আমার ধারণা কালো টাকার বেশিরভাগই বিদেশে পাচার হয়ে গেছে

কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ
Published : 13 Nov 2013, 01:49 PM
Updated : 9 June 2012, 04:53 PM

এই বাজেটকে দুটো কারণে মানুষ দীর্ঘদিন মনে রাখবে। একটি হলো গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার ব্যাপারে দিকনির্দেশনা দেয়া। দ্বিতীয়ত, মানব সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যাপারে অর্থ বরাদ্দ দেয়া। ৩৯ হাজার কোটি টাকা এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সক্ষম মানবসম্পদ দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে। তাই এ খাতে বরাদ্দ দেওয়া বাজেটের তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিক।

একটি রাজনৈতিক দল যেভাবে অঙ্গীকার করে সেই আঙ্গিকেই তারা তাদের নীতি বা বাজেট তৈরি করে। কাজেই একে রাজনৈতিক বাজেট বলার কোনও অবকাশ নেই। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলটি জনগণের কাছে যেসব অঙ্গীকার করেছিল তার কিছু কিছু বাস্তবায়ন করেছে। কিছু হয়নি। সেগুলো বাস্তবায়নের অঙ্গীকার এ বাজেটে থাকা স্বাভাবিক।

তাদের ইশতেহারে এবং পরবর্র্তীতে ভিশন ২০২১-এ তারা এমন একটি কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের অঙ্গীকার করেছিল যেখানে অর্থনীতি অত্যন্ত সচল থাকবে। সেখানে শোষণ থাকবে না, বৈষম্য কমে আসবে এবং অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে।

সেই জন্য তাদের করণীয় হচ্ছে সাধারণ মানুষের পক্ষে বাজেট বিন্যাস করা ও সেই অনুযায়ী বরাদ্দ দেয়। আমরা দেখছি যে এবারের বাজেটে কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আমি এখন মনে করি আমাদের কৃষি এবং গ্রামীণ অর্থনীতি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। তা না হলে এই যে ৬.৭ বা ৬.৩ হারে প্রবৃদ্ধি তা অর্জিত হত না। হ্যাঁ, আমাদের রেমিটেন্স থেকে আয় আসে, গার্মেন্টস আছে কিন্তু গ্রামীণ অর্থনীতিই আমাদের চালিকাশক্তি।

বিদ্যুত খাতে বরাদ্দ বেড়েছে। দেশের ৫০ ভাগ মানুষ এখনও বিদ্যুৎ পায়-ই না। দাম বাড়া নিয়ে কিছু কথাবার্তা হয়। আমরা তাই বিদ্যুতের দাম নিয়ে একটা গবেষণা করেছিলাম। সেখানে দেখেছি, দাম বাড়ানো বড় সমস্যা নয়, সমস্যা হচ্ছে বিদ্যুতের সরবরাহ। সাধারণ মানুষ যদি দাম দিয়েও বিদ্যুৎ পান তাহলে তারা অসন্তুষ্ট হবেন না। এখন মানুষের চাহিদা বাড়ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়েছে। তাই বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়ানোটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

শুধু সাধারণ ভোক্তার জন্য নয়, দেশে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্যও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ দরকার। কাজেই বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমালে দাম বেড়ে যাবে, সেটা না ভেবে সরবরাহ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে। বর্তমান বাজেটে সে ব্যাপারে দিকনির্দেশনা আছে। পুরনো কিছু বিদুৎ প্লান্ট বন্ধ হয়ে আছে। সেগুলোর সংস্কার করে উৎপাদনে নিয়ে যাওয়া এবং নতুনগুলোর ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এ জন্য যথেষ্ট পরমাণে তেল আমদানি করতে হবে। তাতে বিদ্যুতের দাম আবার বাড়তে পারে। আমি অনুরোধ করব, সরবরাহ না বাড়িয়ে দাম যাতে বাড়ানো না হয়।

হ্যাঁ, বিকল্প জ্বালানির কথাও আমরা বলছি। এটা তত সহজ নয়। বায়োগ্যাস, সৌরবিদ্যুৎ ইত্যাদি উৎপাদন করে একটা চেষ্টা করা হচ্ছে কিছুদিন ধরে। এগুলোকে তেল-গ্যাসের পরিপূর্ণ বিকল্প হিসেবে পেতে সময় লাগবে। এ সব প্রজেক্টও প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ। একটা উপায় হতে পারে দেশের তেল-গ্যাস-কয়লার উৎপাদন বাড়ানো। গত দু'বছরে গ্যাস উৎপাদন কিন্তু বেড়েছে। সমুদ্রের একটা অংশ নিয়ে আমাদের মালিকানার জটিলতা আর নেই। এখন সেখান থেকে খনিজ অনুসন্ধানে নজর দিতে হবে। এভাবে জ্বালানি সংকট কমানো যাবে। এ নিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনা আছে। পাশাপাশি অপচয় কমাতে হবে।

আরেকটি আশার কথা, খুব শিগগির জলবিদুৎ আমদানি করতে যাচ্ছি আমরা। ভুটান, নেপাল, ভারতের মতো প্রতিবেশি দেশগুলো থেকে জলবিদুৎ আমদানি করতে গেলে অবশ্য আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভারত থেকে আগামী বছরই আমরা ২৫০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ পাচ্ছি। আশা করছি এই বিদ্যুৎ পেলে আমাদের ঘাটতি কিছুটা কমবে।

মুদ্রাস্ফীতি প্রসঙ্গে আমার মত হলো, একটি অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান বাড়তে থাকলে মুদ্রাস্ফীতি ৮ বা ১০ হলেও কিছু যায় আসে না। আমি স্বল্পমেয়াদের কথা বলছি। দীর্ঘমেয়াদে বিষয়টা ভিন্ন। আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি গত বছর ছিল ৬.৭। এবার বিবিএস বলছে ৬.৩। এই হার হলেও আমরা অসন্তষ্ট নই। কারণ বিশ্বঅর্থনীতির মন্দা, সংকট ইত্যাদি হিসাবে নিলে এটা যথেষ্টই। তার মানে অর্থনীতি যথেষ্ট সচল।

প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ছে কর্মসংস্থান। গ্রামীণ অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান হচ্ছে নানাভাবে। গ্রামে একজন সাধারণ শ্রমিকও এখন প্রতিদিন আড়াইশ' থেকে সাড়ে তিনশ' টাকা আয় করছে। এই টাকা দিয়ে ৯ থেকে ১০ কেজি চাল কেনা যায়। চালের দাম কিন্তু স্থিতিশীল আছে। মূল্যস্ফীতির ফলে সমস্যাটা আসলে বেশি হচ্ছে নির্দিষ্ট আয়ের লোকদের। তাই মূল্যস্ফীতি ৭.৫ থেকে কমিয়ে আনার কথা হচ্ছে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট আয়ের লোকদের কীভাবে আরও আয়ের মধ্যে নিয়ে আসা যায় সে ব্যাপারে পরিকল্পনা চলছে।

এ জন্য মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব নীতির মধ্যে সমন্বয়ও দরকার। মুদ্রানীতি যদি সংকোচনমূলক হয়, তবে রাজস্ব নীতি বিপরীত হতে পারবে না।

বাজেটে ঘাটতি নিয়ে আমাদের দেশে ব্যাপক কথাবার্তা হয়। আসলে একটি বর্ধিষ্ণু অর্থনীতিতে মাত্র ৫ শতাংশ ঘাটতি কোনও সমস্যা নয়। এটা সারা পৃথিবীতেই আছে। সমস্যা হলো, ঘাটতি কীভাবে পূরণ করা হবে সেটা নিয়ে। সরকার তিনভাবে কাজটা করেন। বিদেশি সাহায্য নিয়ে, দেশের জনগণের কাছ থেকে অথবা ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে। বিদেশি সাহায্যের জায়গাটায় গত বছর একটা সমস্যা হয়েছে। এখন পাইপলাইনে থাকা সাহায্যগুলো বের করে নিয়ে আসা জরুরি। তবে আমরা কিন্তু বিদেশি সাহায্য এখন নানা উৎস থেকেই পাচ্ছি। এ বছর বিদেশি সাহায্যের পরিমাণ বরং বেড়েছে।

জনগণের কাছ থেকে সরকার অর্থ নিয়ে যদি উৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করেন তাহলে মুদ্রাস্ফীতি কমে যাবে। তা না করে অনুৎপাদনশীল খাতে ব্যয় করলে মুদ্রাস্ফীতি কমানো যাবে না।

বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে সরকার লোন নিতে পারেন। সমস্যাটা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে নিলে। তখন ব্যাংক টাকা ছাপায়। এতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে। আমি সরকারকে পরামর্শ দেব যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে লোন না নেন। আর যে ২৩ হাজার কোটি টাকা টার্গেট করা হয়েছে, এর বেশি যাতে না নেয়া হয়। বরং কম হলে খুশি হব। বিদেশি সাহায্য এবং সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ানোর মাধ্যমেই যাতে ঘাটতি পূরণ করা হয়।

কালো টাকা সাদা করার জন্য আবারও সুযোগ দেয়া হলো। আমরা বরাবরই এর বিরুদ্ধে। বলা হচ্ছে, এ সুযোগ দিলে কালো টাকার মালিকরা বিনিয়োগে আগ্রহী হবেন। তবু খুব বেশি কালো টাকা সাদা হচ্ছে না। সুযোগ থাকলেও কালো টাকার মালিকরা তা নিচ্ছেন না কেন? আমার ধারণা বেশিরভাগ কালো টাকাই দেশের বাইরে চলে গেছে। তাছাড়া বারবার এই সুযোগ দেয়ার ফলে কালো টাকার মালিকরা কালো টাকা উপার্জনেই আরও বেশি আগ্রহী হচ্ছেন।

হ্যাঁ, বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। তবে এভাবে নয়। গ্যাস-বিদ্যুৎ ইত্যাদির সরবরাহ বাড়াতে হবে। অবকাঠামোগত খাতে বিনিয়োগ করতে হবে। এখন দেশের অবকাঠামো অনেক উন্নত। তবে আরও উন্নতির দরকার আছে। আর দরকার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা, রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে স্থিতিশীল রাখা।

আমি এ প্রসঙ্গে আমাদের রাজনীতিবিদদের উদ্দেশ্যে বলব, এমনভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করে নিজেদের দাবি আদায় করতে হবে যাতে দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। একটি ভাঙ্গা অর্থনীতির দেশের ক্ষমতায় থেকেও কোনও লাভ নেই। তার চেয়ে একটি সুস্থ অর্থনীতির দেশের বিরোধী দলে থাকাও ভালো।

কৃষি খাতে ভর্তুকি এবার একটু কমানো হয়েছে। সেটা খুব বেশি নয়। ৬ বা সাড়ে ৬ হাজার কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৫০০ কোটি টাকা। আসলে কৃষি এখন অনেক উন্নত। এখানে ভর্তুকির তেমন প্রয়োজন নেই। তাই প্রয়োজনের জায়গাগুলোতে ভর্তুকি দিলে বেশি ভালো হবে। তাছাড়া রিলোকেশনের একটা ব্যাপার তো রয়েছেই। কৃষি খাত যদি তার বরাদ্দটুকু ব্যবহার করতে পারে তবে অন্য অদক্ষ খাত থেকে টাকা এ খাতে দেয়া যাবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রতাপ কমেছে সরাসরি কৃষকের ব্যাংকে টাকাটা চলে যাচ্ছে বলে। ফলে কৃষক মূল্য পাচ্ছেন।

শিক্ষানীতি ২০১০ বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। তবে আমাদের কাঙ্খিত লেভেলে নয়। আগের বারের ২০ হাজার কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২২ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। আমি বলেছিলাম অন্তত ২৫ বা ২৬ হাজার কোটি টাকা করতে। যাহোক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে তো কিছু থোক বরাদ্দ থাকে। শিক্ষা খাত যদি দক্ষতা দেখাতে পারে তাহলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অন্য অদক্ষ খাত থেকে অর্থ নিতে পারে। সংশোধিত বাজেটে তো এটা হয়ই।

এবারের বাজেটে গ্রামীণ অবকাঠামোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সে কারণে রেলওয়েকে পুনর্জীবিত করার পরিকল্পনা আছে। কারণ এটা সাধারণ মানুষ ব্যবহার করে। আমাদের যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নত হওয়ায় সড়কপথ বেশি গুরুত্ব পাচ্ছিল। এতে রেলওয়ে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এবার এ খাতে ১ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ বড়িয়ে রেলওয়েকে চাঙ্গা করা হচ্ছে বলে আশা করা যায়।

বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর বাস্তবায়ন। আমি সবসময়ই এটা বলি। একদিক থেকে আমাদের বাজেটের অনেক উন্নতি হয়েছে, মানে বরাদ্দ বেড়েছে। অন্যদিক থেকে দেখলে বাস্তবায়নের জায়গাটায়ও উন্নতি করতে হবে। এ জন্য উন্নয়ন প্রশাসনকে আরও জনমুখী ও শক্তিশালী করতে হবে। সেটাই হলো আসল কথা।


ড. কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ
:অর্থনীতিবিদ এবং ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিক্সের গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান এবং অনারারি রেক্টর।