প্লট, গাড়ি আর বামপন্থী দিলীপ বড়ুয়া

বিদিশা
Published : 7 June 2012, 06:52 AM
Updated : 7 June 2012, 06:52 AM

২০০৮ এর অক্টোবরের কথা। দেশজুড়ে নির্বাচনের ডামাডোল। রাজনীতিবিদরা প্রায় সকলেই রাজধানী ঢাকা ছেড়ে নিজ নিজ এলাকায়। তখন দুপুর। এমনিতে শীতের আমেজ কিছুটা থাকলেও দুপুর বলে সূর্যের তাপটা বেশ প্রবল। এরই মধ্যে নগরীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় তোবড়ানো একটা কোট পরে এক ভদ্রলোক বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। তার হাতে একটি মলিন ফাইল। আশপাশে দু'একটা স্কুটার ছিল, কিন্তু তিনি সে দিকে গেলেন না। কিছুটা ধাক্কাধাক্কি করেই বাসে উঠে চলে গেলেন। বাসটি যাবে শাহবাগ হয়ে মতিঝিলের দিকে।

ঠিক এভাবেই ঘটনাটি বর্ণনা করলেন আমার এক বন্ধু। ২০০৯ এর জানুয়ারিতে বিপুল ব্যবধানে নির্বাচিত হওয়ার পর শেখ হাসিনা যখন তার মন্ত্রিসভা ঘোষণা করছিলেন, টিভি'র সামনে আরও অনেকের মত আমিও ছিলাম। তারও বেশ কিছু্ক্ষণ আগে থেকে বিভিন্ন টেলিভিশনে সম্ভাব্য মন্ত্রীদের নাম প্রচার করা হচ্ছিল। সেখানে দিলীপ বড়ুয়ার নামটি দেখে আমি চমকে উঠলাম। দিলীপদা মন্ত্রী হচ্ছেন! আমার নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না।

দিলীপ বড়ুয়ার সঙ্গে আমার কিছু স্মৃতি ছিল। আমরা একবার একসঙ্গে চীন গিয়েছিলাম। সেটা ছিল এশিয়ার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একটা সম্মেলন। আমি তখন বৈবাহিকসূত্রে জাতীয় পার্টির সঙ্গে জড়িত। ওই পার্টির প্রতিনিধি হিসাবেই আমার যাওয়া। বাংলাদেশ থেকে আরও অনেক রাজনীতিবিদই গিয়েছিলেন। বিএনপি তখন ক্ষমতায়। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান গিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ থেকে গিয়েছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। তাদের সকলের মধ্যে দিলীপদা'র সঙ্গই আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছিল। খুবই সাদাসিধা, অমায়িক একজন ভদ্রলোক। অন্যদের যে খারাপ লেগেছিল, তা নয়। তারা সবাই আমার সঙ্গে খুবই ভদ্র, শালীন আচরণ করেছেন। সম্মেলনের সময়টুকু বাদে, সকলেই নানা জিনিসপত্র কেনাকাটা করেছেন। সবাই বড়বড় দোকানে গেছেন, দামী দামী জিনিস কিনেছেন। একমাত্র ব্যতিক্রম দিলীপ বড়ুয়া এবং তার সঙ্গে থাকা আর একজন বামপন্থী ভদ্রলোক। তারা খুঁজে খুঁজে এক ডলারের দোকানে যেতেন। কেনাকাটায় এই যে কম অর্থ ব্যয়ের প্রচেষ্টা, এনিয়ে ওই সময় তার মধ্যে কোন ধরনের হীনমণ্য ভাব আমার চোখে পড়েনি। বরং মনে হয়েছে, নিজের অঢেল অর্থ না থাকা নিয়ে কিছুটা গর্বিতই বুঝি তিনি।

টেলিভিশনের পর্দায় সেই দিলীপ বড়ুয়ার নাম দেখে আমি আর স্থির থাকতে পারিনি। সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফোন করলাম। একবার রিং হতেই তিনি তুললেন। বললাম-দাদা এসব কি দেখছি! আপনি মন্ত্রী হচ্ছেন!
-হ্যাঁ দিদি, আমিও তো সেরকমই শুনছি। দিদি, দোয়া করবেন।

তিনি আর বেশি কথা বলতে পারছিলেন না। তার গলা ধরে আসছিল। মনে হলো, ওপ্রান্তে তিনি বোধকরি কাঁদছিলেন।
কাকতালীয় ভাবে ওই বন্ধুটি তখন আমার পাশে ছিলো। সে বর্ণনা করলো মাস দু'য়েক আগের তার নিজের চোখে দেখা সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার ওই ঘটনাটি। বন্ধুটি আরও বললো, আমারও সেদিন মতিঝিলে যাওয়ার কথা ছিল। আমি স্কুটার দরদাম করছিলাম। কিন্তু আমার সামনেই দিলীপদাকে ওইভাবে ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠতে দেখে কিছুটা লজ্জাই পেলাম। স্কুটারের দিকে না যেয়ে আমিও পরের বাসে উঠে গেলাম।

বন্ধুটি বেশ রাজনীতি সচেতন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন নিজেও বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। টেলিভিশনে মন্ত্রীদের নামের তালিকায় একটি করে নাম যুক্ত হচ্ছিল, আর আমরা তা নিয়ে আলোচনা করছিলাম। দিলীপ বড়ুয়ার নামটি আসার পর, বন্ধুটি বললো, তাকে মন্ত্রী বানিয়ে শেখ হাসিনা আসলে মেনন আর ইনুকে সাইজ করলো।

তারপর কিছুটা রসিকতার ভঙ্গিতে বন্ধুটি বললো, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন আমরা দিলীপদা এবং নির্মলদা'র (নির্মল সেন) পার্টির লোকবল নিয়ে রসিকতা করতাম। বলতাম উনাদের পক্ষে কারফিউ ভঙ্গ করা সম্ভব, কিন্তু ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা সম্ভব নয়। কারণ, কারফিউ ভাঙতে হলে একজন লোক রাস্তায় নামলেই হয়, কিন্তু ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে হলে রাস্তায় কমপক্ষে তিনজন লোক নিয়ে নামতে হয়, ওই তিনজন লোক জোগাড় করাই ওই মহান দুই বামপন্থীর পক্ষে সম্ভব নয়।

কথাটি আমার বিশ্বাস হলো না। তিনজন মাত্র লোক নেই, অথচ একটি পার্টি আছে, এমনও কি সম্ভব? আবার ভাবলাম, হতেও পারে, এদেশে সবই সম্ভব। রাজনীতিতে একদিনেরও অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও, কেবলমাত্র পার্টি প্রধানের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে এই আমিই তো সেই পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য হয়ে গিয়েছিলাম!

তবে একটা বিষয়ে সেদিন আমরা দু'জনেই একমত হয়েছিলাম, মন্ত্রী হিসাবে দিলীপ বড়ুয়া কতটুকু যোগ্য হবেন-সেটা বলা না গেলেও, তিনি যে একজন সৎ মন্ত্রী হবেন এটা নিশ্চিত।

মন্ত্রী হওয়ার পর দিলীপদা'কে আমি কখনোই ফোন করিনি। তবে তার সঙ্গে একবার দেখা হয়েছে। বছর দেড়েক আগের কথা। আমি তখন ইংল্যান্ড যাচ্ছিলাম। প্লেন পরিবর্তন করতে হবে দুবাই এয়ারপোর্টে। বোর্ডিং পাস সংগ্রহের জন্য লম্বা লাইন, সেখানেই দাঁড়িয়ে দিলীপ বড়ুয়া। একহাতে টিকেট-পাসপোর্ট, অন্য হাতে হ্যান্ডব্যাগ। তিনি যেন কিছুটা হিমশিম খাচ্ছেন। আমি তাকে সালাম দিলাম। বললাম, দাদা চিনতে পেরেছেন?
তিনি হাসলেন, কি যে বলেন দিদি, কেন চিনতে পারবো না? কেমন আছেন আপনি? কোথায় যাচ্ছেন?
এক কথা দু'কথার পর বললাম, আপনি এখন মন্ত্রী। তারপরও আপনি লাইনে কেন?
-কেন, মন্ত্রী হয়েছি তো কি হয়েছে? আমি তো এখনো ইকোনমি ক্লাসেই ভ্রমণ করি। মন্ত্রী তো দু'দিনের ব্যাপার। তাই বিজনেস ক্লাসে উঠে স্বভাবটা নষ্ট করতে চাই না। যখন মন্ত্রী না থাকবো, তখন যেন কষ্ট না হয়।
তার কথা শুনে খুব ভালো লাগলো। ভাবলাম, আহা, আমাদের দেশে যদি এরকম আরও কয়েকজন মন্ত্রী থাকতো! শেখ হাসিনার উপর কিছুটা খুশিই হলাম। ভালোই করেছেন তিনি। কয়েকজন সৎ মানুষকে মন্ত্রী করেছেন।
আসলে এতক্ষণ যা লিখলাম, তা কেবলই ভূমিকা। এবার আসছি মূল প্রসঙ্গে। পাঠকদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, কারণ ভূমিকার চেয়ে মূল প্রসঙ্গটি ছোট হয়ে যাবে বলে।

গত মঙ্গলবার (৫ জুন ২০১২) একটি পত্রিকায় দেখলাম, মন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া নাকি নিজের এবং তার পরিবারের সদস্যদের নামে ঢাকা শহরে পাঁচটি প্লট নিয়েছেন! আবার চট্টগ্রামেও একটি প্লট পাওয়ার জন্য আবেদন করেছেন, সেটি পাওয়াও নাকি একরকম নিশ্চিত। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, তিনি নাকি খুবই দামী জিপে চলাফেরা করেন আজকাল। তার অথবা তার পরিবারের নামে আরও কী কী সম্পদ আছে, তারও কিছু বিবরণ দেখলাম ওই রিপোর্টে।

এ খবরটি আমাকে হতবাক করে দিল। আমি মিলাতে পারলাম না। এটা কি সেই দিলীপ বড়ুয়া, যাকে আমি চীনে ১ ডলারের দোকানের সন্ধানে ছোটাছুটি করতে দেখেছি? যাকে মন্ত্রী হওয়ার পরও দুবাইয়ে ইকোনমি ক্লাসের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি?

আচ্ছা, ঠিক আছে, না হয় ধরে নিলাম পত্রিকাগুলো অতিরঞ্জণ করে লিখেছে। কিন্তু পাঁচটি না হলেও তিনটি, কিংবা দু'টি প্লটতো ঠিক আছে।

বামপন্থী রাজনীতি বলতে আসলে ঠিক কি বুঝায়, আমি ভালো বুঝি না। তবে আমি বামপন্থী মতধারায় বিশ্বাসী লোকদের কয়েকজনকে দেখেছি। আমার পিতা সারাজীবন বামধারার রাজনীতির প্রতি অনুগত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন, অর্থ-সম্পদ-প্রতিপত্তি'র প্রতি লোভ তার মধ্যে কখনো দেখিনি। এখনও, এই বৃদ্ধ বয়সেও, ভাড়া বাসাতে থাকেন। শুনেছি, বামপন্থীদের নাকি একধরনের অহঙ্কার থাকে। ব্যক্তিগত সম্পদ না থাকার অহঙ্কার। আমার বাবার মধ্যে সেই অহঙ্কারটি দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত, রাগান্বিত এবং সবমিলিয়ে গর্বিত। খুব জানতে ইচ্ছা করে, এই সরকারের সঙ্গে জড়িত মহান তিন বামপন্থী দিলীপ বড়ুয়া, রাশেদ খান মেনন, কিংবা হাসানুল হক ইনু-এরা কি ওই অহঙ্কারে অহঙ্কারী?

বিদিশা: ফ্যাশন ডিজাইনার ও লেখক।