একজন তসলিমা নাসরিন

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 20 Sept 2018, 12:35 PM
Updated : 20 Sept 2018, 12:35 PM

বাংলাদেশে ১৯৮০ এর দশকের শেষ সময় থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত একটানা ক্রমশ আলোচিত, সমালোচিত, প্রশংসিত যদি কারো নাম বলতে বলা হয় তিনি নি:সন্দেহে তসলিমা নাসরিন। বাংলাদেশে, বিশেষত মধ্য এবং উচ্চবিত্তদের মাঝে তসলিমা-নিরপেক্ষ কোনও ব্যক্তি আছেন কিনা সন্দেহ; সবাই হয় তসলিমার পক্ষে নয়তো বিপক্ষে। তবে, এখন পর্যন্ত বেশিরভাগের কাছেই তিনি নন্দিত নন, বরং নিন্দিত।

বর্তমানে জীবিত তিনজন বাংলাদেশির নাম যদি বলতে বলা হয় যাদের পরিচিতি জাতীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রয়েছে তাঁদের একজন নিঃসন্দেহে তসলিমা নাসরিন। বাকি দু'জন হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউনূস। কেউ তাঁদের পছন্দ করুন বা নাই করুন, এটা অস্বীকার করবার জো নেই যে, ভিন্ন ভিন্ন ক্ষেত্রের এ তিনজনের নামেই বিশ্ববাসী বর্তমান বাংলাদেশকে চিনে থাকে। এ বিষয়টা যারা দীর্ঘসময় দেশের বাইরে বসবাস করছেন তাঁদের কাছে আরো স্পষ্ট।

সেই তিনজনের একজন তসলিমার শুরুটা হয়েছিল সেই আশির দশকে, মফস্বলের একজন কবি হিসাবে। মফস্বলের কতজনই তো কবিতা লিখেন, কতজনই তো কবি হতে চান। আশির দশকটাই যেন ছিল কবি হবার তাড়নার যুগ, যেন কবি হতে পারলেই জাতে ওঠা যায়।

এমনকি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেও সামরিক শাসক এরশাদ জাতে উঠতে পেরেছেন মনে করতে পারছিলেন না। তাই তিনিও শুরু করলেন কবিতা লেখা। তবে নিন্দুকেরা বলতেন একজন সচিব, যিনি ইমরান নুর নামে কবিতা লিখতেন, তিনিই নাকি এরশাদের কবিতা লিখে দিতেন। এমনকি এ কবিতা লেখকদের তালিকায় আরো যাঁদের নামে রটনা এসেছিল তা থেকে বাদ পড়েন নাই, সৈয়দ আলী আহসান এবং আলাউদ্দিন আল আজাদও।

এরশাদই হলেন বাংলাদেশের একমাত্র 'কবি' যার কবিতা দেশের প্রত্যেকটি সংবাদপত্রে ছাপা হত। এরশাদের এ 'কবি প্রতিভাকে' কটাক্ষ করে তখন কবি মোহাম্মদ রফিক লিখেছিলেন 'সব শালাই কবি হতে চায়'। তবে, ক্ষমতা হারাবার পর আরো অনেক কিছুর সাথে তাঁর এ কবিতা 'প্রতিভারও' বিলুপ্তি ঘটে।

তসলিমা নাসরিনের কবিতা যখন ঢাকার কাগজগুলোতে টুকটাক প্রকাশিত হচ্ছিল এবং তা যখন দু'চারজন বড় কবির নজরে এসেছিল তখন তারা একে নিজেদের উন্নাসিক মানসিকতার জন্য আর দশজন 'মফস্বল কবির' মতো  তসলিমারও জাতে উঠবার প্রচেষ্টার বাইরে কিছু ভাবতে পারেননি।

সহসাই কবিতার পাশাপাশি তসলিমা লেখা শুরু করলেন কলাম। বিষয়টা প্রথম প্রথম এমনই ছিল, কলাম তো কতজনই লেখে, সেখানে মফস্বলের এক অখ্যাত নারীর কলাম পড়ার আর কী আছে! কেউ কেউ একটু ভ্রু কুঁচকে অবাক হতেন অজপাড়া গাঁয়ের নারী লিখছে, এটা ভেবে।

তসলিমা যখন কলাম লেখা শুরু করেন, তখন নারী কলাম লেখক প্রায় ছিল না বললেই চলে। যাদের চোখে তসলিমা নামটা পড়ত তাঁরা ভাবতেন, 'মেয়েমানুষ আর কী লিখবে, বড়জোর ঘরকন্না, স্বামী শ্বশুরের সেবা যত্নের বিষয়আশয়।'

সেসময় নারীরা মূলত এসব নিয়েই লিখতেন। হাতেগোণা যে কয়টা সংবাদপত্র প্রকাশ হত সেখানে 'মহিলাঙ্গন' বা এ ধরণের নামে সপ্তাহে একদিন এক পাতা বরাদ্দ থাকত। আর নারী বিষয়ক ম্যাগাজিন ছিল 'বেগম'। মধ্য এবং উচ্চ অনেক পরিবারেই 'বেগম' রাখা হত। এসব কিছুরই মূল সুর ছিল নারীকে কী করে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ঘরসংসার করতে হবে। ক্ষেত্র বিশেষে যারা চাকরি করেন তাঁদের প্রতি উপদেশ থাকত সবকিছু ঠিক রেখে, সবার যত্নআত্তি করে কীভাবে সংসার এবং চাকরি জীবন একইসাথে ঠিক রাখা যায়।

এর বাইরে উল্লেখ করবার মত নারী সংগঠন বলতে ছিল মহিলা পরিষদ। ন্যাপ (মো) এবং কমিউনিস্ট পার্টি করেন এমন অনেক নারী এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নারী মুক্তি, নারী স্বাধীনতা, নারী-পুরুষ সমঅধিকারের কথা এরা বলত; তবে তারা মনে করত এসব কিছু তখনই আসবে যখন বিপ্লব হয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে। মহিলা পরিষদ যারা করতেন তারা কোনও এক অদ্ভুত কারণে ধরে নিয়েছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে নারীর সমঅধিকার প্রতিষ্ঠা হয়ে গেছে। সুতরাং, বাংলাদেশকেও সে পথে হাঁটতে হবে। মানুষ তখন নারী বিষয়ক ভাবনা বলতে মূলত এসবই বুঝত।

মহিলা পরিষদের বাইরে ছিল আরো কিছু নারী সংগঠন। আর ছিল কিছু রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসাবে নারী সংগঠন। মহিলা পরিষদসহ কোন নারী সংগঠনই তখন পুরুষতান্ত্রিক পরিকাঠামো এবং মূল্যবোধ ভাঙার কথা বলত না। পুরুষতন্ত্র, নারীবাদ এসব প্রত্যয়ের সাথে সাধারণ মানুষের কোন পরিচয়ও ছিল না। দুই/তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান এসব বিভাগের কিছু ছাত্র/ছাত্রী আর শিক্ষকদের মাঝেই এসব প্রত্যয় সীমাবদ্ধ ছিল।

আকিমুন নাহার তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভে বেগম রোকেয়াকে 'পুরুষতন্ত্রের ছাঁচে' গড়া বলেছিলেন। তার কথা ধার করে এক কথায় বলা যায় তৎকালীন সময়ে নারী বিষয়ক পুরো ভাবনাচিন্তা সেরকম পুরুষতন্ত্রের ছাঁচেই সীমাবদ্ধ ছিল।

রাজনীতির অঙ্গন বলতে কিছু  ব্যতিক্রম বাদে পুরোটাই ছিল তখন পুরুষদের জগত। তবে, তসলিমা লেখালেখি শুরু করার কিছু আগে বাংলাদেশ তথা বিশ্ব রাজনীতিতে নারীর অংশীদারিত্বের ইতিহাসে ঘটে গেছে এক যুগান্তকারী ঘটনা। বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির শীর্ষ পদে আসীন হয়েছেন দুই নারী— শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়া। আজ পর্যন্ত বিশ্বের কোন দেশেই একই সাথে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পদে দেখা যায়নি কোনও নারীকে।

এর শুরুটা হয়েছিল শেখ হাসিনার হাত ধরে। শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিকভাবেও অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝে আওয়ামী লীগের প্রধান হতে হয় তাকে। শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং শ্রেণি নির্বিশেষে নানা মানুষের কাছ থেকে তাঁকে শুনতে হয় নানাবিধ টিপ্পনী। অনেকেই তখন তাঁর নেতৃত্বের বিষয়টাকে বাঁকা চোখে দেখত। একজন নারী একটি প্রধান দলকে নেতৃত্ব দিবেন বিষয়টা আমজনতার কল্পনার বাইরে ছিল।

সাধারণ জনগণ তো বটেই, শিক্ষিত মানুষরাও ভাবতেন নারীর কাজ মূলত স্বামী, সন্তান, সংসারের মাঝেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে ছিলেন মুষ্টিমেয় কিছু 'প্রগতিশীল' পুরুষ, যাদের কাছে নারীর স্বাধীনতা তসলিমার কবিতার ভাষায়  'উদার' পুরুষের নারীকে দেবার বা দান করবার বিষয়। অর্থাৎ,পুরুষ নারীকে স্বাধীনতা দেবে। পুরুষের মত স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করবার অধিকার যে নারীরও জন্মগত অধিকার এ ধারনা তখন সে অর্থে সমাজের অগ্রসর অংশের মাঝেও ছিল না।

ফলে, শেখ হাসিনা যখন রাজনীতিতে আসেন তখন তৎকালীন মুসলিম লীগের পাশাপাশি বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ব্যাপকভাবে বলতে শুনা যায় তিনি নারীর প্রধান কাজ অর্থাৎ স্বামীর সেবা আর সংসার বাদ দিয়ে রাজনীতিতে নেমেছেন। এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থক অনেকেও তখন এভাবে ভাবতেন। তবে, অবস্থার রাতারাতি পরিবর্তন হয়ে যায় যখন খালেদা জিয়া বিএনপির হাল ধরেন।

যে যেই রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিশ্বাস করুন একথা অস্বীকার করা যাবে না যে এ দেশে নারী সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা পরিবর্তনে তসালিমা নাসরিনের পাশাপাশি যিনি সচেতন বা আসচেতনভাবে বড় ভূমিকা পালন করেছেন তিনি হলেন খালেদা জিয়া। তিনি এমন এক সময় প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী হন, যখন জনমানসে কোন নারী  বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন সেটা ছিল অকল্পনীয় একটা ব্যাপার।

খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হবার পরপরই উড়িরচরে ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড় আঘাত হানে। তখন, এমনকি পাশ্চাত্যের উচ্চশিক্ষিত কাউকে কাউকেও মন্তব্য করতে শোনা গেছে যে এটা হল নারী নেতৃত্বের ফলে স্রষ্টার অভিশাপ বা গজব। প্রধানমন্ত্রী হিসাবে খালেদা জিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ নারী নেতৃত্ব সম্পর্কে এ ধরনের নেতিবাচক মিথকে ভেঙ্গে দেয় এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে একটি বড় ভূমিকা পালন করে।

এর পাশাপাশি, মৌলবাদের রাজনীতির সাথে নানাভাবে আপস এবং এর বিকাশে ভূমিকা পালন করলেও খালেদা জিয়া হলেন সেই নেত্রী যিনি ওয়াহাবী/মওদুদী আদর্শে বিশ্বাসী সকল 'ইসলামপন্থী' দাবীদার নেতৃত্বকে- যারা সব সময় নারী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার আছেন- তার নেতৃত্ব মেনে রাজনীতি করতে বাধ্য করেছেন।

তবে, তার সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে সামাজিক ক্ষেত্রে নারীদের সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা। আশি এমনকি নব্বই দশক পর্যন্ত বিধবা এবং বৃদ্ধারা সনাতন (হিন্দু) ধর্ম জাত সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সাদা শাড়ি পরতেন। কিন্তু, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হবার পর থেকে রঙিন শাড়ি পরা শুরু করেন যার ব্যাপক প্রভাব জনমানসে ইতিবাচকভাবে পড়ে, যা ক্রমশ বিধবা এবং বৃদ্ধাদের পোশাক সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা দৃষ্টিভঙ্গির গুণগত পরিবর্তন ঘটায়।

কিন্তু, তসলিমা যখন লেখা শুরু করেন তখন হাসিনা এবং খালেদা সবেমাত্র রাজনীতিতে এসেছেন। একটা আপাত: রক্ষণশীল সমাজে বসে তিনি নারীমুক্তি, নারী স্বাধীনতা নিয়ে এমন সব কথা লিখতে শুরু করেন যা আগে কেউ কখনো প্রকাশ্যে লেখেনি বা বলেনি। নারীর অধ:স্তনতার জন্য তিনি প্রথমে সরাসরি দায়ী করেন ইসলাম ধর্মকে এবং পরবর্তীতে সব ধর্মকেই।

তসলিমা শুধু দায়ী বা সমালোচনা করেই ক্ষান্ত থাকলেন না। তিনি নিজে যে সমাজে বাস করেন সে সমাজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝতে পারেন যে সারা বিশ্বের মুসলিমরাই কম বেশি তাদের নিজ ধর্মের বিষয়ে অতিমাত্রায় সংবেদনশীল। এর ফলে, খুব সহজেই ধর্ম নিয়ে সংবেদনশীল কথা বলে তাদের একটা বড় অংশকেই উত্তেজিত করে তোলা সম্ভব।

তসলিমা নিজেকে এক ধরনের লাইমলাইটে নিয়ে আসবার কৌশল হিসাবে ইসলামের এমন সমস্ত বিষয়য়ের দিকে ইঙ্গিত করতে শুরু করেন, যা অচিরেই জনগোষ্ঠীর একটা বৃহৎ অংশকে তার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তোলে। পাশাপাশি, তিনি এটাও মনে করেন যে নারী আন্দোলনের বিষয়টাকে চাঙ্গা রাখতে হলে তাঁকে সবসময়ই লাইম লাইটে থাকতে হবে, সেটা ইতি বা নেতি যেকোনওভাবেই হোক।

তৎকালীন সময়ে নারীমুক্তির একমাত্র কণ্ঠস্বর হিসাবে তসলিমা নিজেকে এবং নারী আন্দোলনকে একক ও অবিচ্ছেদ্য অংশ বা একে অপরের পরিপূরক বলে ভাবতে শুরু করেন। যার ফলে, তিনি মনে করেন তাকে কথায়, লেখায় সব সময় উচ্চকিত থাকতে হবে, যাতে সেটা সমাজে বিতর্ক তৈরি করতে পারে, মানুষকে ইতিবাচক বা নেতিবাচক যেকোনভাবেই হোক না কেন আন্দোলিত করতে পারে। জনমানুষকে আন্দোলিত করতে না পারলে, নারীমুক্তির বিষয়টা প্রান্তীয় অবস্থানে চলে যাবে। মানুষ আর এ বিষয়টা নিয়ে ভাববে না, যেমনটা তেমন করে ভাবেনি তসলিমা লেখালেখি শুরু করার আগে।

ইসলাম এবং অন্যান্য ধর্ম সম্পর্কে সমালোচনা বাংলাদেশে প্রথম তসলিমা নাসরিন শুরু করেননি। ব্রিটিশ আমলে যায়যায়দিন সম্পাদক শফিক রেহমানের বাবা তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের দর্শনের অধ্যাপক, সাইদুর রহমান ছিলেন এদেশে নাস্তিকতাবাদী চেতনা বিকাশের অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ্যেই নানা ধর্ম বা সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে সমালোচনা করতেন। পরবর্তীতে আহমদ শরীফও করেছেন। আরজ আলী মাতুব্বরও তার বইয়ে বিভিন্নভাবে ইসলাম ধর্মের সমালোচনা করেছেন এবং নিজে কেন নাস্তিক হয়েছেন তা সবিস্তারে বর্নণা করেছেন। কিন্তু, কেউই তাঁদের চিন্তাধারা গ্রন্থাকারে বা অন্যভাবে লিপিবদ্ধ করবার জন্য সে অর্থে লাইমলাইটে আসেননি বা ব্যাপক জনগোষ্ঠীকে আন্দোলিত করতে পারেননি। তাদের চিন্তাধারা মূলত কিছু পড়াশোনা করা মানুষজনের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল।

কিন্তু, তসলিমা উপরোক্ত চিন্তাবিদ বা পাশ্চাত্যের নানা মনিষী যেমন- কার্ল মার্কস এদের মত নাস্তিকতার সাথে মানবমুক্তি বা নারীমুক্তির যোগাযোগ এরকম অ্যাকাডেমিক ফর্মে আলোচনা না করে, ধর্ম নিয়ে চিন্তার প্রকাশে এবং ক্ষেত্র বিশেষে আচরণে নৈরাজ্যবাদীতার পথ ধরেন। যা কিনা দ্রুত একজন 'মফস্বলের মেয়ে'কে জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।

'ইসলামপন্থার' রাজনীতি করেন বলে যারা দাবি করেন তারাসহ সমাজের একটা বড় অংশ তসলিমার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। অবস্থা দ্রুতই যেন 'তসলিমা বনাম বাংলাদেশ' হয়ে উঠে। অনেকটা একই সময়ে ইরানের প্রয়াত আয়াতুল্লাহ খোমেনি 'স্যাটানিক ভার্সেস' লিখবার জন্য সালমান রুশদির মৃত্যুদণ্ড জারি করে যে তাঁকে হত্যা করতে পারবে তার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করেন। এর অনুকরণে ধর্মীয় 'মৌলবাদীরা' তসলিমার মাথার মূল্য ঘোষণা করে। এ ঘোষণা দ্রুত তসলিমাকে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত করে তোলে। সারা বিশ্বে তার নাম উচ্চারিত হতে থাকে সালমান রুশদির সাথে একই কাতারে।

জাতীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তসলিমার ব্যাপক পরিচিতি ঢাকার বুদ্ধিজীবী মহলের একটি বড় অংশকে করে তোলে তার প্রতি ঈর্ষান্বিত। অপরদিকে, ইসলামপন্থী বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর তসলিমা বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ এবং ফাঁসির দাবি তৎকালীন খালেদা জিয়ার সরকারকে করে তোলে অনেকটা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। জনগণের সামনে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে তসলিমাকে বিচারের মুখোমুখি করার সাহস বিএনপি সরকারের নেই। তাই তারা ১৯৯৪ সালে রাতের আঁধারে গোপনে তসলিমা নাসরিনকে দেশ থেকে বের করে দেয় অথবা তাকে দেশ থেকে বের হয়ে যেতে সহায়তা করে।

দেশ থেকে বের হয়ে যেয়ে তিনি ক্ষান্ত হননি বা গুটিয়ে নেননি। তিনি লিখতে থাকেন অবিরত। অনেকটা সব্যসাচী লেখকের মত কবিতা, গল্প, উপন্যাস এবং কলাম তো আছেই। কলামের পাশাপাশি তিনি নারীর মুক্তির জন্য সোচ্চার হয়ে উঠেন গল্প, কবিতা এবং উপন্যাসে। তার সব লেখার সারবস্তু থাকে কী করে নারীকে রাষ্ট্র এবং সমাজে পূর্ণ মানবিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা যাবে।

দেশে থাকবার মত  বাইরে এসেও নারীর বিষয় নিয়ে কথা বলবার সময় তসলিমা সেই সব শব্দ এবং বাক্য বেছে নেন যা সমাজে আলোড়ন তৈরি করবে। উদাহরণস্বরুপ বল যায়, 'নারীর গর্ভধারণ করবার স্বাধীনতা রয়েছে', এটা না বলে তিনি বলেন 'জরায়ুর স্বাধীনতা'। তিনি খোলাখুলিভাবে বলতে থাকেন নারীর যৌন স্বাধীনতার কথা। লিখতে থাকেন নারীর উপর নানা ধরণের যৌন শোষণ এবং নিপীড়নের কথা।

সেসময়টি নারীদের পক্ষে খোলাখুলিভাবে প্রিন্ট মিডিয়াতে যৌনতা নিয়ে কথা বলতে পারার বিষয়টি ছিল কল্পনাতীত। বস্তুত, নব্বই দশকেও যৌনতা শব্দটা উচ্চারণ করাটাই ছিল নারীর জন্য ট্যাবু বা নিষিদ্ধ। একজন নারী হিসাবে তসলিমা যখন নারীর উপর যৌন নিপীড়ন, শোষণের পাশাপাশি স্বাধীনভাবে একজন নারীর যৌন জীবন-যাপনের কথা বলেন তখন তার  অভিঘাত তখনকার রক্ষণশীল পুরুষতান্ত্রিক সমাজে হয় প্রবল।

কিন্তু, প্রশ্ন যেটা দাঁড়াচ্ছে তাহলো তসলিমা কি নারীবাদী আন্দোলনে নতুন কিছু বলেছেন? না, তিনি নারীবাদ, ধর্ম, ধর্মের সাথে নারী স্বাধীনতার সম্পর্ক ইত্যাদি কোন কিছু নিয়েই নতুন কিছু বলেননি। তিনি যেটা করেছেন তাহলো পাশ্চাত্যজাত নারীবাদী চিন্তাকে বাংলাদেশের মানুষের সামনে এমনভাবে তুলে ধরা যাতে সমাজে এর একটা তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। তিনি নারীমুক্তির প্রশ্নে সমাজে একটা আলোড়ন তুলতে চেয়েছিলেন, এবং এক্ষেত্রে কোনও সন্দেহ নেই তিনি অত্যন্ত সফল হয়েছিলেন।

তসলিমা যে আলোড়ন তুলেছিলেন সেটা বেগম রোকেয়া পারেন নাই তৎকালীন ঔপনিবেশিক সমাজ বাস্তবতার কারণে। এখানে উল্লেখ্য যে, তসলিমা নাসরিনের মত বেগম রোকেয়াও ধর্মকেই নারীমুক্তির প্রধান অন্তরায় হিসাবে দেখেছেন। তবে, তসলিমা বলতে চান নারীকে তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে হয় ধর্মকে ত্যাগ করতে হবে, নতুবা ধর্মকে সংস্কার করতে হবে।

তসলিমা নারীর উপর নিপীড়ন, শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার রয়েছেন কিন্তু এর থেকে উত্তরণের সুনির্দিষ্ট পথ কী তা নির্ধারণ করতে পারেননি। তিনি অনেকটা পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক নারীবাদী (Liberal feminism) যে ধারা, তা অনুসরণ করেছেন। এ অনুসারে তিনি মনে করেন নারী সংক্রান্ত নারী-পুরুষের যে ট্র্যাডিশনাল দৃষ্টিভঙ্গি সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই নারীর মুক্তি সম্ভব।

তসলিমার কাছে নারী একটি একক উপাদান। ফলে, তিনি নারীর উপরে পুরুষের শোষণ দেখতে পান। কিন্তু, তিনি উচ্চ শ্রেণীর নারী কর্তৃক নিম্ন শ্রেণীর নারী শোষণ অথবা এক জাতির নারী কর্তৃক আরেক জাতির নারীর উপর নিপীড়ন ব্যাখা করতে পারেন না। অর্থনৈতিক বা জাতিগত শোষণের চেয়ে নারীর উপর পুরুষের যৌন শোষণের স্বরূপ ব্যাখ্যা করতেই তিনি বেশি আগ্রহী।

তসলিমা সব ধরনের মৌলবাদী রাষ্ট্রের বিরোধী। তিনি সব ধরণের মৌলবাদকে নারীর অগ্রযাত্রার অন্তরায় মনে করেন। কিন্তু, গণতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক- একনায়কতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোতে নারীর অবস্থান কী এ বিষয়গুলোতে অনেকটাই নীরব থাকেন।

মৌলবাদী রাষ্ট্রের মত তসলিমা সব ধরণের সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধেও সদা সোচ্চার। তাই তিনি বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নিপীড়নের যেমন প্রতিবাদ করেন, তেমনি কাশ্মীরসহ ভারতে মুসলমানদের উপর নিপীড়নের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেন। তিনি যেমন প্যালেস্টাইনে ইসরাইলের ভূমিকার বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকেন আবার ইরাকে মার্কিন অভিযানেরও বিরোধিতা করেন।

তসলিমা মনে করেন যেখানেই বা যিনি অন্যায় করেন, তার প্রতিবাদ করতে হবে। প্রতিবাদ কোনও জীবিত বা মৃত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র, আইন, কানুন, ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম ইত্যাদি দেখে করলে হবে না। কোন কিছুর নামেই অন্যায়কে জায়েজ করা যাবে না বা ন্যায় বলা যাবে না। ব্যক্তিগতভাবে তিনি নাস্তিক হলেও তিনি মুসলমানসহ সব ধর্মের মানুষের ধর্ম পালনের অধিকারের কথা বলেন। তবে একই সাথে তিনি মনে করেন ধর্ম হলো ব্যক্তিগত ব্যাপার, রাষ্ট্র বা সমাজ কোনও ব্যক্তিকে কোনও ধর্ম পালনে বা না পালনে বাধ্য করতে পারবে না।

তসলিমা একাধারে কবি, সাহিত্যিক এবং কলাম লেখক। এর সবকিছুর কেন্দ্রতেই রয়েছে নারী। সাহিত্যিক হিসাবে তিনি হয়ত অতটা সফল নন, যদিও তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থগুলোতে স্বাধীন বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের বিবর্তনের ধারা অত্যন্ত সাবলীলভাবে ফুটে উঠেছে। তবে কবি হিসাবে তিনি সমসাময়িক অনেক কবির চেয়ে যে শক্তিশালী এটা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না। নারী এবং প্রেম বিষয়ক তাঁর কিছু কবিতা নি:সন্দেহে সময়কে অতিক্রম করে যাবে।

তসলিমা যা লিখেছেন তার প্রায় সবই বাংলা ভাষাতে। রবীন্দ্রনাথের পরে তিনিই একমাত্র বাঙালি যিনি বাংলাতে লিখে সারা বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছেন। এর বিপরীতে অনেক ভারতীয় এবং কিছু বাঙালি লেখক ও গবেষকের নিজ মাতৃভাষা ছেড়ে সাবেক ঔপনিবেশিক প্রভুর ভাষা ইংরেজিতে লিখে বিশ্বে নিজেদের পরিচিত করবার ব্যর্থ প্রয়াস লক্ষণীয়। দুই/একজন ব্যতিক্রম বাদে তাদের কেউই বিশ্ব বা নিজ জনগোষ্ঠী কারো কাছেই পরিচিতি বা গ্রহণযোগ্যতা পাননি।

বর্তমানে নির্বাসিত জীবনেও দু'হাতে লিখে যাচ্ছেন তসলিমা। তার কলাম নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বাংলাদেশের দুইটি সংবাদপত্রে। ফেসবুকেও তিনি অত্যন্ত সক্রিয়। কিন্তু তার লেখার আবেদন বা সমাজে এর প্রতিক্রিয়া যেন অনেকটাই ম্রিয়মাণ। এর মূল কারণ হল তসলিমা দেশান্তরী হবার পরে নতুন আরেকটা প্রজন্ম দাঁড়িয়েছে যাদেরকে বলা যায় 'তসলিমা প্রজন্ম'। এদের মনোজগতে তসলিমার চিন্তাধারা ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। তসলিমা যে কথাগুলো বলেছিলেন সেটাই তারা বিভিন্ন ব্লগ, ওয়েব পোর্টাল এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে আরো তীব্রভাবে বলা শুরু করেছে। এর ফলে জনগণের মাঝে একটা আপেক্ষিক সহিষ্ণুতা বা অভ্যস্ততার সংস্কৃতির জন্ম নিয়েছে যা ব্যক্তি হিসাবে তসলিমাকে ম্রিয়মান করে ফেলছে।

তসলিমার সার্থকতা এ জায়গাটিতে যে, যত ক্ষুদ্রই হোক তিনি তার চিন্তাধারার আলোকে একটা প্রজন্ম তৈরি করতে পেরেছেন, যেটা বাংলাদেশের আর কোনও চিন্তাবিদ সে অর্থে পারেন নাই; এমনকি আহমেদ ছফাও এ ক্ষেত্রে তেমন সফল হন নাই। ফরহাদ মজহারও স্বাধীন চিন্তাধারার জন্ম দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত দক্ষিণপন্থার রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন।

তসলিমার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল নিজের চিন্তাধারার সাথে কোনও অবস্থাতেই আপস না করা-সেটা ইতিবাচক বা নেতিবাচক যাই হোক না কেন। সেই আপস না করতে পেরে তিনি যেমন দেশছাড়া হয়েছেন, তেমনি অনেক পরিচিত মানুষ থেকেও নিজেকে বিছিন্ন করে ফেলেছেন, চিন্তাধারা বা ব্যক্তিজীবনে বনিবনা না হবার কারণে। কিন্তু, তিনি অটল থেকেছেন যেটাকে তিনি সঠিক মনে করেছেন সে বিষয়ে।

নিজে দেশছাড়া হলেও মানসিকভাবে তসলিমা পড়ে থাকেন বাংলাদেশে। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারাসহ প্রচলিত যেকোনও আইনে যেকোনও সাজা মাথায় নিয়ে তিনি দেশে ফিরতে ইচ্ছুক। নাগরিকত্ববিহীন অবস্থায় গোলাম আজম অথবা হজ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করা আব্দুল লতিফ সিদ্দীকিকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করলেও তসলিমাকে না ফিরিয়ে আনবার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি  এ দু'টি দলই একমত। যদিও রাজনীতির আর প্রায় কোনও বিষয়ই তাদের মাঝে ঐক্যমত্য দেখা যায় না।

কোনও শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ যখন জেলে বা নির্বাসনে যান তখন তার পিছনে থাকে কোটি জনতার সমর্থন। বিপুল জনতার সমর্থন যে কাউকে যেকোনও অবস্থাতেই মানসিকভাবে করে তোলে শক্তিশালী।

তসলিমা নির্বাসিত জীবন যাপন করেন প্রায় একা। এখনো শুধুমাত্র হাতে গোণা কিছু মানুষ তাকে সমর্থন করেন বা তার পাশে দাঁড়ান। কিন্তু, বছরের পর বছর একা তিনি অদম্য মনোবলে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি যেটা বিশ্বাস করেন সেটাকে আঁকড়ে ধরে, যার ফলে তিনি হয়ে উঠেন বাংলার ইতিহাসে অন্যতম সাহসী ব্যক্তিত্ব।