নভেল গবেষণা, নোবেল প্রাইজ এবং আমাদের প্রত্যাশার ফানুস

মোহাম্মদ আব্দুল বাছিত
Published : 21 Sept 2018, 04:02 PM
Updated : 21 Sept 2018, 04:02 PM

বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় রেখে ভারতীয় উপমহাদেশের গবেষণা নিয়ে নিজের কিছু অনুভূতি লেখার তাগিদ বেশ কিছুদিন থেকে অনুভব করছি। ইদানিং বাংলাদেশে কিছু সেমিনার, কনফারেন্স কিংবা ব্যক্তিগত আলোচনায় গবেষণালব্ধ ফলাফলের বাস্তব প্রয়োগ এবং সেখান থেকে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার নানা পরামর্শ শুনি। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, আজকাল গবেষণায় বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, সাধারণ মানুষ এর সুফল কোথায় পাচ্ছে? বরাদ্দ যখন দেয়া হচ্ছে, স্বভাবতই জবাবদিহিতার প্রশ্ন আসবেই, আসাটাই স্বাভাবিক।

একটু স্পেসিফিকেলি বলছি, আমি মূলত মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণা নিয়ে আলোচনা করছি। আমাদের দেশে মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণা দুই ধরনের, এক পক্ষ নিজের প্রমোশন পেতে যতটুকু লাগে ঠিক ততটুকু করেন, উনারা আলোচনার বাইরে, অন্যপক্ষ অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে কিছু গবেষণা করেন, আলোচনাটা মূলত ওই ধরনের গবেষণা নিয়ে।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু লোখার জন্য একটু পেছনে ফিরে যাচ্ছি। সময়কাল ২০০৬, ভারতের বিখ্যাত বিজ্ঞানী, প্রফেসর রাও (C N R Rao) এর সাথে ভাগ্যক্রমে দুইবার দেখা, তার তিনটি লেকচার শোনা, অন্তত তিন সপ্তাহ প্রতিদিন কিছু না কিছু আলাপ শোনা, কখনো কখনো আলাপে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছিল।  আমি তখন বুয়েটে সদ্য যোগদান করা একজন লেকচারার। প্রফেসর রাও এর সাথে ওই তিন সপ্তাহ আমার জন্য অনেক স্বপ্ন  এবং উচ্চাশার মুহূর্ত ছিল ।  যারা প্রফেসর রাও কে চেনেন না, তাঁদের জন্য বলছি, রাও এই পর্যন্ত প্রায় সতেরশ জার্নাল পেপার, পঞ্চাশোর্ধ্ব বইয়ের অথর, তার সাইটেসন লক্ষাধিক (http://www.jncasr.ac.in/cnrrao/index.html)

তার সাথে আমার প্রথম কথা হয়েছিল, ইটালির আইসিটিপি (ICTP) তে, পরেরবার তার উদ্যোগে বেঙ্গালুরে। আমার মতো একজন লেকচারারের ইমেইলের রিপ্লাই তিনি দিতেন এবং একবার আমার জন্য তার লেখা দুইটি বই উপহার পাঠিয়েছিলেন। যাই হোক আমার কাছে সবসময় মনে হয়েছে তিনি খুব অমায়িক এবং মানবিক একজন বিজ্ঞানী। প্রফেসর রাও এর লেখা প্রায় শ খানেক আর্টিকেল ওই সময় আমি পড়েছি, তার অনেক ছাত্রের সাথে আমার ব্যক্তিগত আলাপ হয়েছে, মোটা দাগে তাদের গবেষণার একটি অংশ আমার জানা হয়েছিল। ওই সময় ভারতের কিছু মানুষের এমন একটি ধারণা ছিল যে, প্রফেসর রাও নোবেল প্রাইজ পেতে যাচ্ছেন।

আমি তখন গবেষণার এ বি সি ডি শিখতেছি, তথাপি আমি বুঝতে পারছিলাম 'জেএনসিএএসআর' (JNCASR) এবং 'আইআইএসসি' (IISc) এর গবেষকরা অনেক ক্ষেত্রে অন্য গবেষকের আইডিয়া এক্সপানড করেন, তাদের শত-শত ছাত্র রয়েছে, প্রাসঙ্গিক বিষয়ে নভেল বা নব উদ্ভাবন গবেষণাকে বিভিন্নভাবে এক্সপানড করে তারা অনেক ভালো রেজাল্ট পান এবং তাদের গবেষণা নেচার সাময়িকী পর্যন্ত পাবলিশ হয়। তবে যেহেতু ওই রকম কোনো নভেল আইডিয়া প্রফেসর রাও এর গ্রুপ কিংবা ওইখানকার অন্য কোন গ্রুপ দিতে পারে নাই, তাই অদ্যাবধি নোবেল প্রাইজ তাদের অধরা। ওই সময় প্রফেসর রাও এর মুখ থেকেই শুনেছি, 'নোবেল প্রাইজ ছাড়া আমি সব প্রাইজই পেয়েছি', কথাটির মাঝে এক ধরনের আক্ষেপ ছিল। কয়েকজনের কাছে আরও একটি কথা শুনছিলাম, সত্য মিথ্যা জানি না, সিরামিক ম্যাটেরিয়ালসে সুপার কনডাকটিভিটি আবিষ্কারের ঘোষণা আসার পর প্রফেসর রাও নাকি তার ল্যাবে তাৎক্ষণিক এটি ডেমন্সট্রেইট করে দেখিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন এটি তিনি আগেই অবজার্ভ করেছেন ।

১৯৮৭ সালে 'superconductivity in ceramic materials' এর জন্য নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয়। আমি খুব ছোট মানুষ, এত বড় একজন বিজ্ঞানীর বিষয়ে কিছু মন্তব্য করা আমাদের সংস্কৃতিতে অনেকটাই ধৃষ্টতা; তথাপি বলছি, প্রফেসর রাও যদি এটি সত্যি সত্যি আগে অবজার্ভ করে থাকেন, তবে এইখানেই উপমহাদেশের মানুষের বিশেষ দুর্বলতা। বিজ্ঞানে যুগান্তকারী কিছু পাওয়ার জন্য পার্টিকুলার বিষয়ের প্রতি যে পরিমাণ কনসেট্রেসন দিতে হয়, এটি মনে হয় আমাদের রক্তে নেই। শুনেছি প্রফেসর রাও ছিলেন কংগ্রেস সরকারের বিজ্ঞান উপদেষ্টা, ভারতের রাজনীতি, অর্থনৈতিক উত্থান এবং সমাজ ব্যবস্থা নিয়ে তিনি ভাবেন এবং ভূমিকাও রাখেন। রাষ্ট্রের একজন বিজ্ঞানীর এহেন ভূমিকা রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক এবং আপাত দৃষ্টিতে এই ধরনের ভূমিকাকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তবে একজন বিজ্ঞানীর কাছ থেকে যদি রাষ্ট্র এই ভূমিকা প্রত্যাশা করে, তাহলে বিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ বা এরূপ কিছু পাওয়ার আশা ত্যাগ করতে হবে। অন্যথায় যুগান্তকারী কোনও আবিষ্কারের খুব কাছে থেকেও ওইটা বিজ্ঞানীর কাছে ধরা দিবে না, নেচার হয়তো এমন আচরণই পছন্দ করে।

সময়কাল ২০০৭। ওই বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে আমি গ্লাসগো ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি' র জন্য গবেষণা শুরু করেছি। আমার সুপাভাইজার জন চ্যাপম্যান  ম্যাগনেটিক ন্যানোস্ট্র্যাকচার নিয়ে কাজ করেন, তার বন্ধু ফরাসি বিজ্ঞানী আলবার্ট ফার্ট ১৯৮৮ সালে জায়ান্ট ম্যাগনোটোরেজিস্ট্যান্স আবিষ্কার করেন (http://www2.cnrs.fr/en/338.htm) । ২০০৭ সালে আলবার্ট ফার্ট এবং পিটার গুয়েনবার্গ জায়ান্ট ম্যাগনোটোরেজিস্ট্যান্স আবিষ্কারের জন্য পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। আমি বেশ আগ্রহে নিয়ে আলবার্ট ফার্ট এর কিছু পেপার পড়লাম, ২০০৯ সালে জার্মানিতে প্রফেসর ফার্ট এর সাথে একটি কনফারেন্সে দেখা হল, জন চ্যাপম্যান  এর ছাত্র হিসেবে পরিচিত হলাম।

একদিন লাঞ্চ টাইমে বিল্ডিঙের পাশে একটি হাফওয়ালে বসে আমি লাঞ্চ করছি, সম্ভবত একটি বার্গার সাথে একটা সফট ড্রিংক। একটু পর দেখি আমার পাশেই প্রফেসর আলবার্ট ফার্ট, প্রায় চল্লিশ মিনিট আমরা কথা বললাম। ম্যাগনেটিকস এবং তার আনুষঙ্গিক বিষয় ছাড়া নিখিল বিশ্বের অন্য কোনও বিষয়ে তার তেমন কোন আগ্রহ রয়েছে বলে আমার মনে হয় নি। ওই কনফারেন্সের একটি সেশনে আয়রন আর নিকেলের ট্রান্সপোর্ট প্রপার্টির উপর কয়েকটা পেপার প্রেজেন্ট হয়েছিল, ওই কাজগুলির  ধারণা এসেছিল ১৯৭০ সালে আলবার্ট ফার্ট এর পিএইচডি থিসিসে।

ঊনচল্লিশ বছর পরেও ওই পিএইচডি থিসিসে উল্লেখিত কাজের আইডিয়া নিয়ে আমার মতো অনেকে পিএইচডি করছিলেন তখন। পাঠক হয়তো বুঝতে পারছেন নভেল আইডিয়া আর নোবেল প্রাইজ কোথায় ধরা দেয়! প্রফেসর  ফার্ট এর সাথে আরও একবার দেখা হয়েছিল ইংল্যান্ডে। প্রতি মুহূর্তে মনে হয়েছে ফার্ট খুবই ফোকাসড, বিষয়ের প্রতি হাইলি কনসেনট্রেটেড, ধ্যান-জ্ঞান একমুখি। ইউরোপের একজন  ফার্ট এর সাথে উপমহাদেশের রাও এর এখানেই সম্ভবত বিশেষ পার্থক্য। ইউরোপের বিজ্ঞানীরা সহজেই  কনসেনট্রেটেড হতে পারেন, কেননা প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে পত্রিকা খুলেই তাদের হয়তো পড়তে হয় না রাজনৈতিক হানাহানির কিংবা সড়ক দুর্ঘটনায় অপমৃত্যর খবর, দেখতে হয় না ক্ষমতার অপব্যবহার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নোংরা রাজনীতির হাল-চিত্র, যত্র -তত্র অহেতুক উম্মাদনা কখনোই ওইখানে নিত্য দিনের বিষয় না। বিরূপ পরিবেশে বসবাস, অনুন্নত গবেষণা সংস্কৃতি নভেল গবেষণায় অবশ্যই এক ধরনের হুমকি স্বরূপ আর তা না হলে অন্তত আইআইএসসি এর মতো জায়গা যেখানে সমস্ত ফ্যসিলিটি বিদ্যমান, ভালো ভালো ব্যাকগ্রাউন্ডের প্রফেসররা কর্মরত ওইখানে কেন এখন পর্যন্ত নভেল আইডিয়া আর নোবেল প্রাইজ আসবে না? অত্যন্ত দুর্বল ডায়াম্যাগনেটিক সিগন্যাল পাওয়া সত্ত্বেও আইআইএসসি এর মতো জায়গা থেকে দেব কুমার থাপা আর আনসু পান্ডে ন্যানোস্ট্র্যাকচারড Au-Ag সিস্টেমে ২৩৬ ডিগ্রি কেলভিনে সুপারকন্ডাক্টিভিটি আবিষ্কারের দাবি করে করে নিজ দেশেই সমালোচিত হন, অন্তত এই শতাব্দীতে এইগুলো ভালো লক্ষণ না।  কেউ কেউ সি ভি রমণ, কিংবা এস এন বসুর উদাহরণ দিতে পারেন, প্রায় একশত পঞ্চাশ কোটি মানুষের বসবাস যে অঞ্চলে ওইখানে শতবর্ষ পূর্বের দুই একজনের উদাহরণ শুধুই একটি ব্যতিক্রম, কেবল তর্কের উদাহরণ।

এইবার আসি আমাদের প্রসঙ্গে। খুব মজার একটি বিষয় দিয়ে শুরু করি। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সময়ের এক সিনিয়র, পরবর্তীতে শিক্ষক, অসম্ভব মেধাবী একজন মানুষ, তাকে নিয়ে প্রায়ই একটি আলোচনা শুনতাম। অনেকেই বিশ্বাস করতেন তিনি নোবেল প্রাইজ পেতে যাচ্ছেন, দুই একজন অধ্যাপককেও বলতে শুনেছি তার নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির বিষয়ে। শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারি নাই। ওই সিনিয়র ভাইয়ের পিএইচডি সুপারভাইজার আর আমার সুপারভাইজার ছিলেন জন চ্যাপম্যান, তাই তার ওই বাংলাদেশি ছাত্রের বিষয়ে জানতে না চেয়ে জন-কেই একদিন জিজ্ঞেস করে বসলাম, 'জন, ডু  ইউ এভার এক্সপেক্ট এ নোবেল প্রাইজ ইন ফিজিক্স'। তার সরাসরি উত্তর ছিল, 'নো, নেভার'।

জানতে চেয়েছিলাম গ্লাসগো থেকে কেউ কি নোবেল প্রাইজ পেতে পারে?  জন বলেছিলেন- পেলে গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ ডিটেকশন গ্রুপ  পেতে পারে। পরবর্তীতে দেখলাম গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ ডিটেকশন নিয়ে পিআরএল (PRL) এ যে পেপার প্রকাশ হয়েছিল ওইখানে গ্লাসগোর বিশ জনের মতো অথর রয়েছে। কাজেই নোবেল প্রাইজ কিসে আসতে পারে, কারা পেতে পারেন তা সায়েন্টিফিক কম্যুনিটির অনেকেই আগে থেকে ধারণা করতে পারে, কেননা এই ধরনের গবেষণা হঠাৎ  স্বপ্নে পাওয়া যায় না, বিজ্ঞানে দৈবাৎ কোনও দুর্ঘটনা ঘটে না। অসম্ভব মেধাবী হয়ে অসম্ভব মেধার চর্চা যিনি করেন, সমস্ত একাগ্রতা দিয়ে একটি বিষয়ে ফোকাস করতে পারেন,  অনুকূল পারিপার্শ্বিক সংস্কৃতিতে যিনি বেড়ে উঠেন তার কাছেই নভেল আইডিয়া আসে।

২০০৫ সালে আমি বুয়েটে যোগদান করি, শ্রদ্ধেয় মরহুম মমিনুল হক স্যারের তত্বাবধায়নে আমি একটি মাস্টার্স ডিগ্রি করি। মমিনুল হক স্যার যে কত ভালো ফিজিক্স পড়াতেন, কত ভালো ফিজিক্স বুঝতেন তা তার আন্ডারগ্র্যাজুয়েট এবং পোস্টগ্র্যাজুয়েট লেভেলের ছাত্ররাই জানে । স্যার তখন বুয়েটের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে সলিড স্টেট ফিজিক্স ল্যাব তৈরি করেন, যদিও যন্ত্রপাতি বলতে তেমন কিছু ছিল না। ২০০৪-২০০৫ সালের দিকে স্যারকে দেখতাম ম্যাগনেটিজম বিষয়ে ইন্ডিয়ান জার্নাল অব ফিজিক্সে একটি পেপার পাবলিশ করতে পেরেই অনেক খুশি হতেন।

একবার আমি বেঁকে বসে বললাম, 'স্যার, আমরা ভালো জার্নালে ট্রাই করি, আর ইন্ডিয়ান জার্নালে না'। স্যার হাসি দিয়ে বললেন, 'আমাদের কী আছে, কী দিয়ে ভালো জার্নালে ট্রাই করবা?'

বললাম স্যার, 'আমার কিছু মানুষের সাথে জানাশোনা হয়েছে, কিছু এক্সপেরিমেন্ট বিদেশ থেকে করানো যাবে।' ওইভাবেই আমরা একটি ড্রাইভ দেয়ার চেষ্টা করলাম। ২০০৭ সালে ম্যাগনেটিক ম্যাটেরিয়ালস নিয়ে কিছু গবেষণা করে আমরা এলসেভিয়ার সায়েন্স এর দুইটি জার্নালে এবং ওয়ার্ল্ড  সায়েন্টিফিক এর একটি জার্নালে মোট তিনটি পেপার পাবলিশ করলাম। এই ঘটনাটির অবতারণা করলাম শুধু ওই সময়ের প্রেক্ষাপট বুঝাতে। এই মুহূর্তে আমাদের অবস্থার বেশ উন্নয়ন হয়েছে, গবেষণায় বরাদ্দ আগের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। তথাপি প্রশ্ন থেকে যায়, এই উন্নয়ন এবং গবেষণা বরাদ্দ বৈশ্বিক স্কেলে কতটুকু? ভারতের সাথে তুলনা করলেও আমরা অনেক পিছিয়ে রয়েছি, এটাই বাস্তবতা।

আমাদের মেধা নিয়ে প্রশ্ন কেউ তুলবে না। তোলে না, কারণ আমাদের ছাত্ররা, এই দেশের মানুষেরাই বিদেশে ইতিহাস পালটে দেন, প্রিন্সটনের মো: জাহিদ হাসান, ওল্ড ডমিনিয়ন ইউনিভার্সিটির মোহাম্মদ আতাউল করিম, ইউসি বার্কলের সাইফ সালাউদ্দিনের মতো অনেকেই রয়েছেন যারা এই দেশেরই মানুষ। তারা শুধু ভালো গবেষণা করেন না, নভেল আইডিয়া সৃষ্টি করে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। তাহলে এইখানে, এই দেশে সমস্যা কোথায়? শুধুই কি ফ্যাসিলিটির অভাব, না, কখনোই না।

পর্যাপ্ত ফ্যাসিলিটি সরবরাহ করলে বর্তমান অবস্থান থেকে উন্নয়ন হবে নিঃসন্দেহে, তবে নভেল আইডিয়া পেতে হলে, নোবেল প্রাইজ ডিজার্ভ করার মতো গবেষণা করতে হলে ফ্যাসিলিটির সাথে সাথে গবেষণা সংস্কৃতির উন্নয়ন অত্যাবশ্যকীয়। একজন  বিজ্ঞানীকে একটি বিষয়ে ফোকাসড থেকে সম্পূর্ণ একাগ্রতা দিয়ে তার গবেষণায় মনোনিবেশ করার জন্য দেশে  রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনীতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, বিশ্ববিদ্যালয়ে সুন্দর পরিবেশ, অবকাঠামোগত  উন্নয়ন এইসব কিছুও অপরিহার্য উপদান । হ্যাঁ একটু একটু করে আমরা গবেষণায় উন্নতি করছি, তবে এখন পর্যন্ত মৌলিক বিজ্ঞানে আমাদের সফলতা (দুই একটি ব্যতিক্রম বাদে) মাঝারি মানের কিছু জার্নালে কিছু সায়েন্টিফিক আর্টিকেল পাবলিশ করা পর্যন্ত। নিজের সক্ষমতা, অক্ষমতা, বাস্তবতা বোঝা এবং পরবর্তী প্রজন্মকে বোঝানোটাও আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

মৌলিক বিজ্ঞানে এবং তার প্রায়োগিক ব্যবহারে কিছু আবিষ্কারের দাবি করতে হলে সুস্পষ্ট গাণিতিক বিশ্লেষণ কিংবা বিশুদ্ধ এক্সপেরিমেন্টাল প্রমাণ দিতে হবে। অন্যথায় এমন দাবি শুধু মুহূর্তের হুজুগ তৈরি করবে।

হোমার তার মহাকাব্যে হেলেনের রূপের কোনও বর্ণনা দেন নাই, অনির্বচনীয় রেখেছেন তার অনিন্দ্য সুন্দরীকে, পারিপার্শ্বিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া থেকে আমরা হেলেনের রূপ কল্পনা করি। শুধু আমরা সাধারণ মানুষই না, হোমারের আড়াই হাজার বছর পরেও ইংরেজ কবি টেনিসন স্বপ্নে দেখেন অগ্নিরূপি হেলেনকে। এমন অলীক স্বপ্ন কাব্যে সম্ভব, কখনোই বিজ্ঞানে নয়, বিজ্ঞান বড়ই নিষ্ঠুর।

(আমার কথাগুলি যেন খুব দ্রুত ভুল প্রমাণিত হয়। আমরা যেন নভেল গবেষণা করে নোবেল প্রাইজ পাই।)