবনবোধের অধিকারী হওয়ায়, সাধারণ দুঃখ-কষ্ট তাকে দুর্বল করতে পারেনি। কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ১৯৫০ সালের ২৬ মে একপত্রে বঙ্গবন্ধু লিখেন,

"… to the man who lives for an idea, for his country, for the good of humanity, life has an extensive meaning, and to that extent pain becomes less important to him." (P. 439)

বঙ্গবন্ধুকে কোনো মামলায় একবার গ্রেপ্তার করলে, নানা ছুতায় তার আটকাদেশ বৃদ্ধি করা হতো। ডিটেনশনের মেয়াদ বৃদ্ধির সময় সরকার বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মিথ্যা এবং অস্পষ্ট নানা অভিযোগ উত্থাপন করত। ১৯৫০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে ডিটেনশন আদেশের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু লিখিতভাবে জানান-

"The grounds you have shown are absolutely false and vague. There is not an iota of truth in it. I do not belief to adopt violent means to overthrow the Govt. nor I am connected with any secret associations and illegal activities." (P. 521)

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নানা নিপীড়নমূলক কখনও কখনও ভয়-ভীতি দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুকে কাবু করার চেষ্টা করেছে। কারাগারে শারীরিক অসুস্থতা তাকে কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু মানসিকভাবে তিনি, কখনও ভেঙে পড়েননি। কঠিন ব্যক্তিত্ব এবং দৃঢ় মনোবল তাকে আরও প্রত্যয়ী করেছে। লক্ষ্য অর্জনে অবিচল বিশ্বাস যেকোনও ত্যাগ স্বীকারে তাকে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত করেনি। ফরিদপুর জেলা কারাগার থেকে ১৯৫০ সালের ২১ ডিসেম্বরে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে লেখা পত্রে বঙ্গবন্ধুর ইস্পাতকঠিন মনোবলের প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন,

"I do not know, how long this case will continue, any how I do not care for that. … I know those who prepared to die for any cause are seldom defeated. Great things are achieved through great sacrifices." (P.556)

প্রথম খণ্ড প্রকাশ হয়েছে, আরও ১৩টি খণ্ড প্রকাশ হলে ১৯৪৮-১৯৭১ সাল পর্যন্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনের নানা অধ্যায় সম্পর্কে আরও স্বচ্ছ, বস্তুনিষ্ঠ ধারণা পাওয়া যাবে। ইতিহাসের উৎস হিসেবে এই হাজার হাজার পৃষ্ঠা নথিপত্রের মূল্য অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের ইতিহাসকে পৃথক করা যায় না। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অবিচ্ছেদ্য। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ পর্বের গোপনীয় নথিপত্র উন্মুক্ত করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন।