৭ই মার্চ: ই-হীন হলেই শ্রীহীন!

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 3 Sept 2018, 08:09 AM
Updated : 3 Sept 2018, 08:09 AM

৭ই মার্চ? না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রীনিবাসের উচু দেয়ালে পাথর বা কংক্রিটের অক্ষরে লেখা রয়েছে, বহু দূর থেকে দৃশ্যমান 'ই-হীন ও শ্রীহীন' ৭মার্চ। বাংলা বানান ও ভাষা-ব্যবহার নিয়ে যে তুগলকী কাণ্ড করে চলেছেন উভয় বাংলার অর্ধশিক্ষিত বুদ্ধিজীবীগণ, তার একটা পাথুরে, 'কনক্রিট' (উভয়ার্থে) নজির খুঁজছিলাম বহুদিন যাবৎ, এবং পেয়েও গেলাম গতকাল রোকেয়া হলের নতুন ভবন উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে গিয়ে। পুরো অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যসহ প্রত্যেক বক্তা পরিষ্কার উচ্চারণ করেছেন: ৭ই মার্চ। জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর উদ্বোধনী-মন্তব্যে রাবীন্দ্রিক, সুললিত হস্তাক্ষরে লিখেছেন ৭ই মার্চ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বা শিক্ষামন্ত্রী কি অশুদ্ধ উচ্চারণ করেছেন বা অশুদ্ধ লিখেছেন?

আমরা শিক্ষিত, ডিগ্রিপ্রাপ্ত (অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিতদের কথা আলাদা) ভাষাবিজ্ঞানীরা ব্যাকরণশাস্ত্রে গত দুই হাজার বছরের গবেষণার ভিত্তিতে একটি স্বতঃসিদ্ধে বিশ্বাস করি: 'কোনো মানব-সন্তান মাতৃভাষা ভুল বলে না।' প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী উভয়েরই মাতৃভাষা বাংলা। সুতরাং এই দুই মানব-সন্তান অবশ্যই ভুল বলেননি বা লিখেননি, লিখতে পারেন না। প্রকৃতপক্ষে জননেত্রী শেখ হাসিনা সংবিধান-সম্মত বানানই ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৪৯ ধারার ২ উপধারায় '৭ই মার্চ', '২৬শে মার্চ, '১০ই এপ্রিল' লেখা রয়েছে। এর মানে হচ্ছে, ভুল করেছি, আমরা অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, অথবা এই নিয়ম যদি বাংলা একাডেমির হয়ে থাকে, তবে বাংলা একাডেমি। আমি জানি না, '৭মার্চ' লেখা সংবিধান লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে কিনা। বাংলা একাডেমি নির্দেশিত বানানরীতি যদি সংবিধানের বানানরীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়, তবে কোন বানানরীতি ব্যবহার করা আইনসম্মত হবে?

পৃথিবীর অনেক ভাষাতেই সংখ্যাশব্দের ডানদিকে ক্রমিক শব্দবাচক প্রত্যয় ব্যবহৃত হয়, যেমন বাংলায়: ১ম, ২য়, ৪র্থ। আছে সময়-জ্ঞাপক প্রত্যয়: ৯টা, ৫টা। ইংরেজি-ফরাসিতে ক্রমিক শব্দবাচক প্রত্যয়গুলোকেই তারিখ-শব্দবাচক প্রত্যয় হিসেবে ব্যবহার করা হয় (উদাহরণ: টুয়েন্টি ফার্স্ট জুলাই, সেভেন্থ অব মার্চ)। বাংলায় কিন্তু আলাদা তারিখ-শব্দ বাচক প্রত্যয় আছে: ১লা-২রা-৪ঠা-৭ই-২১শে। বাংলা ব্যাকরণের এই বিরল সৌন্দর্য, বাংলা ভাষার এই অমূল্য 'সম্পদ', তারিখ শব্দের অপরূপ অঙ্গবস্ত্র এই প্রত্যয়গুলোকে 'আপদ' বিবেচনা করে ছেঁটে বাদ দিয়ে, নব্বইয়ের দশক থেকে উলঙ্গ তারিখ-শব্দ লেখা হচ্ছে। আমি ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও প্রকাশনায় এই অব্যাকরণিক ও অযৌক্তিক ভাষা-আচরণের প্রতিবাদ করে করে ক্লান্ত হয়ে ক্ষ্যান্ত দিয়েছি দুই দুইটি প্রবাদের কথা ভেবে। প্রথমটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের: 'মূর্খে বশ কর তার মতে মত দিয়া; পণ্ডিতেরে বশ কর সত্য কথা দিয়া!' অপরটি সংস্কৃত: 'উপদেশে হি মূর্খানাং প্রকোপায় ন শান্তয়ে' অর্থাৎ 'মূর্খকে উপদেশ দিলে সে রেগেই যায়, শান্ত হয় না!'

আমার যুক্তিটা হচ্ছে, প্রত্যয় ব্যবহার যে কোনো ভাষার একটি রূপতাত্ত্বিক (অর্থাৎ শব্দগঠনের) বাস্তবতা এবং এই বাস্তবতা সহজে বদলানো যায় না। ভাষার শব্দ ও বাক্যগঠনের নিয়ম কালের প্রবাহে, শত শত বৎসর ধরে নিজে নিজে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বদলায়। বাংলাভাষী যদি মুখের ভাষায় ৭ মার্চ, ২১ ফেব্রুয়ারি বলতো, তবে উল্লেখিত প্রত্যয়গুলো বাদ দেয়ার পক্ষে যুক্তি দেখানো যেতো। বাংলাভাষীরা যে মুখের ভাষায় এবং লেখায় এখনও এই প্রত্যয়গুলো ব্যবহার করে তার অন্যতম প্রমাণ, ১লা সেপ্টেম্বর তারিখ সকাল এগারোটার দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা বাংলা বানান এবং দুপুর বারোটার দিকে তাঁর বাংলা উচ্চারণ।

কথ্য ভাষায় কোনো রূপতাত্তিক, ধ্বনিতাত্ত্বিক, বাক্যতাত্ত্বিক নিয়ম লিখিত ভাষায় রহিত করা হলে ভাষাব্যবহারে অকারণ দ্বিধার সৃষ্টি হয়। এই দ্বিধাসৃষ্টির ফল ভয়ঙ্কর হতে পারে। প্রতিযোগিতামূলক পরিক্ষায় কেউ যদি লিখে ৭ই মার্চ, এবং অন্য কেউ ৭মার্চ, তবে তাদের মধ্যে একজনের কম নম্বর পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর মানে হচ্ছে, তারিখ শব্দের সঠিক বানানের উপর ব্যক্তির ভবিষ্যৎ নির্ভর করতেও পারে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারাই যেখানে দ্বিধায় ভুগছেন, সেখানে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কথা বলা বাহুল্য। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমি যদি নিদান দেয় যে ৭মার্চ লিখতে হবে এবং রাষ্ট্রপ্রধান নিজেই যদি সেই নিয়ম না মানেন, তবে সরকারি নিদান এবং সরকারি আচরণ পরস্পর সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায় না কি?

২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত বঙ্গসম্মেলনের প্রচার-পুস্তিকা মুদ্রণ উপলক্ষে তারিখ-শব্দের ব্যাকরণ বিষয়ে শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সঙ্গে আমার মৃদু মতান্তর হয়েছিল। তিনি তারিখ-প্রত্যয় বাদ দিয়ে '৭মার্চ' ধরনের বানান লেখার পক্ষে ছিলেন। আমি উচ্চারণের প্রসঙ্গ তোলাতে তিনি বলেছিলেন: '৭মার্চ লিখেও তো ৭ই মার্চ উচ্চারণ করা যায়!' বাংলাদেশে অনেকেই মনে করেন (বাংলাদেশে ব্যাকরণ বিষয়টা হচ্ছে গরীবের বউ, সবার ভাবী, সবাই গায়ে হাত দিতে সাহস করে!), লিখিত ভাষায় '৭মার্চ' শুদ্ধ, কথ্য ভাষায় ক্ষেত্রে '৭ই মার্চ'। আমি উত্তর দিয়েছিলাম: '৭ই মার্চ যদি উচ্চারণই করবো, তবে লেখায় দোষ কী? ব্যাকরণের কোন যুক্তিতে এবং কোন সুবিধা পাবার আশায় লেখা আর উচ্চারণে এহেন অকারণ পার্থক্য সৃষ্টি করবো?' স্যার আমার ব্যাকরণের শক্ত ব্যাকগ্রাউন্ড সম্পর্কে ওয়াকেবহাল ছিলেন বলে মৃদু হেসে বলেছিলেন: 'আচ্ছা ঠিক আছে, ৭ই মার্চই লেখো, তুমি যদি চাও!'। হায়! ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ, তোমার অঙ্গহানি আমার মতো নালায়েকের চাওয়া-না চাওয়ার উপর নির্ভর করছে!

রবীন্দ্রনাথ কোথাও কোথাও (জাপানযাত্রীর পত্র?) তারিখ-প্রত্যয় ছাড়া ১ শ্রাবণ, বা ২ বৈশাখ লিখেছিলেন। কিন্তু তারিখ-প্রত্যয় বাদ দেবার রীতি ধরে-বেঁধে জোর করে চালু করেছে আনন্দবাজার পত্রিকাগোষ্ঠী, হিন্দির অনুকরণে। আমাদের দেশের সাংবাদিক, প্রকাশক, বুদ্ধিজীবী ও একাডেমিগুলো মূলত পশ্চিমবঙ্গ দ্বারা কুপ্রভাবিত, কারণ উপগ্রহের মত 'ইহাগিগের নিজস্ব কোনো আলো নাই'। আচ্ছা, ওঁর সব আচরণ বিনাপ্রশ্নে অনুকরণীয় হতেই হবে, এমন মাথার দিব্বি কি রবীন্দ্রনাথ নিজেই কখনো দিয়েছিলেন? এক সময় কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষার পরীক্ষার্থীদের রবীন্দ্রনাথের রচনার বানান শুদ্ধ করতে দেওয়া হতো। বানান সংস্কার কমিটির সব নিয়ম মেনে চলবেন বলে লিখিত কথা দিয়েও রবীন্দ্রনাথ প্রাক-সংস্কার অশুদ্ধ বানান লিখেছেন। শরৎচন্দ্রও কথা দিয়ে কথা রাখেননি।

কথা রাখা এঁদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, এবং আমাদের অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না, কারণ বানানের সাথে জড়িয়ে থাকে বহুদিনের অভ্যাস ও ঐতিহ্য যা সহজে বদলানো যায় না। এছাড়া প্রতিটি লেখক একজন উত্তম ভাষাব্যবহারকারী হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তিনি ভাষা-বিশেষজ্ঞ নন। আমি ইচ্ছে করলেই যেমন পদার্থবিদ্যা কিংবা অর্থনীতি সম্পর্কে পেশাদার মন্তব্য করতে পারবো না, তেমনি গত হাজার দুই বছরে ব্যাকরণ নিয়ে যে গবেষণা হয়েছে তার সব খবর রাখা বেশির ভাগ পেশাদার ভাষাবিজ্ঞানীদের পক্ষেই সম্ভব হয় না, সাধারণ-অসাধারণ লেখকের কথা বলাই বাহুল্য।

ভাষা হচ্ছে শব্দকোষ ও ব্যাকরণের যোগফল। সাধারণ মানুষের মনে এমত ভুল ধারণা আছে যে 'ব্যাকরণ' হচ্ছে এমন একটা বই যেটা কোনো একজন পণ্ডিত আগেভাগে লিখে রাখে এবং সাধারণ মানুষকে সেই বইয়ে লেখা নিয়ম মানতে বাধ্য করে। এই ধারণাটা সর্বৈব ভুল। ব্যাকরণ হচ্ছে ভাষার অপরিহার্য কাঠামো, মানুষের শরীরের কাঠামো যেমন তার কঙ্কাল। মানুষের শরীর আর তার কঙ্কাল এক সাথেই বদলায়। ভাষা ব্যবহারের পরিবর্তন মানেই ব্যাকরণের পরিবর্তন। ব্যাকরণ প্রথমে মানুষের মুখের ভাষায় বদলায়। সেই পরিবর্তিত ব্যাকরণের নিয়ম লিপিবদ্ধ করেন বৈয়াকরণ। শব্দকোষে পুরোনো শব্দ হারিয়ে গিয়ে আসে নতুন শব্দ। সংস্কৃত 'লেখনি', 'রাতা' হারিয়ে গেছে, তার জায়গায় এসেছে, আরবি 'কলম', হিন্দি 'লাল'। একজন শব্দবৈদ্য বা অভিধানকার এই বাস্তবতার নিরিখে নতুন অভিধান রচনা করতে বসেন।

সমস্যা হচ্ছে, বাংলাভাষীরা আরও বহু কাল তারিখ-প্রত্যয় ব্যবহার করতে বাধ্য হবে, কারণ ইতিমধ্যে একাধিক তারিখশব্দ বাঙালির সংস্কৃতি ও ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। যতদিন বাঙালি জাতির অস্তিত্ব থাকবে, ততদিন '২১শে ফেব্রুয়ারি', '৭ই মার্চ', '২৬শে মার্চ,' '১লা বৈশাখ', '২২শে শ্রাবণ', '১৫ই আগস্ট', '১৪ই ডিসেম্বর', '১৬ই ডিসেম্বর' – এই তারিখশব্দগুলো প্রত্যয়সহযোগেই উচ্চারিত হবে। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশ ফেব্রুয়ারি' গাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। যদি তারিখ-প্রত্যয় ব্যবহার না করার নিয়ম বলবৎ থাকে তবে এই দ্বিধার অবসান সহজে হবে না।

প্রমথ চৌধুরী সম্ভবত লিখেছিলেন, 'ভাষা মানুষের মুখ থেকে নিবে আসে, এর উল্টোটা হলে, অর্থাৎ নিব থেকে মুখে আসলে মুখে কালি লেগে যায়!' মানব ভাষার ইতিহাসে এই অভূতপূর্ব দুর্ঘটনাটিই ঘটে গেছে বাংলাদেশে। আমার নিজের প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বহু বাংলাভাষী জেনে কিংবা না জেনে, ১ বৈশাখ, ৭ মার্চ বলে থাকেন, যার মানে হচ্ছে, 'বাঙলার মুখ আমি দেখিয়াছি' নোংরা হইতেছে, হায়! বেআক্কেলের নিবের কালিতে! বহুকাল ধরে এই পোড়া দেশে আয়না আর আক্কেলের যে আকাল চলছে সে কথা আর নাই বা বললাম। এছাড়া '৭ই মার্চ' বা '২১শে ফেব্রুয়ারি''র মতো আবেগনিষিক্ত শব্দবন্ধের বানান বিকৃত করার দুঃসাহস যারা করে, ৭ই মার্চের আবেগ ও চেতনা মনে কতটা তারা ধারণ করে, সে প্রশ্নও না হয় ভবিষ্যতের শিকেয়ই তোলা রইল।

পুনশ্চ: 'শেষ নাহি যে শেষ কথাটি বলবে।' আমরা চাই বা না চাই, উপরোক্ত তারিখশব্দগুলো বাঙালি সংস্কৃতির এক একটি কথামূর্তি বা ভাবমূর্তিতে পরিণত হয়েছে। মূর্তির অঙ্গহানি খুব কম উপাসকই মেনে নিতে পারে, বিশেষত ভারতবর্ষের মতো (ভাব)মূর্তিপূজাপ্রবণ অঞ্চলে। তারিখ-প্রত্যয় বাদ দেয়াটা বাঙালি ও বাংলা-বিরোধী গোষ্ঠীকর্তৃক এই সব ভাবমূর্তির অঙ্গহানি করার দীর্ঘমেয়াদি, অবচেতন বা গোপন কোনো ষড়যন্ত্র হতে পারে কি? আপনারা হয়তো বলবেন, আমি একটু বাড়াবাড়িই করে ফেলছি, কিন্তু উত্তরে একজন শার্লক হোমস মৃদু হেসে বলতেই পারেন: 'কোনো সম্ভাবনাই উড়িয়ে দিও না হে, প্রিয় ওয়াটসন!'