মন্দিরে নামাজ- সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সাধারণ গণমানস

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 24 August 2018, 01:14 PM
Updated : 24 August 2018, 01:14 PM

সংক্ষিপ্ত – "ভারতের কেরালা রাজ্যে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ঈদের দিন সকালেও অধিকাংশ মসজিদই জলাবদ্ধ অবস্থায় ছিল। সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।  তারা মালায় জেলার পুরাপ্পিল্লিকাভু রক্তেশ্বরী মন্দির খুলে দিয়েছেন মুসলিমদের জন্য, ঈদের নামাজ পড়ার সুযোগ হয়েছে তাদের।" (কালের কণ্ঠ  ২৩ অগাস্ট ২০১৮)।

ধর্মদস্যুদের সাম্প্রতিক ধর্মীয় সন্ত্রাসের অন্ধকারে এটা নিশ্চয়ই আলোকের ঝর্ণাধারা, কিন্তু বিরল নয়। অতীত বর্তমানে ধর্মগুরুরা তো বটেই, সব ধর্মের সাধারণ মানুষও মানবতার এ প্রদীপটা জ্বালিয়ে রেখেছেন। উদাহরণ অজস্র, সাম্প্রতিক কয়েকটা দেখা যাক।

১. পিটারবোরো শহরের রাম-ধাম মন্দির মেরামতে দশ হাজার ডলার চাঁদা তুলে দিয়েছিলেন টরোন্টোর মুসলিমেরা – ১৮ নভেম্বর, ২০১৫।

২. ভারতের পাঞ্জাবে মসজিদ নির্মাণে চাঁদা তুলে দিয়েছিলেন অমুসলিমরা – ০৮ অক্টোবর ২০১৫।

৩. আমেরিকার ফিলাডেলফিয়াতে দুর্বৃত্তরা ইহুদী সিনাগগ ভাঙ্গচুর করলে (০১ মার্চ ২০১৭), ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ডে প্রাচীন ইহুদী সিনাগগ ভেঙে পড়ার দশা হলে (২০ ডিসেম্বর ২০১৩), মুসলিমেরা সেগুলো মেরামত করার জন্য চাঁদা তুলে দিয়েছেন।

৪. আমেরিকার টেক্সাসে মসজিদে আগুন ধরে ক্ষতিগ্রস্ত হলে মুসলিমদের নামাজ পড়ার জন্য ইহুদী সিনাগগের কর্তৃপক্ষ তাদের হাতে সিনাগগের চাবি তুলে দেন – ২০ ডিসেম্বর ২০১৩।

অসংখ্য ধর্মবিশ্বাসী-অধ্যুষিত দুনিয়ায় সাম্প্রদায়িক শান্তির প্রয়োজন অসামান্য। কিন্তু সেই শান্তি মুফতে আসেনা, তার জন্য মূল্য দিতে হয়। দেখা যাক আমাদের নবীজী (স.) সহ ইতিহাসে সে মূল্য কারা কীভাবে দিয়েছেন এবং তাতে মানুষের কি লাভ হয়েছে।

১। ৬২৮ সাল।  হজ্ব করার জন্য এক হাজার (দলিলভেদে ৭০০ থেকে ১৪০০) মুসলিম সাথে নিয়ে মক্কা'র উপকণ্ঠে এসে তাঁবু গেড়েছেন বিশ্বনবী (স)। কিন্তু মক্কাবাসীরা তাঁকে ঢুকতে দেবে না, যুদ্ধ হয় হয় ভাব।  তখন মক্কাবাসী ও তাঁর মধ্যে বিখ্যাত হোদায়বিয়া শান্তিচুক্তি হয়। সেটা লিখছিলেন হজরত আলী (রা), 'বিসমিল্লাহের রহমানের রাহীম' দিয়ে শুরু করে।  কোরেশ-প্রতিনিধি সোহেল তাতে আপত্তি করলে নবীজী (স.) সেটা  বদলে শুধু 'আল্লাহ'র নামে লিখতে বলেন। এটা লেখার পরে লেখা হলো, "এই চুক্তি করা হলো মুহাম্মদ-উর রসুলুল্লাহ এবং কোরেশদের মধ্যে"।  সোহেল "আল্লাহর রসুল" কথাটায় আপত্তি করলে নবীজী (স.) তা কেটে 'আবদুল্লা'র পুত্র মুহাম্মদ' লিখতে বলেন। কিন্তু হজরত আলী তাতে  রাজী হলেন না।  তাঁর বক্তব্য ছিল এতো বিরোধ হানাহানির একটা প্রধান কারণই হল উনি যে আল্লাহ'র রসুল সেটা প্রতিষ্ঠা করা।  তখন নবীজী নিজের হাতে সেটা কেটে দিলেন এবং 'আবদুল্লা'র পুত্র মুহাম্মদ' লিখতে বললেন।  এভাবে সেই শান্তিচুক্তি কার্যকর হলো, যার মধ্যে কিছু ধারা মুসলমানদের জন্য অসম্মানজনক ছিল, যার জন্য প্রতিটি সাহাবী (ইতিহাসে ঐ একবারই) নবীজীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিলেন।  তারপরেও তিনি চুক্তি মোতাবেক হজ্ব না করেই ফিরে গেলেন ৫০০ কিলোমিটার দূরের মদিনায় যেখান থেকে এত কষ্ট করে এসেছিলেন। কোনো অর্জন ছাড়াই আসা যাওয়া মিলিয়ে মরুভূমিতে স্রেফ পায়ে হেঁটে হাজার কিলোমিটার পাড়ি দেয়া কম কথা নয়।

নবীজী দলিলের প্রমাণে ইসলামের দু-দুটো মূল বাক্যের মূল্য দিলেন এবং কোরেশদের অন্যায় দাবী মেনে নিলেন। কেন নিলেন? কারণ ভবিষ্যৎ ছিল তাঁর কাছে স্পষ্ট, পরের বছর তিনি তিন হাজার মুসলিম নিয়ে বিনা যুদ্ধে বিনা রক্তপাতে মক্কা জয় করলেন। (সেদিন বিশেষ অপরাধের জন্য যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল তাদের চারজন ক্ষমাও পেয়েছিল)। এরই নাম নেতৃত্বের প্রজ্ঞা, এই হল শান্তির মূল্য। কাবা'য় আরাধনার অধিকার সম্প্রদায়ের ছিল, মুসলমানদেরও ছিল। কিন্তু অধিকার কখন কোথায় খাটাতে হয় এবং কখন কোথায় খাটাতে হয়না তা তিনি জানতেন।

২। ১৫৮৮ সাল। ভারতের শিখদের ধর্মগুরু অর্জুনদেব। আমাদের যেমন কাবা শরীফ, ক্যাথলিকদের যেমন ভ্যাটিক্যান, শিখদের তেমনি স্বর্ণমন্দির বানানো হচ্ছে।  গুরুর আদেশ এলো 'লাহোর থেকে মুসলিম সুফি শেখ মিয়া মীরকে নিয়ে এসো, তাঁর হাতে এই স্বর্ণমন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হবে।' সবাই অবাক।  কেন তা হবে? আমাদের সর্বোচ্চ গুরু বেঁচে থাকতে আমাদের সর্বোচ্চ উপাসনালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর অন্য ধর্মের লোকের হাতে হবে কেন ? গুরু'র আদেশ এলো, 'যা বলছি করো। ভবিষ্যতের মানুষকে ধর্মীয় ভক্তির শক্তিতে ধর্মীয় বিভক্তিকে অতিক্রম করে যাবার পথ দেখিয়ে যাব আমরা।' সেই স্বর্ণমন্দির আজো সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে। এ নিয়ে বিশ্বাসীরা তর্ক করতে পারেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই হলো নেতৃত্বের অতুলনীয় প্রজ্ঞা, এই হলো শান্তির মূল্য।

৩। ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২, অযোধ্যা।  ধর্মোন্মাদ কিছু হিন্দু নেতার নেতৃত্বে ধর্মোন্মাদ হিন্দুর দল ভেঙে গুঁড়িয়ে দিলো ৪৭৬ বছরের ঐতিহ্যবাহী  বাবরী মসজিদ।  ওটা নাকি রামের জন্মস্থান, ওই মসজিদ নাকি মন্দির ভেঙে বানানো হয়েছিল, ওখানে তারা আবার মন্দির বানাতে চায়। পরের বছরগুলোতে ভয়াবহ দাঙ্গায় খুন হলো হাজারো নিরপরাধ, প্রধানত- মুসলিম।  উজাড় গ্রাম, জ্বলন্ত ঘরবাড়ি, অসংখ্য বিধবা আর এতিমের আর্তনাদে কেঁপে উঠলো ভারতবর্ষ।  ২০০২ সালের ৩রা মার্চে হিন্দুস্তান টাইমস জনমত জরিপ করলো ওখানে জনতা মন্দির চায় নাকি মসজিদ।  শতকরা ৬৯ দশমিক ১৩ জন সাধারণ মানুষ জানিয়ে দিলেন মসজিদটা যদি মন্দির ভেঙে বানানো হয়েও থাকে, তবু এত রক্তারক্তি করে মানুষ খুন করে মন্দির বানাবার কোনো দরকার নেই, মসজিদের জায়গায় মসজিদই থাকুক।  এরই নাম ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, এরই নাম শান্তির মূল্য যা আজকের ধর্মীয় হিংস্রতার প্রেক্ষাপটে অবিশ্বাস্য মনে হবে।

এই হল সব ধর্মের সাধারণ মানুষের চিরন্তন গণমানস। ধর্মীয় কিংবা রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সব ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এরই নাম মানবতার শক্তি। এপারে এক ফোঁটা রক্তের সাথে ওপারে এক ফোঁটা মর্মস্পর্শী অশ্রু গড়ায় এটা ইতিহাসের সত্য – তা সে বিভক্ত বার্লিনই হোক, ইংল্যাণ্ড-আয়ারল্যাণ্ডই হোক, বিভক্ত বাংলা-পাঞ্জাব-কাশ্মীরই হোক বা ইসরাইল-প্যালেস্টাইনই হোক। তাই তো ইতিহাসের প্রতিটি বার্লিন-প্রাচীর এত ভঙ্গুর।

'মানুষের মন চায় মানুষেরই মন' – কবিগুরু।  তাই তো আন্তর্জাতিক সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে এতো দেয়া নেয়া, তাইতো বম্বের সিনেমায় অভিনয় করেন পাকিস্তানি সালমা আগা, 'শত্রুর দেশ' ভারতে কনসার্ট করেন মেহদি হাসান আর তাঁর সম্পর্কে সে দেশের উচ্চতমা পদ্মশ্রী বলেন – ''উন্কা গলে মে ভগওয়ান ঝরতা হ্যায়" (উনার কণ্ঠে স্রষ্টা উৎসারিত হন- লতা মুঙ্গেশকর)।

তাইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধে জর্জ হ্যারিসন গানে গানে টাকা তোলেন, ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মন্ত্রণাসভা বসে এলিফ্যান্ট  রোডে বাটা'র ম্যানেজার অডারল্যাণ্ড সাহেবের বাসায়। তাইতো বাংলার গায়ক সুমন চাট্যার্জী সুদুর নিকারাগুয়া'র স্যান্দিনিস্তা গণযুদ্ধে জীবনের ঝুঁকি নেয় এসএলআর হাতে,  রবিশংকরের সেতারে ক্যারিবিয়ান পল্লীসংগীত আর পশ্চিমা কর্ড,  হলিউডের ছবিতে জাকির হূসেন আর মেঘ রাগিনীর সা-রে-মা-পা-ণি-সা আর চীনা ভাষায় গেয়ে ওঠেন বাঙ্গালীনি সাবিনা ইয়াসমিন।  আশ্চর্য নয় ?  এত আগুনের মধ্যেও ইসরাইল-প্যালেস্টাইনের নাট্যকর্মীরা একসাথে নাটক করেন, পুরষ্কারপ্রাপ্ত ইসরাইলি ডিরেক্টর অ্যামস্ গিতাই-এর ছবিতে অভিনয় করেন পুরষ্কারপ্রাপ্ত প্যালেস্টাইনি অভিনেতা ইউসুফ আবু ওয়ার্দা। তাইতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় মুসলিম 'ভাবী' আর হিন্দু 'মাতাজি'র সম্ভ্রম রক্ষায় বুকের রক্ত ঢেলে হিন্দু আর মুসলিম যুবক ইতিহাসে রেখে যায় মহামিলনের আর্ত আহ্বান। এ আহ্বান সাময়িক ক্ষতবিক্ষত হতে পারে। কিন্তু প্রাকৃতিক নিয়মেই একদিন সে অভ্রভেদী হবে।

বাগান হোক না শত, ঝড়ে ক্ষত বিক্ষত – নামহীন কোনো ফুল ফুটবেই,

দূর দুরান্ত থেকে, যুগ যুগান্ত থেকে – কলিতে অলিরা এসে জুটবেই!

তীক্ষ্ন খরার পরে, খালবিল নদী ভরে – উত্তাল জল ছল ছলবেই,

ক্ষুদ্র মরণ শেষে, রুদ্র জীবন এসে – জীবনের রূপকথা বলবেই!

হোক পথ দু:সহ, দুর্গম ভয়াবহ – দু'এক পথিক পথ চলবেই,

বোধের বন্ধদ্বারে, নিকষ অন্ধকারে – বিদ্রোহী কিছু দীপ জ্বলবেই!!

মাভৈ !!