‘ঐক্য শয়তানের সঙ্গেও’, কেন?

কবির য়াহমদ
Published : 4 Oct 2018, 12:55 PM
Updated : 4 Oct 2018, 12:55 PM

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় 'শয়তানের সঙ্গেও ঐক্যের' কথা জানিয়েছেন। তার ভাষায়, বিএনপির দাবির সঙ্গে একাত্ম ও সরকারের বিরুদ্ধে যারা আছে তাদের মধ্যে শয়তান থাকলেও তাদের সঙ্গেও ঐক্য হবে। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায় এমন বক্তব্য আসল বিএনপির এই নেতার মুখ থেকে।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের এই বক্তব্য শব্দগত ও রূপক অর্থে বিশ্লেষণ করা যায়। তবে রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রথমত তাকে শব্দগত অর্থের মুখোমুখি হতে হবে। এটা সাহিত্যকর্ম নয় যে রূপক অর্থ নিয়ে মাথা ঘামাবে সাধারণ মানুষ। একজন রাজনীতিবিদকে জনগণের বোধগম্য ভাষায়ই কথা বলতে হয়। সেক্ষেত্রে তার কথার শব্দগত অর্থের আলোচনা প্রাধান্য একদিকে যেমন পাবে তেমনি রূপক অর্থের আলোচনাও প্রাধান্য পাবে রাজনীতি বিশ্লেষকদের কাছে।

সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে 'শয়তান' শব্দটা খারাপ অর্থে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শয়তান শব্দ নেতিবাচক চরিত্র ধারণ করা ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টিকে বুঝিয়ে থাকে। অর্থাৎ গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিএনপির দাবির সঙ্গে একাত্ম থাকা শয়তানের সঙ্গে ঐক্য মূলত খারাপ উদ্দেশ্য ধারিত ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের সঙ্গের ঐক্যকেই বুঝাচ্ছে।

প্রশ্ন ওঠা তাই স্বাভাবিক এই শয়তানের সঙ্গে ঐক্যে কী লাভ বিএনপির? উত্তর একটাই- সরকারের পতন এবং 'যেকোনো মূল্যে' সরকারের পতন। শয়তানের সঙ্গে ঐক্যের যে অভীপ্সা সেটা 'যেকোনো মূল্যে' পতনের সঙ্গেই সম্পর্কিত। এই যেকোনও মূল্যে সরকারের পতনের লক্ষ্য তার বক্তব্যের রূপক অর্থকেও বিম্বিত করে।

বিদ্যমান কিংবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকারের বিরোধী দল বা দলগুলো ক্রিয়াশীল থাকাটাই স্বাভাবিক। এটাই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্য। এই গণতান্ত্রিক সৌন্দর্যে আবার সুস্থ ধারার রাজনীতি থাকাটাই বাঞ্ছিত। অসুস্থ ধারার যে রাজনীতি সেটা গণতান্ত্রিক কিংবা যেকোনও তান্ত্রিক রাজনীতিতে বিবর্জিত। ফলে এই শয়তানের ক্রিয়াকলাপ কিংবা রূপ কোনক্রমেই সুস্থ চিন্তার রাজনীতিবিদ অথবা জনগণের কাছে গ্রহণীয় হওয়ার কথা নয়। যদি সুস্থ ধারার রাজনীতি চলমান থাকে তাহলে শয়তান-রূপের রাজনীতি টেকার কথাও নয়।

এছাড়া শয়তান-রূপের রাজনীতি, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক দল যেখানে সুস্থ চিন্তার মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায় না সেখানে কীভাবে তিনি আশা করেন শয়তানের সঙ্গে ঐক্যের? কীভাবে আশা করেন এই শয়তানরূপী ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠির দ্বারা জনগণের মঙ্গল সাধন? ফলে এই বক্তব্যকে সাধারণভাবে দেখার অবকাশ নাই, যখন আমাদের ইতিহাস বলছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে মাঝেমাঝে ক্রিয়াশীল হয়ে পড়ে অবাঞ্ছিত কিছু শক্তি, যারা রাজনীতিকে রাজনীতিবিদ থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টায় মত্ত থাকে।

রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদদের কাছে এই শক্তি শয়তানের সঙ্গে তুল্য। ক্ষমতালিপ্সু সামরিক কজন কর্মকর্তার ক্ষমতালিপ্সার যাঁতাকলে বাংলাদেশের রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের পিষ্ট হওয়ার নজির রয়েছে। সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান, হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সেনাবাহিনীর ঐতিহ্যিক শৃঙ্খলা ভেঙে ক্ষমতা দখল করে এদেশের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছেন আগেই। এরপর ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে ফের সকল ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে যায় জেনারেল মঈনুদ্দিন। এটাও ন্যক্কারজনক এক উদাহরণ বাংলাদেশের। ওই সময়েও দেশের রাজনীতিকে রাজনীতিবিদদের কাছে থেকে কেড়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্র হয়। দুই বছরের মত দুঃসহ এক পরিস্থিতিতে নিপতিত হয় দেশ। এরপর তারা বিদায় হয়।

রাজনীতিবিদদের বাইরে যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের অভিসন্ধিতে মত্ত থাকে সাধারণ চোখে তারা রাজনীতির শয়তান। তাই শয়তান কিংবা শয়তানদের সঙ্গে ঐক্যের বার্তা দেওয়াকে স্বাভাবিক ঘটনা ভাবার অবকাশ নাই। এখানে কি ভিন্ন কোনও উদ্দেশ্য ক্রিয়াশীল? প্রশ্ন জাগে! এর যৌক্তিক ব্যাখ্যাটাও দরকার, এবং সেটা তার মুখেই।

রাজনীতির অন্ধকারের আততায়ী যারা তারা মূলত রাজনৈতিক শয়তান। এটা বিভিন্ন ব্যক্তি কিংবা দলের রূপ পরিগ্রহ করতে পারে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সাথে 'শয়তানি' করেছে জামায়াতে ইসলামী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে তারা দলীয়ভাবে পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে গণহত্যার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিল। এই জামায়াতে ইসলামী আবার বিএনপির রাজনৈতিক মিত্র। রাজনৈতিক এই মিত্রভাবের প্রভাবটা স্রেফ তাদের জোট কিংবা নির্বাচনী আসন বণ্টনের বিষয়েই সীমাবদ্ধ থাকেনি; আদর্শিকভাবেও সঞ্চারিত হয়েছে। ফলে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী ও তাদের কৃত অপরাধের বিচারকেও বিএনপি নানাভাবে বিতর্কিত করতে চেষ্টা করেছে।

পারেনি, দেশবাসী যুদ্ধাপরাধীদের প্রবল ধিক্কারে বর্জন করেছিল বলে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে সারাদেশের মানুষের সে সমর্থনও বিএনপিকে নাড়া দিতে পারেনি। বদলাতে পারেনি অবস্থান। ফলে দেশের মানুষের চাওয়ার বিপরিতে অবস্থান নিয়েছিল বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে। এর ফল তাদের প্রতিকূলে যাচ্ছে বুঝতে পেরেও তারা আত্মবিনাশী পথকে বেছে নিয়েছিল কেবল রাজনৈতিক মিত্র জামায়াতে ইসলামির আদর্শিক মিত্রে পরিণত হয়েছে বলে।

এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের কিছু মন্তব্য যেখানে তিনি একাত্তরের ত্রিশ লাখ শহীদের সংখ্যা নিয়েও বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। এজন্য দেশবাসী তাকে ধিক্কার দিয়েছে, মামলাও হয়েছে তার বিরুদ্ধে; কিন্তু তবু শোধরাননি তিনি। ফলে ধারণা করা যায়, মুক্তিযুদ্ধকালীন শহীদদের নিয়ে তিনি যে মন্তব্য করেছেন সেটা তার বিশ্বাসের অংশ, এবং সেটা রাজনৈতিকভাবে জামায়াতে ইসলামী-ই ধারণ করে।

বাংলাদেশের জন্মশত্রু জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক শয়তান, এবং এ শয়তানের সঙ্গে নতুন করে জোট করার প্রশ্ন আসছে না বিএনপির। তাহলে গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের উদ্দিষ্ট শয়তান কারা, এবং কাদের সঙ্গে ঐক্য গড়তে চান তিনি সরকার পতনের জন্যে?

বর্তমানে ড. কামাল হোসেন, ডা. এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আ স ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাদের গড়া যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে। এই জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়ে রাজধানীর মহানগর নাট্যমঞ্চে আয়োজিত এক সমাবেশে বিএনপিও যোগ দিয়েছে। ডান-বাম-মধ্যপন্থীদের অনেক দল ও গোত্রের সেই সমাবেশ থেকে বিএনপির কাঙ্ক্ষিত সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্যও শোনা গেছে। ঐক্য প্রক্রিয়া নিয়েও আশাবাদী তারা। এরই মধ্যে এই ঐক্য প্রক্রিয়ার নির্বাচনী জোট নিয়েও কথাবার্তার কথা গণমাধ্যমে এসেছে। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত এই জোটকে বিএনপির 'শয়তান' ভাবার কোনও কারণ নাই।

তবে নির্বাচনী জোট এখনও গঠন হয়নি তাদের, আছে আলাপ-আলোচনার মধ্যেই। এমন পরিস্থিতিতে এই 'জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া' নিয়ে বিএনপির প্রকাশ্য নেতিবাচক মন্তব্য আসার কথাও নয়। তাই এই ঐক্যের উদ্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠি কে বা কারা?

উল্লেখের দাবি রাখে মহানগর নাট্যমঞ্চে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার সমাবেশে ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে দেশকে বিরাজনীতিকরণের অন্যতম কুশীলব ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের উপস্থিতি। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে প্রকাশ, তাকে আমন্ত্রণ জানান নি ড. কামাল কিংবা বি চৌধুরী তথা আয়োজকদের কেউ। তবু ব্যারিস্টার মইনুল ছিলেন অনুষ্ঠানে এবং মঞ্চে। তার সেই উপস্থিতি নানামুখি আলোচনার জন্ম দিচ্ছে। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন। তার সর্বশেষ পরিচিতি ছিল সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে। এবং তিনি তার কার্যকালে দেশে মাইনাস-টু ফর্মুলা কার্যকর করতে নানা ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে সমালোচিত ছিলেন। বর্তমান সরকারের শেষ সময়ে এসে সরকার পতনের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তার সরব উপস্থিতি এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্যের 'শয়তানের সঙ্গে ঐক্যের' ঘোষণা স্বভাবতই উদ্বেগের।

বাংলাদেশের সরকার ব্যবস্থা, ক্ষমতা কোনোকিছুই অরাজনৈতিক ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠির হাতে চলে যাক এটা সুস্থ চিন্তার মানুষদের কেউ চায় না। রাজনীতিবিদদের সকলেই যে রাজনৈতিক শিষ্টাচারে অনুশীলিত সেটাও না, তবু আমরা চাই আমাদের রাজনীতি রাজনীতিবিদদের হাতে থাকুক, সরকার গঠন করুক রাজনৈতিক দলগুলোই। এখানে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থা শক্তিশালী, তাই হয় আওয়ামী লীগ, না হয় বিএনপি এমনই চলবে হয়ত আরও কয়েক দশক। রাজনীতিবিদদের সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে আমরা যেভাবে আছি সেখান থেকে উত্তরণের আশা করতে পারি, আশার কথা শুনতে পারি; কিন্তু এমন অবস্থায় কোনভাবেই রাজনৈতিক শয়তানকে সমর্থন করতে পারি না, তাদের সঙ্গে ঐক্যের কথা ভাবতে পারি না, ঐক্যের কথাও প্রকাশ্য কিংবা গোপনীয় কোনোভাবেই দেখতেও আগ্রহী নই।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের উদ্দেশ্যমূলক এই বক্তব্য তাই অগ্রহণযোগ্য এবং রাজনৈতিক শালীনতা বিবর্জিত। সুস্থ ধারার রাজনীতির অনুশীলনে 'শয়তানের সঙ্গে ঐক্যের' এমন অসুস্থ চিন্তা বর্জন করা উচিত তার, এবং সেটা তার দল ও দেশের স্বার্থেই।