তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রপ্তানি আয় বৃদ্ধি ও যোগাযোগ দক্ষতার প্রয়োজনীয়তা

Published : 2 Sept 2018, 08:17 AM
Updated : 2 Sept 2018, 08:17 AM

২০১৭ সালে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে  রপ্তানি আয় হয়েছে ৮০০ মিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালের লক্ষ্যমাত্রা ১০০ কোটি ডলারে দাঁড়াবে আশা করা যাচ্ছে। (বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৬.১১.২০১৭)

২০১৭ সালে ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে রপ্তানি আয়  হয়েছে ১১১ বিলিয়ন ডলার (সূত্রঃ দি ইকোনমিক টাইমস  ২৫.১.২০১৮)

২০১৭ সালে পাকিস্তানের তথ্যপ্রযুক্তি রপ্তানি খাতে ২০১৭ সালে  আয়  হয়েছে ৩ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালের লক্ষ্যমাত্রা  ৫ বিলিয়ন ডলার। (সূত্র: সফটওয়্যার এক্সপোর্ট বোর্ড,)

২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকারের যাত্রাকালে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আয়  ছিল মাত্র ২৬ মিলিয়ন ডলার। সেক্ষেত্রে ৯ বছরে রপ্তানি চার গুণ বেড়ে যাওয়া দেশের জন্য বড় সাফল্য।  কিন্তু তা সত্ত্বেও এই আয়ে উল্লসিত হওয়ার কিছু নেই।

এই খাতে আমাদের আয় প্রতিবেশি দেশগুলো যাদের সাথে আমাদের তুলনা চলে, তাদের থেকে অনেক কম।

ভারতের এই খাতে রপ্তানি আয় ১১১ বিলিয়ন ডলার, যা আমাদের ১১১ গুণ। ভারতের সঙ্গে  জনসংখ্যা ও জাতীয় আয়ের তুলনা করলে, আমাদের রপ্তানি আয় ১০ বিলিয়ন ডলার বা ৮০ হাজার কোটি হওয়ার কথা।

২০১৬ সালে তথ্য-প্রযুক্তি খাত থেকে ২০২১ সালের মধ্যে রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয় ৫০০ কোটি ডলার। গত দুই বছরে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। প্রবৃদ্ধির এই ধারা বজায় রেখে ২০২১ সালের লক্ষমাত্রায় পৌঁছানো সম্ভব নয়।

তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে সরকারি উদ্যোগের চেয়ে বেসরকারী উদ্যোগ ও সক্ষমতা বেশি প্রয়োজন। এই খাতে রপ্তানি আয়ের সংখ্যাটি দেখে অনেকে উল্লসিত হচ্ছেন। রপ্তানি আয়টিকে অতি মূল্যায়ন করা হচ্ছে। আয়ের মধ্যে যে বড়  রকমের দুর্বলতা আছে, তার উপর নজরই দেওয়া হচ্ছে না যার জন্য এটাকে সমস্যা চিহ্নিত করে, গবেষণাও করা হচ্ছে না।

প্রতিবেশি দেশের রপ্তানি আয়ের উপর নজর দিলে বোঝা যায়। এই খাতে আমাদের আয়, সম্ভাবনার তুলনায় অনেক কম. কম হওয়ার কারণ মূলতঃ দুটি- এই পণ্যটি বিশ্ববাজারে ভালোভাবে উন্নীত (প্রমোট) করা হয়নি। দ্বিতীয় বড় কারণ, এই খাতে কর্মরত প্রকৌশলী ও পেশাজীবীদের 'সফট স্কিলস' এর অভাব।

এই নিবন্ধে সফট স্কিল অভাব কীভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের রপ্তানি আয়কে প্রভাবিত করছে, সেই বিষয়টির উপর আলোকপাত  করবো। 'সফট স্কিলস' সম্পর্কে দেশে কিছু আলোচনা শুরু হলেও অনেকের কাছে এই ধারণাটা অস্পষ্ট। তাই এই বিষয়টি সম্পর্কে কিছুটা ভূমিকা দিচ্ছি।

আমরা যখন গত শতকে ছাত্র ছিলাম, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি বা 'পাঠ্যক্রম বহির্ভুত কার্যক্রম' কথাটা প্রচলিত ছিল।  এই কার্যক্রমগুলো বলতে খেলাধুলা, গানবাজনা, বিতর্কে অংশগ্রহণ ইত্যাদি বোঝাতো।

সফট স্কিলের ধারণাটি অনেকটা 'এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটি' এর আধুনিক রূপ।

সফট স্কিলস বলতে যোগাযোগ, নেতৃত্ব, সামাজিক ও সমন্বয়ের দক্ষতা সমষ্টিগতভাবে বোঝায়। শিক্ষার সাথে যেমন বুদ্ধিমত্তা সম্পৃক্ত। সফট স্কিল তেমন  আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার সাথে সঙ্গে সম্পৃক্ত।

সফট স্কিলস সব পেশাজীবীদের জন্য প্রয়োজন। তবে আইটি পেশাজীবীদের জন্য এটা অত্যাবশ্যক। এই দক্ষতার অভাবে অনেক আইটি পেশাজীবীদের কর্মক্ষেত্রে  প্রযুক্তিগত দক্ষতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।

বাংলাদেশের শিক্ষার মান প্রতিবেশি দেশগুলোর চেয়ে খারাপ না। আমাদের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক মানসম্মত এবং সব উন্নত দেশে স্বীকৃত।  দেশের প্রকৌশলীদের মেধা ও শিক্ষার মান  নিয়ে কখনো প্রশ্ন ওঠেনি। প্রশ্ন উঠেছে, তাদের আন্ত:ব্যক্তিক দক্ষতা নিয়ে।

সফট স্কিলস, যোগাযোগের  দক্ষতা যেকোনো  শিল্প ক্ষেত্রে  প্রয়োজন হয়, তবে এই প্রয়োজন তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে সবচেয়ে  বেশি। প্রযুক্তিক্ষেত্রে  পেশার নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। এই কারণে এই পেশাকে বহুমাত্রিক পেশা বলা হয়।

প্রথমত, নতুন প্রযুক্তির উপর একক ভাবে হয় না, এর জন্য  টিম ওয়ার্ক  করতে হয়। প্রকৌশলীদের নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করতে হয়। উপরন্তু অন্যান্য বিভাগ যেমন  বাজার ও বাণিজ্যিক বিভাগে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয় বিধান করতে হয়। এই কারণে শুধু প্রকৌশলীদের কারিগরি দক্ষতা যথেষ্ট নয়।

'বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে আন্ত:ব্যক্তিক যোগাযোগ দক্ষতার বিকাশ ঘটেনি। সহকারী র্কমকর্তারা জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি পান। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতাই উন্নতির প্রধান মাপকাঠি। বেসরকারী সেক্টরের চাকুরেদের মধ্যে যোগাযোগের দক্ষতা, নেতৃত্বের গুণাবলী বৃদ্ধির সুযোগ সীমিত।

বাংলাদেশি দক্ষ  পেশাজীবীরা যখন বিদেশে কাজ করেন, তখন তাদের সফট স্কিলসের অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। আমি কয়েকটা কোম্পানিতে চাকরি করেছি যেখানে বাংলাদেশি প্রকৌশলী কর্মরত ছিলো। সব বিদেশি সহকর্মী তাদের মেধা ও দক্ষতার প্রশংসা করেছে। কিন্তু কোনো প্রকৌশলীকে কোম্পানির পরিচালক পর্ষদে কখনো দেখিনি।

আরেকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। পৃথিবীর দুইটি বৃহত্তম প্রযুক্তি কোম্পানি গুগল ও মাইক্রোসফট এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা দুই ভারতীয় সুন্দর পিচাই ও সাত্যিয়া নাদেলা। শুধু তাই নয় সিলিকন ভ্যালির সবচেয়ে বড় নয়টি টেক কোম্পানি পরিচালনায় আছেন ভারতীয়রা। (সূত্র: ফোর্বস ম্যাগাজিন)

আমেরিকান  ৫০০ বড় কোম্পানির মধ্যে ১৪ জন ভারতীয় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আছেন। কিন্তু বাংলাদেশের ১ জন সিইও নেই।

ভারতে প্রযুক্তি রপ্তানির পাশাপাশি 'সিইও রপ্তানি'র কথা বেশ জোরেসোরে আলোচনা হয় । এইসব সিইও বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের বেতন ও ভাতা আকাশচুম্বী হয়। যেমন- গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই তার বাৎসরিক বেতন ছাড়াও গত বছর ৩০০ মিলিয়ন ডলার স্টক অপশন হিসাবে পেয়েছেন। ৯ জন ভারতীয় সিইও এর বাৎসরিক আয় ১ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

ফোর্বস ম্যাগাজিনে কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের পন্থা সম্পর্কে যেসব নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, তার সার সংক্ষেপ একটাই যে, নেতৃত্ব দেওয়ার, আলোচনা ও যোগাযোগের দক্ষতা কর্মক্ষেত্রে পদোন্নতির জন্য প্রয়োজন। শুধু শিক্ষা ও মেধা দিয়ে কর্মক্ষেত্রে সফলতা আসে না।

বাংলাদেশে অনেক মেধাবী প্রকৌশলী থাকা সত্ত্বেও তথ্য ও প্রযুক্তি রপ্তানি আয় সম্ভাবনার মাত্র ১০ শতাংশ অর্জিত হচ্ছে। বিদেশেও উপরের পদ পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এর যৌক্তিক কারণ একটাই, যে দেশের পেশাজীবীদের সফট স্কিলসের অভাব রয়েছে।

আমার এই লেখাটির জন্য তথ্য সংগ্রহের  প্রয়োজনে, কয়েকজন বাংলাদেশি ও ভারতীয় প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম।

তারাও একমত যে, ভারতীয় কোম্পানিগুলো সফট স্কিলস এর উপর নিয়মিত ট্রেনিং দেয় কীভাবে একসাথে ভালো টিম হিসাবে কাজ করা যায়, কীভাবে ফলপ্রসূ আলোচনা করা যায়, নিজেদের বিরোধ দূর করা যায় -এই সব বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ  দেওয়া হয়।

আমি যাদের সাথে কথা বলেছি, তাদের মতে, আমাদের দেশের প্রকৌশলীদের  অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভারতীয়দের চেয়ে কম নয়। তবে একই সঙ্গে এটাও লক্ষ্যণীয় যে, ভারতীয়দের সফট স্কিলে দক্ষতা বেশি।

তারা কথাবার্তায় চৌকস ও যোগাযোগে দক্ষ। তাদের ইংরেজি ভাষার মান বেশ ভালো।

কিন্তু দেশের কোম্পানিগুলো তাদের কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিনিয়োগ  করে না। এই কারণে কোম্পানিগুলোর  কর্মক্ষেত্রে যেটাকে  "টিম ওয়ার্ক" বলা হয়, তা  হয় না। কাজের পরিবেশ বেশ ফর্মাল অর্থাৎ যুগোপযোগী নয়।

ভারতীয় পেশাজীবীদের যোগাযোগ দক্ষতা ভালো হওয়ার কারণ কি ? মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ জন্মগতভাবেই  বিভিন্ন গুণের অধিকারী। অনেক রাজনীতিবিদ কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই যোগাযোগে দক্ষ। যাদের  জন্মসূত্রে এইসব গুণগুলো না থাকে, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অর্জন করতে হয়। ভারতের সবগুলো প্রযুক্তি কোম্পানি সফট স্কিলস উন্নয়নে ব্যাপকভাবে  প্রশিক্ষণ দেয়। এই দক্ষতা বাড়ানোর উপর ব্যাপক গবেষণাও হয়।

জরিপে দেখা যায়, যে কোম্পানিগুলো সফট স্কিলস উন্নয়নে বেশি অর্থ বরাদ্দ করে। সেই কোম্পানিগুলোর সফলতা ততো বেশি। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি মোস্তফা জব্বার অভিযোগ করেছেন যে, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে, তারা দক্ষ জনশক্তি পাচ্ছেন না। আর না পাওয়ার কারণে তারা পিছিয়ে আছেন। তিনি পাঠ্যক্রম পাল্টানোর জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।

আমার ধারণা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অ্যাকাডেমিক সিলেবাস মোটামুটি ঠিক আছে। তবে যুগপোযোগী করার প্রয়োজন আছে। আন্ত:ব্যক্তিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ ইন্টার্নশিপের ব্যবস্থা করা দরকার। একমাত্র ডেফোডিলস ইন্টারন্যাশনাল সফট স্কিলসের উপর আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেছিল। এই ধরনের উদ্যোগ আরো নেওয়ার প্রয়োজন আছে।

কিন্তু এ ব্যাপারে কোম্পানিগুলোর যথেষ্ট দায়ভার আছে। তারা সবসময় দক্ষ জনশক্তি আশা করেন। কিন্তু জনশক্তির দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ করেন না। সফট স্কিলস বাড়াতে প্রচুর প্রশিক্ষণের দরকার হয়। এর জন্য কর্মশালা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম অনেক কিছু করতে হয়। কোম্পানিগুলো উচিৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করা।

বেসিসের একটা কথার সাথে আমি একমত যে, 'প্রযুক্তি  ইন্ডাস্ট্রির  কাঁচামাল মানব সম্পদ।' কিন্তু এই কাঁচামালের সরবরাহের উপর শুধু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে থাকা ঠিক নয়। কাঁচামালের উন্নয়নে কোম্পানিগুলোর অনেক দায়িত্ব আছে।

আমি মনে করি না যে, ২০২১ সালের লক্ষমাত্রা বদলানোর প্রয়োজন আছে। এই লক্ষ্যে এখনো পৌঁছানোর সময় আছে। এই লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য জ্যামিতিক হরে প্রবৃদ্ধির প্রয়োজন। সফট  স্কিলের উন্নয়ন এই প্রবৃদ্ধি পূরণে সহায়তা করবে।