তাহাদের কথা ৪ : একজন ‘ইউনিয়নিস্ট’ মন্ত্রীর কাহিনি

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 3 Sept 2018, 09:09 AM
Updated : 3 Sept 2018, 09:09 AM

তিনি 'শ্রমিক-বান্ধব'। নিপীড়িত মেহনতি মানুষের পক্ষে থাকাটা দোষের কিছু নয়, বরং এটা একটা মহৎ গুণ। কিন্তু সবকিছুর একটা নিয়ম আছে, শৃঙ্খলা আছে, আইন আছে। কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কোনো কোনো শ্রমিকের অন্যায়টাকেও জায়েজ করে নিতে চান। গোটা দেশকে জিম্মি করে ফেলেন। সমস্যাটা সেখানেই।

আর এই কাজটা যিনি করেন বলে অভিযোগ তিনি নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। তিনি একাধারে শ্রমিক নেতা এবং মন্ত্রী। সাধারণ মন্ত্রী নন, মহাশক্তিধর মন্ত্রী। তার নির্দেশ পেলে দেশের লাখ লাখ পরিবহন শ্রমিক কয়েক মিনিটের মধ্যে রাস্তায় নেমে দেশকে যেমন অচল করে দিতে পারে। সরকারের আর কোনো মন্ত্রী বা নেতা তা পারবেন না!

তিনি ১৯৭২ সাল থেকে মাদারীপুর জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি। ১৯৭২ সালেই তিনি আবার মাদারীপুর মহকুমা নৌকা মাঝি সমিতি ও হরিজন সমিতি গঠন করে সভাপতি হয়েছিলেন।

মূলত তাঁর 'ইউনিয়নিস্ট' পেশার ব্যাপক পসার ঘটে ১৯৮৭ সাল থেকে। এ সময়ে তিনি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্যসচিব নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯০ সালে সড়ক পরিবহন শ্রমিকদের তিনটি ফেডারেশন এক করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ঐক্য পরিষদ গঠন এবং ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, বিপ্লবী সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও বাংলাদেশ ট্রাক ড্রাইভার্স ফেডারেশন ঐক্যবদ্ধ করে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন গঠন করেন। তিনি এখনো এর কার্যকরী সভাপতি। এখানেই শেষ না। এরপর তিনি হাত বাড়ান পোশাক শ্রমিক সংগঠনগুলোর দিকে। ২০১৩ সালে ৫২টি গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সমন্বয়ে গঠন করা হয় গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদ। এরও প্রধান তিনি।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে দেওয়া ওয়েবসাইটে 'ইউনিয়নিস্ট' পেশায় শাজাহান খানের বিশাল এক সাফল্যের উদাহরণও দেওয়া আছে জীবনবৃত্তান্তে। সেখানে বলা আছে, ১৯৮৭ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত কারণে ড্রাইভার হারুণ অর রশিদকে ফাঁসির আদেশ এবং সুপারভাইজার মজিবর রহমান ও হেলপার আজিবর রহমানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশের প্রতিবাদে আন্দোলন করে তাঁদের মুক্ত করেন। এই আন্দোলনে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।

শাজাহান খানের রাজনৈতিক জীবনও বেশ আলোচিত। ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করতেন। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ সালের মার্চে তিনি মাদারীপুর মহকুমা আওয়ামী লীগের কৃষি সম্পাদক হয়েছিলেন। তবে ওই বছরেরই অক্টোবরে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। এরপর ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে হেরে যান। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতেছিলেন। এরশাদ পতনের পরে ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নির্বাচনে শাজাহান খান জাসদের প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করলেও হেরে যান। এর ঠিক এক মাস পরেই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নৌকায় চড়ে বসেন এবং উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে মাদারীপুর-২ আসন থেকে নির্বাচিত হন। সেই থেকেই তিনি নৌকায় আছেন।

শাজাহান খানের অনেক কীর্তি রয়েছে। তার নির্দেশে এক সময় অসংখ্য বিআরটিসি বাস ভাঙচুর করা হয়। বিএনপি-জামাত জমানায় বেসরকারি বাস মালিক-শ্রমিকরা দেশের কোথাও বিআরটিসিকে নির্বিঘ্নে চলতে দেয়নি। কারণ বিআরটিসি বাস জনপ্রিয় ছিল। শাজাহান খান এবং তার দোসরদের কারণেই বাংলাদেশে বিআরটিসি ও রেলওয়ে বিকশিত হতে পারেনি (এতদ্সংক্রান্ত তথ্যের জন্য ঋণ স্বীকার করছি সাবেক পররাষ্ট্র সচিব, লেখক, গবেষক মহিউদ্দিন আহমদের কাছে) । তারা 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনের নেতা ইলিয়াস কাঞ্চনকেও ফরিদপুরে একবার লাঞ্ছিত করেছে।

শাজাহান খানের প্রাইভেট বাস মালিকরা রেলওয়ের চলাচলেও বাধা দিয়েছে। তাদের দাবিতে, তখনকার যোগাযোগ মন্ত্রী নজমুল হুদা গভীর রাতে রাজশাহী-ঢাকার মধ্যে ট্রেন এবং বাস চলাচলের সময় ঠিক করে দেয় যেন পরদিন সকালে যাত্রীরা বাস বা ট্রেন ধরে ঢাকা আসতে বাধ্য হয়! রেলওয়ে ও বিআরটিসির মত বিশাল রাষ্ট্রীয় সম্পদ ধ্বংসে শাজাহান খানের অবদান নিয়ে গবেষণা হতে পারে। তারপরও তিনি 'কিং খান'। সরকারের একজন দাপুটে মন্ত্রী। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে পর্যন্ত শাজাহান খানকে সমীহ করে চলতে হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েও তিনি সড়কের ব্যাপারে স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। সিদ্ধান্ত নিলেও তা বাস্তবায়ন করতে পারেন না।

এ রকম একজন ব্যক্তি ৯ বছর ধরে বর্তমান সরকারের মন্ত্রী। যদিও মন্ত্রীর চেয়ে তাঁর কাজকর্মে 'ইউনিয়নিস্ট' পেশাতেই বেশি ব্যস্ত দেখা যায়। এমন ব্যক্তিকে মন্ত্রিসভায় স্থান দেওয়ায় সরকারের কাজকর্ম অনেক বেশি গতিশীল হওয়ারই কথা। কিন্তু আসলেই কি তাই হয়েছে?

তিনি বরং সরকারের বোঝায় পরিণত হয়ে আছেন। সম্প্রতি নিরাপদ সড়কের দাবিতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের রাজপথে নামার ঘটনা ইতিহাসে আর একটিও আছে কি না সন্দেহ। আর এর দায় অনেকটাই শাজাহান খানের। তিনি যদি ঘটনার পর পর হাসিমুখে বাংলাদেশের দুই শিক্ষার্থীর ওপর বাস উঠিয়ে দেওয়ার ঘটনার সঙ্গে ভারতের মহারাষ্ট্রের দুর্ঘটনার উদাহরণ টেনে এনে বিষয়টি উড়িয়ে না দিতেন, তাহলে ক্ষোভ এতটা হয়তো বাড়ত না। আন্দোলনের প্রবল ঢেউ দেখে যদিও তিনি বাধ্য হয়ে কৌশলী দুঃখ প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, তিনি নাকি ঘটনা তখনো জানতেন না, হেসেছেন অন্য কারণে।

এমন নয় যে এ ধরনের অসংবেদনশীল মন্তব্য এটাই তাঁর প্রথম, সুতরাং ক্ষমাযোগ্য। এই কাজটি তিনি অতীতেও করেছেন। ২০১১ সালে মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ এবং মিশুক মুনির নিহত হলে চালকদের লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে কথা উঠলে শাজাহান খান বলেছিলেন, 'গরু-ছাগল চিনতে পারলেই তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হবে।'

আবার ২০১৫ সালে পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে নারী লাঞ্ছনার ঘটনায় তিনি বলেছিলেন, 'দেশে কোটি মানুষের বাস। এর মধ্যে ঢাকায় থাকেন দুই কোটি মানুষ। তাই এমন ঘটনা ঘটতেই পারে।' ২০১৭ সালে তার ছত্রচ্ছায়ায় সারা দেশে পরিবহন শ্রমিকেরা ধর্মঘটে গেলে শাজাহান খান বলেছিলেন, 'বাসচালকরা ধর্মঘট করছেন না, তাঁরা স্বেচ্ছা অবসর নিয়েছেন।' একই বছর সাভারে ট্রাকচাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে ঢাকার আদালত ট্রাকচালকের ফাঁসির রায় দিয়েছিলেন। ফাঁসির এই রায়ে তাঁর মন্তব্য ছিল, 'ফাঁসি দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে-তা ভুল ধারণা। একজন মন্ত্রীর সন্তান কুকুর বাঁচাতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন। তাই বলে কি সে কুকুরের ফাঁসি হবে?'

তার এই ভয়ঙ্কর রকমের অসংবেদনশীল মন্তব্য সে দিন তুমুল শোরগোল তুলেছিল। কিন্তু মানুষ অচিরেই সে সব ভুলে প্রাত্যহিকতায় মগ্ন হয়ে পড়েন!

কথায় বলে, ভাগ্য মানুষকে গৌরবের পথে নিয়ে যায়, কিন্তু নিয়তি যা দেয় অহঙ্কার তাকে নষ্ট করে। উচ্চ পদে আসীন মানুষদের কাছে সাধারণ জনতা আশা করে যে তাঁরা কিছু দায়িত্ব স্বীকার করবেন। সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বটি হল, তারা আপন পদটির উপযুক্ত আচরণ করবেন। পদমর্যাদা তারা যদি বাড়াতে না-ও পারেন, পদটির যাতে অবমাননা না হয়, সেটা নিশ্চিত করা তাঁদের কর্তব্য। আমরা এ ব্যাপারে বিশেষ ভাগ্যবান নই। অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদ অলঙ্কৃত করেছেন— কিন্তু তাদের পদের যোগ্য এবং প্রত্যাশিত আচরণ করেননি। খুব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এমন অনেকেরই দেখা মিলেছে যিনি বা যারা জনপরিসরে কথা বলার সময় নিজের দায়িত্বের প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। শাজাহান খান তাদেরই একজন। তার কিছু বক্তব্য বা মন্তব্য কালো দাগ হিসেবেই রয়ে গেছে, যা মুছে ফেলা অসম্ভব।

যে সব ব্যক্তির কারণে বর্তমান সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে, সরকার সমালোচিত হয়েছে তাদের অন্যতম শাজাহান খান। যিনি পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের প্রধান নেতা, তার নির্দেশ এলে যে-কাউকেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে বাধ্য বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। একটি দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদন মতে, ১৯৯২ সাল থেকে নৌমন্ত্রীর সংগঠন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন ফেডারেশনের দেওয়া তালিকা ধরে প্রায় ১ লাখ ৯০ হাজার চালককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। প্রাপ্ত ২০১১-১২ সালেও শাজাহান খানের স্বাক্ষরসম্বলিত তালিকা ধরে যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া হাজার হাজার লাইসেন্স পেশাদার চালককে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে মেয়াদ উত্তীর্ণ শত শত গাড়ি যেগুলো গ্যারেজে ধ্বংস হবার অপেক্ষায় থাকার কথা ছিল।

অনেক সমালোচনা, দাবি-আন্দোলনের পরও তাকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়নি। অন্তত তিনি সব শ্রমিক সংগঠনের পদ থেকে পদত্যাগ করুন-এমন দাবিও উচ্চারিত হয়েছিল। কারণ দর-কষাকষি শক্তির (শ্রমিক সংগঠন) নেতা এবং বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ (মন্ত্রী) একই ব্যক্তি হলে তাতে স্বার্থের সংঘাত হয়। এমনকি তা মন্ত্রীর শপথেরও লঙ্ঘন। তিনি মন্ত্রী হিসেবে অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী না হওয়ার শপথ নিয়েছেন। আবার শ্রমিক সংগঠনের নেতা হিসেবে তিনি তাঁদের স্বার্থটাই বেশি দেখতে বাধ্য। কিন্তু সব দাবি-আন্দোলন-প্রস্তাবকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তিনি ঠিকই শ্রমিক সংগঠন ও মন্ত্রী উভয় পদেই বহাল রয়েছেন!

শরীরের কোনও অঙ্গে পচন ধরলে চিকিৎসক প্রথমে তা সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ সংশোধনের প্রয়াস। সেই প্রয়াস সফল না হলে, শরীরের স্বার্থেই, সেই অঙ্গ কর্তন করা হয়। এটা প্রতিহিংসা নয়, দুঃখের হলেও, আপাতনিষ্ঠুর হলেও এই পথ অবলম্বন করতে হয়। যে মৃত্যু বহু জীবন বিনাশের সম্ভাবনা হ্রাস করে, তার প্রতিপাদন তিক্ত, কিন্তু মাঙ্গলিক। মনে করা হয়েছিল, শাজাহান খানকে সরকার বৃহত্তর স্বার্থেই 'বাদ' দেবেন। কিন্তু না, গণদাবি উপেক্ষা করে সরকার তাকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে রেখে দিয়েছেন! সংসদীয় গণতন্ত্র রক্ষা করা যায় সামাজিক জীবনে সু-আচরণের মাধ্যমে, সুবচনের মাধ্যমে। কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক আচরণকারীরা ব্যক্তিরাই যখন অপরিহার্য হয়ে ওঠেন তখন বুঝতে হবে, পরিস্থিতি আসলেই ভালো নয়!