যাত্রাপালা: চন্দ্রগুপ্ত-৯। নবম অঙ্ক, ১ম দৃশ্য।

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 10 Sept 2018, 01:39 PM
Updated : 10 Sept 2018, 01:39 PM

[পাটলিপুত্র নগরে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের প্রাসাদের অভ্যন্তরস্থ উদ্যান। উদ্যানের মধ্যভাগে অবস্থিত বৃষ্টিস্নাত কদম্ব-বীথিতে পায়চারি করিতে করিতে সম্রাট ক্ষণে ক্ষণে সিংহদ্বারের দিকে উদ্বিগ্ন দৃষ্টিপাত করিতেছিলেন। কিয়ৎকাল পর রথের চক্রঘর্ঘর কর্ণগোচর হইতেই সম্রাট সপ্রহরী সিংহদ্বারের দিকে ছুটিয়া গেলেন এবং শকটের দ্বার উন্মোচন করিয়া জানু ভূমিতে রাখিয়া নতশিরে অবতরণরত চাণক্যের পদবন্দনা করিলেন।]

চাণক্য: চন্দ্রগুপ্ত, আসিতে আসিতে মহামন্ত্রীর মুখে সকলই কমবেশি অবগত হইলাম। শকটের গবাক্ষপথে স্বচক্ষেও দেখিলাম, কিশোর শিক্ষার্থীরা রাজপথে যান নিয়ন্ত্রণ করিতেছে এবং সড়ক-রক্ষীগণ অসহায়ের মতো তাকাইয়া রহিয়াছে। এও শুনিলাম, এই কিশোর-কিশোরীদিগকে শিখণ্ডী করিয়া বিরোধী দলীয় নেতা ও বুদ্ধিজীবীরা নাকি তোমাকে ক্ষমতাচ্যুত করিবার ষড়যন্ত্র করিতেছে।

চন্দ্রগুপ্ত: গুরুদেব, আর্যাবর্ত সকল ক্ষেত্রে শতভাগ সঠিক চলিতেছে না- ইহা বিরোধী দলের মুখ হইতে শুনিবার প্রয়োজন নাই, কারণ আমি নিজেই তাহা অস্বীকার করি না। কিন্তু ইহাওতো সত্য যে সাম্রাজ্য পরিচালনা সহজ কাজ নহে এবং আমি এক জনের পক্ষে সকল পক্ষকে সন্তুষ্ট করাও অসম্ভব।

চাণক্য: প্রিয় চন্দ্রগুপ্ত! উপাসনার মতো সাম্রাজ্য তথা প্রশাসন পরিচালনার দুইটি উপায় আছে: সাকার ও নিরাকার। সাকার প্রশাসন আবার দুই প্রকার: ব্যক্ত ও অব্যক্ত। ব্যক্ত প্রশাসন তিন প্রকার: ১. অতিব্যক্ত, ২. স্বল্পব্যক্ত এবং ৩. অস্ফুট। সাকার প্রশাসনে প্রশাসক উপস্থিত থাকিবেন। তিনি ১. বেশি কথা বলিতে পারেন, ২. স্বল্প কথা বলিতে পারেন কিংবা ৩. চুপ থাকিতে পারেন, যাহাকে আমি যথাক্রমে অতিব্যক্ত স্বল্পব্যক্ত এবং অব্যক্ত বলিতেছি।

তুমি এবং তোমার অমাত্যেরা কথা মোটামুটি বেশি বল, অর্থাৎ তুমি একটি অতিব্যক্ত প্রশাসন চালাইতেছ। তুলনামূলকভাবে খৈলদা স্বল্পব্যক্ত প্রশাসক। অতিব্যক্ত প্রশাসকের তুলনায় স্বল্পব্যক্ত প্রশাসনশৈলী নিরাপদ। সর্বাপেক্ষা নিরাপদ হইতেছে অস্ফুট প্রশাসন। 'অস্ফুট'- অর্থাৎ লোকে বুঝিতেই পারিবে না তুমি আসলে কী বলিতেছ, কিংবা প্রত্যেক শ্রোতা নিজের মতো করিয়া তোমার বক্তব্য বুঝিয়া লইবে, কিন্ত বুঝিতে ভুল হইলে তোমার কোনো দোষ দিতে পারিবে না। যেকোনও প্রশ্ন কিংবা অভিযোগের উত্তরে যদি বল: 'ওঁ', অর্থাৎ 'হুম', তবে তুমি অস্ফুট প্রশাসক। ইহার অর্থ 'হুম, আমি শুনিলাম, ভাবিয়া পরে উত্তর দিব' কিংবা 'হুম দেখি কী করা যায়'।

নিরাকার প্রশাসক পারতপক্ষে জনসমক্ষে আসিবেন না, কথা বলারতো প্রশ্নই আসে না। যদি কিছু বলিতেই হয়, তবে তাহা নিজে না বলিয়া কম গুরুত্বপূর্ণ কোনো অমাত্যকে দিয়া বলাইবেন যাহাতে কোনো ঝামেলা হইলে সেই অমাত্য পদত্যাগ করিতে পারেন। ইহা ব্যতীত কোনো না কোনো বাহানা, যেমন ধর, কোনো বিশ্ব নেতৃসম্মেলন কিংবা শারিরীক অসুস্থতার বাহানা দিয়া প্রশাসক ঘন ঘন বিদেশেও অবস্থান করিতে পারেন। ইহাও নিরাকার প্রশাসকের লক্ষণ। ইহার একটি প্রধান সুবিধা এই যে কোনো অঘটন যদি ঘটিয়াই যায়, তবে সেই অঘটনের দায় প্রশাসকের স্কন্ধে চাপিবে না।

আমি মনে করি, অতিব্যক্ততাই তোমার প্রশাসনের মূল সমস্যা। যেকোনও ব্যাপারে তুমি কিংবা তোমার অমাত্যগণের কথা বলা চাইই চাই। সড়ক দুর্ঘটনায় দুইজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হইয়াছে- ইহা নিঃসন্দেহে দুঃখের বিষয়। মৃত্যু লইয়া হাসাহাসি করা যে কাহারও জন্য শোভন নহে, সাম্রাজ্যের কোনো অমাত্যের জন্যে তো নহেই। পৃথ্বীরাজ কৌহান কেন খামাখা ব্রহ্মাবর্তের দুর্ঘটনার প্রসঙ্গ তুলিয়া দূরদর্শনে শ্বদন্ত (নাকি শ্বদন্ত!) বিকাশ করিতে গেল? তদুপরি যে বক্তব্য স্থলমার্গ-অমাত্য ঐবদুল্ল কৈদরের দিবার কথা, জলমার্গ-অমাত্য পৃথ্বীরাজ কেন তাহা দিতে গেল? এই অভব্য আচরণের জন্যে পৃথ্বীরাজ পদত্যাগ করিলে তোমার প্রশাসনের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হইবার সম্ভাবনা ছিল।

চন্দ্রগুপ্ত: প্রভু, কোনও অমাত্য কোথায়, কখন, কোন বক্তব্য দিবে তাহা নিয়ন্ত্রণ করা কি আমার পক্ষে আদৌ সম্ভব? আমারও তো বয়স হইয়াছে, নাকি? আপনি বারবার বারণ করা সত্ত্বেও স্বীয় জিহ্বাইতো ঠিকমতো সামলাইতে পারি না! পৃথ্বীরাজকে পদত্যাগ করিতে বলা আমার পক্ষে সম্ভব নহে, কারণ সমতটের এক বিশাল অঞ্চলকে এই পৃথ্বীরাজই 'সর্বহারা' নামক দস্যুদিগের কবল হইতে মুক্ত করিয়াছিল এবং মুক্ত রাখিয়াছে। শরিয়তপুর অঞ্চলের লোক তাহাকে ঈশ্বরের দূত মনে করিয়া থাকে। তদুপরি পৃথ্বীরাজ না থাকিলে আমলক দলের জনসভায় অতিদ্রুত ও সুলভে জনসরবরাহের দায়িত্ব আর কাহার উপর অর্পণ করিয়া আমি নিশ্চিত থাকিব? পৃথ্বীরাজের মতো ব্যক্তিগণকে আপনি 'নেতা' না বলিয়া 'দস্যু' বলিতেই পারেন, কিন্তু এই সকল দস্যুদিগকে লইয়াই আমার সরকার-সংসার। সুশীল বুদ্ধিজীবীগণ পত্রপত্রিকায়, সভাসমিতিতে আমার সরকারের প্রশংসা-টশংসা করে বটে, এবং আমিও বিভিন্ন উপলক্ষে তাহাদিগকে ভেজাল স্বর্ণনির্মিত পদক-ফদক দিয়া থাকি বটে, কিন্তু কে না জানে শুষ্ক কথায় চিপিটক ভিজে না। আমলক দলের ভাড়াটিয়া দস্যুগণ চাপাতিবাজি না করিলে আমি কবেই সিংহাসনচ্যুত হইতাম এবং আমি সিংহাসনচ্যুত হইলে আমলক দল কিংবা আর্যাবর্তের কপালে যে কী হইতে পারিত বা ভবিষ্যতে হইতে পারে, তাহা কল্পনা করিয়া এই দারুণ গরমেও আমার মেরুদণ্ড দিয়া যেন মেরুপ্রদেশের বরফস্রোত প্রবাহিত হইতেছে।

চাণক্য: বৎস চন্দ্রগুপ্ত, কোনো শাসকের জনসমর্থন যখন তলানীতে পৌঁছে, তখন দস্যু ও গুণ্ডার উপর নির্ভর করা ছাড়া তাহার আর উপায় থাকে না। আর্যাবর্তে আত্মসমর্পী দলের গুণ্ডাদিগের অত্যাচারের কথা তোমার পিতা শাক্য মজ্জব তাঁহার আত্মজীবনীতে লিখিয়াছেন। আত্মসমর্পী দল একদিন আর্যাবর্তের একমাত্র দল ছিল। মাত্র পঞ্চাশ বছরে সেই দল ইতিহাসের আবর্জনাস্তুপে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে। গুণ্ডানির্ভরতা আত্মসমর্পী দল এবং তাহার নেতাদিগকে রক্ষা করিতে পারে নাই।

সুশাসন নিশ্চিত করিতে না পারিলে আমলক দলেরও একই দশা হইতে পারে। রাজনীতিতে কেহই অপরিহার্য নহে। তুমি ভাবিতেছ, তোমার অবর্তমানে বৈনপী-জৈমত হাজার হাজার আমলকপন্থীকে হত্যা করিবে। করিলই বা, আর্যাবর্তে খুনাখুনি কি নতুন হইতেছে? হালাকু খান বা নাদির শাহেরা কি এতদাঞ্চলে একদিনে কয়েক লক্ষ মানবসন্তান হত্যা করেন নাই। খুনাখুনি-হত্যাই যদি না হয়, তবে তথাকথিত ঈশ্বর মহোদয় কী প্রকারে তাঁহার 'ফ্যামিলি প্ল্যানিং' নিশ্চিত করিবেন? মাভৈ! তোমার-আমার মৃত্যুর হাজার বৎসর পরেও আর্যাবর্তে জীবন সমভাবে বহমান থাকিবে। তোমার আজিকার দুশ্চিন্তা অনাগত যুগের ঐতিহাসিকদের অট্টহাস্যের কারণ হইবে, সন্দেহ নাই।

তবে আপাতত সম্ভবত তোমার ভয় নাই, কারণ তোমার বিপক্ষ নেতৃবর্গ নিতান্তই অপদার্থ। নেত্রী কারাগারে, অথচ বৈনপী দলের নেতাকর্মীগণ অপোগ- শিশুর মত বৃদ্ধাঙ্গুলি চুষিতেছে। আর কর্মনষ্ট, বামাপদ (বাম+আপদ) নেতাদিগের কথা কী বলিব! তোমার পিতার নেতৃত্বে আর্যাবর্ত স্বাধীন করিয়াছে আমলক দল। বামাপদদিগের একটি অংশ এই স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল। তাহাদের কোনো নেতার হস্তে না হইয়া তোমার পিতার হস্তে কেন আর্যাবর্ত স্বাধীন হইল এই দুঃখ তাহারা বংশানুক্রমে মনে পুষিয়া রাখিয়াছে। যে কোনো অজুহাতে শাক্য মজ্জব, তাঁহার পরিবার কিংবা আমলক বিরোধিতাই তাহাদের যাবতীয় রাজনীতির একমাত্র লক্ষ্য। পৃথিবীতে যেমন তিন ধরনের রান্না আছে: ফরাসি, ভারতীয় ও চৈনিক, বাকি সকলই এই তিনের রকমফের, তেমনি আর্যাবর্তেও মূলত দুইটি রাজনৈতিক দল: আমলক ও অনামলক। বৈনপি, জৈমত, কর্মনষ্ট বা বামাপদ সকই অনামলক ঝোলের রকমফের। কোনটি একটু বেশি ঝাল, যেমন জৈমত; কোনটি খুব বেশি ঝাল নয়, যেমন কর্মনষ্ট; কোনটির ঝাল মাঝারি মানের, যেমন বৈনপী।

ঐমেরিকা মহাদেশ-প্রবাসী এক বঙ্গবাসী বৈয়াকরণ অহ্মদ শৈমমক সম্প্রতি ফৌসবুকে লিখিয়াছেন: 'আর্যাবর্তের জনগণের চক্ষে আমলক দল আপদ, বৈনপি বিপদ, জৈমত শ্বাপদ এবং বামাপদরা কোনো পদেরই নহে!', যাহার নিগলিতার্থ হইতেছে, তোমার কিংবা তোমার দলের এখনও আশা আছে। তুমি এবং তোমার মন্ত্রীরা যদি কথা একটু কম বল, নিতান্ত বলিতে হইলে স্বীয় জিহ্বা শাসনে রাখিয়া, শ্রোতাকে অপমান না করিয়া কথা বল এবং সবচেয়ে বড় কথা হইতেছে, কথা বলা হইতে কাজ যদি বেশি কর, তবে যাহারা অধূনা তোমাকে 'আপদ' কিংবা 'গলার কাঁটা' ভাবিতেছে, একদিন তুমি তাহাদিগের 'গলার মালা'য় পরিণত হইলেও হইতে পার।

তোমাকে হত্যা করিবার ও ক্ষমতা হইতে হটাইবার কম চেষ্টা অনামলকেরা করে নাই। একবিংশ অগুস্ত তারিখে দাড়িম্ব-বোম্ব নিঃক্ষেপ, গজাগার বিদ্রোহ, মুক্তাঝিলে তৈন্তলক সমাবেশ, অগ্নিশেল নিঃক্ষেপ, কৌটা আন্দোলন কোনটিতেই তাহারা সফল হয় নাই। রাখে হরি মারে কে! আর্যাবর্তের বিরোধীদলীয় নেতৃবর্গ মহাকাশে স্থাপিত 'গৌরমিত্র' নামক কৃত্রিম উপগ্রহের মতো, যে উপগ্রহ নিজের গায়ের জোরে ঠেলিয়া আকাশে পাঠাইবার মতো ক্ষমতা তুমি চন্দ্রগুপ্ত কিংবা আমলক সরকারের ছিল না। বিদেশ হইতে, বিদেশি প্রযুক্তির সাহায্যে এই উপগ্রহ কক্ষপথে স্থাপন করিতে পারিয়া তোমরা তৃতীয় ছাগশিশুর মতো আহ্লাদে অষ্টখণ্ড হইয়াছ। তোমাদিগের এই উপগ্রহের মতোই আর্যাবর্তের বিরোধী নেতৃবৃন্দের নিজস্ব কোনো আলো নাই, অন্যের আলোকে আলোকিত হইবার চিরবাসনা তাহাদের মনে। অদ্য কিশোরদিগের স্কন্ধে ভর দিয়া তাহারা ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখিতেছে। অদূর ভবিষ্যতে ভিক্ষাজীবী, নগরনটী, মরণাপন্ন রোগী, উন্মাদ, হিজড়া, সদ্যজাত শিশু- জানি না নতুন আর কোনও জনগোষ্ঠীকে আন্দোলনে নামাইয়া তাহারা ক্ষমতা দখলের প্রয়াস পাইবে। সাম্রাজ্যের বিরোধী দলের অবস্থা এতটাই করুণ যে ক্ষুধা অনুভব হইবার ভয়ে তাহারা নিজেরা কোঁত দেয় না, পরের কোঁত দিয়া ফোকটে মলত্যাগজনিত সুখানুভবের গোপন বাসনা মনে পোষণ করে।

চন্দ্রগুপ্ত: প্রভু, আপনার কথা শুনিয়া আশ্বস্ত হইলাম। কিন্তু এই যে গত দুই দিন শত শত কিশোর সড়ক নিয়ন্ত্রণ করিতেছে, এই ঘটনা কি আপনার বিবেচনায় স্বাভাবিক মনে হয়? ইহা হইতে কোনো বিপদই কি হইতে পারে না? আমাদের কি কিছুই করিবার নাই? কিছুই যদি না করি, তবে বিরোধীপক্ষ কি ধারণা করিবে না যে আমরা দুর্বল হইয়া পড়িয়াছি? ধরা যাউক, জৈমতের কোনো অন্ধ সমর্থক যদি কিশোরদিগের ভিড়ে মিশিয়া কোনোক্রমে একটি আত্মবিধ্বংসী বোম্ব বিস্ফোরিত করিয়া দেয় এবং একাধিক শিশুকিশোর যদি সেই বিস্ফোরণে হতাহত হয়, তবে আমি বিষম গণবিস্ফোরণ সামাল দিব কী করিয়া?

চাণক্য: মানবসভ্যতার ইতিহাসে কিশোর-আন্দোলনের এই ঘটনা অভূতপূর্ব বটে। দেখ, পূর্বে লোকে বলিত, আর্যাবর্তের বর্গর-পিজা-মোবাইল প্রজন্মের কিশোরেরা সব ফার্মের কুক্কুট, আকুয়ারিয়মের স্বর্ণমৎস্য। ল্যাপটপ, মোবাইল, ট্যাবের আরশিনগরে তাহাদের চক্ষু সারাক্ষণ নিবদ্ধ। খেলাধূলা, সঙ্গীত, আড্ডা সব বাদ দিয়া তাহারা দিনরাত আরশিনগরে পড়িয়া আছে। এই প্রজন্ম প্রাকৃত উচ্চারণে সংস্কৃত বলে। সমাজ-সংসার-পরিবার-রাষ্ট্রের খবর নিবার সময় ও ক্ষমতা তাহাদিগের একেবারেই নাই। কিন্তু এই বিপ্লব আমদিগের চক্ষে আঙ্গুল প্রবেশ করাইয়া দেখাইয়া দিল, সমাজ-সংসার-রাষ্ট্র সম্পর্কে আমাদিগের তুলনায় তাহারা কম ভাবে না। আমাদের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় তাহারা যারপরনাই বিরক্ত। দেখ, কী মুন্সিয়ানার সহিত তাহারা বিভিন্ন লেইন সৃষ্টি করিয়া সড়ক নিয়ন্ত্রণ করিতেছে, যাহা তোমার সড়ক-রক্ষীবর্গ কদাপি করিতে সক্ষম হয় নাই। কোনো ভাংচুর তাহারা করিতেছে না, সড়করক্ষীদিগকে তাহারা বরং সাধ্যমতো সহায়তা করিতেছে।

তৌহফল্যের মতো মৌর্য সাম্রাজ্যের একজন প্রবীণ অমাত্য যদি বিপরীত মার্গে তাঁহার শকট পরিচালনা করেন, তবে আমরা আর কাহার কাছে কী আশা করিব? যাহা খুশি তাহা করিবার অসৎ উদ্দেশ্যেই কি এই বৃদ্ধ ভামগণ যৌবনে দেশ স্বাধীন করিয়াছিলেন? তোমার সরকারের বড় বড় পদস্থ কায়স্থরা শকট চালনার লাইসেন্স দেখাইতে না পারিয়া কিশোরগণের নিকট অপদস্থ হইতেছে। কিমাশ্চর্যম্ অতঃপরম্! উচ্চপদস্থ পৌলিশ কর্মকর্তাদিগের মধ্যেও কেহ কেহ বিনা লাইসেন্সে শকট ব্যবহার করিতেছে। এইসব অবলোকন করিলে সত্যযুগের কোনো সম্রাট অবশ্যই ক্ষোভে-দুঃখে পদত্যাগ করিতেন। ঘোর কলিযুগ বলিয়া তুমি পার পাইয়া গেল। তবে মন্ত্রী-অমাত্য-রাজপুরুষদিগের অশোভনীয় আচরণ দেখিয়া তোমার অন্তত লজ্জা হওয়া উচিত ছিল। অবশ্য ইহাও ঠিক যে লজ্জা নারীর ভূষণ এবং তুমি কোনো বিচারেই আর সামান্যা নারী নহ!

কিশোরগণ আমলক দলের গুণ্ডাদিগের মত বাসে আগুন দিয়া জলজ্যান্ত যাত্রীদিগের সতীদাহ করিতেছে না। বৈনপী-জৈমতের গুণ্ডাদিগের মত রাতের অন্ধকারে নিরপরাধ যাত্রীদের উপর অগ্নিশেলও তাহারা  নিঃক্ষেপ করিতেছে না। আমাদিগের কর্ণধারণপূর্বক দুই গণ্ডে চতুশ্চপেটাঘাত করিয়া তাহারা দেখাইয়া দিয়াছে, বিপ্লব শান্তিপূর্ণভাবেও করা যায়। তাহাদিগের পৌস্টরসমূহ দেখ: 'রাষ্ট্রের মেরামত চলিতেছে। সাময়িক অসুবিধার জন্যে দুঃখিত'। আমরা যে কেবল রাষ্ট্রের মেরামত করিতে চাহি নাই, কিংবা পারি নাই, তাহা নহে, ক্ষমার অযোগ্য এই দীর্ঘকালীন অপরাগতার নিমিত্ত আমরা কদাপি দুঃখপ্রকাশও করি নাই।

কোনো রাজনৈতিক দল কি সঙ্গোপনে এই আন্দোলনে ইন্ধন যোগাইতেছে? যে সকল পিতামাতা অষ্টাদশবর্ষীয় পুত্র-কন্যাকে হস্তধারণপূর্বক শিক্ষালয়ে লইয়া যায়, বাসররাত্রেও সন্তানকে একা ছাড়িতে যে সকল পিতামাতার কপাল দুশ্চিন্তায় ঘর্মাক্ত হইবার মতো অবস্থা, তাহারা কী করিয়া কিশোর-কিশোরীদিগকে বিনাপ্রশ্নে ক্লাসমুখী হইবার পরিবর্তে নির্বিচারে সড়কমুখী হইতে দিল? এই সব প্রশ্ন  মৈমনক কিংবা মৈসদকের মতো তক্ষশীলার শিক্ষক-গবেষকেরা অবশ্যই একদিন করিবেন। কিন্তু আজন্ম মিথ্যুক, পরদ্বেষী, সুবিধাবাদি, দুর্বৃত্ত পিতামাতাগণের অভিশপ্ত ঔরসে ও গর্ভে এবং আর্যাবর্তের মতো সর্বার্থে বাস-অযোগ্য একটি স্থানে, আজন্ম ফার্মের ফর্মালিনযুক্ত কুক্কুটমাংস ভক্ষণ করিয়া এমন হাজার হাজার দেশপ্রেমী স্বর্ণসন্তান কী করিয়া জন্মলাভ করিল, তাহা ভাবিয়া আমি চাণক্য আপাতত আশ্চর্যান্বিত বোধ করিতেছি। ঠিক এক শত বৎসর পূর্বে, গত শতকের প্রথম দশকের ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকী প্রমূখ কিশোর বিপ্লবীদিগের আত্মার মৃত্যু সম্ভবত হয় নাই। আমি এই ভাবিয়া আশান্বিত হইতেছি যে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম যদি ইদৃশপ্রকার দেশপ্রেমী হয়, তবে আর্যাবর্তের ভবিষ্যৎ নিয়া দুশ্চিন্তা করিবার প্রয়োজন নাই।

তবে কি জান, বৎস চন্দ্রগুপ্ত, এই কিশোর-আন্দোলন মৌর্য জাতির একটি জন্মগত দুর্বলতার লক্ষণ। কিশোরদিগের কাজ লেখাপড়া করা, সড়ক নিয়ন্ত্রণ তাহাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। যাহা যাহার কাজ নহে, সে যদি ঐ কাজ করিতে বাধ্য হয়, কিংবা করিতে গেলে তাহাকে বাধা দিবার কেহ না থাকে, তবে বুঝিতে হইবে, প্রশাসন ভিতরে ভিতরে ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া নিয়ন্ত্রণ শূন্যের কোটায় পৌঁছিয়াছে, অর্বাচীন বাংলায় যাহাকে বলে, 'উপরে ফিটফাট, ভিতরে সদরঘাট'। ইহাকে মৌর্য জাতির জন্মগত দুর্বলতা বলার কারণ এই যে আর্যাবর্তের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় তক্ষশীলা স্থাপিত হইয়াছিল এতদাঞ্চলে জ্ঞানের বিকাশের নিমিত্ত। কিন্তু তক্ষশীলার কোনো স্নাতক কি জ্ঞানের জগতে এমন কোনো অবদান রাখিতে পারিয়াছে যাহা উল্লেখ করিবার যোগ্য? এই বিশ্ববিদ্যায়ের সিলমোহরে লেখা আছে: 'শিক্ষাই আলো'। ভো মূর্খের দল! জ্ঞানই প্রকৃত আলো, শিক্ষা সেই আলোকপ্রাপ্তির অন্যতম উপায় মাত্র।  যে শিক্ষায়তনের মূল লক্ষ্য শিক্ষা, জ্ঞান নহে, সেই প্রতিষ্ঠানের স্নাতকগণ কী করিয়া জ্ঞানের সন্ধান পাইবে? আমি চাণক্য কি সাধ করিয়া এই বিদ্যায়তনকে 'বিশ্ববিদ্যালয়' না বলিয়া 'মহাবিদ্যালয়' বলি!

নিয়মতান্ত্রিকভাবে নহে, একান্তভাবে তোমারই অঙ্গুলিহেলনে নিযুক্ত তক্ষশীলার উপাধ্যক্ষগণ (যেমন আকৈত্রজম্মন কিংবা তদীয় পূর্বসূরি ঐরাবিণ) দেশে-বিদেশে সভাসমিতিতে বলিয়া থাকেন: 'ইহাই পৃথিবীর একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যাহা একটি রাষ্ট্রের জন্ম দিয়াছে। পৃথিবীতে কুত্রাপি এমত বিশ্ববিদ্যালয় নাহি।' আহাহা! এই দাবি করিবার সময় এত পরিমাণ 'গর্ব' তাহাদের চোখেমুখে উপচাইয়া পড়ে যে তাহা ধারণপূর্বক মহাভারতের যুগে সহস্র ঋতুমতী রমণী নির্ঘাৎ গর্ভবতী হইতে পারিতেন, যদিও কোনো প্রকৃত ভিষগাচার্য অবলোকনমাত্র বুঝিতে পারিতেন, গর্ভ নহে, উহা বদহজমজনিত গ্যাস অথবা কালান্তক স্ফোট- অর্বাচীন ইঙ্গরাজি ভাষায় যাহার নাম টিউমার। অক্সফোর্ড কিংবা হার্ভার্ড কোনো রাষ্ট্রের জন্ম দেয় নাই, কারণ রাষ্ট্রের জন্মদান করা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তব্য যজন, যাজন ও অধ্যাপন এবং সেই কর্তব্য তাহারা এমন সুচারুরূপে পালন করিতেছে যে ঐসকল প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীগণের মধ্যে একাধিক নোবেল পুরস্কারধারী রহিয়াছে। তক্ষশীলার মতো 'হাভাতে' ('হার্ভার্ড' শব্দের অপভ্রংশ মনে করিতে পারো!) বিশ্ববিদ্যালয় নিজের কর্তব্য ঠিকঠাকমতো পালন করে না বলিয়াই তাহার শিক্ষার্থীগণের ঘরের অন্ন ভক্ষণ করিয়া বনের মহিষ তাড়াইবার অবসর থাকে। তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি প্রায়-অচল, নড়বড়িয়া শকটের মতো যাহার হর্ন অর্থাৎ ভেঁপু ব্যতীত বাকি সব কিছু বাজে।

তুমি কোটি মুদ্রা ব্যয় করিয়া সড়কে যাননিয়ন্ত্রণের নিমিত্ত রক্তিম ও সবুজ বাতি স্থাপন করিয়াছিলে। কিন্তু  সড়ক-নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব যাহাদিগের উপর দিয়াছ, তাহারা প্রত্যেকে এতটাই লোভী, দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বৃত্ত যে সেই বাতি অনুসরণ করিয়া কখনই তাহারা যান চলিতে দেয় না। কারণ তাহা হইলে বিভিন্ন মোড়ে ও চৌরাস্তায় শকট হইতে উৎকোচ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না। সেদিন নীলক্ষেত্র মোড়ে দেখিলাম, এক 'উদার'(যাহার বড় উদর রহিয়াছে) সড়করক্ষী এক ডাবওয়ালার নিকট হইতে একটি ডাব উৎকোচ নিতে গিয়া দেরি হইবার ফলে সড়কে মহা যানজটের সৃষ্টি হইয়াছে। তোমার প্রশাসনের সিংহভাগ কায়স্থ এক একজন আস্ত পণ্টক 'কাঁটা' শব্দটি যদি 'কণ্টক' হইতে ব্যুৎপত্ত হয়, তবে 'পণ্টক' হইতে কী হয় তাহা অনুধাবন করিয়া লও।

তোমাকে একটি গল্প বলি চন্দ্রগুপ্ত। বঙ্গদেশের সীতাকুণ্ড অঞ্চলে এক ফাঁকিবাজ গৃহশিক্ষক শিক্ষার্থীগণকে প্রাকৃতে উচ্চারিত একটি বাক্য মুখস্ত করিতে দিয়াছিল: 'গোলেমালে খদিন যক'। শিক্ষার্থীরা বিনাপ্রশ্নে সেই বাক্য মুখস্ত করিতেছিল এবং জায়গীর শিক্ষক পাশের তক্তপোষে নাসিকা গর্জন করিতেছিলেন। শিক্ষার্থীগণের এক মাতুল এই ঘটনা লক্ষ্য করিয়া চুপিসারে শিক্ষার্থীগণের পড়া বদলাইয়া দিলেন: 'অ্যাঁন গরি খদিন খাবি, একদিন তুই ধরা ফড়বি!' বিপরীত পাঠ শুনিয়া শিক্ষক মহোদয়ের নিদ্রাভঙ্গ হইতে দেরি হইল না এবং পত্রপাঠ রণে ভঙ্গ দিয়া তিনি পলায়ন করিলেন।

গত এক যুগের শাসনামলে দুর্নীতি ও অব্যবস্থাসহ কোনো সামাজিক সমস্যার সমাধান তুমি করিতে সক্ষম হও নাই। পদ্মাসেতু করিতেছ, কিন্তু নগরীর কোনো ফৌটপথ তুমি খালি করিতে পার নাই। আমলক দলের পোষা কিংবা ভাড়াটিয়া গুণ্ডাগণ তক্ষশীলা নগরীর ফৌটপথ ভাড়া দিয়া তোলা তুলিতেছে আর নগরবাসী রাস্তায় হাঁটিতে গিয়ে আহত-নিহত হইতেছে। তুমি অবশ্য বলিতে পার, অন্য কেহও পারে নাই, আমার পিতৃদেবও ব্যর্থ হইয়াছিলেন। কথায় বলে না: 'দাদাও ফেল, আমিতো কোন ছার!' তোমার কথায় কিঞ্চিৎ সত্য যে নাই তাহাও নহে।  কিন্তু স্বাধীনতার চতুর্দশক পরে জন্মগ্রহণ করা এই কিশোরেরা যদি সফল হইতে পারে, তা সে এক-দুই দিবসের জন্যই হউক না কেন, চেষ্টা করিলে তুমিও আর্যাবর্তে টেকসই পরিবর্তন আনিতে পারিতে। তুমি পার নাই, কারণ তুমি চাহ নাই, অথবা সেই গৃহশিক্ষকের মতো ভাবিয়াছিলে, জায়গীরগৃহে কোনো দিন কোনো বুদ্ধিমান মাতুলের আবির্ভাব হইবে না।

তোমার স্থলমার্গ অমাত্য ঐবদুল্ল কৈদর যে অমূল্য সময়টুকু রাজমার্গে লম্ফঝম্ফ করিয়া, ফাটা গলায় আবোল-তাবোল বক্তব্য রাখিয়া, ইহাকে-উহাকে খামাখা চপেটাঘাত করিয়া নষ্ট করে, সেই সময়টুকু শীতাতপ-নিয়ন্ত্রিত অফিসে বসিয়া সঠিক জায়গায়, সঠিক কর্মকর্তাকে, সঠিক নির্দেশ দিয়া জবাবদিহিতা নিশ্চিত করিবার চেষ্টা করিলে সড়ক-চলাচল অধিকতর নিরাপদ ও সুখাবহ হইতে পারিত। শোনো বৎস চন্দ্রগুপ্ত, হস্তীর দুই ধরণের দন্ত থাকে। মুখের বাহিরে দুটি মাত্র দেখাইবার এবং মুখের ভিতরে বাকি সকল দন্ত চিবাইবার। তোমার প্রশাসন এমন এক অদ্ভূত-দর্শন হস্তী যাহার দেখাইবার দন্ত অগণিত, চিবাইবার দন্ত নাই বলিলেই চলে, কিংবা থাকিলেও পোকায় কাটিয়া কিংবা নিরাময়-অযোগ্য কোনো ইনফেকশনের কারণে সেই দুই একটি দন্ত নড়বড়বড়ায়মান।

চন্দ্রগুপ্ত: প্রভু, আমি জানি, আমার দোষের কোনো অন্ত নাই। এখন মানে মানে কিশোর-বিদ্রোহ সামাল দিবার উপায় বলিয়া দিন।

চাণক্য (মৃদু হাসিয়া): তোমার গুণেরও সীমা নাই চন্দ্রগুপ্ত। এমন সব ব্যক্তি তোমাকে ভালোবাসে, তোমার সরকারের মঙ্গল কামনা করে তুমি কল্পনাও করিতে পারিবে না। এই যেমন সেদিন ব্যোমক্ষেত্র হইতে নীলক্ষেত্র আসিবার পথিমধ্যে এক অতি সাধারণ শকটচালক কথাপ্রসঙ্গে বলিতেছিল: 'মহাশয়, আমি বংশানুক্রমে আমলকদিগকে দ্বেষ করি। আমার পিতা যখন মহান মুক্তিযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাগণের হস্তে নিহত হন, তখন আমি বালকমাত্র। কিন্তু স্বীকার করিতে দ্বিধা নাই, সম্রাট গত এক যুগে সাম্রাজ্যকে সঠিক পথেই পরিচালিত করিতেছেন। তিনি এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়াছেন, যেমন পদ্মাসেতু কিংবা তক্ষশীলা নগরীর মেট্রোরেল, বৈদ্যুতিন যোগাযোগ উন্মুক্ত ও সহজলভ্যকরণ, মুক্তিযোদ্ধাগণকে ভাতাপ্রদান – এই সকল পদক্ষেপ আমার দল বৈনপি কদাপি গ্রহণ করে নাই, করিত না। এই সব পদক্ষেপের ফল বাঙালি জাতির জন্য সুদূর-প্রসারী হইবে সন্দেহ নাই। সম্রাটের সীমাবদ্ধতা অবশ্যই আছে, কিন্তু কী কারণে কলসের ভরা অংশটির দিকে না তাকাইয়া একচক্ষু হরিণের মতো আমি শুধু খালি অংশটির জন্য সমালোচনা করিব?'

মহান মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরমিত্রের প্রতি আর্যাবর্তের অধিকাংশ জনগণের আবেগ এখনও কমবেশি অক্ষুণ্ণ আছে এবং তুমি ও তোমার আমলক দল সেই আবেগ ভাঙাইয়া নিশ্চিন্তে যথেচ্ছ খাইতে পারিতেছ। কিন্তু মনে রাখিও, যত বড় নোটই হোক না কেন, ভাঙতি করিতে করিতে সব নোটই এক সময় ফুটা পয়সায় আসিয়া পৌঁছুছে। তখন কোনো ভবী আর ভোলে না, শত বৎসরের বদ্বীপ পরিকল্পনার স্বপ্ন দেখাইয়া আর কাজ হয় না। জাতি তখন আসল কাজ চায় এবং কাজ যদি না দেখাইতে পার, তবে অতীতের কোন পূর্বপুরুষ কখন, কোথায় শুটকি দিয়া ভাত মাখিয়া খাইয়াছিল, উত্তর পুরুষ খামাখা তাহার ঢেঁকুর তুলিলে, চোঁয়া দুর্গন্ধে লোকে সমার্জনী তুলিয়া মারিতে আসে।

দিন দুই অপেক্ষা কর। আমার গুপ্তচরগণের মুখে শুনিলাম, তক্ষশীলা নগরীর খলিফাগণ ভীষণ ব্যস্ত। কোনো একটি মহল গত রাত্রেই তাহাদিগকে এক দিবস কালের মধ্যে সহস্রাধিক স্কুল-ইউনিফর্ম সীবন করিতে অগ্রিম অর্থ প্রদান করিয়াছে। ধারণা করি, সেই মহল হাজার হাজার অনামলক সমর্থক গুণ্ডাকে নকল ইউনিফর্ম পড়াইয়া কিশোরদিগের ভিড়ে মিশাইয়া দিবে। তাহারই তখন শকট ভাঙচুর করিবে, শকটে আগুন দিবে, রাজরক্ষীদিগের গায়ে আঘাত করিবে। কিশোরগণের শরীরে অত বল কোথায়, অথবা পরিকল্পনামাফিক নাশকতাইবা কোমলমতি শিশুরা কী প্রকারে করিবে? যখনি দেখিবে, সড়কে নাশকতা শুরু হইয়াছে, তখন অবশ্যই জানিবে, অনামলক গুণ্ডাগণ ছদ্মবেশে আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করিয়াছে। তখন আর সমস্যা কী? তোমার হাতে গুটিরতো অভাব নাই এবং খেলাতো মাত্র শুরু। আমলক দলের যে শিক্ষার্থীদিগকে তাহাদের ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায় ছাত্রাবাসে স্থান দিবার বিনিময়ে প্রায়দস্যুতে পরিণত করিয়াছ, তাহাদিগকে দিয়া কিংবা রাজরক্ষীগণকে দিয়া আন্দোলনকারীগণকে খেদাইয়া দিলেই চলিবে।

আলোকচিত্রী সৈহদুল্যম বাড়াবাড়ি করিয়াছে সন্দেহ নাই, অতিসংবেদনশীল ব্যক্তিরা অনেক সময় উত্তেজনায় মাথা ঠিক রাখিতে পারে না, স্থান-কাল-পাত্র-মাত্রাজ্ঞান তাহাদের হারাইয়া যায়। কাহাকে, কখন, কোথায়, কী, কীভাবে বলিতে হইবে তিনি বুঝেন নাই, কিংবা হয়তো যে কোনো কারণে আর্যাবর্তের অন্য অনেক স্বল্পদর্শী বুদ্ধিজীবীর মতো তিনিও ভাবিয়াছিলেন, অবিলম্বে সরকার পতন হইয়া যাইবে এবং ভবিষ্যৎ শাসকের চোখে, অর্বাচীন ইঙ্গরাজিতে যাহাকে বলে 'হিরো', তিনি তাহাই হইয়া যাইবেন। অদ্য প্রাতে ফৌসবুকে দেখিলাম, অনেক বামাপদ, বৈনপী ও জৈমতপন্থী বুদ্ধিজীবী প্রাকৃত বঙ্গভাষায় 'আমিও আইতাছি' ঘোষণা দিয়া রাস্তায় নামিতেছে। এই মূর্খের দল বিস্মৃত হয় যে আর্যাবর্তের ইতিহাসে বৈনপী কিংবা জৈমত কখনও আন্দোলন করিয়া ক্ষমতায় বসিতে পারে নাই। তাহারা সর্বদা ষড়যন্ত্র করিয়া ক্ষমতা অপদখল করিয়াছে। ইহাদিগের মধ্যে কেহ কেহ মনে করে, ঐমরান খান 'ফাঁকিস্থান' নামক ব্রহ্মাবর্তের উত্তর দিকের এক দেশকে আমূল বদলাইয়া দিবে। ভো মূর্খের দল! রঙিন চশমা চক্ষে দিয়া রঙিন বোতলে শ্বেতবারি অবলোকন কি কদাপি সম্ভবে?

তবে বৎস, সৈহদুল্যম কিংবা তাহার স্ত্রী কোন দিক দিয়া কোন অনামলকের কী আত্মীয়- এইসব হাবিজাবি তথ্য আমলে নিবার প্রয়োজন ছিল না। গোবলে পদ্মফুল ফুটিয়া থাকিলেও, পুণ্ডরিক প্রস্ফুটনের নিমিত্ত গোময় অপরিহার্য নহে। সৈহদুল্যম যত কটু কথা বলিয়াছেন, আমিতো এতক্ষণ ধরিয়া তাহার অধিক তোমাকে বলিলাম। কই তুমিত আমাকে দ্বেষ করিতেছ না! কোনো শাসকের অপ্রিয় সমালোচনা সহ্য করিবার ক্ষমতা থাকিতে হইবে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার যত কম করিবে, ততই উত্তম। প্রিয় চন্দ্রগুপ্ত, সৈহদুল্যমকে ঐভাবে টানিয়া-হ্যাঁচড়াইয়া বন্দী করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। অসভ্য রাজপুরুষেরা প্রায়শই ধরিয়া আনিতে বলিলে বাঁধিয়া আনিয়া তোমার প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

হ্যাঁ, অল্প কিছু শিক্ষার্থীকে বন্দীও করিতে পার। ইহাতে বাকিরা ভীতসন্ত্রস্ত হইবে। অহিংস বিষধর সর্প ছোবল না দিক, ফোঁস করিতে তো দোষ নাই। সাম্রাজ্যে অব্যবস্থার সৃষ্টি হইলে বিদ্রোহ-প্রতিবাদ করা জনগণের কর্তব্য। সম্রাটের দায়িত্ব সেই বিদ্রোহ দমন করা এবং পরবর্তিতে বিদ্রোহের কারণ অনুসন্ধান করিয়া সমাধানের চেষ্টা করা। অবশ্য সবচেয়ে ভালো হয় এমনভাবে সাম্রাজ্য পরিচালনা করা, যাহাতে কোনো বিদ্রোহের প্রয়োজনই না হয়। যাহা হউক, বিদ্রোহ যদি করিতেই হয়, তবে জনগণ চেষ্টা করিবে, কত মুন্সিয়ানার সহিত বিদ্রোহ পরিচালনা করা যায়, আর সম্রাটের চেষ্টা থাকিবে কত সতর্কতার সহিত সেই বিদ্রোহ দমন করা যায়। উভয় পক্ষকেই স্মরণ রাখিতে হইবে যে সর্প অবশ্যই মরিতে হইবে, কিন্তু যষ্ঠিখানিও অটুট থাকিলে উত্তম হয়।

প্রিয় চন্দ্রগুপ্ত, তোমার প্রধান সমস্যা, তোমার নিজের আমলক দল। আচ্ছা বল দেখি, তোমার কত জন বিধায়ক দেহরক্ষী-বহর সঙ্গে না লইয়া নিজ নিজ এলাকায় গমন করিবার সাহস রাখে? তোমার পিতৃদেব শাক্য মজ্জব বলিতেন: 'কত দেশের কত নেতা কত রকম খনি পায়: সোনার খনি, রূপার খনি। আমি দুর্ভাগা এক চৌরের খনি পাইয়াছি।' ইহারা যত না চৌর, তাহার অধিক তৈলবাজ। লক্ষ্য করিয়াছ কি, তক্ষশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্কইয়া ছাত্রীভবনে প্রতিষ্ঠিত শাক্যমজ্জবের অয়োময় আবক্ষ-মূর্তির তর্জনী অস্বাভাবিকভাবে দীর্ঘ? খাদ্য গ্রহণ করিলে যদি জীবশরীরের বৃদ্ধি হইতে পারে, তবে তৈল প্রয়োগ করিলে ধাতুমূর্তিরও তর্জনীবৃদ্ধি হইবে না কেন! স্মরণে আসে কি, তোমার পিতৃদেব শাক্য মজ্জব ইহাদিগকে 'চাটার দল' বলিতেন? মাঝে মাঝে ভাবি, এত নারী-পুরুষ চাটুকার থাকিতে তোমার পাদুকা কেন নিত্য কালি করিতে হয়!

তবে বৎস, ইহাদিগের জিহ্বার অগ্রভাগে বংশানুক্রমিক পাদুকা-মশি দেখিয়া ভাবিও না, এই সব 'মাল' খুব নিরীহ প্রকৃতির। পুনর্বার সিংহাসনচ্যুত হইলে স্বচক্ষে তুমি ইহাদিগের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করিবে। যখন তুমি সিংহাসনে আসীন, তখনই ইহারা তৈয়সী এলাকায় শাক্যমজ্জবের বিশাল প্রতিকৃতিতে শ্রীগণ্ডের জরুল বদল করিয়া দিয়াছে (শিল্পী শৈমম শিকদার শাক্যমজ্জবের মূর্তিতে বাম হস্তের তর্জনী উত্তোলিত করিয়াছিল!)। তাহারা সুকৌশলে আমলক দল তথা আর্যাবর্তের শ্রদ্ধার্হ সব তারিখ, ২১শে ফেব্রুয়ারি, ৭ই মার্চ, ২৬শে মার্চ, ১৬ই ডিসেম্বরের অঙ্গহানি করিয়া চলিয়াছে, লিপি ও উচ্চারণে। তুমি কিংবা তোমার পিতা শাক্য মজ্জবের ব্যবহৃত উচ্চারণ ও বানানকে অপক্ষ কদলি প্রদর্শন করিয়া নিজেদিগের আকাঙ্ক্ষামত তাহারা দেবভাষা লিখিতেছে ও বলিতেছে। সুযোগ মিলিবামাত্র ইহারা মৌর্য জাতিকে 'ভাষায় মারিবে, আশায় মারিবে'।

সূর্যদেব অস্তায়মান। গৃহে প্রত্যাবর্তনের সময় সমাগত। সারথিকে রথ আনয়ন করিতে আদেশ কর। কিশোর আন্দোলন লইয়া দুশ্চিন্তার কারণ নাই। অল্প কয়েক দিন পর আত্মসমর্পী ধর্মের বলি-উৎসব উপলক্ষে বেশির ভাগ নাগরিক নিজ নিজ গ্রামে চলিয়া গেলে তক্ষশীলা নগরী খালি হইয়া যাইবে এবং বিদ্রোহেরও স্বাভাবিক পরিসমাপ্তি ঘটিবে। ধারণা করি, সেই উৎসবের আগে আগে নিরপেক্ষ কিংবা অনামলক বুদ্ধিজীবীগণ অতি অবশ্যই ইনাইয়া বিনাইয়া সামাজিক গণমাধ্যমে নিরপরাধ শিক্ষার্থীগণকে মুক্তি দিবার জন্য সম্রাটকে অনুরোধ করিতে থাকিবেন। সৈহদুল্যম, নবশৈব্যাসহ কিশোর আন্দোলনে আটককৃত সকলকে মুক্তি দিলে মুক্ত বন্দীগণ এবং তাহাদিগের পরিববার-পরিজন 'মহান সম্রাটের জয় হউক' বলিয়া তোমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতে থাকিবে। সেই অবসরে তুমি দুর্গাদেবীর মতো দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন করিয়া (অনাগত যুগের কবি নজরুলের ভাষায়) 'জাহান্নামের আগুনে বসিয়া' (মিশরের স্ফিংসের দুর্বোধ্য) 'পুষ্পের হাসি' হাসিতে থাকিও।

(শকটে উঠিয়া) কোনো ব্যক্তিকে কারণে-অকারণে চপেটাঘাত করিয়া অনতিকাল পরে তাহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করিলে শাসকের শক্তি ও ঔদার্য উভয়ই প্রকাশ পায়। অন্যদিকে, সবলের প্রবল চপেটাঘাত হজম করিয়া ক্ষমা করা ব্যতীত দুর্বলেরও কি উপায়ান্তর আছে? হায়! ইহাই যুগান্তরের রাজনীতি। ইহার বিকল্প যে কী হইতে পারে, তাহা যে চাণক্যকে অনাগত যুগের বুদ্ধিজীবীগণ সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিশারদ আখ্যা দিবেন, সেই আমিও ভাবিয়া পাই না।