কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক কি বিএনপিকে নতুন কোন পথ খুলে দিল?

স্বদেশ রায়
Published : 10 Sept 2018, 11:56 AM
Updated : 10 Sept 2018, 11:56 AM

কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর বিএনপি হতাশ না উজ্বীবিত এটা এখন একটা বড় প্রশ্ন। তারা কূটনীতিকদের কাছে তাদের দলের কত লোক গ্রেপ্তার হয়েছে, কত লোক তাদের মতে গুম হয়েছে এমন একটি লিস্ট হস্তান্তর করেছে। এ ধরনের আরো একটি লিস্ট তারা আগেও কূটনীতিকদের কাছে হস্তান্তর করেছিলো। এগুলো কূটনীতিকদের হাতে দিলে কোনও রাজনৈতিক দলের শেষ অবধি কোনও লাভ হয় কিনা তা বলা মুশকিল। তবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কালচারে এটা আছে। যে দল যখন বিরোধী দলে থাকে তখন তারা এটা করে।

তবে যতদূর দেখা গেছে নির্দিষ্ট অভিযোগে যাদের নামে মামলা আছে তাদের লিস্ট কূটনীতিক, মানবাধিকার সংস্থা বা বিদেশী রাজনীতিকদের কাছে দিয়ে কোনও লাভ হয় না। তবে কোনও সরকার যদি মানবাধিকার লঙ্ঘন করে কোনও অত্যাচার চালায় তখন সেটা নিয়ে কূটনীতিকরা সিরিয়াস হন। যেমন ২০০১ এ বাংলাদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর যে অত্যাচার চলেছিলো, যার চরিত্র ছিলো 'এথনিক ক্লিনজিং', তখন এক পর্যায়ে কূটনীতিক ও বিদেশি মানবাধিকার গোষ্ঠি সত্যিকার অর্থে সোচ্চার হয়েছিলেন। অন্যদিকে পুলিশের ওপর হামলা, বিদ্যুত কেন্দ্র পুড়িয়ে দেবার মামলার আসামিদের লিস্ট বিদেশি কূটনীতিকদের হাতে দিলে তাদের কিছু করার থাকে না। তারা কোনও কথা বলতে পারেন না। কারণ,তাদের দেশেও আইনের শাসন বাস্তবায়ন করতে হয় তাদের সরকারকে। যাহোক, তারপরেও বিএনপি এ সব আসামিদের একটি লিস্ট কূটনীতিকদের কাছে হস্তান্তর করেছে। এখন দেখা যাক এর ফল কি হয়!

তবে কূটনীতিকরা এই তালিকার খুব একটা গুরুত্ব না দিয়ে তারা বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে বলেছেন। সেখানে কূটনীতিকরা বিএনপিকে আশ্বস্ত করেছেন, তারা এবার বেশি সংখ্যক নির্বাচন পর্যবেক্ষক দেবার চেষ্টা করবেন। এখানে একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, দুর্নীতির মামলায় খালেদার জেল হবার পর থেকে এ অবধি বিএনপি যতবার কূটনীতিকদের সঙ্গে বসছে, সব সময়ই কূটনীতিকরা বিএনপিকে নির্বাচনে যাবার পরামর্শ দিচ্ছেন।

তারা কোনবারই বিএনপির কত লোক আসামি এবং খালেদার জেলকে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়টির সঙ্গে মেলাচ্ছেন না। কূটনীতিকদের এই আচরণের ভাষা নিশ্চয়ই প্রকাশ করে, খালেদার দুর্নীতির বিষয়টি তারা মেনে নিয়েছেন এবং কোনও দেশের প্রচলিত আইন তার নিজস্ব গতিতে চলুক এটাই চাচ্ছেন। অন্যদিকে বিএনপির যাদের বিরুদ্ধে অন্যায় মামলা করা হয়েছে বলে লিস্ট দিচ্ছে সেটাও তারা ভিন্নভাবে নিচ্ছেন। তারা মনে করছেন, এগুলো একটি দেশের আইন-শৃঙ্খলার বিষয়। অর্থাৎ তারা কোন দুর্নীতির মামলা ও আইন শৃঙ্খলার সঙ্গে ওই দেশের জাতীয় নির্বাচনকে মেলাতে রাজি নন। বিএনপির দৃষ্টিকোণ থেকে, তাদের সমর্থকদের দৃষ্টিকোণ থেকে এ বিষয়টির হয়তো ভিন্ন ব্যাখা আছে। তবে কূটনীতিকদের আচরণ বলছে, তারা এর বেশি যেতে রাজি নন, দেখতেও রাজি নন। তাছাড়া কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কথা বলার এক্তিয়ারও কূটনীতিকদের নেই। আমাদের দেশে মাঝে মাঝে কূটনীতিকরা যে অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলেন এর জন্যে কূটনীতিকদের দায়ী করার আগে আমাদের দেশের রাজনীতিক ও সুশীল সমাজের লোকজনকে দায়ী করতে হবে। কারণ, তারা কূটনীতিকদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে টেনে আনেন। তারপরেও খুব কম কূটনীতিক তার সীমারেখা পার হন।

যাহোক, কূটনীতিকরা বিএনপিকে নির্বাচনে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন। বিএনপি কি সেই পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করছে?  সাংবাদিক হিসেবে বিভিন্ন সূত্রে খোঁজ খবর নিয়ে যতদূর জানি, খালেদা জিয়ার জেলে যাবার পর থেকেই বিএনপির একটি অংশ নির্বাচনে যাবার জন্যে প্রস্তুত। তারা মনে করে যে কোনও অবস্থায় হোক না কেন, বিএনপির এবার নির্বাচনে যাওয়া উচিত। দলের মহাসচিবসহ অনেকেই এই নির্বাচনে যাবার ধারায়। দলের মহাসচিব এ বিষয়ে লন্ডনে তাদের দলের বর্তমান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে দেখাও করেছেন। চার থেকে পাঁচ বার মিটিংও করেছেন। ওই সব মিটিং এর যতদূর যা খোঁজ খবর পাওয়া গিয়েছিলো সে সময়ে তা অনেকটা এমন ছিলো, তারেক রহমান এবার নির্বাচনে যাবার বিষয়ে নমনীয়।

তবে যারা বাংলাদেশের রাজনীতির খোঁজ খবর রাখেন, তারা সকলেই একটা দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে যান অগাস্ট মাসের শেষ সপ্তাহের দিকে। কারণ ওই সময়ে তারেক রহমান ও বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভেতর মত-পার্থক্যের কারণে ফখরুল ইসলাম আলমগীর পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে একটা খবর ছড়িয়ে পড়ে। যদিও বিএনপির সিনিয়র নেতাদের হস্তক্ষেপে বিষয়টি শেষ অবধি পদত্যাগে গড়ায়নি। তবে তারপরেও একটি কুয়াশা রয়ে গেছে, কেন হঠাৎ এমনটি হলো? যাহোক,  এবার কূটনীতিকদের সঙ্গে মিটিং এর পরে আবারও সামনে এসেছে নির্বাচনে অংশগ্রহনের বিষয়টি। অর্থাৎ বিএনপির সিনিয়র নেতারা যা চাচ্ছেন সে মতই দিয়েছেন কূটনীতিকরা। তাদেরকে নির্বাচনে যাবার পরামর্শ দিয়েছেন। বিএনপির সিনিয়র নেতাদের কেউ কেউ মনে করছেন, রাজনৈতিক একটা অবস্থান ধরে রাখার জন্যে তাদের নির্বাচনে যাওয়া প্রয়োজন। আবার মহাসচিবসহ অনেকে মনে করছেন, যদি কোনও মতে তারা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় ঢুকে পড়তে পারেন, তাহলে তারা নির্বাচনে ভালো করবেন। অন্তত একটা বিরোধী দলীয় স্ট্যাটাস তারা ধরে রাখতে পারবেন।

অন্যদিকে তারেক রহমানের অনুসারীরা মনে করছেন এ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অর্থ হলো আওয়ামী লীগকে আবার সরকার গঠন করার একটা বৈধতা দেয়া। এই ধারার অনেক বুদ্ধিজীবী মনে করেন, গত নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার আগে তারা মনে করেছিলেন সরকার পাঁচ বছর কনটিনিউ করতে পারবে না। তাদের সে ধারণা ভুল হয়েছে। তবে তারপরেও নির্বাচনে গিয়ে ছোট একটা বিরোধী দল থাকার থেকে এখন বিএনপির অবস্থান ভালো আছে। তারা এই সরকারকে অবৈধ সরকার বলতে পারছে এবং আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে আওয়ামী লীগ যদিও সরকার গঠন করে তারপরেও সে সরকার দুর্বল হবে। কারণ দশ বছর পরে আবার একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ছাড়া সবল সরকার হতে পারে না।

তাই তখন বিএনপির জন্য খুব দ্রুতই সুযোগ আসবে। তাছাড়া খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ রেখে নির্বাচনে যাওয়ার কোনও অর্থ হতে পারে না। তবে এই ধারা মনে হয় বিএনপির ভেতর দুর্বল হয়ে পড়েছে। অধিকাংশই এখন খালেদা ও তারেক রহমান ছাড়াই নির্বাচনের কথা ভাবছেন। কারণ তারেক রহমানের অনেক নিজস্ব লোকদের গত ঈদের থেকে নির্বাচনী এলাকা নিয়ে তোড়জোড় করতে দেখা যাচ্ছে। তাদের এই তোড়জোড় একটি নতুন ইঙ্গিত বহন করছে। তারা হয়তো মনে করতে পারে, খালেদা ও তারেক রহমান ছাড়া নির্বাচনে গিয়ে যদি তারা কিছু আসনও পান তাহলেও তো সংসদে তারা খালেদা জিয়া সম্পর্কে কথা বলতে পারবেন।

তবে বিএনপির জন্য সব থেকে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তারা নির্বাচনে যাবে কীভাবে? নির্বাচনে যাবার আগে তাদের কোনও শর্তই শেখ হাসিনা মানছেন না। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনরূপ আলাপ আলোচনার কিছু নেই। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন হবে। অন্যদিকে অনেক আশা নিয়ে তারা কূটনীতিকদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভা আয়োজন করেছিলেন তাদের অফিসে। সেখানেও কূটনীতিকরা তাদের কোনও শর্ত নিয়ে সরকারের সঙ্গে দেন দরবারের কোন আশ্বাসই তাদেরকে দেননি। তারা কেবল বলেছেন, অনেক বেশি পর্যবেক্ষকের ব্যবস্থা করবেন তারা। বিএনপি কি তাহলে এখন শুধু পর্যবেক্ষকদের ভরসায় নির্বাচনে যাবে? আসলে বিএনপি কী করবে সেটা বলার সময় এখনো আসেনি। তবে নির্বাচনের পথটি তারা যে ছাড়ছে না তার আরো কিছু হিসাব মেলে যখন দেখা যায়, কূটনীতিকদের কাছ থেকে শুধু পর্যব্ক্ষেকের আশ্বাস পেয়েই বিএনপির সিনিয়র নেতারা তাদের দলীয় কয়েক বুদ্ধিজীবী ও সিনিয়র সাংবাদিককে তারেক রহমানকে বুঝানোর দায়িত্ব দিয়েছেন, তিনি যাতে নির্বাচনে যাবার পক্ষে মত দেন। তারেক রহমানের অনেক পরামর্শক, তাছাড়া তিনি সম্প্রতি ইউটিউবের মাধ্যমে যে ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন তাতে এমন সুস্থ ধারার রাজনীতির পক্ষে তিনি যাবেন কি?