জার্মানে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের শোকসভা ও তার নেপথ্য কাহিনী 

Published : 23 August 2018, 10:25 AM
Updated : 23 August 2018, 10:25 AM

১৮ অগাস্ট জার্মানির মাইন্সে জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে আয়োজন করেছিল জার্মান বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন। এই অনুষ্ঠানে আমি নিমন্ত্রিত ছিলাম। নিমন্ত্রিত ছিলাম বললে ভুল হবে। আমি যেহেতু জার্মান বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের একজন সম্পাদক সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে নিমন্ত্রণ করার কোন প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। সেক্ষেত্রে বলা উচিৎ আমি যথাসময়ে অবহিত ছিলাম।

তবে আমাদের সভাপতি জনাব ইউনুছ আলী খান কখনও ভুল করেন না। প্রত্যেককে ব্যক্তিগতভাবে টেলিফোন করে জানান এবং অন লাইনে নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দেন। এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য জার্মানিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতকেও নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে।

আমি যথা সময়ে নুরেনবার্গ থেকে রওনা দিলাম বাসে। বাসস্ট্যান্ডে আমি যখন টয়লেটে ছিলাম তখন টেলিফোনের ঘণ্টা বাজলো। টয়লেট থেকে বেরিয়ে দেখলাম আমাদের সভাপতি ইউনুস ভাই টেলিফোন করেছিলেন। উনাকে ফোন করে জিজ্ঞাসা করলাম কী হলো ভাই? উনি জানতে চাইলেন  আমি রওনা দিয়েছি কিনা, সব ঠিক আছে কিনা?

আমি বললাম আমাকে নিয়ে আপনার কোনও চিন্তা করতে হবে না, আপনি অন্যদিকগুলো দেখেন। সবাইকে ফোন করে খবর নিতে গেলে অনেক সময় নষ্ট হবে এবং আপনার উপর মানসিক চাপ বাড়বে। আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যাব এবং ফ্রাঙ্কফুর্টে পৌঁছে মাইনসের ট্রেনে উঠে আপনাকে জানিয়ে দেব কয়টার সময় আমি মাইন্স প্রধান রেলস্টেশনে পৌঁছবো। তাছাড়া আমি নিজেই অনুষ্ঠান স্থলে পৌঁছে যেতে পারব।  উনি আমাকে নির্দেশ দিলেন আমি যেন মাইন্স রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে ওখানে অপেক্ষা করি, কারণ আমার পরপরই সোয়া চারটার দিকে মিউনিখ থেকে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী খান আসবেন, আমি যেন উনাকে অভ্যর্থনা জানাই।

রমজান চাচা আসবেন এসব কিছু আমি আগে থেকেই জানতাম উনার টিকেটও আমি ঠিক করে দিয়েছিলাম কোনটা নিলে ভাল হবে। কিন্তু সভাপতি ইউনুস আলী খান আপ্যায়নের ক্ষেত্রে খুবই সতর্ক সবসময়।

আমি ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে মাইনসের ট্রেনে উঠে সভাপতিকে ফোন করলাম যে আমি রওনা দিয়েছি আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে ওখানে পৌঁছে যাব। আর উনাকে জানালাম রমজান আলী খান চাচার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করেছি উনি জানিয়েছেন যে উনার ট্রেন আসতে দেরি হবে। কারণ রাস্তায় কোনও এক জায়গায় লাইনে কাজ চলছে এইজন্য সময়মত আসতে পারবেন না।

ইউনুস ভাই আমাকে জানালেন স্টেশনের একতলায় যে ফুলের দোকান আছে ওখানে অপেক্ষা করতে এবং ওই ফুলের দোকানের সামনে একজন হালকা-পাতলা বাঙালি মহিলাও থাকবে উনি কার্লসরুহে থেকে আসবেন। এই কার্লসরুহে শহরের কথা আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন। এটা বঙ্গবন্ধুর জামাতা ড. ওয়াজেদ আলী মিয়ার একসময়ের কর্মস্থল ছিল। আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও একটা সময় উনার স্বামীর সঙ্গে এই শহরে ছিলেন। যে কারণে উনি এখনও জীবিত আমাদের মাঝে, নাহলে খুনিরা তাঁকেও ছাড়ত না।

আমি আসলে ফুলের দোকানের সামনে অপেক্ষা না করে বাইরে কিছু ছবি তুলছিলাম। এর আগেও আমি মাইন্স স্টেশনের ছবি তুলেছি কিন্তু শীতে। এখন গ্রীষ্মে চিত্র আলাদা গাছে পাতা প্রচুর  আলাদা সৌন্দর্য্য। এরই মধ্যে লক্ষ্য করলাম ইউনুস ভাই আমাদেরকে নিতে এসে গেছেন। উনি এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন আমি কোথায়? বাইরে থেকে আমি ওনাকে দেখতে পাচ্ছিলাম পিছন দিয়ে যেয়ে বললাম ভয় নেই আমি আছি।

কার্লসরুহে থেকে আগত মহিলার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন আমার নাতনি, তুমি আমার ভাই অতএব তোমারও নাতনি। আমাদের নাতনির বাচ্চা ছেলেও তার সঙ্গে ছিল। পরে আমাদেরকে নিয়ে উনি নিজের বাসার দিকে রওনা হলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম- ভাই বাসায় কেন? আমরা তো সরাসরি অনুষ্ঠানের ওখানেই যেতে পারি!

উনি আমাকে একটা হালকা ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন বললেন- "খেতে হবে না! তোমার ভাবি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেছে খেয়ে নিয়ে তারপর অনুষ্ঠানে। বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মান শাখার সভাপতি এবং উনার সহধর্মিণী এই দম্পতির অতিথি আপ্যায়নের জুড়ি নেই, অন্তত আমার জানামতে। এর আগে জার্মানিতে কোন বাঙালি পরিবারের কাছ থেকে আমি এই রকম আতিথেয়তা পাইনি।"

উনাদের বাসায় অতিথিদের জন্য একটা টয়লেট আছে কিন্তু ভাবি আসমা খান আমাকে উনাদের ব্যক্তিগত টয়লেটে পাঠিয়ে দিলেন হাত মুখ ধোওয়ার জন্য। সাধারণত জার্মানিতে বাইরে থেকে এসে হাত মুখ ধোয়ার প্রয়োজন পড়ে না কারণ ধুলাবালি খুবই কম, আর বাংলাদেশের মতো গরমও না। দেশে তো আমাদের সংস্কৃতি এরকম বাইরে থেকে আসলে হাত-মুখ ধোওয়া। আমি যদি কোনও সময় আমার বাচ্চাকে বলি- বাইরে থেকে আসলে একটু হাত-মুখ ধুয়ে নাও।

সে উত্তর দেয়- কেন বাবা আমিতো সকালে মুখ ধুয়েছি। হাতটা ধোবে, কিন্তু মুখ না। কিন্তু এবছর গরম পড়ছে খুব যেটা রেকর্ড। সেক্ষেত্রে ভাবির হাত মুখ ধুয়ে নেয়ার প্রস্তাবটা খুবই স্বস্তিকর এবং উপযোগী ছিল। হাতমুখ ধুয়ে আসতে আসতে দেখলাম টেবিলে খাবার সাজানো হয়ে গেছে।

খাওয়ার টেবিলে বসার আগে কিছুক্ষণের জন্য আমি বাংলাদেশে হারিয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল বাইরে থেকে ফিরে আসলে মা যেমন হাত মুখ ধুয়ে খাবার খেয়ে নেওয়ার জন্য বলতো, টেবিলে খাবার প্রস্তুত করে বসে থাকত পাশে, সেইসব কথা। ভাবির আয়োজনে কোনও ত্রুটি দেখিনি। এইপরিবার এতটাই আন্তরিক যে, ত্রুটি থাকলেও কেউ সেটা খুঁজে পাবে না।

আমি সাধারণত কোন বাঙালির বাসায় খেতে ভয় পাই, কারণ অতিরিক্ত মশলা-মরিচ আমার একেবারেই সহ্য হয় না। একদিন খেলে সাতদিন এর জের থাকে। খাবার টেবিলে দেখলাম চার রকমের তরকারি আমি জার্মানিতে নিজের বাসায়, কখনো চার তরকারি দিয়ে ভাত খাইনি। খাওয়া নিয়ে আমার এত বেশি মাথাব্যথা নেই। সাধারণত এক তরকারি দিয়ে আমি খাওয়া সারি। খাবার টেবিলে বাংলাদেশের সেই ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম, কাঁচা মরিচ, কাগজি লেবু সবকিছুই ছিল। খাবারে মশলার ব্যবহারও ছিল মার্জিত এখানেও উনার ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটে উঠেছে।

আমি উনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ভাবি আপনি পূর্ণসময়ের একটা কাজ করে এত কিছু করেন কীভাবে? আপ্যায়ন, সংগঠনের জন্য সময় দেওয়া!

প্রায় প্রতি সপ্তাহান্তেই উনাদের বাসায় বাংলাদেশের বা জার্মানির অন্য শহরের কোন না কোনও অতিথি থাকেই। তবে একটা ব্যাপারে উনার মনোকষ্ট আছে তাহল আগের মতো আর পড়াশোনা করার সময় পান না। আগে বই না পড়লে উনার ঘুম আসত না, ঘুমের আগে বই পড়তেন এখন আর সময় পান না। আমাকে বলেছেন অনেক সময় একটা তেমন কোনও মজাদার গুরুত্বপূর্ণ বই হলে রাত পার করে দিয়েছেন শেষ না হওয়া পর্যন্ত।

এরপর আমারা গেলাম হলে যেখানে শোক দিবসের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। গাড়িতে একবারে সবাই যাওয়া যাবে না তাই আমি আর ইউনুস ভাই আগে গেলাম, আমাদেরকে ভাবি নামিয়ে রেখে, তারপর বাকিদের নিয়ে গেলেন। হলে পৌঁছেই দেখলাম বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের সাংস্কৃতিক সম্পাদক কনা ইসলাম যুগল সেখানে পৌঁছে গেছেন। উনি এসেছেন স্টুটগার্ট থেকে যে শহর মার্সিডিজ বেঞ্চের জন্য বিখ্যাত।

এর কিছুক্ষণ পর আসলেন বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মান শাখার উপদেষ্টা মাহবুবুল হক। আমি কথা বলছিলাম একজনের সাথে প্রথমে খেয়াল করিনি উনাকে ঘুরে তাকাতেই বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম এর আগে উনি আমাকে দেখেছেন মাত্র একদিন অথচ মনে রেখেছেন।

এই অনুষ্ঠানের একটা বিশেষত্ব ছিল তা হল এখানে প্রধান অতিথি ছিলেন দু'জন। একজন বাঙ্গালি আর একজন জার্মান। এই দুজনই ছিলেন খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজনকে বাদ দিয়ে আরেকজনকে প্রধান অতিথি করতে সভাপতি দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। তখন উনি উনার জার্মান বন্ধু কার্স্টেন লাং এর সাথে পরামর্শ করেন, যিনি আমাদের অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি ছিলেন। কার্স্টেন পরামর্শ দেন যে, তুমি দু'জনকেই প্রধান অতিথি করতে পার কোন অসুবিধা নেই, জার্মানিতেও কোন কোন অনুষ্ঠানে এমন ঘটে। সৌভাগ্যক্রমে দুইজন প্রধান অতিথি থাকলেও এখানে কোন সমস্যা হয়নি এই কারণে যে একজনের অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত থাকার মত সময় ছিল না হাতে আর অন্যজনের আরেকটা অনুষ্ঠান থাকায় আমাদের অনুষ্ঠানের শুরুতে আসতে পারবেন না বলে জানিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হল একজন প্রধান অতিথির সঙ্গে আরেকজনের দেখাই হয়নি।

অনুষ্ঠানের প্রথম অংশের প্রধান অতিথি ছিলেন মাইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অরুন ব্যানার্জি। উনি ঠিক সময়ে অনুষ্ঠান স্থলে সস্ত্রীক পৌঁছে গেলেন। উনার জার্মান স্ত্রীও একজন শিক্ষিকা। বাঙালিদের অনুষ্ঠান শুরু হতে সবসময় একটু দেরিই হয়। আমিও সুযোগ পেলাম উনার সঙ্গে একটু কথা বলার। উনি আমাকে দেখে চিনে ফেললেন, কারণ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠানেও উনি ছিলেন। সেদিন উনার সাথে আমার বেশ খানিক সময় কথা হয়েছিল।

আমাকে উনি বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে কিছু প্রশ্ন করেছিলেন আমি যথাসাধ্য তার উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। অধ্যাপক অরুণ ব্যানার্জি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে মাইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন শাস্ত্রে পাঠদান করেছেন। এখন প্রায় অবসর জীবন যাপন করছেন। তবে এখনও মাইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা পড়ান সেসব শিক্ষার্থীদের যারা বাংলাদেশে এনজিও এর হয়ে কাজ করতে যান। তাছাড়া উনি একজন রবীন্দ্র গবেষকও। 'চিরকালের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর' বলে জার্মান ভাষায় একটা বই বেরিয়েছে সেখানে উনার একটা প্রবন্ধ আছে 'ঠাকুরের স্বপ্নকন্যারা' বলে। এই বইয়ে উনি ছাড়া আরও আটজন জার্মান লেখকের প্রবন্ধ স্থান পেয়েছে। উনাকে বললাম দাদা আপনি তো বাংলায় লিখতে পারেন তাহলে এটা বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবাংলায় একটা ভালো বাজার হতে পারে। উনি বললেন, "তেমন সময় নেই হাতে আর আমি যেটা করি, ব্যবসায়িক চিন্তা করে করিনা। শুধু আত্মতৃপ্তির জন্য করি।"

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যখন উনাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করি উনি বলেন, "বঙ্গবন্ধুর উপর আমার একটু বিশেষ দুর্বলতা ছিল। বঙ্গবন্ধু কলকাতায় পড়াশোনা করেছেন আমিও কলকাতায় সেই একই প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেছি।"  জানালেন, ইংরেজ হটাও আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা উনাকে আকৃষ্ট করেছিল।

বঙ্গবন্ধুকে যেদিন খুনিরা হত্যা করে তখন তিনি জার্মানিতে ছিলেন। পিএইচডি থিসিস লিখছিলেন। এই খবরে তারা স্তম্ভিত হয়ে যান। তারা তিনজন বাঙ্গালি সহপাঠী মিলে পরদিন একটা শোকসভার আয়োজন করেন এটা এখনও মনে আছে। তার সাথে ছিলেন মানিক ও আনোয়ার বলে দুজন, তাঁদের পুরো নাম উনি আর এখন মনে করতে পারেননি। উনার সহপাঠিরা অন্য বিভাগের ছাত্র ছিল। অরুন ব্যানার্জির মেয়েও যুক্তরাষ্ট্রের একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপব।

উনি বললেন, "আজকে আমার মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু বাঙালিদের অনুষ্ঠান সবসময় দেরিতে শুরু হয় তুমি জানো। নিয়ে আসলে হয়ত বিরক্ত বোধ করত এই কারণেই তাকে নিয়ে আসিনি।"

অরুণ দা'র সঙ্গে যখন কথা জমে উঠেছিল ঠিক তখনই আমার ফোন বেজে উঠল। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী খান ফোন করেছিলেন, উনি জানালেন মাইন্সে পৌঁছে গেছেন। তাকে আনার ব্যবস্থা করার জন্য। টেলিফোনটা আমি সভাপতি ইউনুছ আলী খানকে দিলাম কথা বলার জন্য।  ঠিক সেই সময়ে তার পক্ষে রেল স্টেশনে যাওয়া সম্ভব ছিল না, অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার পথে ছিল। এমন একজনকে স্টেশনে যেতে হবে যিনি মুক্তিযোদ্ধা রমজান আলী খানকে চেনেন এবং রেলস্টেশনের রাস্তাও চেনেন। এই সমন্বয় আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যাহোক পরে সিদ্ধান্ত হলো আমি এবং ভাবি যাব রমজান চাচাকে আনার জন্য।

মাইন্স রেল স্টেশনে যেয়ে উনাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ফোন করলাম- 'চাচা আপনাকে দেখছি না কেন?'

বললাম, তিন নম্বর প্লাটফর্মে আসার জন্য, আমি তিন নম্বর প্লাটফর্মে যেয়ে উনাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তখন উনি জানালেন, উনি প্রধান রেল স্টেশনে না নেমে আগেই নেমে গেছেন। কোন এক ভারতীয়ের সাথে তার আলাপ হয়েছিল সে বলেছে মাইন্স এসে গেছে, উনি নেমে পড়েছেন।

আমি গাড়ির কাছে এসে ভাবিকে জানালাম যে এই অবস্থা। তখন ভাবি বললেন ঠিক আছে ওখান থেকে ওনাকে নিয়ে আসি, খুব বেশি দূর হবে না। আমরা রওনা দিয়েছি এর মধ্যে রমজান চাচা আবার ফোন করলেন যে উনি পরের ট্রেনে প্রধান রেল স্টেশনে এসে গেছেন। আমরা আবার ঘুরে তাকে সেখান থেকে নিয়ে আসলাম।

গাড়ি ঠিক সময় মতো আসলে উনার পৌঁছানোর কথা ছিল প্রধান রেল স্টেশনে চারটা বার মিনিটে। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে উনি পৌঁছেছিলেন পৌনে সাতটায়। উনি ছিলেন অনুষ্ঠানের একজন বিশেষ অতিথি উনাকে ছাড়া সভাপতি অনুষ্ঠান শুরু করতে চাচ্ছিলেন না।

এই ঘোরাফেরার মধ্যে আমার অবশ্য একটা সুবিধা হয়েছিল। ভাবির সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। এই সময়টুকুতে আমি তাকে আরও ভালো করে জানতে পেরেছি, বুঝতে পেরেছি। প্রায় ৪০ মিনিটের মতো সময় পেয়েছিলাম। অনেক কথা হয়েছে কিন্তু কোন সময় আমি উনাকে একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করতে শুনিনি বা অপ্রাসঙ্গিক জার্মান কোনও শব্দও ব্যবহার করতে শুনিনি। অথচ উনি গ্রিন হেরাল্ড থেকে ও লেভেল করেছিলেন, তারপর হলি ক্রস কলেজ পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাইক্রো বায়োলজিতে মাস্টার ডিগ্রি করেন। আজকালকার ছেলে-মেয়েরা অহেতুক কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে। এরা কেউ চাকরি করেনা, সবাই 'জব' করে। চাকরি করলে বোধহয় চাকর চাকর মনে হয়, অথচ সেই একই কাজকে যখন 'জব' বলে তখন সে আত্মতৃপ্ত থাকে।

আমরা ফিরে আসলে খুব দ্রুত কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পরে অনুষ্ঠান শুরু হয়। শোক দিবসের প্রতি সম্মান জানিয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। তারপর বাংলাদেশ জার্মানি দুই দেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে শিল্পীরা বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মান শাখার সাংস্কৃতিক সম্পাদক কনা ইসলামের নেতৃত্বে।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন দুই প্রধান অতিথি অধ্যাপক অরুন ব্যানার্জি, লুকাস আগস্টিন (সিডিইউ এর জেষ্ঠ নেতা রাইনল্যান্ডফালস প্রদেশের), রমজান আলী খাঁন (যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এবং উপদেষ্টা বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মানি), নুরুল ইসলাম (মুক্তিযোদ্ধা),আবু সেলিম (উপদেষ্টা বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মানি), মাহবুবুল হক (উপদেষ্টা বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মানি), আমিনুর রহমান খসরু (মুক্তিযোদ্ধা), অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি কার্স্টেন লাঙ্গে (কোষাধ্যক্ষ সিডিইউ মাইন্স,) তরস্তেন মার্টিন রহে (চেয়ারম্যান যুব ইউনিয়ন মাইন্স, পরিচালক সিডিইউ মাইন্স-নোয়েস্টাড), বদরুল ইসলাম (সহ-সভাপতি বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মানি), ইমরান ভূইয়া (সহ-সভাপতি বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মানি), জিল্লুর রহমান (সহ-সভাপতি আওয়ামী লীগ জার্মানি), এম এ খালেক (সাংস্কৃতিক সম্পাদক আওয়ামী লীগ জার্মানি ), মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার (তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন, জার্মানি) এবং সবশেষে সভাপতি ইউনুস আলী খান তার সমাপনী বক্তব্য রাখেন।

উপদেষ্টা আবু সেলিম বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রে কারা জড়িত ছিল আজ পর্যন্ত তা স্পষ্ট না। বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মান শাখা চেষ্টা করে যাচ্ছে বিভিন্ন উপায়ে এই সত্য উদ্ঘাটনের জন্য।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অরুন ব্যানার্জি উনার বক্তব্যে বলেন, "আমরা যেখানেই থাকি যেন  বঙ্গবন্ধুকে কোনদিন ভুলে না যায়। একটি বড় গাছের আরম্ভ হচ্ছে একটি বীজ। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন বাংলাদেশের বীজ।"

অনুষ্ঠানের চলার মাঝেই একটু যখন সময় পেয়েছি তখনই বিভিন্ন অতিথিদের সঙ্গে বিশেষ করে জার্মান অতিথিদের সঙ্গে কথা বলেছি। এঁদের একজন অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি কার্স্টেন লাং-কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'আপনি কি বঙ্গবন্ধুকে চেনেন?'

তিনি উত্তরে বলেন- শেখ রহমান?

আমি বললাম, "হ্যাঁ শেখ মুজিবুর রহমান। আপনি কেমনে তাঁকে চেনেন, আপনি কি তাঁর উপর কিছু পড়েছেন?"

উনি বলেন, "আমি জার্মান বাংলাদেশ কালচারল সেন্টারের একজন উপদেষ্টা। ইউনুস আলী খান আমার ভাল বন্ধু। আমি জানি শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর দেশের মুক্তির জন্য অনেক সংগ্রাম করেছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এনে দিয়েছেন। তাঁর সংশ্লিষ্টতা ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তি সম্ভব ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের পর উনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন। বাংলাদেশ মুক্তির আগে কঠিন সময় পার করেছে। আমি মনে করি আমাদের তাঁকে স্বাধীনতার অগ্রনায়ক হিসাবে গণ্য করা উচিৎ যতোনা আর কিছু।"

এরপর আমি কার্স্টেনকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "অনেকেই বলে যে একটা উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্যের দল তাকে হত্যা করেছিল। আপনি কি সেইরকম মনে করেন, নাকি এখানে কোনও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ছিল? কারণ যদি শুধুমাত্র কয়েকজন সেনাসদস্য তাকে হত্যা করতো তাহলে তারা নিশ্চয় রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেত না!"

তখন উনি বলেন, "শেখ রহমানকে হত্যা করেছিল কারণ এটা ছিল তাঁর রাজনৈতিক মতের ফল। তাঁর রাজনৈতিক মতের কারণে অনেক শত্রু ছিল। আমার মনে হয় এরকম রাজনীতিবিদদের অনেকেরই অনেক শত্রু থাকে। উনি যদি কোন ভুল করে থাকেন তার অর্থ এই না যে তাঁকে হত্যা করতে হবে। শত্রুরা যে রাস্তা বেঁছে নিয়েছে এটা ধিক্কারজনক। বাংলাদেশকে যে স্বাধীনতা উনি এনে দিয়েছিলেন এটা ছিল দেশের জন্য একটা বড় উপহার।  যত যাই কিছু হোক না কেন কোনোভাবেই তাকে হত্যা করার মতো কোনও কারণ ঘটতে পারে না।"

পরে আমি কার্স্টেনকে বলি, "দেখেন অনেকেই অতীতে বলেছে, তার রাজনীতির কিছু ভুল ছিল কিন্তু সেটা কোনওভাবেই প্রমাণিত হয়নি। উনি যে রাজনীতি করতে চেয়েছিলেন সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা না। এবং এর আলোকেই আমরা কিউবাতে কিছু পাটজাত সামগ্রী পাঠিয়েছিলাম, তারপরে আমেরিকা যখন জানতে পারে তারা দুইটা জাহাজ ভর্তি খাবার বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল সেগুলো মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। কথিত আছে খাবারগুলো সমুদ্রে ফেলে দেয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ খাদ্যের অভাব দেখা দিয়েছিল কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু মানুষের পাঁচটা মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা বিধান করতে চেয়েছিলেন যেমন জার্মানি করেছে। জার্মানির মত গণতন্ত্রের কথা ভেবেছিলেন। আপনাদের দেশে যে দলই ক্ষমতায় থাক কিন্তু জনগণের পাঁচটা মৌলিক চাহিদার বিধান করা হয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এই নীতিগুলো পছন্দ হয়নি এই কারণেই ওনাকে অসহযোগিতা করা হয়েছে, এবং একটা আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মাধ্যমে উনাকে হত্যা করা হয়েছে। আপনি নিশ্চয়ই হেনরি কিসিঞ্জারের এর নাম শুনেছেন যে জার্মানিতে জন্মগ্রহণ করেছিল?"

তখন উনি বলেন, "হ্যাঁ, সে আমেরিকার ফরেন সেক্রেটারি ছিল। আমি তখন উনাকে বলি আমরা যতদূর জানি যে এই হত্যার পিছনে তার যথেষ্ট ইন্ধন ছিল।"

এরপর কার্স্টেন লাং তার আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় বলেন, "প্রতি বছর আমি আপনাদের এই শোক সভায় অত্যন্ত আগ্রহের সাথে উপস্থিত হই। শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রের রাস্তা আমাদেরকে দেখিয়েছেন মুক্তির জন্য। তার এই নীতি আদর্শ ধ্যান-ধারনা দুষ্কৃতিকারী কিছু সামরিক সদস্যের কুচিন্তাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এই দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে সকল গণতন্ত্রকামী দেশকে একত্রে থেকে রুখে দাঁড়াতে হবে। যতদিন পর্যন্ত একজন মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের ধ্যান-ধারণাকে বিশ্বাস করবে ততদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের টিকে থাকার আশা জীবিত থাকবে। গণতন্ত্র একটা চেতনা যার জন্য আমাদেরকে সংগ্রাম করতে হবে বা হয়। শেখ রহমান বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন এবং এখন এটা আমাদের কর্তব্য সেই পথকে সুসংগত করা।"

তরস্তেন মার্টিন রহে তাঁর বক্তব্যে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, "আমি চেয়ারম্যান, যুব ইউনিয়ন মাইন্স। অনেকদিন ধরেই আমি আপনাদের এই অনুষ্ঠানে আসি। জনাব ইউনুস খান আমাকে নিমন্ত্রণ করেন। ধন্যবাদ আপনাদেরকে যে আপনাদের সংস্কৃতির সঙ্গে আপনাদের ধর্মের সঙ্গে আমরা একাত্ম হয়ে উদযাপন করার সুযোগ পাচ্ছি আমি আজকে আর বেশি কিছু বলবো না। আপনাদেরকে ধন্যবাদ শুভ সন্ধ্যা।"

তরস্তেন সেদিন তাঁর বাগদত্তাকে নিয়েই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল।

প্রধান অতিথি আগস্টিন লুকাস তাঁর বক্তব্যে বলেন, "প্রিয় বন্ধুগণ আমি খুবই সম্মানিত বোধ করছি এই জন্য যে আমি আজকের এই সন্ধ্যায় বিগত বছরগুলোর মত নিমন্ত্রিত। ধন্যবাদ আমার বন্ধু এবং  বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন এর সভাপতি  ইউনুস আলী খানকে। আজকের এই সন্ধ্যায় আমরা স্মরণ করছি তেতাল্লিশ বছর আগে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের বীভৎস হত্যাকাণ্ডকে।  আমরা এই দিনটাকে এইজন্য স্মরণ করছি না, যে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মারা গিয়েছিলেন, আমরা এই দিনটাকে স্মরণ করছি এই জন্য যে বাংলাদেশের জাতির জনককে হত্যা করা হয়েছিল। তার জীবন খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা তাঁর ছবি এখানে দেখতে পাচ্ছি। দোষারোপ করা হলেও তার নীতি আদর্শ এখন পর্যন্ত বেঁচে আছে। এবং সেই ব্যাপারগুলো অন্যান্য বক্তারা উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশ আবার শেখ মুজিবের নীতিতে ফিরে গেছে। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতা আবার ফিরে এসেছে।"

"আজকের সন্ধ্যা যেমন দুঃখের, কিন্তু অন্য দিক দিয়ে চিন্তা করলে এই সন্ধ্যা খুব গুরুত্বপূর্ণও। কারণ এই সন্ধ্যায় আমরা আপনাদের জাতিরজনককে স্মরণ করছি। আমি আপনাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করছি। এখন শোনা যাচ্ছে, বাংলাদেশ দ্রুত গতিতে উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশ আর গরিব দেশ না এটা এখন একটা উন্নয়নশীল দেশ। আমাদের দেশও উন্নয়নশীল দেশ। আমরা কখনোই সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছায় না, আমাদের সব সময় চেষ্টা করতে হবে ভালোর জন্য। যা জার্মানি এবং বাংলাদেশ ভবিষ্যতে সংঘবদ্ধভাবে করবে। আমি খুবই খুশি আপনারা এখানে জার্মানিতে বসবাস করছেন। আপনাদের জাতির পিতার স্মরণসভায় আমি আপনাদের জন্য একটা সুন্দর সন্ধ্যা কামনা করছি। ধন্যবাদ আমাকে নিমন্ত্রণ জানানোর জন্য।"

মুক্তিযোদ্ধা আমিনুর রহমান খসরু তার বক্তব্যে একটা নতুন ধারণা দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু হত্যা সম্বন্ধে, যা এর আগে আমি আর কারো কাছ থেকে শুনিনি। অনুষ্ঠানে বিদেশি অতিথি থাকায় উনি বাংলায় বক্তব্য শুরু করলেও অনেকেই তাকে জার্মান ভাষায় বলার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু উনি বললেন, যে জার্মান ভালো বলতে পারবেন না, তখন সবাই তাকে বলে যে ঠিক আছে আপনি ইংরেজিতে আপনার বক্তব্য দেন।

তবে উনি যা বলেছেন তার একভাগের সাথেও আমি একমত পোষণ করি না। বক্তব্যের মধ্যেই উনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছেন, মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার ১৫ বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর উপর গবেষণা করছে। আমি তাকে এবং এই সংগঠনের সভাপতি ইউনুস আলী খান ভাইকে অনুরোধ করবো আমার এই কথাগুলো সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছে দেবার জন্য।

আমিনুর রহমান খসরুর বক্তব্য ছিল, "সবাই বলে সামরিক বাহিনীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল কর্মকর্তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে, কিন্তু এটা ঠিক না।"

উনি বোঝাতে চেয়েছেন এরা কেউই সামরিক বাহিনীর লোক ছিল না। এরা সবাই সামরিক বাহিনী থেকে বহিষ্কৃত ছিল। অতএব এরা সন্ত্রাসবাদী, কিন্তু সামরিক বাহিনীর না।

যে কয়জনকে বিচারে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে এরা প্রত্যেকেই বহিষ্কৃত ছিল বা অবসরপ্রাপ্ত ছিল কিনা সেটা আমার সঠিকভাবে এই মুহূর্তে জানা নেই। তবে যতদূর জানি সবাই বহিষ্কৃত ছিল না। অতএব এক্ষেত্রে আমি কোনভাবেই মুক্তিযোদ্ধা আমিনুর রহমানের সঙ্গে একমত হতে পারছি না। তাছাড়া আমার প্রশ্ন হলো- যে কথা আমি আগেও আমার বিভিন্ন নিবন্ধ লিখেছি, সেটা হচ্ছে- 'উচ্ছৃঙ্খল একদল সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তার পক্ষে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা সম্ভব ছিল না। এখানে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র হয়েছিল এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র এখানে জড়িত ছিল- তা না হলে খুনিরা রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেত না।'

তৎকালীন সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমান এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। তার যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ আছে এবং খুনিদের একজন ফারুকের সাথে সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের কথাবার্তাতেও সেটা বেরিয়ে এসেছে। জিয়া কিন্তু সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত ছিলেন না। উইকিলিক্সসহ অনেক আন্তর্জাতিক খবরেও বেরিয়ে এসেছে যে হেনরি কিসিঞ্জারের ইন্ধন এই হত্যার পিছে ছিল।

এরপরেও সাময়িকভাবে যদি এটাকে আমি একটা সন্ত্রাসবাদী হামলা বলে মনে করি, তাহলে কেন সরকারের কোনও সংস্থা সেদিন বঙ্গবন্ধুকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি? আর সন্ত্রাসীদের হাতে সেনাবাহিনীর ট্যাংক বহরের কর্তৃত্ব কীভাবে গেল? এই প্রশ্নগুলো মনে নিয়ে কোনোভাবেই আমি এটাকে একটা সন্ত্রাসবাদীদের হামলা বলে মেনে নিতে পারছি না।

এর অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে যে এটা মুষ্টিমেয় কিছু সন্ত্রাসবাদীর হামলা না। কিন্তু এই স্বল্প পরিসরে সে সুযোগ নেই। মুক্তিযোদ্ধা আমিনুর রহমান খসরু তাঁর বক্তব্যে যে মতবাদ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন তাতে খুনিদের এবং খুনি চক্রের অপরাধকে লঘু করেই দেখানো হবে বলে আমার মনে হয়। কিন্তু নৈতিকভাবে সেটা সঠিক বলে আমি মনে করি না।

আমিনুর রহমান খসরু আমার খুবই শ্রদ্ধেয় উনার সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কও চমৎকার কিন্তু এ ব্যাপারে আমাদের দ্বিমত থেকেই যাচ্ছে, যদি উনি উনার অবস্থান থেকে সরে না আসেন। তবে আমি এও জানি উনি খুবই পরমতসহিষ্ণু গণতন্ত্রী একজন মানুষ এতে আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোনও অবনতি হবে না।

অনুষ্ঠানের প্রায় শেষের দিকে আমি সভাপতি ইউনুছ আলী খানকে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হাকিম টিটুর সঙ্গে ফিসফিস করে কিছু বলতে শুনলাম, এরপরেই আমার ডাক পড়লো। এই দিন অনুষ্ঠানের সময় খুবই কম ছিল আমার আনুষ্ঠানিক কোনও বক্তব্য দেবার ইচ্ছা ছিল না। কারণ বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের ফেসবুক পাতায় এবং অন্য জায়গায় আমি নিয়মিতভাবেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লিখে থাকি। আমি উল্লেখ করেছিলাম এই সংক্ষিপ্ত সময় বা কয়েক মিনিট সময় আমার জন্য বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বলা কঠিন। অনেক কথা আছে বলার জন্য কিন্তু সময়ের অভাব।

আমি শুধু একটা জিনিস আপনাদের কাছে তুলে ধরতে চাই সেটা হল গত ১৭ অগাস্ট অধ্যাপক জাফর ইকবাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে তার 'বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু' নিবন্ধে প্রশ্ন রেখেছেন- 'যারা সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে তারা কী বড় অপরাধী, নাকি যারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষা করে এদেশের মানুষের সামনে বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ত্বকে অস্বীকার করেছে তারা বড় অপরাধী, কে উত্তর দেবে?"

আমি বলেছি, অধ্যাপক জাফর ইকবালের এই প্রশ্নের আগেই আমি লিখেছিলাম বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হত্যা বড় পাপ। আমরা লক্ষ্য করেছি ১৯৭৫ এর ১৫ অগাস্টের পর বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রকাশ্যে এবং নেপথ্যে তার আদর্শকে রুখে দেয়ার জন্য চক্রান্তকারীরা সবরকম তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিল যা এখন পর্যন্ত বিদ্যমান।

অনেকেই হয়তো আমার এই মতামতকে ভুল বুঝতে পারেন যে আমি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডকে লঘু করে দেখছি! অবশ্যই সেটা না। বঙ্গবন্ধু হত্যা একটা জঘন্য পাপ ছিল। কিন্তু একটা মানুষ তার কর্মের মধ্যে নীতি-আদর্শের মধ্যে বেঁচে থাকে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তার নীতি আদর্শকে বাংলাদেশ থেকে চিরতরে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছে ঘাতক ও তাদের সহযোগীরা। বঙ্গবন্ধু যেন তার কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকতে না পারেন সে চেষ্টা তারা চালিয়েছে যা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেয়ে বড় পাপ তো বটেই।

সবশেষে ডাক পড়ে অনুষ্ঠানের সভাপতি বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন জার্মান শাখার সভাপতি এবং কেন্দ্রীয় বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন এর আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ইউনুস আলী খানের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা এবং তার বক্তব্য রাখবার জন্য। উনি বক্তব্যে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন শুধু কয়েক মিনিটের বক্তব্য মানুষের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নীতি ও আদর্শ বিস্তারলাভে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে না। কারণ অধিকাংশ মানুষ বক্তব্য শোনে আবার ভুলে যায়। সেইক্ষেত্রে প্রত্যেকের উচিত বঙ্গবন্ধুর উপরে যেসব গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো বেরিয়েছে সেগুলো পড়া এবং তাঁর নীতি আদর্শ বাস্তবায়ন করার মনে প্রাণে চেষ্টা করা। উনি 'বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী' এবং 'কারাগারের রোজনামচা' বই দুটো সবাইকে পড়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।

ইউনুস খান শুধু জার্মান শাখার সভাপতি হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালন করেন তাই না, কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পাদকের দায়িত্বও উনি সুচারুভাবে পালন করেন। উনি এখানে জার্মান বাংলাদেশ কালচারাল সেন্টারের নেতৃত্ব দেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে জার্মান নাগরিকদের মাঝে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছড়িয়ে দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করতে উনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। যার ফলে এই অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন জার্মান অতিথিকে দেখা গেছে যারা বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে জ্ঞান রাখে।

সাংবাদিকদের কথা সাধারণত কেউ বলে না, মনেও রাখে না। কিন্তু খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে যদি একটু এদিক ওদিক হয় তাহলে সাংবাদিকদের খবর করে ছাড়েন। এনটিভি ইউকে থেকে যে সাংবাদিক এসেছিলেন, উনি আমার পরিচিত মুখ নাম হাবিব উল্লাহ আল বাহার। অনুষ্ঠানের মাঝে আমি উনার একটা ছবি তুলে নিলাম। উনি জানালেন, 'আমি তো ফেসবুকে আপনার বন্ধু। চমৎকার হাসি মুখের মানুষ, হাসিমুখে কাজ করে গেছেন সারাটা সময়। এই অনুষ্ঠানের একটা ভিডিও এনটিভি ইউকে খবরে দেখিয়েছে। বেশ ভাল খবর করেছে এনটিভি ইউকে।"

অনুষ্ঠান শেষে আমার টনক নড়ল বেশি সময় হাতে নেই, রাত ৯ টা ৪৪ মিনিটে আমার গাড়ি। দ্রুত কিছু খেয়ে নিয়ে যেতে হবে। খাবার টেবিলে কোটচাঁদপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যানের সাথে কিছু কথা হল। তিনি তো আজ শোকসভায় জানালেন- 'জার্মানির কোথায় নাকি বঙ্গবন্ধুর এক খুনি পালিয়ে আছে! যদি কেউ তার সঠিক খবর দিতে পারে তিনি এক হাজার ইউরো পুরস্কার দেবেন।'

তিনি আমার বাড়ি চুয়াডাঙ্গা শুনে বেশ আগ্রহী হয়ে উঠলেন। বিস্তারিত খোঁজ নিলেন এবং টেলিফোন নম্বর দিয়ে দিলেন যোগাযোগের জন্য।

এরমধ্যে খান ভাবির সাথে দেখা হয়ে গেল। উনি জিজ্ঞাসা করলেন আমার ট্রেন কয়টায় আর একটা দুঃসংবাদ দিলেন সেটা হল রমজান আলী খান সাহেব তার ট্রেন ধরতে পারেননি। এ বেচারার ভাগ্য এ দিন খারাপ ছিল। আসার সময় ৩ ঘণ্টা লেট, যাওয়ার সময় ট্রেন ছেড়ে গেল।

ভাবি বললেন, উনি স্টেশনে থাকবেন আমার সঙ্গে একই বাসে যাবেন।

আমি ভাবিকে বললাম- 'আমিতো বাসে যাচ্ছি না, আমি যাব ট্রেনে।

রওনা দেব এমন সময়ে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের যুগ্ম সম্পাদক স্নিগ্ধা বুলবুলের আবার আমার সঙ্গে একটা সেলফি তোলার ইচ্ছা হল। এর আগে আমার সাথে জীবনে কেউ সেলফি তোলেনি। মুখ চোখ বাঁকা হয়ে থাকে বিধায় সেলফি জিনিসটা আমার খুব বেশি পছন্দ না। বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন এর একজন আমার সাথে একটা সেলফি তুলতে চেয়েছেন- 'নাও' করতে পারিনা। আবার ওদিকে ভাবিও তাড়া দিচ্ছেন যাতে ট্রেন ফসকে না যায়।

যাহোক সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভাবির সঙ্গে স্টেশন পর্যন্ত এলাম। ভাবি আমাকে বিদায় দিয়ে ফিরলেন আবারও হলে। এই ভদ্র মহিলার ধৈর্য দেখে আমি আশ্চর্য হয়েছি, ওইদিন কতবার যে উনি কতজনকে স্টেশনে দিয়ে এসেছেন আর নিয়ে এসেছেন তার ইয়ত্তা নেই!

স্টেশনে এসে দেখলাম আমার ট্রেন ২০ মিনিট দেরিতে আসবে। প্লাটফর্মে এক ভদ্রলোকের সাথে আলাপ হল।

তিনি বললেন যে, "মাঝেমাঝেই এই ট্রেনে যাতায়াত করেন। সাধারণত এইরকম দেরিতেই আসে ট্রেনটা। একদিন তো ট্রেনটা আসেইনি সেক্ষেত্রে উনি এখান থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট গিয়ে অভিযোগ করেন এবং উনাকে একটা চেক দিয়ে দিয়েছিল রেল কর্তৃপক্ষ ওখান থেকে নুরেনবার্গ পর্যন্ত ট্যাক্সি ভাড়া বাবদ।"

স্টেশনে যেয়ে আমি রমজান চাচাকে পাইনি, উনি ফ্রাঙ্কফুর্ট পৌঁছে গেছেন। ততোক্ষণে সেখান থেকে বাস বা ট্রেনে মিউনিখ যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। উনি বাসে পরদিন সকাল ৮টায় মিউনিখ পৌঁছেছিলেন।

বিশাল এক ইন্টার সিটি ট্রেন আসলো। ট্রেনের বগিগুলো প্রায় সব খালি ছিল।

সামনে টেবিল এমন একটা আসনে বসে  'The Solitude of Alexander Selkirk' কবিতাটার কথা মনে হচ্ছিল-

"I AM monarch of all I survey;

My right there is none to dispute;"

আমার একজন প্রিয় শিক্ষক প্রয়াত আলী আকবর সাহেব আমাদের এই কবিতাটা পড়িয়েছিলেন। যতদূর চোখ যায় সবকিছুর মালিক আমি, আমার রাজত্ব নিয়ে বিরোধিতা করার কেউ নেই- এরকমই অর্থ আমার শিক্ষক সেসময় আমাদেরকে বলেছিলেন।

আসনে বসে কাউকে চোখে পড়ছিল না তখন কবিতাটার কথা মনে হচ্ছিল, যতদূর চোখ যায় সবকিছু আমার এখানে বিরোধিতা করার কেউ নেই। ফোনটা চার্জ দেবার ব্যবস্থা করে জুতা খুলে বসলাম। এই জুতা খুলে বসার দুটো কারণ আছে। প্রথমত জার্মানিতে আপনি জুতা পায়ে দিয়ে সিটের উপর পা তুলে বসতে পারেন না, নিষিদ্ধ। আর এদিন আমার জুতা একটা সমস্যা করছিলো এই কারণে।

ছবি: লেখক