‘বই পরা’ কিংবা ‘পোশাক পড়া’!

সাজিদুল হক
Published : 2 Oct 2018, 01:35 PM
Updated : 2 Oct 2018, 01:35 PM

গত শতকের শেষ দশক বা চলমান শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত যারা স্কুলে যেতেন তারা বই পড়তেন আর পোশাক পরতেন। হঠাৎ করেই কেমন যেন সব উল্টো হয়ে গেল। এখনকার সময়ের যারা, তারা মনে হয় বই পরেন আর পোশাক পড়েন।

আমি মফস্বল জেলা শহরের যে স্কুলটিতে পড়াশোনা করেছি, সেখানে একজন শিক্ষক ছিলেন। জামায়াত আলী ঢালী। আমরা 'জামাত স্যার' বলতাম। উনি বিভিন্ন শ্রেণিতে আমাদের সমাজ বিজ্ঞান পড়িয়েছেন। তার ক্লাসে একটা বিষয় মোটামুটি নিশ্চিত ছিলো। বই দেখে পড়া, যাকে বলা হতো 'রিডিং পড়া'। জামাত স্যার খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। কোথাও কোনও উচ্চারণ ভুল হলে ধরিয়ে দিতেন। আজ এই সময়ে এসে মনে হয় স্যার নিজেও উচ্চারণের ব্যাপারে খুব খেয়াল করতেন। আরও একজন শিক্ষক ছিলেন আমিনুর স্যার। ক্লাস টেনে আমাদের অঙ্ক করাতেন। তার উচ্চারণও ছিল খুব সুন্দর। আর বাংলার কিশোরী মোহন সরকার (ক্রিকেটার সৌম্য সরকারের পিতা) স্যার। আহ! পাঠ্য বইয়ের কবিতাগুলো আবৃত্তি করে শোনাতেন। দারুণ উচ্চারণ। সেই সব স্যারের শেখানো উচ্চারণ যে কিভাবে কাজে দেয় তা এই সময়ে এসে বুঝতে পারি।

আমার সন্তান নেই। থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করতাম, তার স্কুলে ওরকম উচ্চারণ শেখানো হয় কিনা? কিংবা 'র' আর 'ড়' এ দুটো বর্ণের উচ্চারণ ও পার্থক্য শেখানো হয় কিনা?

উপরে দুটি দশকের যে হিসাব দিলাম, আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে ওই সময়টায় আমাদের মোবাইল টেলিফোনে বা কম্পিউটারে ফেইসবুক ছিলো না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম দিয়েছে যোগাযোগের বিশাল ব্যাপ্তি আর কেড়ে নিয়েছে বাংলা বানান।

ফেইসবুকে যারা বাংলা ভাষায় লেখার চেষ্টা করেন তাদের মধ্যে একটা বড় অংশ এই 'পড়া' আর 'পরা'র পার্থক্য বোঝেন না। বা বুঝতে চান না। পাঠ আর পরিধান যে এক জিনিস নয় সেটা আসলেই অনেকে বোঝেন না। নাকি লিখতে পারেন না? 'লেখা'কে লিখছে 'লিখা'। ভয়াবহ নয় কি?

একজনকে বিষয়টা বলেছিলাম। পাল্টা আমাকে বলেছিলেন, 'আরে বুঝলেই হলো। আমি কি বই লিখতে যাচ্ছি?' অবশ্যই ভাষার কাজ যোগাযোগ সহজ করা। কিন্তু তাই বলে ভাষা পাল্টে ফেলবো? লেখার সময় উল্টে ফেলবো? ভাগ্যিস ওই ব্যক্তি বই লিখবেন না। হয়তো লিখলেও ওই রকম ভাষাতেই লিখবেন! (?)

অনেকেই দুঃখ করে বলেন, 'একটা লোক পাই না যে শুদ্ধ করে ইংরেজিতে এক পাতা লিখতে পারে।' নিজে সাংবাদিক হওয়ার সুবাদে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাই। তাদের পেশাদারিত্ব চমৎকার। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই তারা বিজ্ঞপ্তি পাঠান। সমস্যাটা দাঁড়ায় বাংলা বিজ্ঞপ্তিটি পড়ে সেখান থেকে খবর লিখতে গিয়ে।

কারণ বাংলাটার চেয়ে ইংরেজিটা সহজ পাঠ্য। যে কেউ পড়লেই বুঝবেন হয়তো গুগল ট্রান্সলেটরে ফেলে বাংলা অনুবাদ করেছে। যদি তাই হয়, তার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, বিজ্ঞপ্তিটি আগে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে। আর যিনি বাংলায় লিখেছেন তার বাংলা বাক্য সঠিকভাবে লেখার যোগ্যতাটুকু নেই। পড়লেই বোঝা যাবে, ইংরেজি বাক্যের গঠনে বাংলা অনুবাদ করা হয়েছে। এই সর্বনাশ কিভাবে ঘটলো সেটার গবেষণা সমাজবিজ্ঞানী বা ভাষাবিদরা করবেন।

তবে মনে করবেন না আমি এক সময়কার প্রভুদের ভাষার প্রতি জাতক্রোধ দেখাচ্ছি। না। সেই জাতক্রোধ আমার মোটেও নেই। একটি ভাষার ওপর দখল থাকাটা খুব দরকার। আর এই সময়ে আলাদাভাবে ইংরেজি ভাষার প্রয়োজনীয়তা বোঝানোটা বাহুল্য। তাই বলে কী আমরা বাংলা লিখতে পারবো না? হয়তো কদিন পরে আমরা অনেকেই বলবো, 'একটা লোক দেখি না যে বাংলা লিখতে পারে।'

বাংলাদেশ টেলিভিশন-বিটিভিতে এক সময় চমৎকার সব নাটক দেখানো হতো। এখনও অনেকে সেসব নাটক নিয়ে গর্ব করেন। আমার কাছে ওই নাটকগুলোর একটা বিষয় এখন খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। শহুরে চরিত্রগুলোর সংলাপে শুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ। এখনকার নাটকে শুদ্ধ উচ্চারণ পাওয়াটা বেশ কঠিন। আমার চাওয়াটাও হয়তো বেশি! বিষয়টা মোটেও এরকম নয় যে নাটকগুলো উচ্চারণের পাঠ দিচ্ছে। অজান্তে শিক্ষাটা ভেতরে প্রোথিত হয়ে যাচ্ছে।

সেদিন একটি টেলিভিশন চ্যানেলের কোনও একটা অনুষ্ঠানের প্রমোশনাল ভিডিও দেখছিলাম। সেখানে একটি নারী কণ্ঠ 'রাজনীতি' উচ্চারণ করছেন 'রাসনীতি' আবার কখনও বা 'রাচনীতি'। আচ্ছা ওই টেলিভিশনে কি একজনও নেই যে উচ্চারণটা ধরিয়ে দেবে? আর এখন সেসব নাটকও বা কোথায়? এফএম রেডিও মাঝে মাঝে বাধ্য হয়ে শুনতে হয়। সেখানকার উচ্চারণ নিয়ে নাই বলি।

কিংবা এই প্রজন্মের যেসব বাংলাদেশি শিল্পী বাংলা আধুনিক গান করছেন তারাও কি বাংলা উচ্চারণটা শেখেন? বা ফেইসবুক-ইউটিউবে যারা বিভিন্ন উদ্দীপনামূলক বক্তব্য দিয়ে থাকেন, তারা? একজনেরও উচ্চারণ শুনে মনে হয় না তারা ভালো করে বাংলা পড়তে পারেন। একটা বাক্য তারা শুদ্ধভাবে বাংলায় বলতে পারেন না। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি।

এই তো অতি সম্প্রতি সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের মেধা কেমন সেটা মোটামুটি আমরা টেলিভিশনে দেখেছি। ওই প্রতিযোগিতায় যারা বিচারক ছিলেন তাদের একজনের মুখে ৭০ শতাংশ ইংরেজি শব্দ মেশানো বাংলা শুনে মনে হয়েছে দরকার কি বাবা কষ্ট করার! তারচেয়ে পুরো ইংরেজিতেই বললেই তো চলে।

আমাদের এই বর্তমান সময়ে যারা বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন তাদের বাংলা উচ্চারণটাও অদ্ভুত! কেমন যেন ইংরেজি ভাব। বাংলা উচ্চারণটা খুব কষ্টের! আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ক্লাস ফোরের একটি বাচ্চাকে কিছুদিন পড়িয়েছি। একদিন ইংরেজি মাধ্যমে পড়া ওই শিশুটিকে 'প্রস্ফুটিত' উচ্চারণ করাতে যারপরনাই বেগ পেতে হয়েছিল। অথচ বাচ্চাটার মা একটি স্কুলের বাংলার শিক্ষক। সমাজের উচ্চ শ্রেণির কথা বাদই দিলাম। তাদের সমাজে বাংলা হারিয়ে গেছে বহু আগে।

পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়ার অভ্যাস যে দিন দিন আমাদের সমাজে কমে যাচ্ছে তার জন্য বিশাল গবেষণার দরকার নেই। এক সময়কার বইপাড়া হিসেবে খ্যাত ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটে দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। মানুষ যত পড়বে, তত তার নিজের ভাষার ওপর দক্ষতা বাড়বে। বিভিন্ন ধরনের লেখা পড়ে সমৃদ্ধ হবে। আর এখন। যারাই পড়েন তাদের পাঠাভ্যাস দুই থেকে তিনটি লেখকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নামগুলো বললাম না, শোভন হবে না।

কিছু মানুষকে দেখেছি কোন বই পড়ার সময় ফেইসবুকে জানান দেন। এতে আমার একটু উপকার হয়। নতুন বই পেলে পড়তে আগ্রহী হই। কিন্তু আজ পর্যন্ত মানে এই গত ১১ বছর একজনকেও দেখলাম না ফেইসবুকে লিখেছেন যে তিনি বঙ্কিমের বই পড়ছেন। কিংবা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, নিদেনপক্ষে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা শওকত আলী। চোখে পড়েনি। ওসব বই পড়লে তো আর স্ট্যাটাস থাকে না, বাংলা যে! অথচ বিদেশি লেখকের ইংরেজি বই পড়ার ছবি ফেইসবুকে দিলে ছবির নীচে বেশ ভালো মন্তব্য আসবে। তার মানে এখন কি কেউ পড়ে না? অবশ্যই পড়ে।

কিছু মানুষের পাঠ্যাভাস দেখে আমি রীতিমত ঈর্ষা করি। আর বেশিরভাগ মানুষ যে পড়ে না তা নয়। তারা পড়ে। কী পড়ে? ফেইসবুক পড়ে। ফেইসবুকে বিভিন্ন গণমাধ্যমের শেয়ার করা খবর পড়ে। আর কী পড়ে? খাট থেকে ঘুমের ঘোরে পড়ে।

এখনকার সময়ে কেউ যদি কোনও জায়গায় বা বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা নতুন কোন জায়গায় শুদ্ধ বাংলায় কথা বলেন তবে অন্তত আশপাশের একজন বলবে, 'আপনার বাড়ি কিংবা পূর্ব পুরুষের বাড়ি কি কলকাতায়?' বুঝুন অবস্থা। আমি কয়েকবার কলকাতা গিয়েছি। সেখানকার মানুষ যে খুব একটা শুদ্ধ উচ্চারণ করেন তেমন নয়।

তবে হ্যাঁ কিছু ক্ষেত্রে আমাদের চেয়ে সুন্দর উচ্চারণ করে। সেটা ব্যক্তির ওপরও নির্ভর করে। ও বাংলায় 'আজকে' উচ্চারণ করা হয় 'আজগে'। এমন উদাহরণ হয়তো আরও দেওয়া যাবে।

এমন অনেকে বাংলাদেশের রাজধানী শহরে বাস করে লেখালেখি করেন যারা 'ভারতীয় দাদাদের আগ্রাসন' থেকে বাঁচতে বেশ আগে থেকেই নতুন বাংলা তৈরি করছেন! সেগুলো নাকি সাধারণ মানুষের ভাষা! আমি অন্তত সাধারণ মানুষের মুখে ওরকম আরবি-ফারসি মিশেলে কিংবা বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার শব্দ মেশানো বাংলা শুনিনি। যেসব আরবি-ফারসি বাংলা ভাষায় আগে থেকে রয়েছে সেগুলোর কথা বলছি না। যাই হোক সেটা একটা রাজনীতির বিষয়। সেই রাজনীতির কড়চা আজ নয়।

আপাতত ওই বাংলার কথা বাদ দিই। নিজেদের কথা বলি। নিজেদের কথাটাই বলতে হবে বেশি করে। কারণ ভাষাকে ভিত্তি করে জাতিরাষ্ট্র আমরা গঠন করেছি। আমাদের দায়টা বেশি। বাংলা ভাষার ভবিষ্যৎ আমাদের ওপরে নির্ভর করছে।

রোমান হরফে কিভাবে 'শুদ্ধ' বাংলায় লিখতে হবে সেটা নিয়ে একটি পোস্ট কদিন ধরেই ফেইসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খেয়াল করবেন বাংলা বর্ণে নয়, রোমান হরফে।