রকেট সমীকরণ

Published : 19 Sept 2018, 02:06 PM
Updated : 19 Sept 2018, 02:06 PM

জীবনানন্দ দাশ লিখছেন,

পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে—

জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহ্বানে

বুনো হাঁস পাখা মেলে— সাঁই-সাঁই শব্দ শুনি তার;

এক— দুই— তিন— চার— অজস্র— অপার—

এই ছত্রগুলোতে আকাশের তারাদের নিয়ে মানুষের চিরায়ত স্বপ্নই ফুটে উঠেছে, কিন্তু পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে নক্ষত্র অভিমুখে উড়ে যাওয়া সহজ কাজ নয়। সেই মুক্তির জন্য তৈরি করতে হবে শক্তিশালী যন্ত্র যা কিনা পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের নাগপাশ ছিন্ন করতে পারে। এই যন্ত্র হল রকেট ইঞ্জিন। মানুষ তার মস্তিষ্কের গুণে যা কিছু সৃষ্টি করেছে তার মধ্যে রকেট ইঞ্জিন একটি বিশেষ উদ্ভাবন। ভবিষ্যতে মহাকাশ যাত্রার ক্রমঃপ্রসারে, আমার মনে হয়, মানব সভ্যতার উদ্ভাবনের তালিকার এক নম্বর স্থানটি দখল করে নেবে এই রকেট ইঞ্জিন।

জীবনানন্দ মারা গিয়েছিলেন ১৯৫৪ সনে, তিনি "জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহ্বানে" রকেট উৎক্ষেপণ দেখে যেতে পারেন নি। মানুষের মহাশূন্যে যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৫৭ সনের ৪ঠা অক্টোবর যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন পৃথিবীর কক্ষপথে একটি কৃত্রিম উপগ্রহ স্থাপন করতে পারে। R7 নামে একটি রকেট স্পুটনিক নামের এই উপগ্রহটিকে কক্ষপথে নিয়ে যায়। এটা ভাগ্যের পরিহাসই বলতে হবে যে মানুষের মহাকাশে ভ্রমণ কোনো চিরায়ত স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য হয় নি, বরং ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্রকে পরিশীলিত করার মধ্যে দিয়ে অর্জিত হয়েছে। তখনকার ঠাণ্ডা লড়াইয়ের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন উভয়ই আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র বানাচ্ছিল যা কিনা বিধ্বংসী পারমাণবিক বোমা বহন করতে পারে। আর এই কাজের জন্য উভয় দেশই সাহায্য পেয়েছিল বন্দী জার্মান বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সেই জার্মান বিজ্ঞানীরা হিট্লারের জন্য সৃষ্টি করেছিল V-2 মারণাস্ত্র রকেট। যুদ্ধের শেষে V-2 এর প্রধান স্রষ্টা জার্মান বিশেষজ্ঞ ভেরনার ভন ব্রাউন মার্কিন সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন। মানুষকে চাঁদে নিয়ে গিয়েছিল Saturn V নামে যে বিশাল রকেট তার সৃষ্টি বলতে গেলে ভন ব্রাউনের হাতেই।

স্যাটার্ন ৫ আজ পর্যন্ত যত রকেট বানানো হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে ভারি, সবচেয়ে উঁচু। এর উচ্চতা ছিল ১১১ মিটার বা ৩৩৬ ফুট। চিন্তা করুন একটি ৩৩ তলা বাড়ি, তার থেকেও উঁচু ছিল সেই রকেট। এবার চিন্তা করুন সেরকম একটি রকেটের প্রতিটি অংশকে জোড়া লাগানো হচ্ছে, প্রথম স্টেজটি ১৩ তলা, দ্বিতীয় স্টেজটি ৮ তলা ও তৃতীয় স্টেজটি ৬ তলার সমান। এর ওপরের ৬টি তলায় কমান্ড মডিউল, চাঁদের ল্যান্ডার ইত্যাদি। নিচের তিনটি স্টেজেই জ্বালানী ছাড়া আর কিছু নেই।

কি পরিমাণ জ্বালানী লাগবে? সেও এক বিশাল ব্যাপার। প্রথম স্টেজটিতে ৮১৭,০০০ লিটার কেরোসিন ও ১,৩১১,১০০ লিটার (বা প্রায় ১৩ লক্ষ লিটার) তরল অক্সিজেন থাকত। মঞ্চ থেকে রকেট উৎক্ষেপণের মাত্র ১৬৮ সেকেন্ড বা তিন মিনিটের মধ্যেই এই সব জ্বালানী শেষ। ঐ তিন মিনিটে প্রথম স্টেজটির কাজই ছিল পুরো রকেটটিকে প্রায় ৬৭ কিলোমিটার ওপরে উঠিয়ে দেয়া আর তার গতিবেগকে সেকেন্ডে ২.৩ কিলোমিটার করা। প্রথম স্টেজটির জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে তাকে মূল রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন করা দেয়া হত।

প্রথম স্টেজটিতে পাঁচটি ইঞ্জিন থাকত। একইরকম এই পাঁচটি ইঞ্জিনের নাম Rocketdyne F1। প্রতিটি ইঞ্জিন প্রতি সেকেন্ডে ২,৫৭৮ কিলোগ্রাম জ্বালানী (কেরোসিন আর তরল অক্সিজেন) পোড়াত। পাঁচটি ইঞ্জিন মিলে প্রতি সেকেন্ডে পোড়াত প্রায় ১৩,০০০ কেজি বা ১৩ টন জ্বালানী, একটি দোতলা বাসের ভরের সমান! কী পরিমাণ বল বা থ্রাস্ট প্রতিটি ইঞ্জিন থেকে পাওয়া যেত? ৬,৭০০,০০০ নিউটন বা সাতষট্টি লক্ষ নিউটন। এই সংখ্যাটা আমরা তুলনা করতে পারি GE কোম্পানীর একটি আধুনিক বোয়িং বিমানের জেট ইঞ্জিনের সাথে। GE9X বর্তমানের উড়োজাহাজে ব্যবহৃত সবচেয়ে শক্তিশালী ইঞ্জিন। তার থ্রাস্ট হল প্রায় ৪৭০,০০০ নিউটন। অর্থাৎ একটি রকেটডাইন ইঞ্জিন GE9X এর তুলনায় ১৪ গুণ বেশী বলশালী।

জীবনানন্দ থেকে রকেট ইঞ্জিনে কেমন করে এলাম? তার কারণ নক্ষত্রের স্বপ্নকে সত্যি করতে হলে পৃথিবীর বুক থেকে ওপরে উঠতে হবে, কিন্তু সেই ওপরে ওঠা সহজ ব্যাপার নয়। পৃথিবী যেমন আমাদের বাসস্থান দিয়েছে, তেমন ভাবেই পৃথিবী আমাদের ধরে রেখেছে। পৃথিবীর বুকে প্রাণের আবির্ভাব এবং তার থেকে কোটি কোটি বছরের বিবর্তনে যে মানুষের উদ্ভব তাতে মহাশূন্য যাত্রার কথাটা লেখা ছিল না। এখন মানুষ সেই প্রাকৃতিক বিবর্তনের বাইরে এসে মহাবিশ্বকে বুঝতে চাইছে, তার রকেট ইঞ্জিন বানানোর প্রচেষ্টা মহাজগৎকে বোধগম্য করার অ্যাডভেঞ্চার।

পৃথিবীর কক্ষপথের রকেট মারফৎ কোনো যান স্থাপনা করা একটা দুরূহ ব্যাপার। এতখানি দুরূহ যে পৃথিবীর নিকট কক্ষপথে (পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে কয়েক শ কিলোমিটার ওপরে) যেতে যে পরিমাণ শক্তি খরচ হবে সেটা মঙ্গলে যেতে যা হবে তার অর্ধেক। তাই মহাকাশে যাবার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপ চাঁদে যাওয়া নয়, বরং পৃথিবীর কক্ষপথে যান স্থাপন করা। এই কাজটা কঠিন, প্রতি সেকেন্ডে ৭ থেকে ৮ কিলোমিটার গতি না হলে তা সম্ভব নয়। আর সেই গতি অর্জনের জন্য চাই প্রচুর শক্তি (energy) ও ক্ষমতা (power)। এই ক্ষমতাটা জোগাড় করতে হচ্ছে রাসায়নিক জ্বালানী থেকে, কেরোসিন-অক্সিজেন বা অক্সিজেন-হাইড্রোজেনের মিশ্রণ থেকে। সেই জ্বালানীর আবার প্রচুর ভর। আমাদের গ্রহ যদি তার ঘনত্ব ঠিক রেখে একটু বড় হত, তাহলে আমরা রাসায়নিক জ্বালানী ব্যবহার করে পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে কখনই কক্ষপথে উঠতে পারতাম না। আমাদের অপেক্ষা করতে হত নতুন ধরণের শক্তির জন্য – হয়তো পারমাণবিক ফিশন বা ফিউশনের, অথবা বস্তু ও পরাবস্তুর (antimatter) বিক্রিয়ার জন্য। আর কত পরিমাণ জ্বালানী ব্যবহার করলে কত পরিমাণ গতি পাওয়া যাবে সেটা ঠিক করে দেয় পোলিশ-রুশ বিজ্ঞানী ৎসিওলকভস্কির (১৮৫৭-১৯৩৫) রকেট সমীকরণ:

এখানে mi হল রকেটের জ্বালানীসহ আদি ভর, mf হল জ্বালানী খরচ করার পর চূড়ান্ত ভর। ve রকেটের পেছন দিকে গ্যাসের বিনির্গমন গতিবেগ ও Δv হল সম্মুখে গতিবেগ পরিবর্তনের মান। আর ln হল ন্যাচারাল বা প্রাকৃতিক লগারিদম।

কনস্টান্টিন ৎসিওলকভস্কি নিয়ে এখানে বেশী কিছু লিখছি না। মস্কো থেকে দক্ষিণে কালুগা শহরে একটি বিদ্যালয়ের শিক্ষক এই বিজ্ঞানী জুল ভার্নের মতই মহাকাশে অ্যাডভেঞ্চারের স্বপ্ন দেখতেন। পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ এড়ানোর জন্য বহু-স্টেজের রকেট, জ্বালানী হিসেবে তরল অক্সিজেন ও হাইড্রোজেনের ব্যবহার, কক্ষপথে বসবাসের জন্য ঘূর্ণায়মান স্টেশন, নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজনীয় গতি গণনার জন্য সমীকরণ – এরকম বহু ভবিষ্যতের ধারণা তিনি দিয়ে গেছেন কোনো বড় বিজ্ঞানী বা প্রকৌশলীদের সাহচর্য ও সাহায্য ছাড়াই। বলা হয়ে থাকে ভন ব্রাউনের নিত্য সাথী ছিল জার্মান ভাষায় অনুদিত ৎসিওলকভস্কির একটি বই।

ওপরের ৎসিওলকভস্কি সমীকরণ থেকে নিচের সমীকরণটি পাওয়া সম্ভব।

এখানে বাঁ দিকের রাশিটি রকেটের কত ভগ্নাংশ জ্বালানী সেটা নির্ধারণ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যদি গ্যাসের নির্গমন গতিবেগ (ve) সেকেন্ডে ৫ কিলোমিটার হয় ও গতিবেগ পরিবর্তন (Δv) সেকেন্ডে ১০ কিলোমিটার করতে হয়, তবে জ্বালানীর পরিমাণ রকেটের ভরের ৮৬% হতে হবে। অর্থাৎ পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে কক্ষপথে পৌঁছাতে আমাদের যে যানটি তৈরি করতে হবে সেই যানটির সবটুকুই প্রায় জ্বালানী দিয়ে ভর্তি, কক্ষপথে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যাবার সুযোগ খুবই কম।

এবার অন্য একটা উদাহরণ দিই। ৎসিওলকভস্কি সমীকরণ অনুযায়ী একটি যান শূন্য গতিবেগ থেকে দেড় মিনিটের মধ্যে সেকেন্ডে ৩ কিলোমিটার গতিবেগ অর্জন করতে পারে, কিন্তু এর জন্য রকেটটিকে তার ভরের ৭৫% ভরসম্পন্ন জ্বালানী খরচ করতে হবে। অ্যাপোলো-১১ যে স্যাটার্ন-৫ রকেটটি ব্যবহার করেছিল উৎক্ষেপণ কেন্দ্রে সেটির ভর ছিল ২৮৮০ টন। তিন মিনিটের মধ্যে সেটার ভর হয়ে গেল মাত্র ৭৫০ টন, তার মূল ভরের এক-চতুর্থাংশ, আর গতিবেগ হল সেকেন্ডে ২.৩ কিলোমিটার। তাত্ত্বিকভাবে পাওয়া সেকেন্ডে ৩ কিলোমিটার থেকে গতিহ্রাসের কারণ মূলতঃ বায়ুমণ্ডলের জন্য ঘর্ষণজনিত বল ও পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ সঙ্গে লড়াই করার জন্য শক্তি-খরচ। ঐ রকেটটির ওজনের ৯৩% ভাগই ছিল জ্বালানী।

নভোচারী ডন পেটিট The Tyranny of Rocket Equation (রেফারেন্স ১.) নামে একটি চমকপ্রদ লেখায় বলেছেন রকেটে জ্বালানীর পরিমাণ যেখানে রকেটের সামগ্রিক ভরের ৮৫% থেকে ৯০% ভাগ, সেখানে সাধারণ একটি গাড়ির জ্বালানী গাড়িটির মোট ভরের মাত্র ৪%, একটি বড় জাহাজের ৩%। অবশ্য বিমানের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা আবার ৩০% থেকে ৪০%। তিনি বলছেন প্রকৌশলের দৃষ্টিকোণ থেকে জ্বালানীই যখন একটি যানের মূল উপাদান সেখানে সামান্য একটা জিনিসের পরিবর্তন করতে হলে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন। পেটিট বলছেন যতদিন আমরা রকেট সমীকরণের স্বেচ্ছাচারিতায় আবদ্ধ থাকব ততদিন সহজে মহাকাশে ভ্রমণ সহজ হবে না, হয়তো ভবিষ্যতে অল্প ভরের নতুন ধরণের জ্বালানী আমাদের রকেট সমীকরণ থেকে মুক্ত করবে।

পৃথিবীর বিশাল মাধ্যাকর্ষণের কুয়ো থেকে ওপরে ওঠা একটা কষ্টসাধ্য কাজ। এই কাজটা কঠিন। কিন্তু ভবিষ্যতের মানুষকে এই কাজে ব্রতী হতে হবে, কারণ আমাদের গ্রহের বাইরে পরিবেশ যতই প্রতিকূল হোক না, আমাদেরকে মহাবিশ্বকে জানার জন্য, খনিজ পদার্থের জন্য, শক্তি আহরণের জন্য সেই পরিবেশে ভ্রমণ করতে হবে। এই কাজটাকে সহজ করার জন্য ভবিষ্যতের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন করতে হবে নতুন রকেট ইঞ্জিন যার জ্বালানীর ভর হবে নগণ্য।