সঙ্ঘ আর মোদির মন্ত্রীদের বৈঠক প্রসঙ্গে

গৌতম রায়
Published : 23 August 2018, 10:52 AM
Updated : 23 August 2018, 10:52 AM

নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি জোট সরকার কেন্দ্র ক্ষমতায় আসার পনের মাসের ভিতরেই বিজেপির প্রাণভ্রোমরা আরএসএস,  সরকারের শীর্ষ স্তরের কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে একটি অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করে।  কেন্দ্র সরকার এবং আরএসএসের ভিতরে সমন্বয়ের নানা দিক খুঁটিয়ে পর্যালোচনা করার উদ্দেশ্যেই ওই বৈঠকটি ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত হয়।

এই বৈঠকের প্রেক্ষিতটি কিন্তু অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ছিল। মোদি সরকার ভারত রাষ্ট্রের জনসাধারণের নীতি নির্ধারণের কি রূপরেখা তৈরি করবে- তার একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত সরকারকে দিতেই ওই বৈঠক টি আরএসএসের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল।

এই বৈঠকের শেষে সরকারের শীর্ষস্তরের ব্যক্তিত্বরা,  প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ প্রায় সকলেই বৈঠকে সঙ্ঘের ঠিক করে দেওয়া গাইড লাইনটি আরো ভালোভাবে মেনে চলার উদ্দেশ্যে অঙ্গীকার করে কাজ করতে শুরু করে দেন।

এই বৈঠকটির কথা দুয়েকটি ইংরেজি সংবাদপত্রে প্রকাশ হলেও গোটা দেশে বৈঠকের বিষয়বস্তু সেভাবে যাতে না ছড়ায় সেদিকে আরএসএসের যে সতর্কতা ছিল, সেটি অনেকাংশে ই সফল হয়েছিল। ফলে অ-বিজেপি রাজনৈতিক শিবিরে কেন্দ্রের মন্ত্রীদের সঙ্গে আরএসএসের শীর্ষ নেতৃত্বের এই বৈঠকের বিষয়টি তেমনভাবে প্রকাশ্যে আসেনি।

এই বিষয়টি নিয়ে তেমন কিছু রাজনৈতিক চাপান উতোর তখন রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে দেখতে পাওয়া যায় নি। যে কারণে অত্যন্ত ধূর্ততার সঙ্গে আরএসএস তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের উপর নিজেদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বিস্তারের কাজটি খুব সহজভাবেই হাসিল করে নিতে পেরেছিল মোদি ক্ষমতাসীন হওয়ার অল্প কিছুদিনের ভিতরেই।

সরকার এবং তার প্রাণভ্রমরার ভিতরে এই যে সমন্বয় বৈঠক, সেটা কিন্তু আরএসএস বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে কোনো নোতুন ঘটনা নয়। অতীতে অটলবিহারী বাজপেয়ীর জামানাতে ১৯৯৮  সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন এনডিএ জোটের প্রধান শরিক বিজেপি এবং তাদের মস্তিষ্ক আরএসএসের ভিতরে এই ধরণের সমন্বয়কারী বৈঠক বহুবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেদিক থেকে এই বৈঠক মোদি জামানাতে কোন নোতুন বিষয় না হয়েও মোদি জামানার এই বৈঠকের ভিতর দিয়ে কিন্তু তিনটি নতুন বিষয় উঠে এসেছে।

প্রথম বিষয়টি হলো- অতীতে বিজেপি কখনো একক গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে পারে নি। তাই মোদির আমলে বিজেপির এই একক গরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠনের পর সঙ্ঘের কর্মসূচি রূপায়ণে মোদি সরকারের রূপরেখা এবং কৌশল কী হবে- সেই সম্পর্কে মোদিসহ তাঁর মন্ত্রীসভার শীর্ষস্তরের মানুষজনের নির্দেশিকা দেওয়ার লক্ষ্যে এই বৈঠককে বিশেষ রকমের গুরুত্বের জায়গায় রেখেছিল আরএসএস। স্বভাবতই সেই গুরুত্বের প্রায়োগিক দিক অবলম্বন এই বৈঠকে সফলভাবেই করেছিল সঙ্ঘ।

এর বাইরে সঙ্ঘ পরিবার হিসেবে পরিচিত আরএসএসের বিভিন্ন শাখা সংগঠনগুলির সঙ্গে সঙ্ঘের রাজনৈতিক সংগঠন তথা কেন্দ্রের শাসক বিজেপির সমন্বয়ের দিকটি যাতে খুব ভালোভাবে তৈরি হয় প্রথম থেকে – সেই বিষয়েও এই বৈঠকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।

কৌশলগত কারণেই বাজপেয়ী জামানাতে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, রাষ্ট্রীয় সেবিকা বাহিনী, অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ, ভারতীয় মজদূর সংঘ ইত্যাদি আরএসএসের বিভিন্ন শাখা সংগঠনগুলি কিছুটা বেপরোয়া মনোভাব দেখিয়েছিল। সেই সময়ে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির একক গরিষ্ঠতা না থাকার জন্যে আরএসএস বহুক্ষেত্রেই তাদের একান্ত নিজস্ব কর্মসূচিগুলির প্রচার, প্রসার, প্রয়োগ ঘটাতে পারে নি। সঙ্ঘের নিজস্ব কর্মসূচিগুলির যথাযথ প্রচার বা প্রসার ঘটাতে না পারার ফলে সঙ্ঘ কর্মীদের ভিতরে যাতে কোনো রকম হতাশার পরিবেশ পরিস্থিতি তৈরি না হয়, সেই জন্যেই সঙ্ঘ বাজপেয়ী জামানাতে সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখা সংগঠনগুলিকে কিছুটা অবাধ স্বাধীনতাই দিয়েছিল নিজেদের মতো করে চলার জন্য।

সেই স্বাধীনতার অগাধ ব্যবহার করে, যথেচ্ছ ব্যবহার করে সঙ্ঘ পরিবারের শাখা সংগঠনগুলি বাজপেয়ী সরকারকে বিশেষ কোনো রকম বেকায়দায় ফেলেছিল কি না সে নিয়ে গোটা সঙ্ঘ পরিবারের ভিতরে যথেষ্ট বিতর্ক ছিল। সেই বিতর্কের নিরিখে মোদি সরকারের আমলে গোটা সঙ্ঘ পরিবারের ভূমিকা কী হবে – সেটা পর্যালোচনার জন্যে সংশ্লিষ্ট বৈঠকে জোরদার আলোচনা হয়।

সঙ্ঘ পরিবারের কোনো শাখা সংগঠনের কাজে যাতে মোদি সরকার কোনোভাবে বেকায়দায় না পড়ে তার জন্যে মোদি সরকারের সূচনা পরব থেকেই আরএসএস অত্যন্ত বেশি রকমের সক্রিয় থেকেছে। বস্তুত বাজপেয়ী সরকারের আমলে সংশ্লিষ্ট সরকারে বিজেপির একক গরিষ্ঠতা না থাকার জন্যে সঙ্ঘের কর্মসূচিগুলির প্রচার-প্রসারে সঙ্ঘের বিভিন্ন শাখা সংগঠনগুলিকে বেশি রকমের সক্রিয় করেছিল আরএসএস। সঙ্ঘ পরিবারের সেই অতিসক্রিয়তা বহু বিতর্কের ও সৃষ্টি করেছিল।

সেই বিতর্কের পরিবেশে সঙ্ঘের নিজস্ব কর্মসূচিগুলির বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের বেশ কিছু অসুবিধা হয়েছিল বলে সঙ্ঘ নেতৃত্ব বর্তমান সময়ে মনে করে। তাই মোদি জামানাতে বিজেপির একক গরিষ্ঠতা থাকার ফলে সেই সমস্যা গুলির যাতে কোনো অবস্থাতেই পুনরাবৃত্তি না ঘটে সে জন্যে আরএসএস প্রথম থেকেই সক্রিয়। সেই সক্রিয় চিন্তার কথা সঙ্ঘ নেতৃত্ব মোদি সরকারের সঙ্গে আলোচ্য পর্যালোচনা বৈঠকে একদম প্রথমেই পরিস্কার করে দিয়েছিল।

আরএসএসের সঙ্গে মোদি সরকারের মন্ত্রীদের এই সমন্বয় বৈঠক ঘিরে যে সঙ্ঘ পরিমণ্ডলের ভিতরেও বিতর্ক কম ছিল না, তা বোঝা যায় বিশিষ্ট গবেষক ওয়াল্টার কে অ্যান্ডারসন এবং শ্রীধর ডি ডাম্বলেকে দেওয়া ব্রিজেশ উপাধ্যায়ের একটি সাক্ষৎকারের ভিতর দিয়ে।

ব্রিজেশ উপাধ্যায় হলেন আরএসএসের শাখা সংগঠন 'ভারতীয় মজদুর সংঘ', যারা মূলত শ্রমিক ফ্রন্টে কাজ করে, সেই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক। তাঁর সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিল চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি দিল্লিতে। এই সাক্ষাৎকারে ব্রিজেশ উপাধ্যায় বলেছিলেন- 'অটলবিহারী বাজপেয়ীর শাসনকালের ভিতর দিয়ে গোটা সঙ্ঘ পরিবারই অনেক শিক্ষা গ্রহণ করেছে। সরকারের অনুমোদনজনিত বিষয়গুলি সম্পর্কে বাজপেয়ীর আমলে সামগ্রিক ভাবে সঙ্ঘ পরিবারের শাখা সংগঠনগুলির একটা সামগ্রিক ধারণা তৈরি হয়েছে। সেই ধারণার উপর ভিত্তি করেই মোদি সরকারের সঙ্গে সঙ্ঘ পরিবারের সব কটি শাখা সংগঠনের পারষ্পরিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে এবং সেই তৈরি হওয়া সম্পর্কের নিরিখেই পারষ্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সব কিছু চলছে।"

সংশ্লিষ্ট গবেষকদের ব্রিজেশ উপাধ্যায়ের এই বক্তব্যকেই সমর্থন জানিয়েছিলেন অপর এক সঙ্ঘ পরিবারের শাখা সংগঠনের বিশিষ্ট্য নেতা বদ্রীনারায়ণ চৌধুরী চলতি বছরের ই ১৬ জানুয়ারি।

আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে- লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে আরএসএস গত ২০১৪  নির্বাচনে যেভাবে সরাসরি তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির হয়ে কাজ করেছিল, এমনটা তারা এর আগে দেশের লোকসভা নির্বাচনের ক্ষেত্রে মাত্র আর একবারই করেছিল এবং সেটা তারা করেছিল বিগত ১৯৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময়কালে।

সেই সময়কালের জনতা পার্টি, যার ভিতরে আরএসএসের তৎকালীন রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জনসঙ্ঘ অন্তর্ভুক্ত ছিল, তাদের জেতাতে সেদিন আরএসএস এই ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের মতো সক্রিয়তা দেখিয়েছিল (এই তথ্য গবেষকদের দিয়েছেন বিজেপির অন্যতম শীর্ষনেতা রামমাধব। তিনি দীর্ঘদিন আরএসএসের মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ওয়াশিংটন ডি সি তে ২০১৭ সালের ২৩  শে অক্টোবর এই সাক্ষাৎকারটি রামমাধব দিয়েছিলেন।) ।

১৯৭৭ এবং ২০১৪  এর লোকসভা নির্বাচনে আরএসএস অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল বলে এই কথা মনে করার কিন্তু কোনো কারণ নেই যে, অন্যান্য লোকসভা নির্বাচনগুলিতে আরএসএস তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা নেয়নি, বা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। তবে উল্লিখিত দুটি লোকসভা নির্বাচন হলো সেই স্তরের নির্বাচন যেখানে প্রচারপর্ব থেকে শুরু করে নির্বাচনের যাবতীয় আনুসঙ্গিক বিষয়ে আরএসএসের একদম সর্বোচ্চ স্তরের নেতৃত্ব অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। '৭৭ এবং '১৪ র লোকসভা নির্বাচনে যে পর্যায়ে আরএসএসের শীর্ষ নেতৃত্ব প্রচারপর্ব থেকে শুরু করে ভোটের খুঁটিনাটিতে অংশ নিয়েছিলেন,  তেমন অতি সক্রিয়তা আরএসএস আগের কোনো লোকসভা নির্বাচনে দেখায় নি।

জরুরি অবস্থার জটিলতায় আরএসএস যথেষ্ট নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিল। তথ্যভিজ্ঞ মহলের একটি মত আছে যে, আরএসএসের কর্মকাণ্ড তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে জরুরি অবস্থা জারির ক্ষেত্রে অনেকখানি সাহস জুগিয়েছিল।

এই অভিমত লিখিত আকারে পোষণ করেছেন তৎকালীন গোয়েন্দা প্রধান তথা পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল টি ভি রাজেশ্বর। এই মতের যথার্থতা যাই থাকুক না কেন, জরুরি অবস্থার সময়ে আরএসএস এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের ভিতরকার সম্পর্ক ঘিরে নানা চাপান উতোর আছে। ইন্দিরা গান্ধীর রোষানল থেকে বাঁচতে তৎকালীন সরসঙ্ঘচালক বালসাহেব দেওরসের শ্রীমতী গান্ধীর কাছে পাঠানো মুচলেকা জাতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে একটি বহুল চর্চিত অধ্যায়।

জরুরি অবস্থাজনিত অধ্যায়টিকে অবলম্বন করে আরএসএস তাদের নিজেদের সংগঠন এবং মতাদর্শের প্রচার , প্রসারের কাজটি যথেষ্ট ভালোভাবে করে সাধারণ মানুষের ভিতরে নিজেদের একটা ভালোরকমের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। এই গ্রহণযোগ্যতার উপর ভিত্তি করেই তারা '৭৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে এতোখানি প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল। এমনটা পরবর্তীতে  ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে নিজেদের সামাজিক প্রযুক্তির উপর নির্ভর করে, নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি করে সংশ্লিষ্ট বছরের লোকসভা নির্বাচনে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির হয়ে কাজ করতে সক্ষম হয়েছিল।