ফেইসবুকে গুজব বন্ধের উপায় ও ‘জুতা আবিষ্কার’ প্রসঙ্গ

Published : 25 August 2018, 01:57 PM
Updated : 25 August 2018, 01:57 PM

ফেইসবুকে গুজব ও অপপ্রচার একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছু দেশ ফেইসবুক সেন্সর করেছে, কিছু দেশ ফেইসবুক নিষিদ্ধ করেছে। ফেইসবুক উদ্ভুত সমস্যা ডিজিটাল প্রযুক্তিগতভাবে সমাধান করা যায়. ফিজিক্যালি ধর পাকড় ও গ্রেপ্তার এ সমস্যার সমাধান নয়।

প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, কোনও ধরনের যাচাই-বাছাই ছাড়া বিভিন্ন ইস্যুতে ফেসবুকে গুজব ও অপপ্রচার চালানোর ফলে ফেইসবুক এখন একটা সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তথ্যমন্ত্রী  সম্প্রতি বলেছেন, যারা গুজব ও মিথ্যাচার করে সামাজিক গণমাধ্যমের অপব্যবহার করে, সরকার তাদের বিরুদ্ধে শূন্য বা 'জিরো টলারেন্স' নীতি অবলম্বন করবে, অপপ্রচারকারীদের শক্ত হাতে দমন করবে।

শক্তভাবে দমন করা বলতে যদি গ্রেপ্তার, রিমান্ড ইত্যাদি বোঝায়, তাহলে বলতে হয়, এই শক্ত পদ্ধতি সামাজিক মাধ্যমের ক্ষতিকারক মিথ্যাচার বন্ধ করতে পারবে না।

ফেইসবুকে অপপ্রচার বন্ধের এই ব্যাপক তৎপরতা দেখে আমার কবিগুরুর 'জুতা আবিষ্কার' কবিতার কথা মনে হয়. ধুলো দূর করার প্রচেষ্টায় দেশের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। পরে মন্ত্রী সহজ বুদ্ধি দিলেন, শুধু পা দুটো চামড়া দিয়ে ঢেকে দিলেই তো রাজ্যময় ঝাড়ু দেওয়া লাগে না। সারা দেশে এতো অভিযান না চালিয়ে ফেসবুকটাকেই ডিজিটাল চামড়ায় মুড়ে দিলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়। এরকম ঢাকা বলতে বুঝাচ্ছি  সেন্সর।

শুধু তথ্য ও প্রযুক্তি আইন প্রয়োগ করে ফেইসবুকে গুজব ও মিথ্যা খবর বন্ধ করতে গেলে অনেক সময় হিতে বিপরীত হয়। ডিজিটাল অপরাধের উৎস সন্ধান করে অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে গেলে অনেক সময় নির্দোষ মানুষ সাজা পায়  কারণ ভুয়া খবর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুয়া আইডির মাধ্যমে  ছড়ানো হয়।

এই গুজবগুলো অনেক  ক্ষেত্রে দেশের বাইরে থেকে ছড়ানো হয়. যার জন্য প্রকৃত অপরাধীরা  ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে।

জার্মানির নতুন আইনে ফেইসবুক ও অন্যান্য ডিজিটাল মিডিয়ার বিষয়বস্তু সেন্সর করার আইন করা হয়েছে। ফেইসবুকে ঘৃণা, বিদ্বেষমূলক ও ক্ষতিকারক খবর প্রকাশ হলে তা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরিয়ে ফেলতে হবে, অন্যথায় ৫০ মিলিয়ন ইউরো অর্থাৎ পারে ৫০০ কোটি টাকা জরিমানা করা হবে। ফেইসবুককে ইতিমধ্যে দুই বার জরিমানা করা হয়েছে।

মুক্ত  গণতন্ত্রের দেশ যুক্তরাজ্যেও ফেইসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমগুলো নিয়ন্ত্রণ করার আইন আগের চেয়ে কঠোর করা হয়েছে। ডিজিটাল মিডিয়াগুলোকে সন্ত্রাসী ও জাতীয় নিরাপত্তার পরিপন্থী খবর ফিল্টার করতে বলা হয়েছে। শাস্তি সবদেশেই কঠোর করা হয়েছে।

ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোতে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনগুলো প্রয়োগ করা হয় সাইবার অপরাধ ঠেকানোর জন্য। সাইবার অপরাধ বলতে প্রযুক্তিগত বিষয় যেমন হ্যাকিং, স্পামিং, আইডেন্টিটি চুরি করা- এইসব বোঝায়। মিথ্যা অপপ্রচার, ক্ষতিকারক খবর দমন ফৌজদারী দণ্ডবিধি অনুযায়ী হয়।

কিছু কিছু গুজব দেশদ্রোহী কাজের মধ্যে পরে, কিছু গুজব যেগুলো দিয়ে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয় যেগুলো সন্ত্রাসী কাজের মধ্যে করে। ধর্মকে অবমাননার জন্য ফেসবুককে একটা মাধ্যম  হিসাবে ব্যবহার করা হয়। গুজব ও মিথ্যা খবরের পাশাপাশি ফেইসবুকের মাধ্যমে প্রচুর হুমকি দেওয়ার ঘটনা ঘটে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হত্যার হুমকি দিলে প্রযুক্তি আইন নয়, ফেডারেল আইনে বিচার করা হয়। ফেইসবুকে জার্মানির ফুটবলের ব্যর্থতার কারণে ফুটবলারদের হত্যা করার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তাদের খুনের হুমকির  আইনে বিচার  করা হচ্ছে। অনেক দেশে গুজব, হুমকি ও মিথ্যা খবরগুলো যে উদ্দেশ্যে করা হয়, তাদের সংশ্লিষ্ট আইনে বিচার করা হয়।

ফেইসবুকের মিথ্যা খবর ও গুজব ছড়ানোয় দেশের চরম ক্ষতি পারে। শ্রীলংকায় ফেইসবুকে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস ছড়ানোর কারণে সে দেশের সরকারকে ৭ দিনের জন্য ফেইসবুক বন্ধ করে দিতে হয়েছিল।

বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী সংস্থাগুলো ফেইসবুকের গুজব ও মিথ্যা খবর ধর-পাকড়ের মাধ্যমে প্রতিকার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ফেইসবুক যার মাধ্যমে এই ক্ষতিকর, জনস্বার্থ বিরোধী কাজগুলো হচ্ছে, সেই ফেইসবুকের শাস্তি হচ্ছে না।

ফেইসবুক একটা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম । যেকোনো যোগাযোগ মাধ্যমেই  বিদ্বেষমূলক, সন্ত্রাসী ও দেশদ্রোহী খবর ছড়ালে তার দায়িত্ব তাদের আছে। ফেইসবুকের এইসব ক্ষতিকারক খবর ছড়ালে, তার প্রতিকার করার দায়িত্ব তাদেরই। এ দায়িত্ব শুধু বাংলাদেশের পুলিশের নয়।

যেকোনো অপপ্রচারের অভিযোগ সব সময় ফেসবুকের উপর আসে। প্রকৃতপক্ষে ফেইসবুকের চেয়ে ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং যেমন হোয়াটজ আপ, ভাইবার ইত্যাদি প্লাটফর্মে মিথ্যা খবর বহু গুণিতক আকারে প্রচার হয়। ফেইসবুকের খবরের উৎস বের করা যায়। কিন্তু এইসব ইনস্ট্যান্ট মেসেজিং এর উৎস বের করা খুবই কঠিন।

আরেকটি কঠিন সত্য- মানুষ আসল খবরের চেয়ে 'ফেইক' খবরের প্রতি আকর্ষিত হয় বেশি। সাধারণ ও নিরপেক্ষ জনগণও  গুজবগুলো পোস্ট করে। তাদের বন্ধুরাও আবার পোস্ট করে। এইভাবে গুজব জোরালোভাবে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পরে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আসন্ন কংগ্রেস নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ফেসবুক মিথ্যা খবর ও গুজব বন্ধ করার জন্য ফ্যাক্ট চেকিংয়ের অঙ্গীকার করেছে। সব বিজ্ঞাপনদাতার আইডি চেক করা হবে।

বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে ফেসবুকে মিথ্যা প্রচারণা চরম আকার ধারণ করতে পারে। পুলিশের পক্ষে এই গুজব বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাই বিষয়টি ভিন্নভাবে ভেবে দেখতে হবে।

গুজব ও অপপ্রচার বন্ধের জন্য আমার অভিমত, ফেসবুককে চাপ প্রয়োগ করা ফলপ্রসূ হবে। দেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী আছে। প্রবাসেও প্রচুর ব্যবহারকারী  আছেন। ফেইসবুক কখনোই এতো ব্যবহারকারী হারাতে চাইবে না. তারা বাংলাদেশ সরকারের দাবি মানবে।

সরকারের উচিৎ হবে জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের মতো কঠোর অবস্থানে দাঁড়ানো।

জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই না করে পেইজ খোলা বন্ধ করলে অনেক ঝামেলা মিটবে। তবে ফেইসবুক নিষিদ্ধ করা ঠিক হবে না।