গুজব: প্রেক্ষিত মনস্তত্ত্ব, অবাধ তথ্য প্রবাহ ও দায়িত্বশীলতা

সাজ্জাদুল হাসান
Published : 30 August 2018, 03:23 PM
Updated : 30 August 2018, 03:23 PM

গত কিছুদিন ধরে আমাদের দেশে 'গুজব' নিয়ে ভীষণ হৈচৈ। এক পক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা ব্যস্ত গুজব ছড়াতে আর অন্য পক্ষ গলদঘর্ম গুজব মোকাবেলায়। সাধারণ মানুষ অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিধাগ্রস্ত! কোনটা সত্য আর কোনটা গুজব?

'গুজব' আসলে কি? এর আভিধানিক অর্থ – রটনা, ভুল বা অসঙ্গত তথ্য প্রচার। উইলিয়াম শেক্সপিয়ার চমৎকারভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন 'গুজব'কে :

"Rumour is a pipe

Blown by surmises, jealousies, conjectures

And of so easy and so plain a stop

That the blunt monster with uncounted heads,

The still-discordant wavering multitude,

Can play upon it."

প্রশ্ন জাগে এ নিয়ে এত মাতামাতি বা উদ্বেগের কি আছে?  সম্ভবত এ প্রশ্নের উত্তর কিছুটা পাওয়া যাবে প্রিয় কবি শামসুর রাহমানের 'পণ্ডশ্রম' কবিতায়:

"এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,

চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।

কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,

আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।

দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,

কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে।

কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল?"

'গুজব' – তিন অক্ষরের আপাত নিরীহ এই শব্দটি কখনো কখনো ভীষণ অপ্রতিরোধ্য! এর গতিবেগ আলোর গতির চাইতে দ্রুত। প্রখ্যাত মার্কিন কথা সাহিত্যিক মার্ক টোয়েনের ভাষ্য মতে, 'সত্য তার জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে গুজব বা মিথ্যা সমস্ত পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে আসতে সক্ষম।'

আর বর্তমানে প্রযুক্তির এই উৎকর্ষতার সময়কালে বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অভাবনীয় বিস্তার এবং প্রভাবের কারণে গুজব ছড়াচ্ছে একেবারে চকিতে – 'শেয়ার' বা 'রিটুইট' বাটন ক্লিক করতে যতটুকু সময়ের প্রয়োজন হয় ঠিক ততটুকু সময়ে।

কেবল আমাদের সমাজে নয়, সুদূর অতীত কাল থেকে দেশে দেশে নানা কারণে 'গুজব' ছড়িয়েছে। কখনো বা স্বার্থান্নেষী মহল ইচ্ছে করে 'গুজব' রটায় আবার কখনো অবাধ তথ্য প্রবাহের ঘাটতির কারণে 'গুজব' তার ডালপালার বিস্তার ঘটায়। প্রসঙ্গক্রমে, কয়েকটি ঐতিহাসিক গুজবের উল্লেখ করা যেতে পারে:

১৭৫০ সালে  হঠাৎ করে প্যারিসের রাস্তা থেকে শিশুরা উধাও হয়ে যেতে থাকে। কেউ বলতে পারছিল না কী কারণে এ রকম হচ্ছে!   এরকম এক ভয়াবহ পরিস্থিতিতে যখন সবাই বিশেষ করে শিশুদের অভিভাবকেরা ভীষণ উদ্বিগ্ন; চারিদিকে রটে যায় যে, সম্রাট লুই (পঞ্চদশ) কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত। এ রোগ থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় শিশুদের রক্তে স্নান করা। আর  সে কারণে রাজার লোকেরা শিশুদের অপহরণ করছে। গুজবটি মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে যায়।  বিক্ষুব্ধ জনসাধারণ প্রতিবাদে নেমে আসে রাজপথে, যার ফলে প্যারিসে সংঘটিত হয় ব্যাপক দাঙ্গা।

সত্যটা হচ্ছে, কর্তৃপক্ষ রাজপথ থেকে অবাঞ্চিতদের অপসারণের নির্দেশ দেয়। কাজটা যাতে যথাযথভাবে হয় সে কারণে পুলিশ বাহিনীকে গ্রেপ্তার প্রতি অর্থ দেয়া হতো!  যত বেশি গ্রেপ্তার তত টাকা! অতিউৎসাহী পুলিশ সদস্যরা গণহারে (শিশুসহ) গ্রেপ্তার শুরু করে এবং তাদের কারাগারে পাঠাতে থাকে। পরবর্তীতে দেখা যায়, এ সব অপহৃত শিশুদের সকলেই ফিরে এসেছিলো।

১৭৬১ সালের শুরুর দিকে লন্ডনে দুইটি মৃদু ভূমিকম্প হয়।  স্বাভাবিকভাবে লন্ডনবাসী কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন।  এরমধ্যে গুজব রটে যায়, এপ্রিলের ৫ তারিখে আঘাত হানবে শক্তিশালী এক ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প।  আতংকিত নগরবাসী পালাতে থাকে শহর ছেড়ে। যাদের বিকল্প কোথাও যাওয়ার জায়গা ছিলোনা তারা খোলা মাঠে অবস্থান নেয়। জনৈক সৈনিক এ ব্যাপারে এতটাই নিশ্চিত ছিলেন যে, তিনি পুরো শহরে রাস্তায় রাস্তায় জনসাধারণকে ভূমিকম্পের ভয়াবহতা সম্বন্ধে অবহিত করতে থাকেন। দুঃখজনক ভাবে কয়েক মাস পরে ওই সৈনিকের  স্থান হয় এক পাগলাগারদে।

এ কথা ভাববার কোনো অবকাশ নেই যে, গুজব ছড়ানোর প্রবণতা কেবল অতীতকালে ছিল। এমনকি বর্তমানেও ক্রমাগতভাবে গুজব রটছে এবং কখনো কখনো তা অসম ক্ষতির কারণ হচ্ছে। ২০০৮ সালের ৩ অক্টোবরে হঠাৎ করেই  ইন্টারনেটের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী স্টিভ জবসের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ায় তাঁকে হাসপাতালে নেয়া  হয়েছে।  খবরটি শেয়ার বাজারে ছড়িয়ে পড়তেই বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সৃষ্টি হয় আতঙ্কের। লেনদেনের প্রথম ঘন্টায় অ্যাপলের শেয়ারের ব্যাপক দরপতন ঘটে যার অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! ঘটনাটির সূত্রপাত হয়, যখন ১৮ বছরের অজ্ঞাতনামা এক যুবক সিএনএন' এর আই রিপোর্ট ওয়েবসাইটে খবরটি পোস্ট করে। কর্তৃপক্ষ কোনোরকম যাচাই-বাছাই ছাড়াই সংবাদটি পরিবেশন করে!

প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী নিকোলাস ডিফনজো এবং প্রশান্ত বড়দিয়ার মতে যে কোনো গুজবের চারটি প্রধান বৈশিষ্ট্য থাকে; এগুলো হলো:

১. এতে অবশ্যই কোনো না কোনো তথ্য থাকতে হবে। কোনো মতামত বা মতবাদ বা তত্ত্ব গুজবে পরিণত হয় না।

২.  হতে হবে প্রচারযোগ্য

৩. অনিশ্চিত তথ্য সূত্র  বিধায় সত্যতা যাচাই করা সম্ভব নয়।

৪. বিষয়টি প্রাসঙ্গিক এবং একেবারে সমসাময়িক হতে হবে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, আসলেই কি গুজব বা মিথ্যা সত্যের চেয়ে দ্রুত গতিতে ছড়ায় বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে? বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ এমআইটি'র তিন জন গবেষক:  সরুষ ভসুগি, দেব রয় এবং সিনান এরাল কর্তৃক সম্পন্ন এ সংক্রান্ত একটি  গবেষণাপত্র অতি সম্প্রতি বিখ্যাত বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল 'সাইন্স' ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।  গবেষণাপত্রের শিরোনাম ছিল  'অনলাইনে সত্য এবং মিথ্যা সংবাদের বিস্তার' (The spread of true and false news online)।

২০০৬ থেকে ২০১৭ সাল অবধি টুইটারে পরিবেশিত গুজব বা মিথ্যা তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখতে পান, উক্ত সময় কালে প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার গুজব  ৩০ লাখ ব্যবহারকারী  ৪৫ লাখ বার টুইট করেন!

ছয়টি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান টুইট গুলোর সত্য-মিথ্যা যাচাই করে। সমস্ত তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে গবেষকরা এই মতে উপনীত হন যে, সত্য ঘটনা বা তথ্যের তুলনায় মিথ্যা বা গুজব প্রচারিত হয় অনেক দ্রুত গতিতে এবং তার ব্যাপ্তি অনেক প্রসারিত ও গভীর।

উদাহরণ স্বরূপ: একটি গুজব, প্রকৃত ঘটনার তুলনায় ছয় গুণ দ্রুত গতিতে মানুষের কাছে পৌঁছায়! ব্যবসা, বিজ্ঞান এবং বিনোদন সংক্রান্ত গুজব সমূহ অপেক্ষাকৃত বেশি জনপ্রিয় তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে রাজনৈতিক গুজব!

গুজব দ্রুত গতিতে ছড়ানোর অন্তর্নিহিত কারণ তাহলে কী? এই তিনজন গবেষকের মতে, বিষয় বৈচিত্র্য এবং তথ্য বা ঘটনার অভিনবত্ব এর মূল কারণ।

গর্ডন অলপোর্ট এবং লিও পোস্টম্যান ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত রিউমার সাইকোলজি (Rumor Psychology) নামক গবেষণা গ্রন্থে গুজব ছড়ানোর মনস্তাত্ত্বিক কারণ সমূহ নিবিড়ভাবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের মতে:

.  অনিশ্চিত পরিস্থিতি: যখন কোনো ঘটনা বা পরিস্থিতির উপর কারো নিয়ন্ত্রণ থাকে না কিংবা কী কারণে ঘটনা ঘটছে সে বিষয়ে কারো কোনো সম্যক ধারণা থাকে না তখনি গুজব ছড়ানোর সম্ভাবনা যায় বেড়ে।

২. উদ্বেগ: মানুষ যখন উদ্বিগ্ন থাকে সে সময়ে গুজব ছড়ানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। উদ্বেগের সঙ্গে অনিশ্চয়তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। অনিশ্চিত পরিস্থিতি অনেক সময় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

. তথ্যের গুরুত্ব: সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সমূহ কে ঘিরে গুজব সহজেই ছড়ায়।

. অস্পষ্টতা: কোনো বিষয় বা তথ্যের ব্যাপারে অস্পষ্টতার কারণে মানুষ গুজবের মুখাপেক্ষি হয়।

. সামাজিক অবস্থান: অনেক সময় কোনো এক বিশেষ গোষ্ঠী বা ব্যক্তি নিজেদের সামাজিক অবস্থান কে ভিন্ন ভাবে উপাস্থপনের জন্য গুজবের আশ্রয় নেয়।

নিশ্চিতভাবেই আমাদের গুজব মোকাবেলা করতে হবে। কেননা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো ব্যাপক ক্ষতির কারণ হতে পারে। কোটি টাকার প্রশ্ন: কীভাবে?  তথ্যের অবাধ প্রবাহ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, কাজের স্বচ্ছতা ইত্যাদি বিষয় সমূহ নিঃসন্দেহে অতি গুরুত্বপূর্ণ। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বোধকরি ব্যক্তি তথা জনসাধারণের সচেতনতা এবং দায়িত্বশীলতা। নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের ভাষায়:

"কেন মিছে

কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?

নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;

কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।"