ক্রিকেট:  জিততে হলে জানতে হবে

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 3 Oct 2018, 02:40 PM
Updated : 3 Oct 2018, 02:40 PM
এশিয়া কাপের পর আবার আমাদের আবেগের ঢাকনা খুলে গেছে। আমরা আবেগপ্রবণ জাতি। এটা বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি আমাদের দেশপ্রেম অনেক বেশি। যতদিন যাচ্ছে ততদিন এই আবেগ আর দেশপ্রেম বাড়ছে। যত সংঘাত থাক আর কলহ থাক বাংলাদেশ বলতে আমরা সবাই এক।
এশিয়া কাপের ফলাফল যাই হোক এ খেলার পর বোঝা গেছে মূলত সাম্প্রদায়িকতাও রাজনীতির তৈরি এক অসুর। যার ভিত্তি মানুষের মনে নড়বড়ে। সে কারণে লিটন দাস কোন ধর্মের বা কোন সম্প্রদায়ের সেটা কেউ বিবেচনায় রাখেননি। বরং দেশ ও দেশের বাইরে লিটনই আজ হিরো। লিটন দাস খেলার মাঠেও হিরো ছিলেন ফাইনালের রাতে। তার মাথায় উঠেছে সেরা খেলোয়াড়ের মুকুট। কিন্তু আমাদের আবেগ বা দু:খ তাতে চাপা পড়েনি।
কেন পড়েনি? কারণ আমাদের বিরুদ্ধে সব খেলাতেই কোনও না কোনভাবে এমন সব সিদ্বান্ত দেয়া হয় যা ভিত্তিহীন। সবাই জানেন পাকিস্তান আর ভারত দুটোই ক্রিকেটের পুরনো দল। তাদের অতীত বর্তমান বা ভবিষ্যত মিলিয়ে তারা আমাদের চাইতে হয়তো এখনো এগিয়ে। কিন্তু তারমানে এই না যে, আমরা আগের জায়গায় আছি। বরং আমাদের জায়গা এখন অনেক শক্ত। আমাদের দলের ক্রিকেটাররা যেকোনও সময় রুখে দাঁড়িয়ে যে কোনও ঘটনা ঘটিয়ে দিতে পারেন।
যেকোনও খেলোয়াড়ের তূলনায় সাইজে বা আকারে ছোটখাটো মুশফিক কি করে দেখালো! শ্রীলংকার দিন আমরা ধরে নিয়েছিলেম খেলা শেষ। লজ্জাজনক কোনও পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে হবে। এই ছোটখাটো খেলোয়াড়টি সেদিন বুকের সাহস আর খেলার শিল্পে ঝলসে উঠে দেখিয়ে দিয়েছিল খেলা কাকে বলে। এরপর পাকিস্তান বধেও তার তূলনা নাই। দু' দুটো খেলায় শতরান বা কাছকাছি যাওয়া মুশফিককে পাকি কমেন্টটারদের একজন এই বলে প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছেন, তাকে শচীন, লারা কিংবা রিকি পন্টিং-দের মত small বলা গেলেও short বলা যাবেনা। এই মন্তব্য আমাদের প্রাণিত করেছে। কিন্তু কেন এ জাতীয় মন্তব্য আমাদের কমেন্টেটার করতে পারলেন না?
আমরা সাধারণভাবে জানি ধারাভাষ্যকারেরা কোনও দলের হয়ে কথা বলেন না। আসলে কি তাই? আপনি কখনো গাভাস্কারকে ভারতের কোনও খেলোয়াড়ের সমালোচনা করতে শুনেছেন? বা নিন্দা। যেটুকু বলেন সেটুকু পরাজিত হবার বেদনার দু:খ থেকে। তার বাইরে সবটাই প্রশংসা। রমিজ রাজা পাকিদের খেলার দিন শুরু থকে শেষ অবদি তাদের বন্দনা আর পজিটিভ কথা বলায় ব্যস্ত থকেন। আর এরা বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের এক লাইন প্রশংসা করলে সমালোচনা করেন তিন লাইন। এটা তাদের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। খেয়াল করবেন যখন কোনও বির্তকিত সিদ্বান্ত বা বিষয় আসে এরা কিভাবে নিজেদের দেশের হয়ে লড়তে শুরু করেন।
এসব কথা আম্পায়রদের কানে যায় কি যায় না- সেটা বড় কথা না। বড় ব্যাপার এগুলো পুরা দুনিয়ার মানুষ শোনে আর প্রভাবিত হয়। আমাদের দেশের ধারা ভাষ্যকার আতাহার আলী খান ভালো বলেন। এমন না তিনি না বুঝে বলেন! কিন্তু দেশের হয়ে জোর গলায় কথা বলা বা প্রতিবাদ তিনি করেন না। অথবা করতে জানেন না।
ভাষ্য মানেই যখন গলাবাজী তখন তা আমাদেরও করতে হবে বৈকি। আমার ধারণা অবিলম্বে এমন একজন বা একাধিক ভাষ্যকারের প্রয়োজন যারা বাংলাদেশ দলের বিরুদ্ধে পণ্ডিত নামে পরিচিত ভাষ্যকারদের মুখোশ উন্মোচন করে বাংলাদেশের হয়ে কথা বলতে পারবেন। এটা না হলে সারা দুনিয়ায় আমরা দুধভাত দল হিসেবেই থেকে যাব। আর উপদেশ শুনতে শুনতে মেরুদণ্ডও বাঁকা থেকে সোজা হতে পারবেনা।
আর একটা কথা বলা দরকার। বাংলাদেশের কত খেলোয়াড় আর ক্রিকেটার আছেন যারা অবসর জীবনযাপন করছেন! কতজন আছেন যারা ক্রিকেটের ব্যাকরণ অন্যদের পড়াতে পারেন। তাদের ভেতর কি দুয়েকজন ছাড়া কি আম্পায়ার হবার মত কেউ নাই? আমাদের দেশের আম্পায়ার থাকা মানে আরেক দেশের খেলোয়াড় ও আম্পায়ারদের মনে একটা সমীহ ভাব থাকবে। থাকবে ভয়ও। টিট ফর ট্যাটের জমানায় ভারসাম্য রাখতে হলে আমাদের একজন আম্পায়ারদের জায়গা করে নেওয়া জরুরী।
মনে রাখতে হবে ভারত পরাশক্তি। তারা হার মানতে নারাজ।  আমাদের কাছে হারাকে  তারা তাদের দেশের ইমেজ বা সম্মান নষ্ট করা মনে করে। এই ফলস প্রাইড বা অযৌক্তিক গর্ব ভাঙতে যে লবিং আর শক্তির দরকার সেটা আমাদের আছে? যদি না থাকে তো এখন থেকে সে পথে হাঁটতে হবে। পাকিস্তান আপাতত বেকায়দায় বলে হার মেনে নিলেও একসময় তারাও এমন সব অনাচার করবে। মিডিয়ায় দেখলাম পাকিস্তানি টিভি শোতে বলা হচ্ছে তারা নাকি আমাদের খেলা শিখিয়েছে। গর্ব করে বলছিলো বাংলাদেশের মত দুধের শিশুর কাছে হারাটা অন্যায়। এসব কথা যে যেভাবেই বলুক মূলত এর পেছনে আছে হামবড়া ভাব। আত্মদম্ভ আর অর্বাচীনতা। সেদেশে রাগ করে টিভি সেট ভাঙার এ দৃশ্যও ভাইরাল হয়েছে। আমাদের তারুণ্যের জন্য এটা লেসান।
এখান থেকে বুঝতে হবে দেশপ্রেমের কাছে ধর্ম বোধ বা রাজনীতি বড় নয়। পাকিস্তানিরা তাদের দেশ ও দলের ব্যাপারে একশ ভাগ নিবেদিত। সে জায়গায় আমরা যেন বুকে মুখে পতাকা বা উল্কি নিয়ে তাদের জয় কামনায় মাঠে না যাই। আমরা যেন কোনভাবেই আমাদের দেশ ও জাতিকে ছোট না করি।
আজ আরো একবার সময় এসেছে যুক্তি আর আবেগকে একত্রিত করার। বাংলাদেশের মানুষ এবং দেশের বাইরের বাংলাদেশিরা একযোগে যে সমর্থন আর ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা তুলনাবিরল। সামাজিক মিডিয়ায় আমরা কেঁদে কেটে যতটা আকুল ঝগড়া লড়াইয়ে যতটা পারদর্শী, ততটাই পিছিয়ে আছি অ্যাকশনে। আমাদের যারা কর্তা তারা জিতলে খুশি হন, হারলে রাগ করেন। এমন চেহারা ব্যক্তির হতে পারে, জাতির না। জাতিকে নেতৃত্ব দিতে হলে বলিষ্ঠ ও কর্মমুখর প্রতিবাদী হতে হবে।
যেকোনও জাতি বা দেশকে কেউ এমনিতে জায়গা ছেড়ে দেয়না । জায়গা করে নিতে হয়। আমাদের তরুণেরা তা করছেন। কিন্তু শেষ অবদি আমাদের ঘাড়ে বা কাঁধে যে বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় তার নাম অন্যায়। সে অন্যায় থেকে মুক্তির পথ এখন ই খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায় হা হুতাশেই নিমজ্জিত থাকবো আমরা।
বলিষ্ঠ ভাষ্যকার , নিজেদের আম্পায়ার, প্রতিবাদী লবিং আর সবাই মিলে রূকে না দাঁড়ালে ভারত পাকিস্তান কিংবা যেকোন দেশের মোড়লীপনা বন্ধ করা যাবেনা। তাই এদিকে মনযোগী হয়ে মাশরাফি মুশফিক লিটনদের হাতে কাপ তুলে দেয়াই হোক আগামী দিনের অঙ্গীকার। আমাদের কবি বলেছেন-

 

অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে

তব ঘৃণা তারে যেন তৃণ সম দহে।

ঘৃণার আগুন হোক শক্তির আলো। জয় হোকে বাংলাদেশ ক্রিকেটের।