চীন কি উত্তর কোরিয়াকে ধরে রাখতে পারবে?

বিজন সরকার
Published : 30 Sept 2018, 01:49 PM
Updated : 30 Sept 2018, 01:49 PM

সপ্তাহ খানেক আগেই দুই কোরিয়ার মধ্যে আরেকটি ঐতিহাসিক সামিট হয়ে গেল। সামিটটি হয়ে গেলে উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ংইয়ং-এ। দুই কোরিয়ার বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে এটি তৃতীয় সামিট। এই সামিটটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি হল উত্তর কোরিয়ার দেড় লাখ নাগরিকের সামনে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইন এর আবেগময় ভাষণটি। মুনই দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট যিনি উত্তর কোরিয়া সফরে গিয়ে ভাষণ দেওয়ার সুযোগ পেলেন।

আরেকটি বিষয়ও তাৎপর্যপূর্ণ। বিষয়টি হলো উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উনের সিউল সফরে যাওয়ার ঘোষণাটি। কোরিয় উপদ্বীপে শান্তির ঘোষণা ও পরমাণু কেন্দ্র ধ্বংস করার বিষয়গুলি আলোচনায় স্থান পেলেও উল্লেখিত বিষয়গুলি এখন রুটিন ওয়ার্কের মতো দাঁড়িয়েছে।

উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে রাজনীতিটি অন্য জায়গায়। সামিটের পরে সিউলে গিয়ে মুন জানিয়েছেন- বল এখন যুক্তরাষ্ট্রের কোর্টে। মুন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে দেখা করবেন। সেখানেই হয়ত তিনি কীভাবে বলটি কিক করতে হবে সেটির ব্যাখ্যা দিবেন। সামিটের পরে কিম জং উন চমৎকার একটি চিঠি ট্রাম্পকে দিয়েছেন বলে ট্রাম্প নিজেই জানিয়েছেন।

কিন্তু অস্থির কিম জং উনের রাজনৈতিক আচরণের হরহামেশা পরিবর্তন ক্রমশ কেন স্থির হয়ে উঠছে? কিমের এই স্থির হয়ে উঠার প্রবণতা চীনকে কি অস্থির করে তুলছে না? কিম জং উন যতোক্ষণ অস্থিতিশীল, চীন ততক্ষণ দুশ্চিন্তামুক্ত। এই বিষয়টি চীনের নেতৃত্ব ও উত্তর কোরিয়ার নেতৃত্ব ভাল করেই বোঝে।

একটি উদাহরণ দেই।

পানমুনজম সামিটের পরে 'ম্যাক্স থান্ডার দ্বিপক্ষীয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচি'র প্রতি ইঙ্গিত করে উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল। এই সামরিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিটি আগেই নির্ধারিত ছিল। উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন, দক্ষিণ কোরিয়ার সফরের সময়েও দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের এই সামরিক মহড়া নিয়ে কোনও আপত্তি জানায়নি। বরং তিনি বলেছিলেন- "আমি বুঝতে পেরেছি দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার এই সামরিক প্রশিক্ষণটি আগেই নির্ধারণ হয়েছে।"

পানমুনজম সামিট ও সিঙ্গাপুর সামিটের পর চাপে পড়া চীনকে আশ্বস্ত করতে কিম জং উন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর সাথে বেশ কয়েকবার দেখা করেন। দেখা করার পর থেকেই উত্তর কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান সামরিক প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য বিষয়ের প্রতি সংবেদনশীল হয়ে উঠেছিল। এমনকি দুই কোরিয়ার মধ্যে পূর্বনির্ধারিত একটি উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা উত্তর কোরিয়া বাতিল করে দিয়েছিল। তাও আবার অনুষ্ঠানটি শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে।

উত্তর কোরিয়ার আচরণের হঠাৎ এমন পরিবর্তনের মূল কারণ চাপে পড়া চীনকে কিছুটা চাপমুক্ত রাখার প্রয়াস। তবে কিম জং উন যেভাবে নিজের অর্থনীতির পরিবর্তনের কথা ভাবছেন, উন্নত বিশ্বের সাথে যোগাযোগের প্রবল তাগিদ অনুভব করছেন, নিজের উপর আরোপিত কঠোর নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্ত হতে চাচ্ছেন, এমতাবস্থায় চীনের বুক পকেটে থেকে সেটি সম্ভব নয়। একটি দেশের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে শিথিল করার মত পরাশক্তি চীন এখনো হয়নি। চীনের পরামর্শে দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে নির্ধারিত আলোচনা বাতিল করে কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সিঙ্গাপুর সামিটে কিম জং উন যে শেখানো প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন, সেটি অস্থায়ী এবং কৌশলী বলেই মনে হয়েছিল তখন।

বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া 'স্ট্যালিন রাষ্ট্র' উত্তর কোরিয়া প্রায়ই অস্থিতিশীল আচরণ করলেও পানমুনজম সামিট এর সফলতা বিবেচনায় নিয়ে এটি বলা যায়- দক্ষিণ কোরিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সম্পর্ক ক্রমশ উন্নতির দিকে। দেশ দুটির আস্থার জায়গাটি ক্রমশ সুদৃঢ় হচ্ছে। দেশ দুটির সম্পর্ক গত সাত দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ভালো পর্যায়ে রয়েছে। তারা নিজেদের মধ্যে সময়কে সমন্বয় করেছে। ২০৩২ সালে যৌথভাবে অলিম্পিক আয়োজনের জন্য প্রতিযোগিতা করার সিদ্বান্ত নিয়েছে।

পানমুনজম সামিটে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইন উত্তর কোরিয়ার কোন কোন প্রজেক্টে দক্ষিণ কোরিয়া সহযোগিতা করতে চায় সেসবের একটি তালিকা ইউএসবিতে উত্তর কোরিয়া শাসক কিম জং উনের কাছে হস্তান্তর করেছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার বড় বড় বিনিয়োগকারিরা উত্তর কোরিয়ায় বিনিয়োগের জন্য খুব আগ্রহী হয়ে উঠছে। হুন্দাইয়ের মত জায়ান্ট কোম্পানিগুলি জোর আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। শেষ সামিটে স্যামসাং কোম্পানির নির্বাহীদের একটি বড় বিনিয়োগকারী গ্রুপ মুনের সফর সঙ্গী হয়েছেন।

পানমুনজম সামিটে যে মাত্রায় দক্ষিণ ও উত্তরকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছিল তাতেই বিশ্বের দুই পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের নতুন করে হিসাবনিকাশের জন্য খতিয়ান খুলতে হয়েছিল। পানমুনজম সামিটের পরে অতীতে কয়েক দশক ধরে প্রতিষ্ঠিত সকল ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছিল।

কোরীয় উপদ্বীপে পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ আলোচনায় দুই কোরিয়া অনেকদূর এগিয়েও এসেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার সিআইএ এর স্টেশন প্রধান এড্রো কিম এখানে বড় ধরনের একটি ভূমিকা রেখেছে। প্রসঙ্গত, এড্রো কিম কোরিয়ান ও ইংরেজিতে সমান দক্ষ। উত্তর ও দক্ষিণ কোরীয় কালচারের বিষয়ে সে খুবই অভিজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পে দুইবার উত্তর কোরিয়াতে গিয়ে কিম জং উনের সাথে দেখা করেছেন। একবার গিয়েছিলেন সিআইএ প্রধান হিসাবে, দ্বিতীয়বার গেলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে। মাইক পম্পের সাথে কিম জং উনের দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সময় এড্রো কিম ছিলেন। তিনি কোরিয়ান ভাষা থেকে ইংরেজি অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন। ধারণা করা হচ্ছে, মাইক পম্পে যখন সিআইয়ের প্রধান হিসাবে কিম জং উনের সাথে সাক্ষাৎ করেন তখনো এড্রো কিম পাশেই ছিল। পুরো মিটিং এর খুঁটিনাটি বিষয় দেখভালের দায়িত্ব তার হাতেই ছিল।

এড্রো কিম বহুবার উত্তর কোরিয়ার সফর করেছেন বলে ধারণা করা হয়। এমনকি উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের পরিবারের সাথেও আগেই থেকেই জানাশোনা আছে বলে কোরীয় উপদ্বীপ বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন।

এখানে মূল পয়েন্ট হল, যুক্তরাষ্ট্র কেবল উত্তর কোরিয়াকে পরমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করতে চাচ্ছে, বিষয়টি কেবল তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উত্তর কোরিয়ার যে পারষ্পারিক আস্থার সঙ্কটটি আছে, সেটিও দূর করতে চাচ্ছে। উত্তর কোরিয়াকে ক্রমশ বিচ্ছিন্নতা থেকে সরিয়ে উন্মুক্ত বিশ্বে নিয়ে আসার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাকে সামনে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আগাচ্ছে। আর এতে যুক্তরাষ্ট্রের পাশে থেকে বিশ্বস্ত বন্ধুর ভূমিকা পালন করছে দক্ষিণ কোরিয়া।

এমতাবস্থায়, একটি প্রশ্ন এখন বিশ্বের সামনে উন্মুক্ত হয়ে উঠেছে। উত্তর কোরিয়ায় যে মাত্রায় আন্তর্জাতিক স্তরে নিজকে নিয়ে আসছে, পারমাণবিক স্থাপনাগুলি ধ্বংস করার কথা বলছে, যে ঘনিষ্ঠতায় দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে মিলিত হচ্ছে, যেভাবে নিজ দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে দক্ষিণ কোরিয়াকে পাশে পেতে সায় দিচ্ছে,  এরকম চলতে থাকলে চীন কতদিন উত্তর কোরিয়ার উপর দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে প্রতিষ্ঠিত প্রভাব ধরে রাখতে পারবে?

আমরা সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো কয়েকটি প্যারামিটারের বিশ্লেষণ সাপেক্ষে।

এখানে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ফ্যাক্টরটিই হচ্ছে পানমুনজম সামিট। এই সামিটের দক্ষিণ ও উত্তরের মধ্যকার পারমানবিক অস্ত্রমুক্ত কোরীয় উপদ্বীপ রাখার ঘোষণা, উত্তর কোরিয়ার উপরে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের পজিটিভ মূল্যায়ন, চীনের কৌশলী অবস্থান, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে কিম জং উনের সিঙ্গাপুর সামিট ও সর্বশেষ মুনের উত্তর কোরিয়ার সফরের বিষয়গুলি বিবেচনায় নিয়ে উত্তর কোরিয়া কতদিন চীনের বলয়ে থাকবে সেটির একটি তাৎপর্যপূর্ণ অনুমান করতে পারি। অধিকন্তু, উত্তর কোরিয়ার সাথে চীনের বছর দুয়েকের মত শিথিল সম্পর্ক ও চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার জন্য চীনের উপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপের বিষয়গুলি খুবই বিবেচনাযোগ্য।

পানমুনজম সামিটির পরপরই চীন খুব নার্ভাস হয়ে পরে। বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দেয় কোরীয় উপদ্বীপের উপর চীনের-পররাষ্ট্রনীতিতে। মুন জায় ইন সামিটটির পর ট্রাম্প, জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজে আবে ও জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের সাথে টেলিফোনে কথা বলেছিলেন।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এর সাথে প্রায় সপ্তাহ খানেক পরে কথা বলেন।  সামিটের দুইদিন পরই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উত্তর কোরিয়াতে সফরে এসেছিলেন। ২০০৭ সালের পরে এটাই ছিল চীনের সর্বোচ্চ কোন নেতার উত্তর কোরিয়ার সফর। এতেও চীন উত্তর কোরিয়াকে নিয়ে আশ্বস্ত হতে পারেনি। স্বয়ং কিম জং উনকে যেতে হয়েছিল চীনের প্রেসিডেন্টের সাথে করতে চীনের দালিয়ান শহরে। কিম জং উনকে বারবার বলতে হয়েছে চীনেই উত্তর কোরিয়ার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু।

চীন দুটি বিষয়ে আতঙ্কিত। প্রথমটি হল, উত্তর কোরিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ার কোরীয় উপদ্বীপ থেকে মার্কিনি বাহিনীর প্রত্যাহার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোন আলোচনা এখনো হয়নি। কেবল উত্তর কোরিয়ার শাসক গোষ্ঠীর নিরাপত্তা ও শাসন ব্যবস্থা পরিবর্তন না হওয়ার নিশ্চয়তা কথা বলা হচ্ছে। প্রসঙ্গত বলে রাখি, যুক্তরাষ্ট্র প্রয়োজনে উত্তর কোরিয়াতে হামলা করবে, তবু কোরীয় উপদ্বীপ থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে না।

দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ কোরিয়া উত্তর কোরিয়াতে বড় ধরনের বিনিয়োগের কর্মকাণ্ড শুরু করেছে। এতে করে দক্ষিণ কোরিয়ার হাজার হাজার ফ্যাক্টরিগুলি চীন ত্যাগ করে উত্তর কোরিয়ায় চলে আসতে পারে। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের বহু কোম্পানি চীন থেকে উত্তর কোরিয়ায় চলে আসতে পারে।

তবে চীন কোনভাবেই এই দুটি সম্ভাবনা এড়াতে পারবে না। উত্তর কোরিয়া যতই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যাচ্ছে, উত্তর কোরিয়া চীন থেকে ততই দূরে সরে আসছে।

এখন প্রশ্ন হল, চীন কি ইচ্ছে করলে উত্তর কোরিয়াকে আর কয়েক দশক বিচ্ছিন্ন করে রাখতে পারত?

এটির সরাসরি উত্তর, 'না'। উত্তর কোরিয়া দেশটির নিজের স্বার্থেই পারমাণবিক অস্ত্রগুলি বানিয়েছে; আজকে যে উত্তর কোরিয়া কূটনৈতিক আলোচনায় বাড়তি সুবিধা পাচ্ছে সেটির মূল কারণ দেশটি এখন পারমাণবিকভাবে শক্তিধর।

উত্তর কোরিয়া চীনের বলয়ে খুব ভাল ছিল না। তবে চীনকে এড়িয়ে উত্তর কোরিয়া অন্য কোন অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশের সাথে সম্পর্ক করতে পারছিল না। পারমাণবিক পরীক্ষার আগে দেশটির প্রতি নিষেধাজ্ঞা থাকা অবস্থায় চীন পাশে থাকলেও উত্তর কোরিয়া চীনের প্রতি খুব সন্তুষ্ট ছিল না। উত্তর কোরিয়া সেই অবস্থান থেকে বের হওয়ার সুযোগ খুজচ্ছিল।

চীনের সাথে উত্তর কোরিয়ার দেড় থেকে দুই বছরের সম্পর্কের গ্যাপের প্রমাণ পাওয়া যায় তিনটি ঘটনায়।

কিম জং উন যখন একের পর এক পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো শুরু করল, চীন তখন কিছুটা বিরক্ত। তবে একেবারেই যে অখুশি ছিল তা আবার সঠিক নয়। উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যখন যুদ্ধের ভাব ঠিক তখনই চীন উত্তর কোরিয়াকে সরাসরি জানিয়ে দেয়, কোন ধরনের যুদ্ধে চীন উত্তর কোরিয়া পাশে থাকবে না। চীন তার নিজের সীমান্তে কোন পারমানবিক শক্তিধর দেশ চায় না, চায় একটি স্থিতিশীল 'বাফার স্টেট'। সেই 'বাফার স্টেট' চীনের ভূরাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হবে। যাহোক, উত্তর কোরিয়া এতে বেশ ক্রোধ হয়।

ধারণা করা হয় কিম জং উন রেগে গিয়েই তার ফুফা জেং সাং তায়েককে হত্যার নির্দেশ দেন। কারণ তায়েক চীনের সাথে উত্তর কোরিয়ার সম্পর্কের বিষয়টি দেখভাল করতেন। এমনকি কিম জং উনের সৎ ভাই কিম জং নামকে হত্যার পিছনে একই চিন্তা কাজ করতে পারে বলে উত্তর কোরীয় বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। কারণ কিম জং নাম দীর্ঘ দিন ধরেই চীনের ম্যাকাও-এ বসবাস করতেন। কিম জং উন বিশ্বাস করতেন তার সৎভাইকে নিয়েও চীন খেলতে পারে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডের পরপরই চীন ও উত্তর কোরিয়া সম্পর্কের অবনতি ঘটে। চীন উত্তর কোরিয়ার উপর আন্তর্জাতিক নানান নিষেধাজ্ঞার বিষয়েও কোন আপত্তি জানায়নি।

এখানে কোন সন্দেহ নেই যে উত্তর কোরিয়া দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চীনের ছত্রছায়ায় আন্তর্জাতিক রাজনীতি পরিচালনা করে আসছে। এমনকি যখন উত্তর কোরিয়া একের পর এক পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়ে আসছিল, তখনো চীনের অবস্থান ছিল কৌশলী। কোরীয় উপদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতা বন্ধ করার লক্ষ্যে উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক পরীক্ষার প্রতি চীনের এক ধরনের মৌন সমর্থনও ছিল। চীনের ধারণা ছিল এতে করে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক উপস্থিত কমিয়ে উত্তর কোরিয়ার সাথে আলোচনায় বসবে। তবে পুরো হিসাবনিকাশ পাল্টে দিয়েছে দুটি বিষয়।

প্রথমটি হল দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়ে-ইন এর শান্তির বার্তা। কোন সন্দেহ নেই যে উত্তর কোরিয়ার কাছে মুন জায়ে-ইন একজন পরীক্ষিত শান্তিবাদী মানুষ। উত্তর কোরিয়ার প্রতি তার শান্তির বার্তা দেশটিকে আশ্বস্ত করেছে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হল, ডোনাল্ড ট্রাম্প যে পারমাণবিক উত্তর কোরিয়া মেনে নিবে না তা স্পষ্ট করে দিয়েছিল। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে, ট্রাম্প যে ২০২০ মধ্যেই উত্তর কোরিয়ায় হামলা করবে সেটির স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। ট্রাম্প জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদেই ঘোষণা দিয়েছিল, প্রয়োজনে উত্তর কোরিয়াকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়া হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের তেমন একটি প্রস্তুতির প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। যুক্তরাষ্ট্র যে উত্তর কোরিয়ায় হামলা করতে সামান্যতম দ্বিধা করবে না এবং এই হামলার ফলে কেবল রেজিম পরিবর্তন নয়, দেশটিও যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে চলে যাবে সেটি উত্তর কোরিয়ার শাসক গোষ্ঠী ও চীনের প্রশাসকেরাও ভাল করেই বুঝতে পেরেছিল। অধিকন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প যে চীনের সাথে অর্থনৈতিক যুদ্ধে লিপ্ত তাতে চীনেরই বেশি ক্ষতি হচ্ছে। চীন বাধ্য হয়েই ২০২২ সালের আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দুইশ বিলিয়ন ডলার বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিলেও শেষ রক্ষা হয়নি। ট্রাম্প চীনের ২০০ বিলিয়ন ডলারের পণ্যের উপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করেছে।

চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি প্রায় পাঁচশ বিলিয়ন ডলার। ট্রাম্প বেশ সফলতার সাথেই উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ইস্যুতে চীনের সাথে তার দেশের বাণিজ্য ঘাটতির বিষয়টি প্রাসঙ্গিক করতে পেরেছেন। ফলে যুক্তরাষ্ট্রে বাণিজ্য হারানো এবং উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার অজুহাতে কোরীয় উপদ্বীপে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে শক্তিশালী পারমাণবিক সমরাস্ত্রের উপস্থিতি চীনকে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছে। উত্তর কোরিয়ার উপর চীন  নিজের কর্তৃত্ব কমিয়ে এনেছে।

এমতাবস্থায়, চীন কতদিন উত্তর কোরিয়াকে নিজের বলয়ে রাখতে পারবে সেটি এখন বড় প্রশ্ন। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে কিম জং উনের সিঙ্গাপুর সামিটি এবং যুক্তরাষ্ট্রে কিম জং উনের সফরের সম্ভাবনার পরে সেই প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে।