‘রাজনীতির পাঁঠা’দের কাছে নাগরিক সমাজের আত্মসমর্পণ?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 16 Sept 2018, 01:10 PM
Updated : 16 Sept 2018, 01:10 PM

দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকে আমরা যে একটি ন্যূনতম গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছি-এই জন্য আমাদের হতাশা আর গ্লানির শেষ নেই। এই গ্লানি অবশ্যই রাষ্ট্রের, একই সঙ্গে আমরা যারা এই রাষ্ট্রের নাগরিক আছি তাদেরও। রাষ্ট্রের গ্লানি বহু-আলোচিত। এক দিকে অগণতান্ত্রিক আধিপত্যকামিতার ব্যাধি, অন্য দিকে সর্বজনীন উন্নয়নের যথার্থ ও যথেষ্ট পরিবেশ রচনায় ব্যর্থতা, উভয় ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রযন্ত্রের যন্ত্রীরা দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু এই দায় নাগরিকরাও এড়াতে পারেন না। কেননা 'রাজপুরুষ'রা যদি 'রাজধর্ম' থেকে বিচ্যুত হন, তবে তাদের আত্মসংশোধনে বাধ্য করার কাজটি নাগরিকদেরই। সেই কাজ যে তারা করেন না, এমন নয়। কিন্তু একটা প্রবল ঢেউ বা আন্দোলন সৃষ্টির মত সামাজিক প্রতিবাদ এখনও দেখা যায়নি। সামাজিক চাপ রাষ্ট্রশক্তিকে প্রতিকারের আয়োজনে বাধ্য করেছে-তেমন উদ্যোগ আমাদের দেশে নেই বললেই চলে।

এখানেই নাগরিকদের ব্যর্থতা। এখানেই নাগরিকের গ্লানি। তারা প্রজাতন্ত্রের মর্যাদা রক্ষায় প্রায়শই নিজ দায়িত্ব পালন করেন না। তারা শাসকের কাছে যথার্থ সুশাসন দাবি করেন না, তার পরিবর্তে নানা রকম প্রলোভনের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। সেই প্রলোভন পদ-পদবির মাধ্যমে আসতে পারে, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা-পদক-লাইসেন্স-পারমিটসহ নগদ-নারায়ণের মাধ্যমে হতে পারে। কিংবা হতে পারে পরোক্ষ কোনো উপায়ে-সুবিধা প্রাপ্তির মাধ্যমে। নাগরিকরা তাতে আহ্লাদিত হয়ে বিপুল দুঃশাসন কিংবা চরম অন্যায়কেও প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন।

নিজেদের স্বার্থ-সুবিধা-সমর্থনের জন্য রাজনীতিকরা এই সব অন্যায় পথ অনুসরণ করেন, তা অন্যায়। কিন্তু নাগরিকরা এই অন্যায়কে মেনে নেন, তাও কম গর্হিত নয়। প্রসাদ বিতরণ করে আনুগত্য কিনবার এই প্রক্রিয়া যে 'রাজনীতিসচেতন' বাংলাদেশে রীতিমত সফল, তা একটি নির্মম সত্য বুঝিয়ে দেয়: আমাদের সমাজ এখনও প্রজার সমাজ, নাগরিকের নয়। প্রজা রাজানুগ্রহ পেয়ে ধন্য বোধ করে, নাগরিকের কাছে সেটা অপমানজনক। নাগরিক প্রসাদ চান না, আপন ভাগ্য জয় করবার অধিকার ও সুযোগ চান। আমাদের প্রজাতন্ত্র কবে নাগরিকতন্ত্র হবে, রাজধানীর রাজপথে অবশ্য সে প্রশ্ন উঠবে না। মিডিয়াতেও এ আলোচনাটি অনুক্ত! হতাশা সেখানেই!

দুই.

নাগরিকরা সমাজের শিক্ষিত ও সচেতন অংশ। সারা পৃথিবীতেই সিভিল সোসাইটি বা নাগরিক সমাজ, 'লিবারেল ভ্যালুজ'-এর ধারক বলে দাবি করেন। ঐ যে আছে না ভলতেয়ারের বাণী-আই ডু নট এগ্রি ইউথ হোয়াইট ইউ হ্যাভ টু সে, বাট আই উইল ডিফেন্ড টু দ্য ডেথ ইয়োর রাইট টু সে ইট – এইসব ভ্যালুজ আর কি। আমাদের সুধী সমাজও নিজেদের এমন মহৎ দাবি করেন। অন্তত মুখে, আলাপ আলোচনায়! কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন আছে কি?

একটা সময় ছিল, যখন সাদাকে অন্য যে কোনো রং থেকে আলাদা করা যেত। যখন ন্যায়-অন্যায়, শোষক-শোষিত, দীন ও হীনের মধ্যে লক্ষণরেখাটি সুস্পষ্ট ও প্রায় দুরতিক্রম্য ছিল। নীতি ও দুর্নীতি বিষয়েও তা-ই। ফলে, সমাজের জাগ্রত, বিবেকবান, চিন্তাশীল অংশ যখন 'অন্যায়ের' প্রতিবাদে পথে নামতেন, তখন তার পদক্ষেপটি ছিল দ্বিধাহীন, নৈতিক, প্রেরণা-সঞ্চারী।

সমাজের এই বিবেকী আলোকিত অংশ, যাকে ইদানিং 'নাগরিক সমাজ' হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই 'নাগরিক সমাজ' ঔপনিবেশিক বাংলায় প্রথম সংগঠিত ভাবে পথে নামে ১৬ অক্টোবর ১৯০৫, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে। স্বদেশপ্রেমের গান গেয়ে সবার হাতে রাখি বেঁধে বাঙালির ঐক্য ধরে রাখতে ব্রতী হয়েছিলেন যে সব জ্যোতিষ্ক, রবীন্দ্রনাথ তাঁদের অন্যতম। যদিও এই নাগরিক সমাজের শ্রেণি/বর্ণ/সম্প্রদায়গত পরিচয়, অবস্থান, শক্তি ও দুর্বলতার বিষয়গুলি পরবর্তী সময়ে নানা তির্যক তাত্ত্বিক প্রশ্নের মুখোমুখি, যার সবটাই হয়তো ফেলে দেওয়ার নয়। তবুও দেশে দেশে ক্ষমতাদম্ভীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের ভূমিকা যে সমাজকে জাগিয়ে তোলে, তাতেও সন্দেহ নেই। পরম শক্তিমানও তা সব সময় অবজ্ঞা করতে পারেন না। প্রসঙ্গত, ১৯৬৮ সালের মে মাসে, প্যারিসে ক্রমপ্রসরমাণ সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে জাঁ পল সার্ত্রে আইন অমান্য করে গ্রেপ্তার হলে তদানীন্তন ফ্রান্সের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা শার্ল দ্য গল, সার্ত্রের বিবেকী ভূমিকাকে কার্যত আঠারো শতকের ফরাসি জ্ঞানদীপ্তির নায়ক ভলতেয়ারের সঙ্গে তুলনা করে, তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেওয়ার আদেশ দিয়ে বলেছিলেন, আমরা ভলতেয়ারকে গ্রেপ্তার করতে পারি না!

ঔপনিবেশিক বাংলায় এই প্রশ্নবান নাগরিক সমাজ নানাভাবে ব্রিটিশ শাসনের যৌক্তিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে গেছেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তানি শাসনামলে শিক্ষানীতির আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীকারের আন্দোলনে নাগরিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। স্বাধীনতার পরেও দেশীয় শাসকদের সামনে অস্বস্তিকর প্রশ্ন রাখতে পিছপা হননি। স্বাধীনতার পর অবশ্য রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি সাম্যের প্রশ্নেও নাগরিক সমাজ বিশেষ ভাবে আলোড়িত হয়েছে। এর পর নানা সময়ে সামরিক শাসন, মৌলবাদী অপতৎপরতা, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, গণতন্ত্র ইত্যাদি ইস্যুতে নাগরিকরা অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছেন।

কিন্তু কালক্রমে আমাদের নাগরিকদের ভাবমূর্তিও ক্রমশ কালিমালিপ্ত হয়েছে। আমাদের রাজনীতি যেমন আওয়ামী লীগ-এন্টি-আওয়ামী লীগ দুই শিবিরে বিভক্ত, নাগরিক সমাজও এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। নাগরিক সমাজের একটা অস্বস্তির কারণ চিরন্তন: তার আবেদনের ধরন মূলত নৈতিক। কিন্তু তাকে মূলধন হিসেবে কব্জা করে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দল। তবে আগ বাড়িয়ে নাগরিক সমাজের সদস্যরাই স্বার্থ-সুবিধামত এদল-ওদলে ভিড়ে যান। দলের পক্ষে ভূমিকা পালন করেন। দলের হয়ে সওয়াল-জবাব করেন। দলের অনেক 'অশিক্ষিত-অসংস্কৃত' নেতাদের সঙ্গে দহরম-মহরমেও তাদের কোনো সমস্যা হয় না। জ্ঞানগম্যি, সাংস্কৃতিক দূরত্বও তাদের দলবাজিতে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারে না। একপেশে শাসন, মাঠে-ময়দানের নিত্য ও প্রকাশ্য কাজিয়া/নৈরাজ্যেও শিক্ষিত নাগরিক সমাজের খুব একটা অস্বস্তি লক্ষ করা যায় না। বেশ তারা মানিয়ে নেন।

নাগরিক সমাজের সদস্যদের 'রাজনীতির পাঁঠা'দের কাছে এই আত্মসমর্পণ খুবই বিস্ময়কর। কারণ ছোটবেলা থেকে অতুলপ্রসাদী গানের চেতনাবাণী 'হতে পারি দীন তবু নহি মোরা হীন' শুনতে শুনতে বেড়ে ওঠা সাধারণ বাঙালির মনে রাজনীতির ন্যায্যতা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ দানা বাঁধাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু না, দলীয় রাজনীতির কাছে নিজেদের আনুগত্য বিকানো নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা ঠিকই দুই দলে বিভক্ত হয়ে গেছেন। নাগরিকরা রীতিমত এদল-ওদলের পক্ষে ওকালতি করেন। দলনিরপেক্ষ, মত নিরপেক্ষ বিবেকতাড়িত নাগরিক সমাজ আজ বড়ই দুর্লভ!

এক দুর্বোধ্য সময়ের মুখোমুখি বাংলার নাগরিক সমাজ। একদিকে বোমা-গ্রেনেড হামলাকারীদের দোসর 'খুনীর দল', আরেক দিকে কাউকে তোয়াক্কা না করা 'গায়ের জোরে টিকে থাকা' শাসক দল। কাকে রেখে কাকে ঠেলবেন? কী ভাবে 'সামাজিক নৈতিকতার বাহক'রা এই দ্বন্দ্ব পার হবেন, পার হবার নির্দেশনা দেবেন?

তিন.

অন্যায় অবিচার দুর্নীতিতে সামাজিক পরিমণ্ডল যখন বিষাক্ত হয়ে যায়, সমাজের প্রতি মানুষ বিদ্বিষ্ট হয়ে ওঠে, তখন কিছুসংখ্যক মানুষ পুরনো সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করে, পুরনো রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধেও অসন্তোষ প্রতিবাদ হয়ে প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবাদ কোনো সময় মৃদু, কখনও তীব্র, কখনও নীরব, কখনও সরব, কখনও সংস্কারকামী, কখনও ধ্বংসাত্মক। স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন দেখা যাচ্ছে, দেশের প্র্রথাবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ঘুণ ধরেছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কাঙ্ক্ষিত দায়িত্ব পালন যখন করতে শোচনীয় রকমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে, তখন নাগরিক সমাজের ভূমিকা পালনের প্রশ্নটি সামনে চলে আসছে। নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতাদের অগোচরেই এক অরাজনৈতিক অনির্বাচিত নতুন ব্র্যান্ডের 'নাগরিক সমাজের' নতুন বাজার তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই 'নতুন বাজারে' দলবাজ ব্যক্তিরাই সরব হয়ে উঠছেন!

চার.

'রিপাবলিক' কথাটার মানে কী? সাধারণ মানুষ 'রাষ্ট্র' তৈরি করে, অর্থাৎ ভোট দিয়ে সরকার তৈরি করে, এ তো গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবেই জানা কথা। তার উপর আবার প্রজাতন্ত্র কেন? রাজার বিপরীত শব্দই তো প্রজা, তার মানে, যে সব দেশ রাজ-শাসিত নয়, সেগুলোই প্রজাতন্ত্র।

আসলে 'রিপাবলিকান' দেশ শব্দটার মধ্যে যে আসলে রাজা-প্রজা বাদ দিয়েও একটা আলাদা কথা আছে, কেবল ভোট দিয়ে সরকার তৈরির ব্যাপার নয়, সব রকম সরকারের উপরে যে 'রাষ্ট্র', সেটাই যে আসলে জনসাধারণের, সব সাধারণের সম্পত্তি, সেখানেই যে এ দেশের সব মানুষের সমতা ও দায়িত্বের নির্দেশ, ব্যক্তি-স্বাধীনতা ও ব্যক্তি-অধিকারের চূড়ান্ত স্বীকৃতি: এই সব চেনাশোনা কথাগুলো ভাবতে গিয়ে মনে হল, এসব কেবলই কথার কথা, ফাঁকি, প্রতারণা।

এই রাষ্ট্র দেশের সব মানুষের সম্পত্তি: 'প্রজাতন্ত্র' কথাটি যখন এই অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন আসলে বলার চেষ্টা হয় যে, এর মধ্যে সকলের অধিকার ও দায়িত্ব প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার, সেটা গণতন্ত্রের অধিকারের চেয়ে অনেকখানি বড়। শ্রেণি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, সমাজ, সব কিছুর ঊর্ধ্বে ব্যক্তির সেই অধিকার দাবি করে যে, সব নাগরিককে রাষ্ট্র সমান করে দেখবে, এবং সব নাগরিক রাষ্ট্রকে সমান করে কাছে পাবে।

কিন্তু সেই ভাবনার রূপায়ণ আমরা দেখলাম কই? স্বাধীন বাংলাদেশকে যারা মেনে নিতে পারেনি, সেই সব সু্বিধাবাদী-চতুর গোষ্ঠীর বুদ্ধি-পরামর্শ-সহযোগিতায় পঁচাত্তরের পরে বিভিন্ন অন্ধকারের কীট এবং সেনাশাসক জিয়াউর রহমানের হাত ধরে বাংলাদেশের উল্টোযাত্রা শুরু হয়। সামরিক শাসকরা রাজনীতিকে হেয় আর অজনপ্রিয় করার আয়োজন চালায় সে আয়োজনে আমাদের নাগরিক সমাজ এমনকি অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক নেতারাও অবলীলায় গা-ভাসান। ফলে খারাপের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে 'আদর্শিক রাজনীতি' একটু একটু করে খারাপ হতে থাকে। আদর্শ স্রেফ ফাঁপা বুলিতে পরিণত হয়। জনসমর্থনের আসল নিয়ামক হয়ে দাঁড়ায় ভণ্ডামি, প্রতারণা, ধর্মীয় বুজরুকি আর টাকার খেলা। এই বাস্তবতায় আমাদের নাগরিকরা মেরুদন্ড সোজা করে রাজনৈতিক দলের দাসত্ব ত্যাগ করে এই অধঃপতনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারেননি।

সময়ের প্রয়োজন মেটাতে আমাদের নাগরিক সমাজ রাজনৈতিক দলের মতই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। তবে কি আমাদের নাগরিকরা কেবলই 'প্রজা'? দলবাজ, শিরদারাহীন অক্ষম 'উজবুক'? বিভ্রান্ত ও বিপথগামী রাজনৈতিক দলের কাছে খুব অল্পদামে বিবেক এবং আনুগত্য বিক্রি করে দেওয়া ভরসাহীনের দল? 'রাজনীতির পাঁঠা'দের কাছে আত্মসমর্পণকারী 'অক্ষম ক্লীব'-এর সমষ্টি?