নীরবে চলে গেলেন আমৃত্যু সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সামির আমিন!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 17 August 2018, 12:45 PM
Updated : 17 August 2018, 12:45 PM

চলতি শতকের অন্যতম সেরা চিন্তাবিদ, তাত্ত্বিক, দার্শনিক ও অ্যাক্টিভিস্ট সামির আমিন গত ১২ অগাস্ট, ২০১৮ প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেছেন। এমন একজন বিখ্যাত ব্যক্তির মহাপ্রয়াণের ঘটনাটি মূলধারার গণমাধ্যমে মোটেও গুরুত্ব পায়নি। জাতীয়-আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সামির আমিনের প্রয়াণের খবরটি প্রায় ব্ল্যাক আউট ছিল!

সংবাদপত্রগুলো কী সব ফালতু নিউজ দিয়ে পৃষ্ঠা ভরে রাখে। সেখানে এই তুখোর সংগ্রামী ব্যক্তিটিকে নিয়ে এক কলাম সংবাদ ছাপানোর গুরুত্ব কেউ অনুভব করল না কেন?

এখানেই গণমাধ্যমগুলোর 'চরিত্র' খুঁজে পাওয়া যায়। পুঁজি ও কালোটাকার মালিকদের স্বার্থসংরক্ষণকারী গণমাধ্যমগুলোর কাছে সামির আমিন কোনো দিনই গুরুত্ব পাননি। কারণ তিনি আমৃত্যু পুঁজিতন্ত্র ও কালোটাকার মালিকদের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। পুঁজিতন্ত্র কীভাবে নিপীড়িত মানুষকে শোষণ করে, নিঃস্ব করে তা তথ্য-উপাত্তসহ বর্ণনা করেছেন। এই পুঁজিতন্ত্রের অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভের দিশা বাতলেছেন। তাই পুঁজিতন্ত্রের দোসর গণমাধ্যমে সামির আমিন সব সময় ব্রাত্যই রয়ে গেছেন!

১৯৩১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তিনি মিসরীয় পিতার ঔরস ও ফ্রেঞ্চ মাতার গর্ভে কায়রোতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামাতা দুজনেই ছিলেন চিকিৎসক। বাল্যকালে মিসরের পোর্ট সৈয়দ শহরের স্কুলে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে ফ্রান্সের প্যারিসে রাজনীতিবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা এবং পরিসংখ্যান ও অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ফ্রান্সে অবস্থানকালে তিনি ফ্রেঞ্চ কমিউনিস্ট পার্টিতে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন যে আদর্শ ও মূল্যবোধ পরবর্তীকালে তাঁর বিভিন্ন লেখা এবং চিন্তায় দারুণভাবে প্রভাব ফেলে। প্যারিসের পড়াশোনা শেষে তিনি কায়রো ফিরে আসেন এবং একজন অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারক হিসেবে দেশে এবং বিদেশে ভূমিকা পালন করেন।

তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়ন নীতি পর্যালোচনার একটি বিশেষ ঘরানা হিসেবে তাঁর লেখালিখি এজি ফ্রাঙ্কসহ আরও অনেকের সঙ্গে 'ডিপেন্ডেন্সি থিওরি' নামে পরিচিত। তবে তিনিই এই তত্ত্বটিকে বিশিষ্ট করে তুলেছেন। ডিপেন্ডেন্সি থিওরি বা নির্ভরশীলতার তত্ত্ব দিয়ে তিনি মার্কসীয় অর্থনীতির একটি নবপাঠের সূচনা করেছিলেন। নির্ভরশীলতা তত্ত্বে তিনি দেখিয়েছেন পৃথিবী আসলে দুই ভাগে বিভক্ত, কেন্দ্র (কোর) এবং প্রান্ত (পেরিফেরি)। এই কোর এবং পেরিফেরির সম্পর্ক নির্ভরশীলতার। কোর দেশগুলো কাঁচামালের জন্য পেরিফেরির উপর নির্ভরশীল এবং পেরিফেরির দেশগুলো তৈরি মালপত্রের (ফিনিশড গুডস) জন্য কোর দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল। আরেকটা ব্যাপার হলো, এই নির্ভরশীলতার ফলে অসম বাণিজ্যের সৃষ্টি হয় এবং পুঁজিবাদী কাঠামোতে একটা চিরস্থায়ী বৈষম্য বিরাজ করে।

নির্ভরশীলতার তত্ত্বের এই অন্যতম প্রবক্তা ও অনুরাগীর মতে, তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নয়নের প্রধান কারণ দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শোষণ এবং শিল্পায়নের বাস্তব শর্তগুলোর ক্ষয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে 'অসম বিনিময়' ব্যবস্থা। অর্থাৎ উপনিবেশ ও অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদই এর প্রধান কারণ। এই অবস্থা থেকে উদ্ধার পাবার একমাত্র পথ হচ্ছে আন্তর্জাতিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার সঙ্গে সকল সম্পর্কের ছেদ ঘটানো।

খোদ মার্কসবাদীদের মধ্যে এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও তিনি এই তত্ত্ব নিয়েই এগিয়ে যান। সামির আমিন প্রথাগত মার্কসবাদী ধারার‍ মধ্যে থেকে উন্নয়ন নীতি, উন্নয়নের ইতিহাস, সমাজের অর্থনৈতিক গঠন ইত্যাদি নিয়ে বিস্তর লিখেছেন। তিনি বিশ্বজুড়ে মার্কসাদীদের প্রভাবিত করেছেন। নানা ভাবে অনুপ্রাণিত করেছেন।

কর্মজীবন ইউরোপ-আফ্রিকায় পরিব্যপ্ত হলেও নিজের জন্মভূমি ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক সংগ্রামের বিষয়গুলো নিপুণভাবে তুলে এনেছেন প্রায় পাঁচ যুগের পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কর্মে। বিশ্বব্যবস্থার নানা অনুষঙ্গে সামির আমিনের রাজনৈতিক সক্রিয়তা ও কর্মময় জীবন এক অনন্য দৃষ্টান্ত।

অনেকে মনে করেন, সামির আমিনের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা, পাশাপাশি রাজনৈতিক সংগ্রাম  তাঁকে 'ভাগ্যহত' করেছে। তিনি দুনিয়ার তাবৎ কিশোর-যুব-বিপ্লবীদের নিয়ে 'থার্ড ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল ফোরাম' নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। এই সংগঠনের মাধ্যমে তিনি সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন চেহারা উন্মোচন করে একটি সমতা-ন্যায্যতাভিত্তিক উদার সমাজতান্ত্রিক বিশ্বসমাজ গড়তে চেয়েছিলেন।

তিনি মার্ক্সবাদী হয়েও প্রথাগত সমাজতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার বাইরে চিন্তা করেছেন। নিজেকে 'সৃজনশীল মার্কসবাদী' হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। সঙ্গত কারণেই তিনি নাইট-স্যার উপাধি, বুকার বা নোবেল থেকে বঞ্চিত থেকেছেন। এমনকি তাঁর মৃত্যুর খবরটি প্রকাশের ব্যাপারেও সীমাহীন উদাসীনতা দেখিয়েছে সাম্রাজ্যবাদের পোষ্য গণমাধ্যমগুলো।

মার্ক্সবাদী চিন্তাধারা, মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের সম্পদ লুন্ঠন, বশংবদ শাসকদের দ্বারা সাধারণ মানুষের শোষণ বঞ্চনার ইতিহাসকে তিনি তিনি তথ্য-উপাত্ত-যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইউনিপোলার পৃথিবীর বিপরীতে একটি মাল্টিপোলার পৃথিবীতে বিশ্বাসী ছিলেন। সামির আমিন মনে করতেন যে নিওলিবারালিজমের তাত্ত্বিক ভিত্তি নাজুক অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। অবশ্য তার মানে এই নয় যে পুঁজিবাদ ভেঙ্গে পড়ছে। বরং পুঁজিবাদের বর্তমান অবস্থাটা আর থাকছে না এবং আমরা একটি নতুন ধাপে পদার্পণ করছি।

সামির আমিনের সবচেয়ে বড় অবদান হল ইউরোসেন্ট্রিজম ধারণার বিকাশ। ১৯৭০ এর দশকে ডিকলোনাইজেশন এবং পোস্ট কলোনিয়াল পৃথিবীর চিন্তাকাঠামো বদলে দেওয়ার জন্য এই শব্দটি সামনে নিয়ে আসেন। তিনি ইন্টারন্যাশনালাইজেশন তত্ত্বেরও প্রবক্তা।

সামির আমিনের সাড়া জাগানো গ্রন্থ 'ক্যাপিটালিজম ইন দ্য এজ অব গ্লোবালাইজেশান'-এ তিনি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চেহারা তুলে ধরেন। এই বইয়ে তিনি দেখিয়েছেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বব্যাপী একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের লক্ষে পাঁচটি সেক্টরকে তাদের মূল স্তম্ভ হিসাবে নির্ধারণ করেছে। এগুলো হচ্ছে: প্রযুক্তিগত আধিপত্য, বিশ্বব্যাপী পুঁজি বাজারের নিয়ন্ত্রণ, পৃথিবীর সকল প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আধিপত্য, গণমাধ্যম ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর আধিপত্য এবং গণবিধ্বংসী অস্ত্রের ওপর আধিপত্য।

এই পাঁচটি ক্ষেত্রে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য জারি রেখেছে, যদিও এই আধিপত্য সব ক্ষেত্রে যান্ত্রিকভাবে একই ধরনের নয়। বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ওই আধিপত্যের হেরফেরও ঘটে।

মার্কিন কর্পোরেশনগুলো-ধনবান রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে প্রযুক্তিগত আধিপত্য বিস্তার করে চলেছে। বিশেষ করে সামরিক খরচাপাতির ভেতর দিয়ে রাষ্ট্রের সাহায্য ও সহযোগিতা ছাড়া আধিপত্যের বলয়ের অধিকাংশই টিকে থাকতো না।

প্রযুক্তির পরে আসে বিশ্বব্যাপী পুঁজি বাজারের নিয়ন্ত্রণ। সামির আমিন এ-বলয়ের নাম দিয়েছেন অর্থের বাজারের আর্থিক নিয়ন্ত্রণ। বিশ্বব্যাপী লগ্নি-পুঁজির আনাগোনা বা আমদানি-রফতানি একচেটিয়া পুঁজিবাদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

আর এ-প্রবাহের ওপর প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য করছে মার্কিন কর্পোরেশনগুলোই। এখানে বলা দরকার যে, অর্থের বাজারকে গতিশীল করার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ভূমিকা আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে অনেক। প্রযুক্তির কারণেই আমরা লক্ষ করছি ভারচুয়াল শেয়ার বাজারের অভূতপূর্ব বিস্তৃতি। আর প্রযুক্তির কারণেই উদ্ভাবিত হয়েছে যাকে বলা হচ্ছে ইলেকট্রনিক। হ্যাঁ, ওই প্রযুক্তির কারণেই অভাবনীয় অংকের টাকা বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে স্থানান্তরিত হয় মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই। উড়ে-উড়ে ঘুরে-বেড়ানো এবং জুড়ে-বসা পুঁজির আরেক নাম ওই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদই। আর এই পুঁজির দুনিয়া-সফরকে অবাধ করার ক্ষেত্রের সহায়কের ভূমিকায় থাকে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো-ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, আইএমএফ এবং ডাব্লিউটিও।

পুঁজি বাজারের নিয়ন্ত্রণের পরেই আসে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর আধিপত্যের বিষয়টি। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদ শোষণ ও লুণ্ঠন করার ক্ষেত্রেও ওই মার্কিন কর্পোরেশনগুলো (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তির সহযোগিতায়) সবচাইতে এগিয়ে আছে। এখানেও কোনো জাতি-রাষ্ট্রের সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে এমনকি জাতি-রাষ্ট্রের বিভিন্ন দমনমূলক হাতিয়ার (যেমন সেনাবাহিনী) ব্যবহার করা ছাড়া পুঁজিবাদী কর্পোরেশনগুলো তৃতীয় বিশ্বের প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে পারে না। অসংখ্য উদাহরণ দেয়া সম্ভব। তবে একটি পুরাতন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ এখানে উপস্থিত করা যায়। নাইজেরিয়ার কথাই ধরা যাক। এই দেশের তেলসম্পদের প্রায় অর্ধেকটা চলে যায় ইঙ্গ-ডাচ কোম্পানি শেল-এর কাছে আর বাকি অর্ধেকের বেশিটা নিয়ে নেয় মার্কিন কোম্পানি শেভরন। সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ যেমন মানুষকে নির্দ্বিধায় হত্যা করে, কর্পোরেট পুঁজির প্রাকৃতিক সম্পদ লুটপাটও ভূমি এবং পরিবেশকে ধ্বংস করার ভেতর দিয়েই মানুষকে হত্যা করে।

কর্পোরেট পুঁজির একচেটিয়া আধিপত্যের আরেকটি বলয় হচ্ছে গণমাধ্যম ও যোগাযোগের বলয়। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যুগে আজ পৃথিবীর সবচাইতে বড়ো গণমাধ্যমগুলোর স্বত্বাধিকারী হচ্ছে গুটিকয়েক কর্পোরেশন। বর্তমান বিশ্বের মিডিয়া-সাম্রাজ্যবাদ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দিক থেকে একচেটিয়া কর্পোরেট পুঁজির সাম্প্রতিকতম স্তর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু মিডিয়া-সাম্রাজ্যবাদ কেবল রাজনৈতিক অর্থনীতির বিষয় নয়; তা সাংস্কৃতিকও বটে। প্রকৃতপক্ষে মিডিয়া-সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্যবাদী সংস্কৃতির উৎপাদন-বিনিময়-ভোগ-বন্টনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। মার্কিন মিডিয়া-সংস্থাগুলো ব্যবসায় করার পাশাপাশি এবং ব্যবসার স্বার্থেই বাজারের মতাদর্শ ও পুঁজিবাদী মূল্যবোধ বিভিন্নভাবেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে থাকে।

একচেটিয়া আধিপত্যের আরেকটি বলয় হচ্ছে গণবিধ্বংসী যুদ্ধাস্ত্র। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বর্তমান সময়ে যেমন, পুঁজিবাদের আগের পর্বেও তেমনি স্পষ্টভাবেই প্রমাণিত হয়েছে যে, অস্ত্রের বিষয়টি একই সঙ্গে সামরিক ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তাৎপর্য বহন করে।

যেখানেই যুদ্ধ, সেখানেই তো অস্ত্রের ব্যবসায় জমে ওঠে। আর যুদ্ধ কেবল অস্ত্রের ব্যবসায়কেই আকৃষ্ট ও ত্বরান্বিত করে না; তা একই সঙ্গে যুদ্ধকালীন পণ্যের উৎপাদন-বিতরণ-বিনিময়-ভোগের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াকেও চালু রাখে। আর এভাবেই তো কর্পোরেশনগুলো মুনাফা লোটে। যুদ্ধের সঙ্গে পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সম্পর্ককে তিনি তত্ত্বায়িত করেছেন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই।

ধর্ম নিয়েও তিনি অনেক লেখা লিখেছেন। তাঁর ভাষায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যা চলছে, সেটি হচ্ছে 'রাজনৈতিক ইসলাম'। তবে ধর্ম নয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তন ও উত্তরণের রূপরেখাই ছিল তাঁর সকল লেখার মূলবিষয়বস্তু।

যে 'আরব বসন্ত' নিয়ে সারাবিশ্বে উচ্ছ্বাসের জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, সেই আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নিয়েও সামির আমিন গভীর সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। আরব বসন্তকে মধ্যপ্রাচ্যে বিদ্যমান সামাজিক-রাজনৈতিক অসন্তোষের বাস্তব প্রতিক্রিয়া হিসেবে গণ্য করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এই আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করবে বলে তিনি যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, পরবর্তীকালে সেটাকেই সত্য হতে দেখা গেছে।

প্রখর ধীসম্পন্ন অর্থনীতিবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক সামির আমিন মধ্যপ্রাচ্যসহ পশ্চিমা প্রেসক্রিপশনের গা ভাসিয়ে দেয়া তৃতীয় বিশ্বের তথাকথিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের নেপথ্যে পশ্চিমা কর্পোরেট মিডিয়ার মিথ্যে প্রচারণা এবং বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সার্টিফিকেট ও ফাঁপা বুলির স্বরূপ বার বার তুলে ধরেছেন।

সামির আমিনের লেখা প্রায় অর্ধশতাধিক গ্রন্থের অধিকাংশই ফরাসি ভাষায়। তবে তিনি কখনোই আরব ও মধ্যপ্রাচ্যের ঘটনাক্রম থেকে নিজের দৃষ্টিকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেননি। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক শোষণ, পশ্চিমা বিশ্বব্যবস্থা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহাসিক-রাজনৈতিক বিবর্তন ও পালাবদলের ইতিহাসকে তিনি নির্মোহভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করার পাশাপাশি উত্তরণের পথও বাতলে দিয়েছেন। সিরিয়ায় আগ্রাসন নিয়ে আমিনের মন্তব্য ছিল-

''রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে বিরোধিতা করে বিদেশি শক্তির সাহায্য নিয়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীর প্রকৃত সন্ত্রাস সমস্যার সমাধান নয়। এই প্রশ্নের উত্তর হল আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই ব্যবস্থাকে বাস্তবে পরিবর্তন করা। এটিই হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। এবং এটি একটি প্রশ্ন যা উত্থাপিত হয়েছে। আমরা জানি না, আমি জানি না, আমার মনে হয় কেউ জানে না কীভাবে বিষয়গুলো এগোবে: হয় সরকার, অথবা সরকারের ভিতরের লোকজন, তা বুঝবে এবং বাস্তব সংস্কারের দিকে অগ্রসর হবে, আলোচনার চেয়েও বেশি কিছু করে, জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাহায্যে শাসন ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যস্ত করে, অথবা বিস্ফোরণকে নিষ্ঠুরভাবে মোকাবিলা করার পথ ধরে রাখবে যা এখন পর্যন্ত করে চলেছে। তারা যদি এই পথে চলতে থাকে, এক সময়ে তারা পরাজিত হবে, কিন্তু তারা পরাজিত হবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উপকারের জন্য।''  

বৈশ্বিক পরিসরে তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে পরিচিত কাজের মধ্যে রয়েছে- অ্যাকুমুলেশন অন এ ওয়ার্ল্ড স্কেল, নিওকোলোনিয়ালিজম ইন ওয়েস্ট আফ্রিকা, আনইকুয়াল ডেভেলপমেন্ট, ইমপেরিয়ালিজম অ্যান্ড আনইকুয়াল ডেভেলপমেন্ট, দ্য আরব নেশন, দ্য ল অফ ভ্যালু অ্যান্ড হিস্টোরিক্যাল ম্যাটেরিয়ালিজম, ক্লাস অ্যান্ড নেশন, হিস্টোরিক্যালি অ্যান্ড কারেন্ট ক্রাইসিস, দ্য ফিউচার অব মাওইজম, ডিলিংকিং, ইউরোসেন্ট্রিজম এবং ক্যাপিটালিজম ইন দ্য এজ অব গ্লোবালাইজেশন। তিনি মার্কসীয় ধারার পত্রিকা মান্থলি রিভিয়্যুর একজন নিয়মিত লেখক ছিলেন। বর্তমান বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক সংকটগুলো বুঝতে এই বইগুলো অত্যন্ত সহায়ক।

সামির আমিন স্বপ্ন দেখেছিলেন, একটি সমাজতান্ত্রিক উদার গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদি সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার। পুঁজিবাদ নিয়ন্ত্রিত বৈশ্বিক রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এমন একটি সমাজ নির্মাণের প্রচেষ্টাকে অনেকে 'সোনার পাথরবাটি' বলতে পারেন। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব-সংকট থেকে মুক্তির যে যে পথ সামির আমিন দেখিয়েছেন, তার চেয়ে উন্নত, ভিন্ন কোনো পথ আমাদের সামনে আদৌ কি আছে?

পরিশেষে শ্রদ্ধা জানাই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী এই মহান ব্যক্তিকে!