‘জাতীয় ঐক্য’ কতখানি জাতীয়?

কবির য়াহমদ
Published : 23 Sept 2018, 12:40 PM
Updated : 23 Sept 2018, 12:40 PM

অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামের নতুন এক রাজনৈতিক জোটের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। শুরুতেই এই জোট ব্যাপক আলোচনায়। গণমাধ্যমসহ রাজনৈতিক মহলে তাদের নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলছে। এই রাজনৈতিক জোট কতখানি প্রভাব বিস্তারকারী হতে পারে এনিয়ে নির্মোহ বিশ্লেষণের দাবি রাখলেও আদতে সেটা হচ্ছে না।

যুক্তফ্রন্ট জাতীয় ঐক্যের উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়েছে বলে জোটের শীর্ষনেতারা দাবি করলেও তাদের জনকল্যাণকামী প্রকৃত উদ্দেশ্য এখনও পরিস্কার নয়। তবে তাদের বক্তৃতা বিবৃতিতে যা পরিষ্কার তা হচ্ছে এটা সরকারবিরোধী এক জোট, এবং উদ্দেশ্যই তাদের সরকার পরিবর্তনের। এই জোট আগামি নির্বাচনে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছে, এবং সেটা সকল দলের অংশগ্রহণের ভিত্তিতে।

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যেতে তারাও আগ্রহী নয়, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আগামী নির্বাচন দলীয় সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। সে লক্ষ্যে প্রস্তুতিও নিচ্ছে আওয়ামী লীগ ও নির্বাচন কমিশন। কয়েকটি মিটিং আর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমেই গড়ে ওঠা এই জোটের এখন পর্যন্ত দেওয়া বিভিন্ন বক্তব্যে তারা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের বাইরে অন্য সরকার চাইছে সেটা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে।

'জাতীয় ঐক্য' যারা করবেন বলে জানাচ্ছেন তাদের সকলেই বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি চরমভাবে বিরক্ত, অথবা আরও একটু খোলাসা করলে বলা যায় তারা সরকারের প্রতি চরম বিদ্বেষ পোষণকারী। যেকোনও মূল্যে আওয়ামী লীগ সরকারকে সরিয়ে তারা অন্য কাউকে ক্ষমতায় দেখতে চান- এটাই উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্যপূরণে তারা নিজেরা কতখানি দায়িত্ব নিতে আগ্রহী কিংবা সক্ষম এনিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। ফলে জাতীয় ঐক্য কেবল আওয়ামী বিরোধী ঐক্যের যে প্রক্রিয়া সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

যুক্তফ্রন্ট নামের যে রাজনৈতিক জোট গঠিত হয়েছে তার নেতৃত্বে আছেন ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী। আছেন ড. কামাল হোসেন, আ স ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নার মত নেতারা। বদরুদ্দোজ্জা চৌধুরী বাদে বাকি সকল নেতারা পূর্বে আওয়ামী লীগ থেকে বিভিন্ন সুবিধাদি প্রাপ্ত। এবং একটা সময়ে সেসব সুবিধা ভোগের পর আওয়ামী লীগ তাদের সরিয়ে দিয়েছে অথবা নিজেরা সরে গেছেন। এরপর থেকে তাদের রাজনীতির প্রধানতম লক্ষ্য আওয়ামী লীগ বিরোধিতা এবং সেটা দিবালোকের মত স্পষ্ট। আর বদরুদ্দোজা চৌধুরী নিজে বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন রাজনীতিবিদ এবং একটা সময়ে বিএনপির মনোনয়নে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেও সেই দলের কারণেই তাকে সে পদও ছাড়তে হয়। তবে বিএনপি তার প্রতি নানা অবিচার আর অসম্মান করলেও এখনও তিনি বিএনপির প্রতি দুর্বল।

দেশে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এই দুই দলের দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা শক্তিমান হওয়ার কারণে দু'দলের যেকোনও একদলে আশ্রয় নিতে হয় অধিকাংশকেই। সে হিসেবে তার প্রতি বিবিধ অবিচার করা হলেও বি চৌধুরী বিএনপিকে ছাড়তে পারেন নি। ডানধারার রাজনীতিতে হাতেখড়ি হওয়া তার পক্ষে আওয়ামী লীগের প্রতি হেলে যাওয়ার সুযোগ সামান্যই। তাই বিএনপি যাই করুক না কেন বিএনপি তাকে ছাড়লেও তিনি দলটিকে ছাড়তে পারছেন না। আ স ম আব্দুর রব জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) একাংশের প্রধান। পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনার পর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ফের ক্ষমতায় আসার পর তিনি সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন। এরপর একটা সময়ে আওয়ামী লীগ ও তার মধ্যে দূরত্বের সৃষ্টি হয়। জাসদ অপর অংশের নেতা হাসানুল হক ইনুকে কাছে নিয়ে আসলে আরও দূরে সরতে থাকেন রব; এবং দলীয় শত্রু-খণ্ডাংশের বন্ধুকে নিজের শত্রু হিসেবেও জ্ঞান করতে শুরু করেন। মাহমুদুর রহমান মান্না আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন কিন্তু একটা সময়ে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, এমনকি সরকারের বিরুদ্ধে নাশকতার পরিকল্পনা করেন বলেও অভিযোগ ওঠে। এনিয়ে জেলেও যেতে হয় তাকে।

ড. কামাল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে দূরে সরতে সরতে একটা সময়ে গণফোরাম নামের একটা পৃথক রাজনৈতিক দল গঠন করেন, এবং তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও আওয়ামীবিরোধিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

এ নেতাদের রাজনীতি দীর্ঘদিন থেকে আওয়ামী লীগের বিরোধী শিবিরে। পাঁচ বছর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট যখন সরকার পতনের লক্ষ্যে পেট্টোলবোমা-নাশকতার রাজনীতি করছিল, তখন একা আওয়ামী লীগ সরকারকেই এ দুঃসহ পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে হয়েছে। ওই সময়েও তারা সে সব নাশকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন নি। উলটো সরকারের নাশকতা দমনের লক্ষ্যে চালিত বিভিন্ন পদক্ষেপের সমালোচনা করেছেন। আওয়ামীবিরোধিতাই যে তাদের প্রকৃত লক্ষ্য সে নিয়ে তাই কোন প্রশ্ন নাই।

এই নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যের কথা বলছেন, এবং সেটা জাতীয় ঐক্যের নামে, কিন্তু জাতীয় ঐক্য যারা গড়তে চাইছেন তারা আগে থেকেই একটা পক্ষের বিপক্ষে। এই পক্ষ হচ্ছে সরকারপক্ষ। তাই তাদের জাতীয় ঐক্যের ধারণাটিকে জাতীয় ঐক্য বলা যায় না। কারণ তারা নিজ থেকেই সরকারকে এই ঐক্যের বাইরে রেখেছেন, অথবা ঐক্যের মধ্যে আনতে চান নি।

যুক্তফ্রন্টের দাবিকৃত জাতীয় ঐক্য তখনই জাতীয়ভাবে সমাদৃত হতো যখন তারা এই প্রক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ ও শরিক দলগুলোকে একই প্ল্যাটফরমে নিয়ে আসতে চাইত। কারণ তারা স্বীকার করুক কিংবা নাই করুক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল এবং তাদের বৃহৎ এক ভোটারশ্রেণি রয়েছে। এই বিশাল ভোটারশ্রেণিকে বাইরে রেখে কীভাবে জাতীয় ঐক্য হয়? এটা বড়জোর সরকারবিরোধী ঐক্য, জাতীয় ঐক্য নয় কোনোভাবেই।

যুক্তফ্রন্ট যারা গঠন করেছেন তাদের লক্ষ্য আওয়ামী লীগকে হটিয়ে নতুন সরকার। কী পরিকল্পনা তাদের এনিয়েও কিছু জানায়নি তারা। ফলে এই জোট উদ্দেশ্যবিহীন। দেশশাসনের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নাই যাদের তারা কীভাবে আশা করে সরকার গঠনের? এছাড়া এই জোটের নির্দিষ্ট ক'জন ব্যক্তি ছাড়া সারাদেশে কী কোন নেতা-কর্মী-সমর্থক আছে? উত্তর- নাই! তাহলে? আর যারা কেন্দ্রে বিভিন্ন আলোচনা সভা আর সংবাদ সম্মেলনে বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছেন তারাও বা কতটুকু জনসম্পৃক্ত- এটাও প্রশ্নসাপেক্ষ। এই জোটের নামে নেতাদের কেউ যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করে তাহলে তাদের সম্ভাবনাই বা কতখানি? এসব ব্যাপারও আলোচনার দাবি রাখে, মূল্যায়নের দাবি রাখে।

যুক্তফ্রন্ট নামের জোট গঠনের পর তাদের কয়েকটি আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছেন বিএনপি নেতারা। ফলে ধারণা করাই যায় এই জোট আদতে বিএনপির একটা শাখা হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী। অথচ তারা জাতীয় ঐক্যের নামে শুরু করেছিল। যদি বিএনপির ২০ দলীয় জোটের সাথে তারা ঐক্য করে নির্বাচনে অংশ নেয় তবে মূল দল বা জোট হবে কোনটা? কারা এক্ষেত্রে আসন ভাগাভাগিতে মুখ্য ভূমিকায় থাকবে? যুক্তফ্রন্ট কি বিএনপির সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করবে, নাকি বিএনপি যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে আসন ভাগাভাগি করবে? সেক্ষেত্রে কে কত আসন পাবে?

বিএনপি ও যুক্তফ্রন্টের ঐক্য হলে বাস্তবতা বিবেচনায় মূল দলের ভূমিকায় থাকবে বিএনপি। ফলে এই জাতীয় ঐক্য এক ফাঁপা বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। মিডিয়ায় কভারেজ পাওয়া বড় বড় নেতারা ও তাদের জোট মূলত নামসর্বস্ব এক জোটে কিংবা খণ্ডাংশে পরিণত হবে।

আগামীর সরকার নিয়ে যুক্তফ্রন্টের বাস্তবতাভিত্তিক কোনও কর্মসূচি না থাকলেও ওই জোটের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না জানিয়েছেন, তারা অন্তত দুই বছর ক্ষমতায় থাকতে চান। বিএনপির সঙ্গে ঐক্য হচ্ছে এটা ধরে নিয়েই তিনি একথা বলছেন। তার দাবি, দেশে সুশাসন নিশ্চিত করতে এই দুইবছর তারা ক্ষমতা চান। অর্থাৎ বিএনপির সঙ্গে তাদের জোট হয়ে নির্বাচিত হলে তারা বাকি তিন বছর বিএনপিকে দিতে চান। সরকারে এই ভাগাভাগি বিএনপি কতখানি মানবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না, তবে এর আগে তারা বিএনপির কাছে কত সংখ্যক আসন চান এবং পান সেটাও দেখার বিষয়।

যুক্তফ্রন্ট-বিএনপির ঐক্য হলে এটা আদতে বাংলাদেশের রাজনীতির কোন পরিবর্তন করবে না। দুর্নীতির মামলায় বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে রয়েছেন। এছাড়া খালেদা জিয়ার অবর্তমানে বিএনপি গঠনতন্ত্রের পরিবর্তন এনে যাকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বানিয়েছে সেই তারেক রহমান বাংলাদেশের একাধিক আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত এবং আইনের দৃষ্টিতে তিনি পলাতক আসামি। নিকট ভবিষ্যতে তার দেশে ফেরার সম্ভবনাও কম। এই মামলাগুলো বাদেও তিনি বিতর্কিত 'হাওয়া ভবন'-এর কর্ণধার, এবং নানা কারণে চরমভাবে বিতর্কিত। এই বিতর্কিত একজনকে নেতৃত্বে রেখে যুক্তফ্রন্টের সুশাসন ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলাটা রীতিমত স্ববিরোধিতা।

বিএনপির ২০ দলীয় জোটের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীসহ এমন অসংখ্য দল রয়েছে যাদের নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন নেই। এমন অনেক দল রয়েছে যাদের নাম পর্যন্ত অনেকেই জানে না। আগে থেকেই তারা ভোটের মাঠে কোনরূপ প্রভাব বিস্তার করতে পারে না, পারার কথাও না। এই দলগুলোর সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট নামের জোট অন্তর্ভুক্ত হলে সেটা আগের অবস্থার কোন পরিবর্তন আনতে পারবে বলে মনে হয় না। ভোটের মাঠের এই হিসাবেই বাইরে এই অন্তর্ভুক্তিতে লাভ যে একেবারে নাই, তা নয়। লাভ আছে, তবে সেটা স্রেফ মিডিয়া কাভারেজের ক্ষেত্রেই।

তাই যতই ঢাকঢোল পেটানো হোক না কেন, কেবল আলোচনায় থাকা ছাড়া যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক কোন সম্ভাবনা আদতে নাই। জাতীয় ঐক্য তাই কেবল ফাঁপা বুলি। সরকারি দল আওয়ামী লীগ, তাদের শরিক দলগুলো ও আওয়ামী লীগের বর্তমান মিত্র হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিও আসবে না এই জাতীয় ঐক্যে; ফলে জাতীয় ঐক্যের নামে যে আলোচনা হচ্ছে তা মূলত আওয়ামী লীগবিরোধী জোট। স্রেফ সরকারবিরোধী কিছু দল আর জোটকে নিয়ে 'জাতীয় ঐক্যের' নামে যে জোট গঠনের চেষ্টা চলছে সেটা কোনোভাবেই 'জাতীয় ঐক্য' নয়; এটাকে বড়জোর সরকারবিরোধী ঐক্য বলা যেতে পারে, জাতীয় নয়। এই জোট আলোচনায় না থাকা নামে বৃহৎ কতিপয় রাজনৈতিক নেতার আলোচনায় আসা ছাড়া আর কিছু নয়, তাদের রাজনৈতিক সম্ভাবনাও তাই শূন্য!