ব্রাভো বাংলাদেশ !

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 26 Sept 2018, 12:51 PM
Updated : 26 Sept 2018, 12:51 PM

সামনে নির্বাচন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার। রাজনীতিকদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তো ক্যানাডার আবহাওয়ার মতো ক্ষণে ক্ষণে বদলায় এবং সেজন্য তারা লজ্জিতও হন না। কিন্তু আওয়ামী লীগ সে ওয়াদা রক্ষা করেছে যা জীবনে দেখে যেতে পারব বলে ভাবিনি।

"শেখ হাসিনা ছাড়া কোন বাপের বেটির পক্ষে সম্ভব ছিল না যুদ্ধাপরাধের বিচার করার। যুদ্ধাপরাধের বিচার শুধুমাত্র একটি নির্বাচনী প্রতিজ্ঞা না – এটা বাঙালি জাতিসত্তার প্রাণের দাবী" – ব্যারিস্টার তুরীন আফরোজ।

অবশ্যই, তুরীন আফরোজ! পঁচাত্তরের পর থেকে জাতির রাজনীতি যে কলঙ্কিত পথে গেছে তাতে একাত্তরের কসাইদের শাস্তি তো দূরের কথা বিচারের আশাও ছেড়ে দিয়েছিলাম। দুর্দম এই মূল্যবোধ আর আইনি যুদ্ধে পুরো জাতিকে আপনারা বিজয়ী করে ছেড়েছেন, বিজয়ী সেনাপতিদের একজন হিসেবে আপনাকে অভিনন্দন। সময়ের বুকে প্রস্তরস্বাক্ষরে আপনাদের পদচিহ্ন এঁকে গেলেন, কোনোদিন তা ম্লান হবেনা। এবারে দেখা যাক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ দ্বারা মুসলিম গণহত্যাকারীদের বিচার ও শাস্তি কেন মুসলিম ইতিহাসে অনন্য বিস্ময়।

মুসলিম ইতিহাসের হাজার বছর একদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রবল বিস্ফোরণের যুগ যা পুরো মানবজাতিকে প্রচণ্ডবেগে প্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে গেছে। সেই মুসলিম দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদেরকে আজ বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন, তাদের ওপরে প্রচুর বই লেখা হয়েছে। আমাদের বিজ্ঞানীরাও পিছিয়ে নেই, ইংল্যাণ্ডের কীল বিশ্ববিদ্যালয়ের ড: মিসবাহ দ্বীন-এর লেখা 'সায়েন্স আন্ডার ইসলাম – রাইজ, ডিক্লাইন অ্যাণ্ড রিভাইভ্যাল' এ বিষয়ে চমৎকার বই।

অন্যদিকে ক্রমাগত চলছিল প্রায় বিশ বাইশটা 'খলিফাতুল মুসলেমিন'-এর নামে রাজবংশের ক্ষমতার হিংস্র লড়াই, বিদ্রোহ, পাল্টা বিদ্রোহ, বিদ্রোহ দমন, আততায়ী দ্বারা খলিফাদের গুপ্তহত্যা, খেলাফতের উচ্ছেদ ইত্যাদি। লড়াই মানেই ধ্বংস, হত্যা ও প্রাণহানি। নিচের তালিকা প্রমাণ করে যে মুসলিম হওয়াটা মুসলিমের হাতে মুসলিম হত্যারই বাঁধা হতে পারেনি, অন্য ধর্মের তো কোন ছার।

নিচে তালিকা দিচ্ছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী বিভাগের যে কোনো ছাত্রকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে পারেন। গণহত্যা মানে একাত্তরের মতো গণহারে সাধারণ মানুষ হত্যা। নিচের তালিকার সব যুদ্ধে গণহারে সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছে এ দাবি আমরা অবশ্যই করতে পারিনা। অবশ্যই সব যুদ্ধে সাধারণ মানুষ নিহত হয়নি, কিন্তু যুদ্ধ হয়ইনি কিংবা যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে তারপরেও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে যেমন কারবালায় কিংবা আব্বাসীয়দের বিজয়ের পর কিংবা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের মক্কা দখলের পর (নীচে দেখুন)। কারবালায় ইমাম হোসেন (রা) যুদ্ধ করতে যান নি – বালক বালিকা তরুণ তরুণী,  এতগুলো নারী ও ছয় মাসের বাচ্চা (আসগর) নিয়ে কেউ যুদ্ধে যায় না। সীমারের নেতৃত্বে এজিদের সৈন্যেরা ফোরাত নদী ঘিরে ধরলে পানির অভাবে তারা প্রথমে মিনতি করেন, পরে বাধ্য হয়ে অস্ত্র তুলে নেন। কিন্তু তাদের ওপরে গণহত্যা হয়েছিল। অনেক দলিলে দেখা যায় তখন যুদ্ধে আরব পেনিনসুলায় গোত্রের নারী-পুরুষ সহ সব সদস্য জড়িয়ে পড়ত, আহত নিহত হত।

এমনিতে ইতিহাসের প্রায় সবকিছুতেই বিশেষজ্ঞদের দ্বিমত আছে কিন্তু সেই রাজা বাদশাহদের (কিছু ব্যতিক্রম বাদে) নৃশংসতার ব্যাপারে মোটামুটি সবাই একমত। এমনকি সাহাবীরাও এর হাত থেকে রেহাই পান নি। প্রমাণ আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়, উদ্ধৃতি দিচ্ছি:-

১.  প্রথম দিকের অন্তর্ঘাত যুদ্ধের সম্ভাবনা ও যুদ্ধ ধরা আছে সহি বুখারী ৯-১৮৩ (রসূল স: বললেন বৃষ্টিধারার মত অজস্র লোককে হত্যা করা হবে), ৯-২০৪, ২৩৭, ১-৮৫, ৩-১০২, ৬৪৭, ৪-৪০১ (রসূল স: বললেন এ থেকে কোনো আরব বাড়ি রেহাই পাবেনা) ইত্যাদি। এরকম অনেক আছে সহি মুসলিম, সুনান আবু দাউদ ও অন্যান্য সহি হাদিসেও।

২. উদ্ধৃতি:- "বাদশাহদের প্রায় সব জমিজমা ও দালান কোঠা অবৈধভাবে অর্জিত। কাহারো উচিত নহে এসব সুলতানকে মুখ দেখানো বা তাহাদের মুখ দেখা। তাহাদের অত্যাচারের জন্য তাহাদিগকে ঘৃণা করা উচিত, তাহাদের অস্তিত্বকেই নিন্দা করা উচিত, তাহাদের প্রশংসা করা উচিত নহে…তাহাদের রাজপ্রাসাদ ও সাজ-পোশাককে নোংরা ও অনৈসলামিক ঘোষণা করা উচিত"… তিনি সকল মন্ত্রীদিগকে চিঠিতে লেখেন যে, − "স্বৈরতন্ত্রের অত্যাচার সকল সীমা অতিক্রম করিয়াছে। আমি এইস্থান ত্যাগ করিয়া যাইতেছি যাহাতে স্বৈরতন্ত্রের এই নিষ্ঠুর ও নির্লজ্জ কর্মকাণ্ড আমাকে দেখিতে না হয়" = উদ্ধৃতি শেষ, ইমাম গাজ্জালী − (এ শর্ট হিস্ট্রি অব্ দ্য রিভাইভালিস্ট মুভমেণ্ট ইন্ ইসলাম − পৃষ্ঠা ৬২-৬৩ – মৌদুদী)।

৩. উদ্ধৃতি:- যুদ্ধের সময় ছাড়াও শুধু শান্তিকালীন অবস্থায় হাজ্জাজ (হাজ্জাজ বিন ইউসুফ) এক লক্ষ পঁচিশ হাজার লোক হত্যা করিয়াছিলেন… সাঈদ ইবনে জোবায়ের-এর ন্যায় উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন সৎলোকদিগেরও তিনি মস্তক উড়াইয়া দেন। তিনি মদিনার অসংখ্য সাহাবীর হাতে সীসার মোহর আঁটিয়া দিয়েছিলেন…. হযরত হাসান বসরী বলিতেন "হাজ্জাজ খোদার গজব স্বরূপ" – উদ্ধৃতি শেষ – মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা, পৃষ্ঠা ১৯৫ – কলকাতা ঈদ নামাজের পেশ ইমাম, অল ইন্ডিয়া কংগ্রেসের দু'দফা প্রেসিডেন্ট মওলানা আবুল কালাম আজাদ।

৪. ভারতের যেমন কৌটিল্য চাণক্য, জার্মানির যেমন অটো ভন বিসমার্ক, মুসলিম ইতিহাসের রাজনীতিতে তেমনি ধুরন্ধর রাজনীতিক আমর বিন আস। মৃত্যুশয্যায় তিনি বিলাপ করেছেন, উদ্ধৃতি – "দুনিয়ায় লাভ বেশি কিছু করি নাই অথচ দ্বীন বরবাদ করিয়াছি সেই অনুপাতে অনেক বেশি" – উদ্ধৃতি শেষ – মৃত্যুর দুয়ারে মানবতা, পৃষ্ঠা ১৯২ – মওলানা আবুল কালাম আজাদ।

৫. ৭৫০ সালে আব্বাসীয়রা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে উমাইয়া খলিফা দি্বতীয় মারওয়ানকে হত্যা করে এবং খেলাফত দখল করার পর পুরো উমাইয়া গোত্রকে 'সমঝোতা' করার জন্য রাজপ্রাসাদে ডিনারের দাওয়াত করে। নিমন্ত্রিতদের সংখ্যা স্পষ্ট পাওয়া যায়না কিন্তু কমও নয় নিশ্চয়ই। সবাই ডিনারে এলে দরজা বন্ধ করে সবাইকে কচুকাটা করা হয় – মাত্র একজন পালাতে পেরেছিলেন, তিনি পালিয়ে স্পেনে চলে যান ও স্পেনের খলিফা হয়ে বসেন, তার নাম আবদুর রহমান ১।

অতীত বর্তমানে কোনো খেলাফত বা মুসলিম মেজরিটি দেশ বিচার করেছে, শাস্তি দিয়েছে কোনো গণহত্যাকারী মুসলিমদের? নো, নেভার ! বাংলাদেশ দিয়েছে। পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে দেশ ১৯৭২ এর সংবিধানে সাংবিধানিকভাবে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করার সাহস দেখিয়েছিল।

বাংলাদেশ একমাত্র মুসলিম মেজরিটি দেশ যে ১৪০০ বছরের ইতিহাসে সর্বপ্রথম বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে সফলভাবে স্পর্ধা দেখিয়েছে মুসলিম গণহত্যাকারী কসাইদের বিচার করার, শাস্তি দেবার। এতোবড় গর্ব আমরা রাখব কোথায়? নিচে তালিকা দেখুন – প্রথম তিন শতাব্দী তুলে দিচ্ছি, এর পরের কাহিনীও একই রকম মর্মান্তিক। খেলাফতের শেষের দিকে এটা কমেছিল।

সাল

৬৬১ − হজরত আলী নিহত − সিরিয়ার শাসক মাবিয়া উমাইয়া খেলাফত প্রতিষ্ঠা

৬৮০ − মাবিয়ার মৃত্যু, এজিদ খলিফা হল- কারবালায় নবীজীর প্রিয় নাতি হজরত হোসেন সহ ও-পরিবারের অনেকে নিহত

৬৮৪ − মক্কায় আবদুলা বিন জুবায়ের-এর খলিফা হবার ঘোষণা, মার্জ রাহাত-এর যুদ্ধ

৬৮৭−৬৯২ − কুফা-য় মুখতার নিজেকে খলিফা ঘোষণা করলে মক্কায় জুবায়ের, কুফা-য় মুখতার ও সিরিয়ায় এজিদের বংশধর আবদুল মালিক, একসাথে এই তিন খেলাফতের উদ্ভব – রক্তাক্ত যুদ্ধে মুখতার ও জুবায়ের নিহত। আবদুল মালিকের সেনাপতি হিসাবে ইতিহাসের কুখ্যাত নৃশংস হত্যকারী হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ক্রমাগত গণহত্যা।

৬৯৫ − জাজিরা, আহয়াজ ও কারুন-এর তিনটে যুদ্ধ

৭০২ − ইরাকে আশাথ বিদ্রোহ, দায়রুল জামিরা'র যুদ্ধ

৭০২ থেকে ৭৩৭ পর্যন্ত মুসলিম সৈন্যদের বহু দেশ জয় ও ফ্রান্সের সীমানায় পরাজয় − আবার মুসলিমের গৃহযুদ্ধ

৭৪০ − (ক) ইরাবে শিয়া বিদ্রোহ। (খ) উত্তর আফ্রিকায় বারবার বিদ্রোহ

৭৪৩ − খোরাসানে শিয়া বিদ্রোহ

৭৪৪ − বিদ্রোহীদের অভ্যুত্থানে খলিফা ২য় ওয়ালিদ নিহত

৭৪৫ − খোরাসানে আবার শিয়া বিদ্রোহ − খারাজী দ্বারা কুয়া ও মসুল দখল

৭৪৬ − খোরাসানে আবু মুসলিমের বিদ্রোহ

৭৪৯ − ইস্পাহান ও নিহাওয়ান্দ-এর যুদ্ধ

৭৫০ − (ক) আব্বাসীয়-দের দ্বারা রক্তাক্ত গণহত্যায় উমাইয়া খেলাফতের অবসান। (খ) যাব-এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ

৭৫৫ − খোরাসানে আবার বিদ্রোহ

৭৬২ − ইব্রাহিম ও নাফ্উজ জাকিয়া-র নেতৃত্বে শিয়া বিদ্রোহ

৭৬৭ − সিজিলমাসা-য় খারেজী শাসনের শুরু

৭৭২ − উত্তর আফ্রিকায় জানবি-র যুদ্ধ, মরক্কোতে বিদ্রোহী রুস্তমিদ খেলাফত শুরু

৭৮৮ − মগরেব-এ ইদ্রিসিদ খেলাফত শুরু

৭৯৯ − খাজার-দের বিদ্রোহ দমন

৮০০ − উত্তর আফ্রিকায় আঘলাবিদ খেলাফত শুরু

৮০৩ − ইমাম জাফর বারমকি-র খুন

৮১৪ − খলিফা হারুন রশীদের মৃত্যুতে দুই পুত্র আল্ আমিন ও আল্ মামুনের ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ। আল্ আমিন নিহত

৮১৫ − ইবনে তুবা-র নেতৃত্বে শিয়া বিদ্রোহ − কয়েক বছর যুদ্ধের পর সেনাপতি হুরমুজান নিহত

৮২০ − খোরাসান-এ তাহিরিদ খেলাফত শুরু

৮২৭ − মুতাজিলা-দের সাথে অন্যান্যদের বিরোধ শুরু

৮৩৭ − জাট বিদ্রোহ

৮৩৮ − আজারবাইজান-এ বাবেক বিদ্রোহ দমন

৮৪৩ − তাবারিস্তান-এ মাজাইর বিদ্রোহ

৮৬১ − বিদ্রোহী অভ্যুত্থানে খলিফা মুতাওয়াক্কিল নিহত

৮৬৪ − তাবারিস্তান-এ যায়দি খেলাফত শুরু

৮৬৬ − খলিফা মুতাসিম বিতাড়িত − নূতন খলিফা মুতা'জ

৮৬৭ − সিস্তান-এ সাফারিদ খেলাফত শুরু

৮৬৮ − মিশরে তুলুনিদ খেলাফত শুরু

৮৬৯ − খলিফা মুতা'জ বিতাড়িত − নূতন খলিফা দাসী-পুত্র আল্ মুহতাদি

৮৭০ − তুর্কী বিদ্রোহে আল্ মুহতাদি নিহত − নূতন খলিফা আল্ মুতামিদ

৮৭৩ − রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তাহিরিদ খেলাফতের উচ্ছেদ,

৮৭৪ − দক্ষিণ ইরাকে জাঞ্জ বিদ্রোহ

৮৯১ − কেন্দ্রীয় খেলাফত অস্বীকার করে বাহরায়েন-এ কামাতিয়ান শাসনে উদ্ভব

৮৯৭ − কামাতিয়ান দ্বারা বসরায় গণহত্যা

৯০৫ − মসুল ও জাজিরা-য় হামদানিদ খেলাফত শুরু − মিশরে তুলুনিদ খেলাফতের উচ্ছেদ

৯০৮ − সামানিদ খেলাফত দ্বারা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সাফারিদ খেলাফতের অবসান – অন্যান্য সূত্র ও ইসলামিক ওয়েরসাইট

বিভিন্ন দলিলে সালের কিছু পার্থক্য দেখা যায়।

(লেখকের "শারিয়া কি বলে, আমরা কি করি" বইয়ের একটি অধ্যায়)