মনীষার আলো: অভিজিৎ ভাবনা

মারুফ রসূল
Published : 11 Sept 2018, 02:10 PM
Updated : 11 Sept 2018, 02:10 PM

তিনি জন্মেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে— মুক্তিযুদ্ধের পরের বছরই (১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২) তাঁর জন্ম। মাত্র বিয়াল্লিশ বছর বয়সে (২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫) তাঁর ক্ষত-বিক্ষত শবদেহটি ঘিরে যখন জ্বলে উঠেছিল প্রতিবাদের মোমবাতি, আমরা জেনেছিলাম— মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে প্রতিদিন নিহত হচ্ছে অযুত প্রশ্নবোধক চিহ্ন এবং মাটি-চাপা দেয়া হচ্ছে দ্বিতীয় বিদ্যার যাবতীয় পাঠ্যসূচি।

১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি কবি শামসুর রাহমানকে হত্যার চেষ্টা থেকে চলতি বছরের ১১ জুন প্রকাশক শাহজাহান বাচ্চু হত্যাকাণ্ডের যে মৌলবাদী অপরাজনীতি বাংলাদেশে বিরাজ করছে, তার শিকার হয়েছিলেন অভিজিৎ রায়। এই অপরাজনীতির বিরুদ্ধে মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির যে লড়াই তা আজও চলমান, তার এক উজ্জ্বল সহযোদ্ধা তিনি। সুতরাং অভিজিৎ রায়ের শবযাত্রার গন্তব্য যা-ই হোক তাঁর চিন্তার প্রতিভা জাতির মুক্তচিন্তার মানসকাঠামো নির্মাণের নির্বিকল্প অংশ। আর এটা আরও টের পাই যখন তাঁর গ্রন্থের ওপর চলে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা বা তাঁকে সসম্ভ্রমে পাশ কাটিয়ে চলাটাই নিরাপদ মনে করে রাষ্ট্র ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান।

জীবনানন্দ তাঁর একটি কবিতায় লিখেছেন— 'এখন অপর আলো পৃথিবীতে জ্বলে'। সৃষ্টিশীল ও গবেষণাধর্মী অভিসন্দর্ভ যদি আলোর আকর হয়, তবে অভিজিৎ রায় কাজ করেছিলেন এই 'অপর আলো'র কারুকার্য নিয়ে। তিনি খুঁজে ফিরেছিলেন একটি 'অপর ভাষা'— সেটা সাহিত্যের ভাষা নয়, তবে চিন্তা-পদ্ধতির ভাষা। এখানেই অভিজিৎ রায় তাঁর সম-সাময়িক সৃষ্টিশীল মানুষদের সঙ্গে বন্ধনীভুক্ত হয়েও খানিকটা তফাতের। তাঁর নাতিদীর্ঘ জীবনের কর্মপ্রয়াস গভীর, অবিচল কিন্তু ব্যঞ্জনাময়। ২০০১ সালে তিনি যখন তাঁর চিন্তার সহযোদ্ধাদের নিয়ে 'মুক্তমনা' ওয়েবসাইটটি তৈরি করেন, তখনও বাংলা ব্লগ ধারণাটি অতো সুপরিচিত ছিলো না। 'মুক্তমনা'য় তখন থেকেই অভিজিৎ রায় ও তাঁর সহযোদ্ধারা একটি সুপরিকল্পিত লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করতে থাকেন। আমাদের মেনে ও মানিয়ে নেয়া চিন্তার বদ্ধ জলাশয়ে 'মুক্তমনা' বারবার প্রশ্ন করতে শেখার তাগিদ তৈরি করেছিল। আমরা বলতে বোঝাচ্ছি, সে সময়ে যারা স্কুলে পড়তাম এবং কালেভদ্রে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পেতাম।

২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে মৌলবাদীদের চাপাতির আঘাতে আহত হয়েছিলেন প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক লেখক হুমায়ুন আজাদ। সে সময়ের গণমাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে এই খবর ছাপা হয়েছিল, ছাপা হয়েছিল শিক্ষার্থীসহ সর্বস্তরের মানুষের প্রতিবাদের খবর। কিন্তু আজ তো একথায় একমত হতে কারও দ্বিধা থাকার অবকাশ নেই যে, গণমাধ্যম তার গঠন ও তার কাছে মানুষের প্রত্যাশার কারণেই দীর্ঘ গভীর কোনও নিবন্ধ লিখতে পারে না। সুতরাং হুমায়ুন আজাদের ওপর পাশবিক আক্রমণ ও সে নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদের খবর আমরা মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীরা খবরের কাগজে পড়ছিলাম। কিন্তু এর পেছনের রাজনীতিকে তলিয়ে দেখার সুযোগ আমাদের ছিল না। সেই সুযোগটি তৈরি করে দিয়েছিল 'মুক্তমনা'। একের পর এক নিবন্ধ পিডিএফ আকারে ওয়েবসাইটে রাখা হতো এবং সেগুলো পড়তে পড়তে আমরা জেনেছিলাম— এটি কেবল একজন প্রথাবিরোধী লেখকের ওপর আক্রমণ নয়, এর সঙ্গে যোগাযোগ আছে বাংলাদেশের জন্ম-ইতিহাস এবং দর্শনগত লড়াই। তাই আজ এ কথা স্বীকার করতে আমাদের গর্ব হয় যে— সেদিন 'মুক্তমনা'র ক্লাসরুমে আমাদের চৈতন্যের চক্ষুদান পর্ব সমাপ্ত হয়েছিল, স্যানফরাইজড মধ্যবিত্ত ও লুম্পেন শিল্পচর্চার বাইরে আমরা সৃষ্টিশীলতার আরেকটি দিক আবিষ্কার করেছিলাম।

নিজের লেখায় অভিজিৎ রায় যেহেতু শেষ পর্যন্ত ছিলেন আশাবাদী, শেষ পর্যন্ত ব্রুনোর মতোই তিনি সূর্যকে সাক্ষী রেখে নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলির ছাপ যুক্তির সিলমোহরে প্রত্যায়িত করেছিলেন— সেহেতু আমরা পাঠক হিসেবে তাঁর গ্রন্থগুলোকেই ধরে নিতে পারি আশাবাদের সাঁকো। আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী তাই আমাদের বিবেচনায় কেবল মহাবিশ্বের সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধীয় একটি বই-ই নয়, এটি অভিজিৎ রায়ের আত্মজীবনীরও শিরোনাম।

লেখক ফরিদ আহমেদের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে বইটি প্রকাশিত হয়েছিলো ২০০৭ সালে। এই বইটির বিজ্ঞান-বিষয়ক তত্ত্ব সন্নিবেশ নিয়ে কথা বলার যোগ্যতা আমার নেই কিন্তু যে অসামান্য পরিশ্রমে লেখকদ্বয় বৈজ্ঞানিক নানা শব্দের বাংলা পরিভাষা ব্যবহার করেছেন— তা তুলনারহিত। হায়! সূর্য আমাদের আড়ালে দাঁড়িয়েছিল আলো হাতে অপেক্ষারত, আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম অন্ধকারে নিজেদের স্বভাবদোষে।

বৈজ্ঞানিক ও সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা অভিজিৎ রায়ের আরেকটি বই সমকামিতা। ২০১০ সালে বইটি প্রকাশ করেছিল 'শুদ্ধস্বর'। আমার জানা মতে, বিজ্ঞান ও সমাজ-মনস্তত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে সমকামিতার ওপর এটিই সম্ভবত বাংলায় লেখা প্রথম বই। এ বইটিতে অভিজিৎ রায় যেভাবে একটি ধারণাকে ভেঙেছেন, প্রচলিত ও বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপটে তার বিচার করেছেন, তা পাঠকের সামনে চিন্তার একটি জগৎ প্রতিষ্ঠা করে। এই মাত্র ক'দিন আগে সমকামিতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিশেবে বর্ণনা করা ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিল করে দেশটির সর্বোচ্চ আদালতের দেয়া ঐতিহাসিক রায় ঘোষিত হয়েছে। প্রকাশের আট বছর পর আমাদের বোধগম্য হলো কেন সমকামিতা গ্রন্থের উৎসর্গপত্রে অভিজিৎ রায় দান্তের ডিভাইন কমিডিতে বর্ণিত নরকের প্রবেশদ্বারের উৎকীর্ণ পদাবলী তুলে ধরেছিলেন এবং বাক্যটি দীর্ঘ করেছিলেন কার্ল মার্কসের প্রসঙ্গ এনে।

২০১১ সালে লেখক রায়হান আবীরকে (২০১৪ সালে ক্যান-ফিকো পুরস্কারপ্রাপ্ত) সাথে নিয়ে অভিজিৎ রায় লেখেন অবিশ্বাসের দর্শন বইটি। দর্শনগত ধারণাকে প্রশ্নের পাথরে যাচাই করে পুরো বইটি এগিয়ে নেয়া হয়েছে। যাঁরা বইটি পড়েছেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে চমৎকৃত হবেন বইটির বিষয়বস্তু এগিয়ে নেবার অভিনব পদ্ধতিগুলো লক্ষ্য করে।

২০১২ সালের বইমেলার শেষদিকে বের হয় তাঁর আরেকটি বই ভালবাসা কারে কয়। এখানেও তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক চোখ সজাগ, তিনি নির্মোহ যৌক্তিক চোখে বিজ্ঞানের ধারাবাহিকতায় বর্ণনা করেছেন ভালোবাসার অপার্থিব বিস্ময়কে।

তাঁর সর্বশেষ বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে, একেবারেই ভিন্ন একটি বিষয়ে। ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো: এক রবি-বিদেশিনীর খোঁজে বইটিতে আমরা যে অভিজিৎ রায়কে পাই, তিনি ঘড়ির বয়ষ্ক কারিগরের মতোই খুঁজে বের করেন রবীন্দ্রনাথের হূদয়জ অলিগলি— তবে ভিন্ন আঙ্গিকে। বলা ভালো, ওকাম্পো ও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাংলায় বহুল পঠিত দুটো বই— শঙ্খ ঘোষের ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ (১৯৭৩) এবং কেতকী কুশারী ডাইসনের রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সন্ধানে (১৯৮৫)— বিবেচনায় নিয়েও অভিজিৎ রায়কে তাঁর ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির জন্য একটি স্বতন্ত্র অবস্থানে রাখা যায়। রবীন্দ্রনাথকে নয়; ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোকে প্রসঙ্গ কাঠামোতে রেখেই অভিজিৎ রায় এই অনন্য সম্পর্কের সমীকরণ খুঁজেছেন— বর্তমান লেখকের এই যুক্তি নির্মোহ এবং অবশ্যই প্রমাণসাপেক্ষ।

অভিজিৎ রায় খুব বেশি লিখে যেতে পারেননি। তাঁর সৃজনযাত্রায় রক্তাক্ত ছেদচিহ্ন আমাদের যে ক্ষতি করেছে, তা অপূরণীয়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে বিশ্বাসের ভাইরাস বইটির কথা আমার বারবার মনে পড়ে। ধর্মান্ধতায় ক্ষত-বিক্ষত বাংলাদেশের এক্স-রে প্লেটটি তিনি আমাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ২০১৪ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। এর এক বছর পরই তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বইটিও এখন আর বইমেলাতে পাওয়া যায়না। অর্থাৎ মৌলবাদের গভীর অসুখে আক্রান্ত বাংলাদেশের চিকিৎসা আপাতত বন্ধ আছে। ক্ষত ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে।

আমরা যাকে বলি সৃষ্টিশীলতা, তার খোঁজে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষের মুখোমুখি হলে আসলে আমরা তাঁর সৃষ্টির সঙ্গেই সংলাপ নির্মাণ করি। অভিজিৎ রায়ের ব্লগপোস্টগুলোর কিছু কিছু বই আকারে বের হলেও অনেকটা অংশই এখনও রয়ে গেছে ব্লগে— হয়তো এটাই বাঞ্ছনীয়। সুতরাং অভিজিৎ রায়কে সামগ্রিক জানতে হলে সেই পোস্টগুলোও গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্লগপোস্টগুলো আমার বিবেচনায় এ কারণেই এতো গুরুত্বপূর্ণ যে— আমাদের নাতিশীতোষ্ণ, নরম, লিরিক্যাল, অনপরাযুক্ত, নিখুঁত ও নিয়মানুগ চিন্তা প্রক্রিয়ায় এই ব্লগপোস্টগুলো প্রবর্তন করেছে নানা ক্র্যাক, প্রশ্ন-যুক্তি ও বিজ্ঞানমনষ্কতা ঢুকে পড়েছে তার মধ্য দিয়ে। এখানেই তিনি বর্তমান, তিনি সার্থক।

বিন্দুতে বিন্দুতে তাঁর দর্শনের জ্বলে উঠাই নির্মাণ করে অভিজিৎ সঞ্চারপথ। সে সঞ্চারপথে একদিন বাংলাদেশ হাঁটবেই। সে পর্যন্ত তাঁর বইগুলো থাকুক আমাদের সামনে, বইয়ের বক্তব্যগুলো থাকুক আমাদের মগজে।