সৈয়দ আশরাফ: আপনার প্রয়োজন এখনো ফুরোয়নি

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 24 Sept 2018, 01:00 PM
Updated : 24 Sept 2018, 01:00 PM
সেদিন সকালে উঠেই খবরটা দেখলাম।  জীবদ্দশায় মানুষকে সম্মান করার রেওয়াজ কম আমাদের। থাকলে অনেক মানুষই আমাদের দেশ ও জাতিতে চিরস্মরণীয় হতেন। তারচেয়েও বড় কথা আমরা একটি কৃতজ্ঞ জাতিতে পরিণত হতে পারতাম।
আমাদের ভালোবাসা শ্রদ্ধাবোধ কিংবা অসম্মান করার প্রবণতা সবকিছু কেমন স্বার্থপরের মতো। আমি যে কথাটা সবসময় বলি আমরা আসলেই একটা কমলালেবু জাতি। যার মানে বাইরে কমলার খোসা আমাদের একত্রিত করে রাখলেও আমরা সবাই একেকটি ভিন্ন কোষ। আমাদের এক করে রেখেছে দেশ সংস্কৃতি ও সীমানা।
এর বাইরে কী নিয়ে ঐক্য আছে আমাদের? এই যে এতবড় যুদ্ধ আর তার ফলে পাওয়া দেশ, তাকেও কি আমরা সবাই মিলে ভালোবাসি? আমাদের পতাকা-সঙ্গীত-নেতা-পিতা সবাইকে আমরা তোপের মুখে রেখে শান্তি পাই। একত্রে রবীন্দ্রনাথ নজরুল বঙ্গবন্ধুকে না মানা বাঙালি এখন স্বার্থ আর সুযোগের বাইরে কাউকে সম্মান করেনা।
সকালে দেখলাম সৈয়দ আশরাফ গুরুতর অসুস্থ। তার বিষয়ে লেখার আগে কয়েকটা কথা বলে নেই। এখন রাজনীতি বা রাজনৈতিক নেতাদের আসলে কেউ তেমন শ্রদ্ধার চোখে দেখেনা। এই যে চারদিকে প্রধানমন্ত্রীর প্রশস্তি বা গুণগান তার পেছনেও আছে ধান্দাবাজী। তিনি যদি আজ আর গদিতে না থাকেন বা কোন কারণে অবসরে যান তখন কি  আমরা এভাবে তার কথা লিখবো বা বলবো?
সমাজের শরীরে যে পচন তার জন্য রাজনীতি ব্যাপকভাবে দায়ী। একটা সময় ছিলো যখন রাজনীতিবিদেরা সমাজসেবা আর জনকল্যাণে এই কাজে আসতেন। সে কারণে আমাদের অতীতে আমরা এমন কিছু রাজনীতিবিদদের পেয়েছিলাম যারা একটা আদর্শে বিশ্বাস করতেন। আমি কোন রাজনৈতিক আদর্শের কথা বলছি না। আমি বলছি তাদের জীবনযাপনের কথা। সে আমলে প্লেইন লিভিং হাই থিকিং ছিল মূল কথা। পরে সাফারি আর লম্বা কোটের সেনানায়কেরা এই জায়গাকে নামিয়ে আনলেন হাই লিভিং আর প্লেইন থিকিং'য়ে। এখন আরো খারাপ অবস্থা। এখন হলো হাই লিভিং আর নো থিকিং এর যুগ।
কোনভাবে টুপাইস কামালেই হলো। আজ লন্ডন কাল প্যারিস পরশু ঢাকা এভাবেই চলে যায় জীবন। এদের মানুষ এখন ভালোবাসে কি না জানিনা তবে ভয় পায়। আর ভয় ও ত্রাসে তারা নেতা হয়ে আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতে থাকে।
এমন দু:সময়েও আমাদের জাতীয় জীবনে কিছু মানুষ আছেন যারা এখনো পুরনো চালে নিজেদের চলতে দিতে ভালোবাসেন। সৈয়দ আশরাফ তেমন একজন নেতা। তার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আছে সেগুলো বিশ্লেষণ করলেই দেখবেন তিনি প্রচলিত নেতাদের বাইরে একজন সাধারণ মানুষ। শুনেছি তিনি দেরিতে ঘুম থেকে উঠতেন। কারণ সকাল থেকে তদবীরবাজ আর স্বার্থপরদের জন্য সময় দিতেন না।
নিন্দুকেরা বলে তিনি নাকি কর্মীদের সময় দিতেন না। এর মাজেজা বোঝাও কঠিন না। তিনি তেমন মানুষ নন যে সারা দিনরাত খালি এর বিরুদ্ধে ওর ওর বিরুদ্ধে এর কথা শুনবেন। আর একটা বড় বিষয় তিনি প্রগলভ ছিলেন না। এখন তো প্রগলভতার যুগ।
নেতাদের ধারণা তাদের কোন কাজকর্মের খবর কেউ রাখেনা। তারা মাইক বা মিডিয়া পেলেই খালি বকবক করবেন আর আমরা শুনে বলবো : দারুণ দারুণ। এগিয়ে চলেন জাতীয় কিছু। সৈয়দ আশরাফ তেমন কিছু ছিলেননা। যে বিষয়টা আমরা মনে রাখিনা অনেক কথা বলার ভেতর এক ধরণের বিপদ থাকে। আমি কারো নাম বলে বিপদে পড়তে চাইনা। কিন্তু আমরা সবাই জানি বিরোধী দল বিএনপির মহাসচিবের পরিমিত কথন আমাদের খারাপ লাগে না। অন্যদিকে কারো কারো কথা শুনলে মনে হয়, থামলে বাঁচি।
আমি বলিনা যে তিনি সবসময় নিজের ইচ্ছেয় বলেন। বা তারা বলতে চান। বলতে হয় তাদের দিয়ে বলানোও হয় হয়তো। সৈয়দ আশরাফের সময় যেটা ছিলো তিনি  এত কথা বলতেন না। আর বললেও পরিমিত । এই পরিমিতি বোধের নামই কিন্তু আধুনিকতা। মনে আছে দেশের সর্বাধিক প্রচারিত নামে পরিচিত দৈনিকের সম্পাদক ও তার সহযোগী আমার এক বন্ধুর কথোপকথনের অডিও ফাঁস হয়েছিল একসময়।
আমি তা মন দিয়ে শুনেছি একাধিকবার। কারণ এর নেপথ্যে কি আছে বোঝার দরকার ছিল। আপনি যদি তা শুনে থাকেন অবশ্যই বুঝবেন এর কারণ ছিলো ঈর্ষা আর পাত্তা না পাওয়ার বেদনা। খেয়াল করুন এখন যখন অতিকথনের তোড়ে সরকারী দলের হাল খারাপ তখন এরা চুপ। কারণ এরা খুব ভালো জানে ড্যামেজ বা লোকসান  যা করার তা যখন ভেতর থেকেই হচ্ছে তাদের আর বলার দরকার নাই।
মূলত তার উত্তরাধিকার তাকে এমনভাবে বড় করেছে যেখানে কথা বলার প্রয়োজন ছিল কম। আমরা জানি এই মানুষটি কার সন্তান। তার পিতা ছিলেন এদেশের জন্মলগ্নের রাষ্ট্রপতি। মুক্তিযুদ্ধের কান্ডারি। পঁচাত্তরের  নির্মম ও আইনবিহীন সভ্যতাহীন হত্যার শিকার। তারপরও আমরা তার গলায় কোনদিন তেমন কোন প্রতিহিংসার কথা শুনিনি। পিতার কথাও বলতেন না তেমন করে। শুধু প্রয়োজনের সময় বলেছিলেন , তাঁর রক্ত পরীক্ষিত। যা কোনদিন বেঈমানি করতে জানে না।
এই মানুষটি যখন সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে চলে গেলেন তখনও নীরব। রাজনীতিতে আসা যাওয়া যে একটা সাধারণ ও চলমান বিষয় সেটা আমরা মানি না। যেকোনও দলে আসা আছে, যাওয়া নাই। ক'দিন আগে এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সারাদেশে ফেটে পড়েছিল। মানুষের হাসি যে কত বীভৎস আর নির্মম হতে পারে সেটা দেখেছিলাম আমরা। মানুষের একটাই চাওয়া তখন  এই হাসি বন্ধ হোক । এই নেতাকে সরানো হোক। হয়েছে ? কেন হয়নি তা আমরা সবাই বুঝি।
কিন্তু কিছুদিন পর ভুলে যাই। এটার ভেতর আরেকটা সত্য আছে। এই নিষ্ঠুর মানুষটিকেও আমরা ভুলে যাবো। কোনদিন কোন পজিটিভ কারণে তাকে মনে রাখবে না কেউ। অথচ চলে যাবার পরও আমি দেখেছি মানুষ বিশেষত নারীদের ভেতর কি তুমুল জনপ্রিয় সৈয়দ আশরাফ।
ব্যক্তিগত জীবনে শীলা ঠাকুরের স্বামী তিনি। এমন এক পত্নী পেয়েছিলেন যিনি আধুনিক ও লেখাপড়া জানা মেধাবী। দূরারোগ্য ব্যধিতে ভোগার সময় সাহায্য বা অনুদানের কিছুই নেননি পদবীধারী আশরাফ ভাই। উল্টো নাকি বলেছিলেন ঢাকার বাড়িটা বিক্রি করে দিলেই চিকিৎসার টাকা হয়ে যাবে। তা করার আগেই না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন শীলা ঠাকুর। তখন তিনি বিলেতে থাকাকালীন সময়ে আমি যোগাযোগের চেষ্টা করি।
বিলেত প্রবাসী সুশান্তের কল্যাণে সম্ভবও হয় তা। প্রথমদিন না পেলেও পরের দিন ফোনে পেয়ে যাই তাকে। ঠিক যেমনটি মনে করেছিলাম তেমন শান্ত আর চমৎকার ব্যবহার। কথা বলার সময়টুকুতে খেয়াল করেছি যত বলেন শোনেন তার বেশি। তার ভদ্রতা ও অমায়িক আচরণ যেকোন মানুষকে মুগ্ধ করতে যথেষ্ট। এমন মানুষই আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দরকার।
দেশের রাজনীতির ওপর মানুষের যে রাগ বা অভিমান বা রাজনীতি নিয়ে নেতাদের নিয়ে যেসব অভিযোগ তার নিরসনে সৈয়দ আশরাফের মত নেতার বিকল্প নাই। তিনি প্রমাণ করেছেন রাজনীতি করতে হলে খালি কথা বলতে হয়না। মানুষের ব্যক্তিত্ব আর তার পরিমিতিবোধ ও ম্যাজিকের মত কাজ করে বৈকি।
সকালে দেখলাম তিনি গুরুতর অসুস্থ। এও পড়লাম সংসদ ও তাকে ছুটি দিয়েছে। সৈয়দ আশরাফ অনেকদিন পর জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গণে  একজন আধুনিক নেতা ও মানুষ হয়ে জনগণের দৃষ্টি কেড়েছিলেন। আমরা তার নিরোগ দীর্ঘজীবন কামনা করি। বন্ধু কবি আসাদ মান্নানের কবিতার পঙক্তি থেকে বলি- সৈয়দ বংশের ফুল সৈয়দ আশরাফ আবার ফিরে আসুন। আবার সরব ও সচল হোন। আপনার প্রয়োজন ফুরোয়নি এখনো।