রামু ট্র্যাজেডি: ধর্মীয় উসকানিতে সতর্ক হতে হবে

Published : 30 Sept 2018, 01:03 PM
Updated : 30 Sept 2018, 01:03 PM

রামুর উত্তম বড়ুয়া নামে এক যুবক তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টে পবিত্র কোরান অবমাননা করেছে এমন অভিযোগ তুলে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে বৌদ্ধ বিহার এবং পল্লীতে হামলা করা হয়েছিল।

পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া, টেকনাফ এবং পটিয়ায় একই ঘটনা ঘটে।

এই ঘটনায় অনেক বিহার, পুরাকীর্তি ধ্বংস হয়ে যায়। পরে সরকারি উদ্যোগে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ বিহার এবং বসতবাড়িগুলো পুনরায় নির্মাণ করা হয়। কেউ একজন ধর্মঅবমাননাকর এই ছবিটি তাকে ট্যাগ (যুক্ত) করে দিয়েছিল। অনেকের মতে, ছবিটা আরো আগে ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে ফেইসবুকে ঘুরপাক খাচ্ছিল। বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল।

২০১২ সালে আমার কোন ফেইসবুক অ্যাকাউন্ট ছিলনা। কেননা ফেইসবুক সম্পর্কে আমার তেমন কোন সম্যক ধারণা ছিলনা। উল্টো অনেকটা নেতিবাচক ধারণা ছিল। সবসময় এটা মনে করেছি যে, একজন ধর্মীয়গুরু হিসেবে এটা আমার দরকার নেই। ২০১৪ সালে আমি ফেইসবুক তথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবেশ করি।

এখন ফেইসবুকে লাইক, কমেন্টস, শেয়ার, ট্যাগ এসব কিছুটা বুঝি। উত্তমের অপরাধ হল কেউ তাকে ধর্ম অবমাননাকর এই ছবিতে ট্যাগ বা যুক্ত করেছিল। ওই ছবিটাও নাকি কারসাজি করে বানানো ছিল। কেউ তাকে ছবিটাতে ট্যাগ করায় ছবিটা তার অ্যাকাউন্টে দেখা যাচ্ছিল। যারা পরিকল্পিতভাবে উত্তমের উপর ধর্ম অবমাননার দায় ছাপাতে চেয়েছিল তারাই দ্রুত অপপ্রচার করে সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। একপর্যায়ে তারা খুব দ্রুত এবং সহজে রামু সহিংসতার ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলে। তার উপর রাজনৈতিক কিছু নেতা এবং রামু উপজেলা থেকে জেলা পর্যন্ত প্রশাসনের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে সেদিন ঘটনা এতদূর গড়াতে পেরেছিল।

যারা এদেশের চিরায়ত ঐতিহ্য সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায় এবং আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে চায় তারা এই অপচেষ্টা অতীতেও করেছিল, বর্তমানও করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। তবে পরিকল্পনা তাদের হতে পারে কিন্তু তা বাস্তবায়ন করতে হলে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া আদৌ সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে কোনও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা তথা ঘটনা ঘটাতে হলে সাধারণ মানুষকে উসকানো এবং খ্যাপানো অনিবার্য হয়ে পড়ে।

তাদের এই নোংরা পরিকল্পনা নস্যাৎ করতে হলে সাধারণ মানুষকে সহিষ্ণু হতে হবে। ধর্ম অবমাননার মত স্পর্শকাতর  ঘটনার ক্ষেত্রে বিচার বিশ্লেষণ না করে, বিবেচনা না করে, কেবল আবেগ এবং ক্ষোভের বশীভূত হয়ে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠা উচিত নয়। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে বিশেষ করে কাজে লাগাচ্ছে। এটা সাধারণ মানুষেকে বুঝতে হবে।

কেউ যদি সত্যি সত্যি ধর্ম অবমাননা করেও থাকে তাহলে তার এই অপকর্মের দায় কেবল তার ওপরেই বর্তায়। তার ধর্ম, সম্প্রদায় এমনকি পরিবারের ওপর দায় ছাপানো যাবেনা। দেশে আইন-কানুন আছে। সেই অনুসারে অপরাধীর বিচার হবে। এটুকু ধৈর্য তো ধারণ করতে হবে। ধর্মীয় উসকানি দিয়ে যেহেতু সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটানো সহজ কাজ হয়ে পড়েছে তাই স্বার্থান্বেষী মহল এটাকে বেশি কাজে লাগাচ্ছে।

এ ধরনের ঘটনা একটা ঘটলে পরে এর ক্ষতির দিক বহুমুখী হয়। একদিকে ক্ষতিগ্রস্তরা শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী আক্রান্ত হচ্ছে বলে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়, ঘটনার দায় মাথায় নিয়ে কিছু মানুষকে ঘরছাড়া হতে হয়, মামলা খেয়ে কেউ কেউ সর্বস্বান্ত হয়, কেউ বা বিনাদোষে কষ্ট পায়। সর্বোপরি এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং আস্থার পরিবেশ নষ্ট হয়। অথচ ঘটনার পরিকল্পনাকারী, ইন্ধনদাতা এবং রাঘববোয়ালরা ধরাছোয়ার বাইরে থেকে যায়।

২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর বৌদ্ধ বিহার এবং পল্লীতে এবং পরের দিন ৩০ সেপ্টেম্বর উখিয়া, টেকনাফ এবং পটিয়ায় একই হামলার ঘটনা ঘটে। একথা দেশ-বিদেশের সবাই জানেন। এ ঘটনা দৈবক্রমে ঘটেনি। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হল, ঘটনার সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করতে না পারায় কিংবা চিহ্নিতদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরা সাক্ষ্য না দেওয়ায় ঘটনার ছয় বছরেও রাষ্ট্র এই ঘটনার বিচারকার্য শেষ করতে পারছে না। জানিনা এভাবে আরো কত বছর লেগে যায়।

রামু সহিংসতার স্মরণে আয়োজিত এক সভায় ড. সুলতানা কামাল বলেছিলেন, 'আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য চল্লিশ বছর ধরে অপেক্ষা করেছি। রামু সহিংসতার বিচারের জন্যও প্রয়োজনে চল্লিশ বছর অপেক্ষা করবো। তবুও এই হামলার বিচার হতেই হবে।' কয়েক দিন আগে মামলাগুলোর আইনজীবীর সাথে কথা বলেছিলাম। মামলার সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে না পারায় তিনিও হতাশা প্রকাশ করলেন। সাক্ষী হাজির না হওয়ার কিছু কারণও আছে। ঘটনার পরপর প্রত্যক্ষদর্শী এবং ভুক্তভুগীদের মধ্যে যে একটা আগ্রহ, দায়বোধ এবং আবেগ ছিল তা হয়তো এখন দিন দিন লোপ পাচ্ছে। অনেকে নিরাপত্তা, লাভ-ক্ষতি এবং বিভিন্ন হিসাব-নিকাশ করে সাক্ষী দেওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। আরেকটা কারণ হতে পারে যে, তারা যাদেরকে এই হামলার জন্য দায়ী বলে মনে করেন বা যাদের দেখেছেন তারা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এতেও সাক্ষীরা হতাশ হয়ে থাকতে পারেন। আর মামলায় যাদেরকে সাক্ষী করা হয়েছে তা আদৌ তারা জানতেন কিনা কিংবা তাদের সম্মতি ছিল কিনা এটাও একটা বিষয় হতে পারে।

রামু সহিংসতার ঘটনায় রামুতে ৮টি, উখিয়ায় ৭টি, সদরে ২টি, এবং টেকনাফে ২টিসহ মোট ১৯টি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। রামুতে আট মামলার একটির বাদী ছিলেন ক্ষতিগ্রস্ত এক ব্যক্তি। তিনি নিরাপত্তার কথা ভেবে সেই মামলাটি ২০১৪ সালে আপস মীমাংসা করেন। বাকি মামলাগুলোর বাদী পুলিশ। পরবর্তীতে বাকি আঠারো মামলার পাঁচটি মামলা অধিকতর তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন পিবিআইকে দেওয়া হয়েছে। পিবিআই ২০১৬ সালে তদন্ত শেষে চারটি মামলার প্রতিবেদন আদালতে পেশ করেন। এভাবে চলছে ঘটনার ছয় বছর।

ঘটনার পরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অধীনে তদন্ত হয়েছে, বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়েছে, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আরো বিভিন্নভাবে তদন্ত হয়েছে। সংবাদ আর গণমাধ্যমে অনেক হামলাকারীদেরকে নিয়ে সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার ও প্রকাশিত হয়েছে। তবুও সাক্ষীর অভাবে যদি এই ঘটনার বিচার সম্পন্ন করা না যায় তাহলে এই মামলাগুলোর ভবিষ্যত কি হবে জানিনা।