বাজেট-পূর্ব ভাবনা ২০১২-১৩

আলী আহমদ
Published : 5 June 2012, 09:08 AM
Updated : 5 June 2012, 09:08 AM

গত শতকের নব্বইয়ের দশকের একেবারে গোড়ার দিকে বাংলাদেশে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) প্রবর্তিত হয়। তার কাছাকাছি সময়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য উদারিকরণের লক্ষ্যে শুল্ক হার হ্রাস ও সুষমকরণের ফলে বাজেট ঘোষণার ঠিক আগে এখন আর খুব একট হৈচৈ হয় না।

১৯৯১ সাল থেকে সমহারে মূল্য সংযোজন কর প্রবর্তনের পর থেকে এখন পর্যন্ত এই কর ব্যবস্থাকে এমন বিকৃত করে ফেলা হয়েছে যে তাকে মূল্য সংযোজন কর বলে চেনা এখন দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনও কখনও শিল্প-বাণিজ্যের বাস্তব অবস্থার প্রয়োজনে এটা হয়েছে। আবার কখনওবা বিশেষ বিশেষ ব্যক্তি বা শক্তিধর কোনও উপাদানের চাপের সামনে নতি স্বীকার করেছেন সরকার। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের একটা চাপ ছিল। সেই চাপ সামাল দিতে শিল্প-বাণিজ্য সংস্থাগুলোর বিরোধিতার মুখেও শেষ পর্যন্ত নতুন একটি মূল্য সংযোজন কর আইন, ২০১২ প্রণয়ন করতে বাধ্য হয়েছে সরকার।

তবে ওই পক্ষগুলোর সঙ্গে কিছুটা আপোষ করতে হয়েছে। তার প্রমাণ ২০১৫ সাল থেকে আইনটি কার্যকর হবে বলে মেনে নিয়েছে সরকার। আশা করা যাচ্ছে, সংসদের চলমান বাজেট অধিবেশনেই এটি আইন হিসেবে পাস হবে।

যা হোক, এ সব কারণেই বাজেটে কিসের ওপর কর বাড়বে আর কিসের ওপর কমবে তা নিয়ে এখন জল্পনা-কল্পনা প্রায় অনুপস্থিতই বলা চলে। তার স্থান দখল করছে ক্রমাগত সুস্থ বাজেট ভাবনা।

জাতীয় বাজেটের আকৃতি ও প্রকৃতি কী হবে এখন সেটাই ভাবনার ও বিশ্লেষণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবার আমরা সে দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নিই।

৭ জুন, ২০১২, জাতীয় সংসদে বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। বাজেট পেশ করার আগে খাতওয়ারী কী পরিমাণ কিংবা মোট ব্যয় বাজেটের কত শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হলো তা যেমন আমাদের অজানা তেমনি তার কোনটির কী সম্ভাব্য ফলাফল পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে মন্তব্য করাও অসম্ভব। এখন শুধুই অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এবং এরই মধ্যে আমাদের নজরে আসা কিছু বিষয়ের নিরিখে কয়েকটি মন্তব্য করা সম্ভব।

আমরা জানতে পেরেছি যে এবারের বাজেটের মোট আকৃতি দাঁড়াবে এক লাখ নব্বই হাজার কোটি টাকার। বিদায়ী ২০১১-২০১২ অর্থ বছরের এক লাখ তেষট্টি হাজার কোটি টাকার বাজেটের তুলনায় এটি ১৭ শতাংশ বেশি। জানা গেছে, এর মধ্যে ৫৪ হাজার কোটি টাকা থাকবে উন্নয়ন বাজেটের জন্য। দেশের জনসাধারণের সার্বিক উন্নয়নই হচ্ছে জাতীয় বাজেটের লক্ষ্য। আর সে জন্যই প্রাধিকার অনুযায়ী খাতওয়ারী অর্থ বরাদ্দ করা হয়। বিশেষ বিশেষ ওই সব খাতের উন্নয়ন ও অন্যান্য ব্যয়ের জন্য আগে থেকেই প্রাক্কলিত (ESTIMATED) খরচ জানা থাকে।

বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিও প্রণয়ন করা হয়। আশা করা হয় যে, ওই কর্মসূচি অনুযায়ী অর্থবছর শেষ হবার আগেই সংশ্লিষ্ট সবাই ওই টাকা ব্যয় করে উন্নয়ন প্রকল্প কিংবা তার অংশবিশেষ বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু সংবাদপত্র পাঠকের মধ্যে অন্তত কেউ কেউ নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন যে, পরবর্তী বাজেট ঘোষণার মাত্র দু' এক মাস আগ পর্যন্ত মোট বরাদ্দের অধিকাংশ প্রায় অধিকাংশ উন্নয়ন প্রকল্পের বেলায়ই ব্যয় করা হয় না।

এটি দুয়েক বছরের ঘটনা নয়। বছরের পর বছর ধরেই চলে আসছে এই অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতা। এর জন্য কে বা কারা দায়ী তা নির্ণয় করা খুব মুশকিলের বিষয় নয়। কিন্তু এই অবস্থার লক্ষ্যণীয় কোনও পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে কী দাঁড়ায় আসুন এবার সেদিকে একটু তাকিয়ে দেখা যাক।

আমাদের অর্থবছর জুলাই থেকে জুন পর্যন্ত। প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তারা মে-জুন মাসে হঠাৎ যেন গা-ঝাড়া দিয়ে ওঠেন। অব্যবহৃত টাকা খরচের জন্য তখন হন্যে হয়ে প্রচুর অপচয় ঘটান সরকারি অর্থের। এ খবর এখন আর গোপন নেই।

এ তো গেল একদিকের কথা। অন্যদিকে বাজেট বরাদ্দ ব্যয়ের হিসেব কষেই উন্নয়নের হিসেব করা হয়। বরাদ্দের পুরো টাকাই যদি ব্যয় করা না হলো, কিংবা উন্নয়নের নামে অপচয় করা হলো, তাহলে প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধি (Estimated growth) কীভাবে সম্ভব? এই কঠোর বাস্তবতার প্রেক্ষিতে প্রতিবছর অধিকতর ব্যয়-বরাদ্দ, বৃহৎ থেকে বৃহত্তর বাজেট ও ক্রমবর্ধমান জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এক ধরনের প্রহসনে পরিণত হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী শুধু একা নন, কিংবা সামগ্রিকভাবে মন্ত্রিপরিষদও কেবল নয়; সংসদ, আমলাতন্ত্র ও রাজনীতিবিদদের এ ব্যাপারে অধিকতর সচেতন হতে হবে। হ্যাঁ, এসব ব্যর্থতা সত্ত্বেও অবশ্যই কিছু উন্নতি হচ্ছে, কিন্তু সে তো মাঠের কৃষক, কারখানার শ্রমিক আর প্রবাসী শ্রমিকদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিন-রাত পরিশ্রম করার ফসল হিসেবেই উঠছে আমাদের ঘরে।

২০১২ এবং ২০১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান দেশগুলো মোট জাতীয় আয়ের কী রূপ প্রবৃদ্ধি তার একটি প্রাক্কলন করেছে বিশ্বব্যাংক। সেটি এ রকম :

১। বাংলাদেশ ২০১২ সালে এটা ৬.০১ শতাংশ এবং ২০১৩ সালে ৬.৪ শতাংশ (৩.৬.২০১২ তারিখ উন্নীত করে তারা তখন বলছে এটি হবে ৬.৩%)।
২। ভারত– ৬.৫%– ৭.৭%
৩। নেপাল — ৩.৬% — ৪.০%
৪। পাকিস্তান — ৩.৯% — ৪.২%

বিশ্বব্যাংক প্রাক্কলিত তুলনামূলক এই চিত্রটি থেকে দেখা যাচ্ছে যে এই অঞ্চলে ভারতের পরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। পাকিস্তান ও নেপাল বাংলাদেশের তুলনায় বেশ অসুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।

এতে অবশ্য আত্মতুষ্টির খুব একটা অবকাশ নেই। অর্থনীতিবিদরা জানেন যে, ২০২১ সাল নাগাদ আমাদের স্বপ্নের 'মধ্যম আয়ের দেশে' পরিণত হতে হলে অর্থাৎ গড় মাথাপিছু আয় অন্তত ১৩০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে হলে জিডিপির বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৭.৫% – ৮% এর মধ্যে হতে হবে। সদ্য শেষ হতে যাওয়া অর্থবছরেও এই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭.০%। বিশ্বব্যাংক অবশ্য বলছে যে, এটা হবে ৬.৩%। আর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো দাবি করছে ৬.৩২%। পার্থক্যটা বিশাল নয়, তবে ৭% থেকে বেশ দূরে। ২০১২-১৩ বাজেটে এই প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭.৩%। এই লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবতাবর্জিত। উচ্চাকাক্সক্ষী কিংবা অনর্জনীয় নয় মোটেই, তবে বিশেষ কতগুলো বিষয় অর্জনের পথে প্রচন্ড বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা হচ্ছে।

বিদায়ী ২০১০-১১ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ যেখানে ছিল জিডিপির ১৯.৫%, ২০১১-১২ তে তা নেমে দাঁড়িয়েছে ১৯.১%। ক্রমবর্ধমান পেট্রোলিয়াম পণ্য আমদানির ওপর ভর্তুকি দেয়াসহ অন্যান্য অনেকগুলো কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে বিশাল ঋণগ্রহণ বেসরকারি খাতে প্রাপনীয় বিনিয়োগযোগ্য ঋণের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। নতুন বাজেটে ভর্তুকি উঠিয়ে দিলে কিংবা নিদেনপক্ষে বিশেষভাবে কমিয়ে দিলে হয়তো এই সংকটের পুনরাবৃত্তি হবে না। তবে গ্যাস-বিদ্যুতের তীব্র সংকট কোন জাদুবলে কয়েকমাসের মধ্যেই কাটিয়ে উঠে দেশের অবস্থা বিনিয়োগবান্ধব করে তোলা যাবে তা অর্থমন্ত্রীই ভালো জানেন।

ইউরো সংকটের কারণে ইউরোপে যে মন্দাভাব দেখা দিয়েছে, গ্রীসের সম্ভাব্য বহিস্কারে সেটা আরও তীব্র হতে পারে। ১৭ জুন গ্রীসের শেষ রাউন্ড নির্বাচনের পর এই অবস্থাটা অবশ্য পরিস্কার হয়ে যাবে। ইউরোপের মন্দা তীব্র হলে তার বিরূপ অভিঘাত বাংলাদেশের রফতানিসহ অন্যান্য সব দিকেই পড়বে।

ক্রমহ্রাসমান সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ দারুন উৎকণ্ঠার কারণ। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ অবকাঠামোর সার্বিক উন্নয়ন ও আত্মধ্বংসী রাজনীতি বন্ধ করা যাবে, আর এভাবে আগামী বছর বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে নাটকীয় কোনও মোড় নিবে এমন আশা করা সম্ভবত বাস্তবানুগ নয়। এসব কারণেই বাজেটের বাস্তবায়ন লক্ষ্য অনুযায়ী সম্ভব হবে এমনটি আশা করা ঠিক হবে বলে মনে হয় না। অর্থমন্ত্রী জাতির প্রয়োজন অনুযায়ী উন্নয়ন-ব্যয়ের প্রাধিকার ঠিক করে হিসেব কষে অর্থ-বরাদ্ধ দেখিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার প্রদর্শনসহ রঙিন একটি স্বপ্ন দেখাতে হয়তো সমর্থ হবেন। কিন্তু ঐ রঙিন স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অর্থপ্রাপ্তি, তা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার ও বার্ষিক উন্নয়ন প্রোগ্রাম তার অভীষ্টে পৌঁছে দিতে অতীতে পারেনি Ñ প্রায় কোনও অর্থমন্ত্রীর সময়ই এটা হয়নি। এখন কি তা সহজেই হয়ে যাবে?

সেটা হলে আমরাই খুশি হতাম সবচেয়ে বেশি। কিন্তু আমাদের আশঙ্কা অতীতের মতো এবারও উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না। তবে তার কতোটা কাছাকাছি পৌঁছানো যায় সেটিই হবে লক্ষ্য করার বিষয়।

উন্নয়নের লক্ষ্যে কিংবা সাধারণভাবে বাজেটের ব্যয় নির্বাহের জন্য শুধুই বেসরকারি বিনিয়োগ ও প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের কথা বলেছি। কিন্তু সরকারও উন্নয়ন কর্মকান্ডে এক সুবিশাল বিনিয়োগকারী। তবে আধুনিক সময়ে, বাজার অর্থনীতির জয়জয়কারের এই সময়ে সে বিনিয়োগ সাধারণত বাণিজ্যিক কিংবা শিল্পখাতে করা হয় না। সামাজিক ও ভৌত অবকাঠামো সৃষ্টিতে যে কোনও দেশে মূল ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে সরকারই। আমাদের দেশেও তাই করতে হচ্ছে এবং হবে। সরকার কয়েকটি উৎস থেকে এই তহবিল যোগাড় করে থাকে। এর প্রধানতম উৎস হচ্ছে কর এবং ডিউটি। তা আয়ের দপ্তর হচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।

আমাদের কর সংগ্রহ ব্যবস্থা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বিপুল সমালোচিত। দুর্নীতি, অদক্ষতা, প্রশিক্ষিত জনবলের অপ্রতুলতা ইত্যাদি কারণে কর রাজস্ব আয় আমাদের খুবই কম। কর ও জিডিপির অনুপাত আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও ১৫ কিংবা ১৬ অথবা তারও উপরে, অনেক বছর পর্যন্ত আমাদের ক্ষেত্রে কখনও ১০ ছাড়াতে পারিনি। গত তিন-চার বছরে গড়ে রাজস্ব বোর্ডের কর আদায়ের হার ১৮-১৯% হিসেবে বাড়ায় কর-জিডিপি অনুপাত এ বছর ১২ হবে হলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মনে করে।

বোর্ড অবশ্য আইনি ও অবকাঠামোগত সংস্কারে নিয়োজিত। আশা করা যাচ্ছে, আগামীতে এই অনুপাত আরও বৃদ্ধি পেয়ে সন্তোষজনক একটি অবস্থানে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। সর্বস্তরে দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যাপারে রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে তার কুফলও সর্বব্যাপী। রাজনীতিবিদদের এ দিকটিতে আন্তরিকভাবে মনোযোগ দেয়ার সময় অতি দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে।

আমরা কি উন্নত একটি দেশ হব, না ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হব তা শ্লোগান হিসেবে নয়, বিশ্বাসের অংশ হিসেবে মনে রাখতে হবে। উপরের দৃষ্টান্ত নিচের দিকে বেশি প্রভাব ফেলে। উপদেশ নয়, এই পুরনো কথাটা ক্ষমতাশালীরা মনে রাখলে সবচেয়ে ভালো।

আলী আহমদ : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাক্তন সদস্য।