নদীদের কেন মরতে হবে এভাবে?

অপূর্ব শর্মা
Published : 29 August 2018, 01:43 PM
Updated : 29 August 2018, 01:43 PM

রাত থেকেই মনটা প্রচণ্ড বিষণ্ণ। কোনও কিছুই ভালো লাগছে না। সাংবাদিক সুবর্ণা নদীর মুখটা বার বার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। অনেক চেষ্টা করেও স্বাভাবিক হতে পারছি না। স্বগোত্রীয় এই বোনটির অপলক চাহনি বিদীর্ণ করছে মনকে। সে যেনওবলছে, 'আমি তো বাঁচতে চেয়েছিলাম, অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চেয়েছিলাম; কিন্তু আমাকে কেনও বাঁচতে দেওয়া হলো না। নিজের ঘরেই কেন নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হতে হলো আমাকে? রাষ্ট্র কেন নিরাপত্তা দিতে পারলো না?'

হ্যাঁ। এই 'কেন'টাই আজ বড় একটা প্রশ্নবোধক হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের সামনে। নদী হত্যার পর দুই অক্ষরের এই শব্দটি বড্ড পীড়া দিচ্ছে। কেন? কেন অকালে মরতে হবে সাংবাদিকদের? কেনও নির্যাতিত হতে হবে? তারচেয়ে বড় কথা হলো, সংবাদিক হত্যা, পেটানো, নির্যাতন, কিংবা মামলায় জড়িয়ে সাংবাদিককে বিপর্যস্ত করা কি আমাদের দেশে আজ 'অঘোষিতভাবে জায়েজ' হয়ে গেছে? ক্ষোভ থেকেই বললাম কথাটি। দেশে সাংবাদিক হত্যা, নির্যাতনের বেদনাবহ ইতিহাস পর্যালোচনা করলে যে কারোরই এমনটি মনে হতে পারে। একথা মনে হওয়ার কারণ একটাই, সেটা বিচারহীনতা। বিশেষ করে সাংবাদিকদের বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে যে দীর্ঘসূত্রিতা আমরা লক্ষ্য করি তা সত্যিই দুঃখজনক। কেন আমাদের বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে! কেন?

এইতো মাত্র ক'দিন পূর্বে নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনে বেধড়ক পিটুনি খেলেন সাংবাদিকরা। খোদ তথ্যমন্ত্রী এ ঘটনায় নিন্দা জানালেন। কিন্তু প্রশাসনের টনক নড়ল না। সাংবাদিকদের পেটানোর ভিডিও এবং স্থিরচিত্র পত্র-পত্রিকায় এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলো, কিন্তু আজ পর্যন্ত ঘটনার সাথে জড়িত কাউকে খোঁজে পেলো না পুলিশ! গ্রেপ্তার করতে পারলো না একজনকেও। আমাদের দক্ষ পুলিশ বাহিনী সাংবাদিকদের বেলায় কেন 'অদক্ষতার' পরিচয় দেন বুঝতে পারিনা! অন্য প্রায় সবক্ষেত্রেই যে বাহিনীর সাফল্য প্রশ্নাতীত তাদের আমাদের বেলায় 'ধীরে চলার নীতি' বড্ড বেশি পীড়া দেয় মনে। অনেক ক্ষেত্রেই আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর 'অতি উৎসাহী' ভূমিকা আমরা প্রত্যক্ষ করি, কিন্তু গণমাধ্যমের বিচার প্রাপ্তির বেলায় তেমনটি দেখার সৌভাগ্য হলোনা আজও।

সুবর্না নদী কাজ করতেন আনন্দ টিভিতে। পাশাপাশি অনলাইন নিউজ পোর্টাল 'দৈনিক জাগ্রত বাংলার' সম্পাদক ছিলেন। সাংবাদিকতায় সাহসী ভূমিকার জন্য বেশ সুনামও কুড়িয়েছিলেন নদী। কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়েই তাঁর আজর্কের পর্যায়ে আসা। ঝুঁকিপূর্ণ এ পেশার ঝুঁকিকে মেনে নিয়েই নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন তিনি। সত্য প্রকাশে ছিলেন দৃঢ়চেতা। অসত্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পিছপা হননি কখনো।

তাঁর নির্ভীকতার প্রমাণ পাই তারই ফেসবুক স্ট্যাটাস থেকে। কিছুদিন পূর্বে তিনি টাইমলাইনে লিখেছিলেন, ''জীবনে যদি কিছু করে দেখাতে চাও, তাহলে একলা কীভাবে লড়তে হয়, তা শিখে নাও…।'' কাউকে পাশে না পেয়েই হয়তো একা লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন সুবর্ণা। কিন্তু লড়াইটা লড়ার আগেই অকালে প্রাণটি হারাতে হলো তাঁকে। এবং সেটা নিজ আলয়ে। দুর্বৃত্তরা নৃশংসভাবে তাকে হত্যা করে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।

নদী হত্যায় অনাথ হয়ে গেছে তাঁর একমাত্র মেয়ে জান্নাত। মাত্র ৯ বছরের এই মেয়েটিরই বা কি হবে? সে যখন সে বুঝতে শিখবে, বড় হবে, সে যদি প্রশ্ন করে, কি অপরাধ ছিলো আমার মায়ের? তখন তার প্রশ্নের কি উত্তর দেবো আমরা?

কবি, সাংবাদিক আবু হাসান শাহরিয়ার নদী হত্যার পর ক্ষোভ থেকে দেওয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, 'অমেরুদণ্ডী করপোরেট সাংবাদিকতার যুগে সুবর্ণা নদী ছিলেন একজন মেরুদণ্ডী সাংবাদিক। আনন্দ টিভিতে যা বলতে পারতেন না, তা নিজের অনলাইন পোর্টালে লিখতেন।… সুবর্ণা নদীর মৃত্যু আবারও প্রমাণ করল, বাংলাদেশ সাহস ও সত্যকে প্রযত্ন দিতে অক্ষম। তারপরও মেরুদণ্ডীদের কাছে প্রত্যাশা, সুবর্ণা নদীর লড়াই তারা জারি রাখবেন। ব্যক্তির জয়-পরাজয় আছে; স্বপ্ন চিরবিজয়ী।'

সত্যিই কি তাই? আমাদের শিরদাঁড়াটা যদি শক্ত থাকতো তাহলে কি একের পর এক ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যেতো অপরাধীরা? হয়তো না।