আসন্ন নির্বাচন: চিলের আমদানি এবং কান সাবধান

Published : 24 August 2018, 02:14 PM
Updated : 24 August 2018, 02:14 PM

প্রয়াত কবি শামসুর রাহমান তার 'পণ্ডশ্রম' কবিতায় লিখেছিলেন-

"এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে

চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে"।

আমাদের সমাজে কিছু লোকের অবস্থা বর্তমানে হয়েছে অনেকটা উপরের কবিতার মত।একটু লক্ষ্য করলে দেখবো কোন একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে একটি মহল থেকে খুব উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে এক একটি গুজব ছড়ানো হয়। আর তৎক্ষণাৎ আমাদের সমাজের কিছু লোক সেই গুজবকে বিশ্বাস করে অতিবিপ্লবী হয়ে চরম ধ্বংসাত্মক কিছু করে বসে। তারপর যতক্ষণে তারা তাদের ভুল বুঝতে পারে, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়, ক্ষতি যা হবার হয়ে যায়। তারা কান চিলে নিয়ে গেছে শুনে দৌড়ানো শুরু করে। একবারও কানে হাত দিয়ে দেখার প্রয়োজন মনে করেনা যে কান যথাস্থানে আছে নাকি নেই?

ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে গুজব নামের চিলটি আমাদের দেশের পিছু নিয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সময়ে নোট ছাপানোকে কেন্দ্র করে গুজব ছড়ানো, বাসন্তীকে ইচ্ছাকৃতভাবে জাল পরিয়ে ছবি তুলে গুজব সৃষ্টি, মিথ্যা ব্যাংক ডাকাতির ধোঁয়া তুলে গুজব সৃষ্টি, মেজর ডালিমের বউকে নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগ তুলে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে গুজব ছড়ানো হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে এই গুজবের ধরন পরিবর্তন হয়েছে। কখনও সাম্প্রদায়িক গুজব ছড়ানো হয়েছে এই কথা বলে যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসছে মসজিদে উলু ধ্বনি শোনা যাবে, আবার কখনও প্রতিবেশি রাষ্ট্রের বিষয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে যে বাংলাদেশ ভারতের অঙ্গ রাজ্য হয়ে যাবে, কখনও ধ্রুব সত্যকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য গুজব ছড়ানো হয়েছে যে দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আশার পর দেশকে ডিজিটাল করার কাজে যখন দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে তখন এই  কুচক্রী মহল গুজব ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয় ডিজিটাল মাধ্যমকে। ফেসবুকে 'বাঁশের কেল্লা' নামক গ্রুপ খুলে সেখানে ফটোশপের মাধ্যমে মিথ্যা ছবি বানিয়ে বড় ধরনের দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা হরহামেশাই হয়েছে। চাঁদে সাইদীকে দেখা গেছে,  হেফাজতের লাখ লাখ কর্মী মারা গিয়েছে, রামুতে মিথ্যা ছবি বানিয়ে বৌদ্ধ বিহার আক্রমণ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে রসরাজের উপর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার মিথ্যা গুজব, এ সবই ছড়ানো হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যাবহার করে।

সর্বশেষ আমরা দেখেছি কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ভয়ানকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে উস্কে দেয়া হয়েছে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ। অনেকেই না বুঝে আবেগের বশবর্তী হয়ে এই সব কুচক্রী মহলের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে নিজের জন্য এবং পরিবারের জন্য ডেকে এনেছেন সমূহ বিপদ।

কুচক্রী মহলের 'চিলে কান নিয়ে গেছে' টাইপ গুজবের মূল টার্গেট তরুন সম্প্রদায়। কুচক্রী মহল জানে বাংলাদেশের সমস্ত আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে এই তরুণ সম্প্রদায়। বাংলাদেশের  বেশিরভাগ বড় বড় অর্জন এসেছে এই তরুন সম্প্রদায়ের হাত ধরে এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দিবে এই তরুণ সম্প্রদায়। কুচক্রী মহল ভাল করে জানে বাংলাদেশের তরুন সম্প্রদায়কে যদি বিপথে নেয়া যায় তাহলে খুব সহজে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলা সম্ভব। বাংলাদেশের সমস্ত অর্জনের পথকে রুদ্ধ করা সম্ভব। তাই তারা গুজব ছড়ানোর জন্য সেই সব মাধ্যমকে ব্যবহার করতে বেশি পছন্দ করে যে সকল মাধ্যমে তরুণরা বেশি সময় কাটায়। যেমন- ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব ইত্যাদি ।

সামনে নির্বাচন। তাই এই নির্বাচনকে সামনে রেখে কুচক্রী মহল আরও তৎপর হয়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। তারা চেষ্টা করবে আরও কিছু গুজবের চিল আমদানি করে তাদের স্থানীয় পরিবেশকদের মাধ্যমে সমাজে ছড়িয়ে দিয়ে সমাজকে অস্থিতিশীল করতে। তাই সময় থাকতে এদেরকে চিহ্নিত করে এদের ব্যপারে সাবধান হতে হবে। বিগত কয়েকটি আন্দোলনের ছড়ানো গুজব থেকে সৃষ্ট উস্কানির ব্যাপারে অতি উৎসাহী ছিল পশ্চিমা দেশ যুক্তরাষ্ট্র, আল-জাজিরা নামক গণমাধ্যম এবং তাদের এদেশিয় পরিবেশকরা।

যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের অতি উৎসাহ নতুন কিছু নয় ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আসার পর থেকেই তারা কারণে-অকারণে দেশের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে, পদ্মা সেতু নিয়ে অযথা মিথ্যা গুজব সৃষ্টি করেছে, এমনকি সর্বশেষ দেশের স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়েও মন্তব্য করে কূটনীতিক শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন করেছে। সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হলো, একদিকে তারা তাদের দুতাবাস থেকে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের চলাচলের উপর সতর্কতা জারি করে, আবার অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রাতের আঁধারে পুলিশকে না জানিয়ে ঢাকা শহরে গোপন বৈঠক করে! অথচ নিয়ম অনুযায়ী কোন রাষ্ট্রদূতের চলাচলের আগে পুলিশকে জানাতে হয়। পুলিশ কূটনৈতিক প্রটোকল অনুযায়ী সেই রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে।

যুক্তরাষ্ট্র বা আল জাজিরা বা এদের স্থানীয় পরিবেশকদের মুখে একটাই স্লোগান- বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিশ্চিত করতে চায়। আসুন তো একটু দেখি যারা গণতন্ত্রের কথা বলে মুখে ফেনা তুলে তাদের নিজেদের গণতন্ত্রের কি অবস্থা!

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কতটুকু 'গণতন্ত্রমনা' (!) সে কথা বিশ্ববাসীর অজানা নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হবার পর খোদ আমেরিকাতে যে বিক্ষোভ হয়েছে মিডিয়ার কল্যাণে তা সবাই দেখেছে। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী দৈনিক ইকোনমিস্টের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ যেসব প্রতিষ্ঠান বৈশ্বিক গণতন্ত্রের র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করে তাদের মতে ২০১৬ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আর পূর্ণ-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নেই। এটি 'পূর্ণ গণতন্ত্র' থেকে 'ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্র' শ্রেণিতে নেমে গেছে। কানাডাভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর রিসার্চ অন গ্লোবালাইজেশন (গ্লোবাল রিসার্চ) এর গবেষক জেমস এ লুকাস তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ৩৭টি রাষ্ট্রে হস্তক্ষেপ করে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ২০ মিলিয়ন তথা ২ কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ৯টি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তির মধ্যে মাত্র ৩টি চুক্তি অনুসমর্থন করেছে আর ৬টি এখনও অনুমোদন করেনি।

জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে মাত্র ৬টি রাষ্ট্র নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য দূরীকরণ সংক্রান্ত আন্তর্জতিক মানবাধিকার চুক্তি অনুমোদন দেয়নি এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের একটি। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের সংবিধিতে তো স্বাক্ষর করেই নি, বরং যুক্তরাষ্ট্র অনেক রাষ্ট্রকে এ মর্মে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে বাধ্য করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের কোনও সেনা সদস্য গণহত্যা, যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করলেও তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতে মামলা করা যাবে না। এছাড়া, ঐতিহাসিকভাবে এটা প্রমাণিত যে, যেসব দেশ যুক্তরাষ্ট্রকে নিজেদের দেশে গণতন্ত্র রক্ষা এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমন্ত্রন জানিয়েছে পরবর্তী কালে সেসব রাষ্ট্র ব্যর্থ ও অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। যেমন- আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া, মিসর ও সিরিয়া । এখন, এই যুক্তরাষ্ট্র যখন মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের কথা বলে তখন আসলে একটি বিখ্যাত প্রবাদের কথা মনে পরে যায় 'আপনি আচারি ধর্ম পরকে শেখাও'।

এবার আসি আল জাজিরার কথায়। আল জাজিরা হল 'আল জাজিরা মিডিয়া নেটওয়ার্ক'-এর মালিকানাধীন এবং কাতারের দোহা সদর দপ্তর থেকে সম্প্রচারিত একটি সংবাদভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল। প্রাথমিকভাবে এটি আরবি ভাষার খবর হিসেবে চালু হলেও এবং বর্তমান স্যাটেলাইট চ্যানেলটি টিভি চ্যানেল হিসেবে আল জাজিরা থেকে একাধিক ভাষায় বিশ্বের বিভিন্ন নেটওয়ার্কের সঙ্গে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রসারিত হচ্ছে। আল জাজিরা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। আল জাজিরা কাতার সরকার মালিকানাধীন চ্যানেল। আল জাজিরা নামক এই গণমাধ্যমটি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই হাহাকার শুরু করেছে যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, বাংলাদেশে মানবাধিকার নেই। যে কোন ঘটনার মধ্যেই তারা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার হরণ দেখতে পান।

আচ্ছা আল জাজিরা যে দেশের চ্যানেল অর্থাৎ কাতারের গণতন্ত্রের কী অবস্থা আমরা কি জানি? কাতার একটি রক্ষণশীল রাজতন্ত্রের দেশ। যেখানে গণতন্ত্রের লেশ মাত্র নেই। কাতারে রাজার বিরুদ্ধচারণ করা বা রাজার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মত পোষণ করা আইনত নিষিদ্ধ এবং দণ্ডনীয় অপরাধ। সেই রাজতন্ত্রের তল্পিবাহক গণমাধ্যম যখন আমাদের দেশের গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলে তখন আসলে আমাদের মনে পরে যায় গ্রাম দেশে সেই প্রবাদ প্রচলিত কথা 'ঝাঁঝর বলে সুঁইকে তোর পেছনে ছিদ্র'।

সর্বশেষ আসি, এদের কিছু লোকাল এজেন্ট আছে বাংলাদেশে, যারা রাতের আধারে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গোপন মিটিং করে বেড়ায়। কারণে-অকারণে আল জাজিরাতে সত্য মিথ্যা বানিয়ে বাংলার আকাশে গুজবের চিল উড়িয়ে দেয়। জানতে হবে এরা কারা? এরা হচ্ছে সেই প্রজাতির লোক যারা বলবে 'আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি, জনগণের কথা বলি।' অথচ এই গোত্রীয়ভুক্তরা কখনও গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচিত হবার যোগ্যতা রাখে না। জনগণ সব সময় এদের জনপ্রতিনিধি হবার খায়েশকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই এই গোত্রীয়ভুক্তরা সবসময় ক্ষমতায় যাবার জন্য অন্ধকারের চোরাগলি খোঁজে। পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় যাবার খায়েশ তাদের সারাজীবনের।

অতএব, বাংলাদেশের তরুণ সম্প্রদায়কে এই কুচক্রী মহলের বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে যেহেতু সামনে নির্বাচন, তাই গুজবের চিল উড়িয়ে দিয়ে এই কুচক্রী মহল বাংলাদেশের তরুণ সম্প্রদায়কে অন্ধকারের চোরাবালিতে নিমজ্জিত করে পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় আশার চেষ্টা করবে। বাংলাদেশের তরুণ সম্প্রদায়কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, নিজেদের মেধা মনন কাজে লাগিয়ে এই কুচক্রী মহলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে নাকি এদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়ে শেষে অনুতাপ করবে এই বলে যে-

"নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;

কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।

ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?

বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।"