দিদির দাদাগিরি ও আমাদের সম্পর্ক

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 14 Sept 2018, 12:38 PM
Updated : 14 Sept 2018, 12:38 PM

মিডিয়া খুলতেই দেখি মমতা দিদির ছবি। দিদিকে দেখলেই আমার হাসি পায়। না না কোনও কৌতুক না। সবসময় সিরিয়াসলি কথা বলেন তো, তাই। এই যে ক'দিন আগে কলকাতায় একটা উড়ালপুল ভেঙে পড়লো। তিনি তখন দার্জিলিংয়ে। সেদিন নাকি প্লেন নাই, যোগাযোগও নাই, তাই আসলেন না। যতদূর জানি বড় বড় মানুষরা দুর্যোগের সময় হেলিকপ্টার ব্যবহার করেন। তাঁর জন্য কি তাও ছিল না? দিদি এসেছিলেন পরদিন।

যা হোক। দিদির হাসিমাখা মুখ সহজে দেখা যায় না। এ যাত্রায় তা দেখলাম। বলেছেন, শেখ হাসিনা জিতলে তিনি আসবেন। এটা যদি তাঁর মনের কথা হয়, তবে তাঁকে সাধুবাদ । কিন্তু দিদি আমাদের নেত্রীর পথের কাঁটা হিসেবে বিছিয়ে রাখা তিস্তাচুক্তির কী হবে? আপনি কি বোঝেন না এ সমস্যা ভোটের বাক্সে প্রভাব ফেলতে পারে? তাছাড়া আপনার আর আমাদের সীমান্তে কিছু হলেই আপনি যে ভাষায় কথা বলেন, তখন তো মনে হয় না আপনি আসলে আসতে চান। আপনার বঙ্গের রাজনীতি বা অর্থনীতি নিয়ে আমাদের কিছু বলার নাই। আমাদের চাওয়া খুব অল্প।

দয়া করে আমাদের দেশে ভারত বিরোধিতা বাড়তে দিয়ে এদেশের  গতিশীলতা আর উদার রাজনীতি নষ্ট করবেন না। আমাদের মাথার ওপর রোহিঙ্গা সমস্যার পাহাড়। সে বিষয়ে আপনারা নিরব। আমাদের তিস্তা শুকিয়ে কাঠ আপনারা, স্তব্ধ। সীমান্তে মারমারি তো হয় না, হয় একতরফা 'মারি'। সে 'মারি'তে যখন কাঁটাতারে লাশ ঝুলিয়ে দেয়া হয়, তখন একটু কথা বলবেন প্লিজ!

আমরা ইলিশ জামদানি দিতে মুক্তহস্ত। আমাদের মানুষেরা যায় আর খরচ করে আপনার দেশে। কলকাতার রাস্তাঘাট বাজার বাংলাদেশিতে সয়লাব। আপনাদের পণ্য আমাদের ঘরে ঘরে। আপনারা ভয়ে দেখান না বটে আমাদের গৃহকোণের শান্তি কেড়ে নিয়েছে আপনাদের সিরিয়াল। এতকিছুর পরও আমরা আপনাদের ভালোবাসি। তাই দিদি কে জিতলে আসবেন, আর কে না জিতলে আসবেন না, এমন বলে বিরোধী শিবিরকে চাঙ্গা করবেন না। দয়া করে যখন ইচ্ছে আসুন। কিন্তু শর্ত একটা। ভালোবাসার বিনিময়ে ভালোবাসা। বন্ধুত্বের বিনিময়ে বন্ধুত্ব। দাদাগিরি না।

ভারত আমাদের বিশাল প্রতিবেশি। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালো থাকা সবদিক থেকে জরুরি। কারণ নেহেরুর ভারত আর আজকের ভারতে অনেক তফাৎ। এখনকার ভারত এক পরাশক্তিও বটে। কিন্তু এটাও মানতে হবে একাত্তরের ভারত আর আজকের ভারত এক নয়। ফুলেফেঁপে বলশালী দেশটির রাজনীতিতে এসেছে পরিবর্তন। সেদেশের সরকারে এখন বিজেপি। বিজেপি হিন্দু দল। সেটা বলতে বা বলায় তাদের কোনও লজ্জা নাই। বরং মোদির নেতৃত্বে ভারতের যে অগ্রগামী ভূমিকা সেটাই এখন বিশ্বেও স্বীকৃত।

আমাদের সাথে তাদের সম্পর্কের বিষয়টা বিজেপি আমলে ব্যাহত হতে পারে এমন ধারণা বদ্ধমূল ছিলো। কারণ কংগ্রেস আর আওয়ামী লীগ একাত্তরে এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করার পাশাপাশি ইন্দিরা-মুজিব সম্পর্কও ছিল দুইদেশের ভালোবাসার সূত্র। সময়ে আজ তাঁরা যেমন নাই, কংগ্রেসও হীনবল। রক্তের উত্তরাধিকার ভারতের রাজনীতি বেশীদিন মানেনি। তারা ফিরে এসেছে তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনায়। জাতীয়তাবাদ নানাভাবে নানা কারণে তার চেহারা বা আদল ঠিক করে। রাষ্ট্র,সমাজ, ভাষা এমনকি ধর্মের ভিত্তিতেও জাতীয়তাবাদের বিস্তার হয়। এখন যে জাতীয়তাবাদ ভারতকে একত্রিত করে রেখেছে তার পেছনে ধর্মভিত্তিক পরিচয় প্রধান। কিন্তু এটাও বুঝতে হবে মোদির আমলে সাম্প্রদায়িকতা বা তেমন কিছু ততটা বেগবান হতে পারেনি। বহুমত ও পথের সমন্বয় কিংবা ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যই হয়তো তাদের জায়গাটা ধরে রাখে। যা আমরা পারিনা।

ভারত যেমন রক্তের উত্তরাধিকার ছেড়ে আসতে পেরেছে আমরা পারিনি। বলছিলাম আমাদের মিডিয়া জুড়ে ভারতের সাথে সম্পর্কের যে গুণগান তা মিথ্যা হয়তো নয়, কিন্তু এটাও সত্য ভারত বিরোধিতা এখনো আমাদের রাজনীতির এক বিষফোঁড়া। এর জন্য কে কতটা দায়ী সেটা সবাই কমবেশি বোঝেন। বুঝিনা যেটা সেটা হচ্ছে, কী কারণে ভারত বিরোধিতা আর সাম্প্রদায়িকতা সমার্থক?

আওয়ামী লীগ বেশ বুঝতে পারে এই বিশাল প্রতিবেশির সাথে বিবাদ করা লাভ হবেনা। আমেরিকার কথাই ভাবুন। পাশের দেশেগুলোর সাথে তাদের সম্পর্ক মনোহর কিছু না, বরং আছে নানা সমস্যা। এমনকি জলসীমায় বিদ্যুৎ দিয়ে লোকপাচার বন্ধ করার মত কাজও হয় সেখানে। আছে কাঁটাতার । কিন্তু ফেলানী আছে কিনা সেটা জানিনা!

যে বিষয়গুলো আমাদের দেশ ও ভারতের সাথে সম্পর্কের বৈরি সেগুলো নিয়ে রাজনীতির মাথাব্যথা নাই। বরং তাকে জিঁইয়ে রাখাই যেন তার কাজ।

একটা বিষয় আমরা সবাই জানি ভারতের নিন্দা বা তার নামে গায়ে জ্বালা ধরলেও আমাদের মানুষেরা ভারত ভ্রমণে রেকর্ড করেন। কয়েকবছর ধরে সেদেশে যাবার হিড়িক এবং সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণ। নানা কারণে যেতে হয় বৈকি। বিশেষত চিকিৎসা আর কেনাকাটার জন্য ভারত এখনো প্রিয়। চিকিৎসা বিষয়টা বড় গোলমেলে। আমাদের সমাজে মেধাবী ডাক্তার কিংবা চিকিৎসকের কমতি নাই। কমতি সেবার। আমাদের চিকিৎসাসেবা মুখে যাই বলি, এখনো মান্ধাতা আমলে। সাথে আছে বাণিজ্য। একেকটা বড় বড় মেডিক্যাল সেন্টার বা নার্সিংহোম যেন ফাইভস্টার হোটেল। এদের ভেতরে-বাইরে ফকফকা বটে, কাজের বেলায় ঘোড়ার ডিম। মনে হবে আপনি আরামে শুয়ে থাকার জন্য সেখানে যাচ্ছেন। না আছে সেবা, না চিকিৎসা। ফলে এগুলো গরীবের রক্ত চুষলেও মধ্যবিত্ত আর ধনীদের নাগাল পায়না। খেয়াল করবেন বড় বড় মানুষ নামে পরিচিতজনেরা কিছু হলেই ব্যাংকক সিঙ্গাপুর কিংবা ইউরোপে চলে যান। এমনকি দেশের রাষ্ট্রপতিও। তাহলে যে সেবা যে চিকিৎসায় রাষ্ট্রপতির আস্থা নাই সাধারণ মানুষ সেখানে আস্থাশীল হবেন কী করে? ভারত হলো এ জায়গায় নিম্ম মধ্যবিত্ত, বড়জোর মধ্যবিত্তের টার্গেট। এটা এড়ানোর উপায় নাই।

আর আছে কেনাকাটা। পূজা তো বটেই ঈদের আগে আপনি কলকাতায় হাঁটতে গেলে যার সাথে ধাক্কা খাবেন, তিনিই বাংলাদেশি। বাণিজ্যের এমন রমরমা বাজার ভারত কেন হাতছাড়া করবে? তাই তারা রাজনৈতিকভাবে এমন সব কথা বলে মনে হয় পরম দোস্ত। আজ মিডিয়ায় এও দেখলাম মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, তিনি আবার আসবেন যখন শেখ হাসিনা ফের সরকার গঠন করবেন। এটা তাঁর মুখের কথা না মনের কথা জানিনা তবে এমন বক্তব্য সন্দেহজনক।

কারণ আমাদের দেশের রাজনীতিতে কে সরকার গঠন করবে আর কাকে জনগণ নির্বাচিত করবেন সেটা তিনি বলে দিতে পারেন না। এর মানে কি এই আর কেউ গদিতে এলে তিনি আসবেননা? এই ভদ্রমহিলা বামরাজত্বে সাধারণ নামে পরিচিত নেতাদের পোশাকে বা জুতোয়-চটিতে হারিয়ে দিলেও, সরকারিভাবে সেখানে একনায়কত্ব কায়েম করেছেন। কলকাতার বুদ্ধিজীবী-লেখক-গায়ক সবাই তাঁকে এমনভাবে বন্দনা করেন মনে হয় লজ্জায় কান কাটা যায়। কিছুদিন আগে নচিকেতার মত প্রতিবাদী গায়ক বলেছেন মমতার ভেতর নাকি লেনিনের ছায়া আছে। আগে জানলে লেনিনের মূর্তি ভেঙে ফেলার দরকার পড়তো না। তিনি নিজে লজ্জায় ভেঙে পড়তেন। লিঙ্গভেদ ভুলে যাওয়ার মত স্তাবকতা হয়ে সেখানে।

সেগুলো আমাদের বিবেচ্য না। আমাদের কথা হচ্ছে যে তিস্তার পানি বন্টন মমতার কারণে হয়নি বলে বাজারে চালু সে ব্যাপারে তাঁর কি বক্তব্য? এ বিষয়ে কিছু বলেন না কেন তিনি? বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের নাজুকতা তো সেখানে। নাজুক সম্পর্ক সীমান্তে। আমাদের বিরোধী দলগুলো ও আসলে এক ধরনের চামাচামিতে ব্যস্ত। বিএনপির যত ভোট আর সমর্থন তার পেছনে এই ভারত বিরোধিতা। সেটা বুঝতে পেরে খালেদা জিয়া কী করেছিলেন? সেদেশের রাষ্ট্রপতি বাঙালি প্রণব মুখার্জির সাথে দিন তারিখ ঠিক করেও দেখা করেননি। সে দেখা না করার পাপ বা ভুল তাঁকে কী শাস্তি দিয়েছে তা আমরা সবাই জানি।

কিন্তু যেটা বুঝিনা এটাই যদি তাদের আদর্শ বা স্ট্যান্ড পয়েন্ট হয় তো এখন তারা প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে ভারতের সমর্থনের জন্য মরিয়া কেন? একটা তো পরিষ্কার অবস্থান থাকতে হবে। ভোটের জন্য সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য আপনারা ভারতের সাথে বৈরিতার ভাব দেখাবেন, আবার সুযোগ বুঝে পায়ে ধরবেন- এটা কেমন নীতি? ভারতের রাজনীতি তো বাঙালিরা নিয়ন্ত্রণ করেনা।

যারা করে তারা খুব ভালো জানেন আমরা কী চাই আর কতটা দিলে আমাদের মেরুদণ্ড সোজা থাকে না। তাই তারা সেভাবেই খেলেন। এই খেলার কারণে আজ অবধি আমাদের দেশে সুষ্ঠু বিরোধিতা কিংবা গঠনমূলক সম্পর্ক কোনটাই গড়ে ওঠেনি।

উল্টো সেদিন খবরে দেখলাম ভিসা আবেদন এত বেশি যে তাদের ঢাকা শহরে একাধিক কেন্দ্র খুলতে হয়েছে। ভারতের সাথে সম্পর্কে যে নির্ভরতা সেটা যতদিন সুষ্ঠু ও সমার্থক না হচ্ছে বিরোধিতা মুখের কথা হয়েই থেকে যাবে। শেখ হাসিনা এখন অনেক প্রাজ্ঞ । তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জায়গা করে নেয়ার কারণে অনেক কথা মুখের ওপর বলতে পারেন। বিশেযত, সবকিছু কন্ট্রোল বা নিয়ন্ত্রণের একটা বিষয় আছে তাঁর ভেতর। ফলে নানা বিষয়ে ভারতের সাথে বৈষম্য কমানো আর নিজেদের চাওয়া বুঝে নিতে পারেন তিনি। কিন্তু সমাজ তা মানেনা। সমাজে এখনো বদ্ধমূল ধারণা আওয়ামী লীগ ভারতকে সব দিয়ে দেয়। আর এই ধারণার ভুক্তভোগী নিরীহ সংখ্যালঘু আর কিছু উদারমনা মুসলিম জনগোষ্ঠী। যারা মূলত ভারতের কোনও আনুকূল্য পায় না। ব্যবসা আনুকূল্য যারা লাভ করে তাদের অন্তরেই ভারত বিরোধিতা প্রকট।

রোহিঙ্গা, তিস্তার পানি, সীমান্ত- এমন সব জটিল বিষয়ে একটা সমঝোতা বা ভারতের ন্যায্য ভূমিকা না থাকলে এই ধোঁয়াশা যাবে না। এবং সেটা জনগণের কাছে স্পষ্ট হতে হবে। নাহলে কাগজে কলমে চিকিৎসায় বা বেড়াতে যাবার জন্য ভালো সম্পর্ক থাকলেও, খেলার মাঠ কিংবা রাজনীতিতে এবং সমাজে সম্পর্ক হবে সাপে-নেউলে। এটা কারো কাম্য না। বাড়িতে বাড়িতে ভারতীয় টিভির সিরিয়াল, ভারতীয় মুভি আর কথায় কথায় তাদের বিরুদ্ধাচারণের কারণগুলো খুঁজে বের করা কঠিন কিছু না। কিন্তু জানলেও তার সমাধান চাইনা আমরা। জিঁইয়ে রাখলে ভূমিদস্যুদের লাভ।  জিইয়ে রাখতে পারলে রাজনীতির লাভ।