অটল বিহারি : সাম্প্রদায়িকতাকে আড়াল করেছিলেন কৌশলে

গৌতম রায়
Published : 17 August 2018, 11:37 AM
Updated : 17 August 2018, 11:37 AM

সদ্য প্রয়াত অটল বিহারি বাজপেয়ী ছিলেন এক বর্ণময় রাজনৈতিক চরিত্রের মানুষ। মেধা, মননশীলতা, ধী শক্তি, সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী চেতনা, প্রবাহমান ভারতবর্ষের সমন্বয়ী ভাবধারার  সঙ্গে বৈপরিত্যের এক রহস্যপূর্ণ সহাবস্থানে অবস্থান করা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।

বিরোধী নেতা হিসেবেও তিনি যেমন বর্ণিল ছিল, তেমনই দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও ছিলেন রঙিন। ক্ষুরধার বাগ্মিতায় তিনি সমকালীন বহু গণ্যমান্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সমানভাবে পাল্লা দিয়ে গেছেন। তাঁর মননশীল বক্তৃতার অনুরাগী ছিলেন স্বয়ং পণ্ডিতত জওহরলাল নেহরু। শাসক শিবিরে অবস্থান করেও তাঁর বক্তৃতা ছিল অত্যন্ত মনোগ্রাহী। একটা কবিসত্তা তাঁর জীবনবোধের ভিতরে সব সময়েই জড়িয়ে ছিল। সেই কবি সত্তার সম্যক বিকাশেরই নাম রাজনীতিক অটল  বিহারি বাজপেয়ী। পরিশীলিত শব্দ উচ্চারণের ভিতর দিয়ে বিরোধী রাজনীতিকে অতিক্রম করে যাওয়ার একটা নিজস্ব স্টাইল ছিল তাঁর। সেই আঙ্গিকের ভিতরে ছিল না কোনো অসৌজন্যের প্রকাশ। ছিল না কোনো অসংসদীয় আচার আচরণ। তাই শত রাজনৈতিক বিরোধিতা স্বত্ত্বেও তিনি বিরোধী রাজনৈতিক শিবির থেকে যে ধরনের সম্ভ্রম নিজ গুণে আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন- এমনটা আজকের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না ই বলা যেতে পারে।

অটল বিহারির রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সংশ্রব তাঁকে তাঁর রাজনৈতিক মেধাকে সঙ্ঘীয় ভাবধারায় গড়ে দিয়েছিল। স্বয়ংসেবক হিসেবে অটলবিহারি তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। আরএসএস সংসর্গ থেকেই সঙ্ঘের তৎকালীন রাজনৈতিক সংগঠন ভারতীয় জনসঙ্ঘের সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল।

শ্যামা প্রসাদের শেষ কাশ্মীর যাত্রার যাত্রাপথের অনেকখানি অংশের সফর সঙ্গী ছিলেন অটল বিহারি। শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক চিন্তা অটল বিহারির রাজনৈতিক বোধ গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনেকখানি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল।

ভারতের জাতীয় আন্দোলনের যে জাতীয়তাবাদী ধারা, সেই ধারার সঙ্গে একটা পৃথক সম্পর্ক গড়ে তুলে জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রবাদে রূপান্তর করার রাজনৈতিক চেতনাই ছিল অটল বিহারির প্রজ্ঞার মূলমন্ত্র।

অটল বিহারি আরএসএস এর ভাবধারাতে সঞ্জীভুত হয়ে, জাতীয়তাকে রাষ্ট্রবাদে পরিণত করার ব্যাপারে চিন্তাধারায় উজ্জীবিত ছিলেন। গান্ধী-নেহরুর জাতীয়তাবাদের সাথে তার চিন্তার একটা আসমান জমিন ফারাক রয়েছে।

এই ফারাকটিকে অটলবিহারি তাঁর সুদীর্ঘ বর্ণময় রাজনৈতিক জীবনে অত্যন্ত যত্ন সহকারে লালন করে গিয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রবাদে রূপান্তরিত করে, সেই রাষ্ট্রবাদের সঙ্গে বাজপেয়ীজীর যাপনচিত্র আমাদের দেশের প্রবাহমান রাজনীতির গতিপ্রকৃতিকে ও অনেকাংশে প্রভাবিত করেছে। এই রাষ্ট্রবাদী চিন্তার নিগড়েই প্রবাহমান জাতীয়তাবাদের চেতনাকে একপাশে সরিয়ে রেখে প্রধানমন্ত্রীত্বের দীর্ঘ প্রায় সাড়ে ছয় বছর কাল সময় অনায়াসে যাপন করেছিলেন অটলবিহারি বাজপেয়ী।

তিন দফায় এনডিএ নামক একটি নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোটকে অটলবিহারি প্রায় সাড়ে ছয় বছর সময়কাল ধরে সাউথ ব্লকে টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন- তা কম বড়ো কৃতিত্ব দাবি করে না। গুজরাট গণহত্যার পর গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে 'রাজধর্ম' পালনের পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই সময়ে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বিরাজ করা অটলবিহারি বাজপেয়ী।

রাষ্ট্রবাদের নামে তাঁর এই আলঙ্কারিক নিরপেক্ষতা রাষ্ট্রের পক্ষে কতোখানি মঙ্গলদায়ক ছিল – তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও, এই আপ্তবাক্য উচ্চারণের ভিতর দিয়ে বাজপেয়ী নিজেকে অনেকখানি সমালোচনার উর্ধ্বে প্রতিস্থাপন করতে পেরেছিলেন। সময়ের নিরিখে এইভাবে সমালোচনার উর্ধ্বে একটা জাতীয় সঙ্কটকালে নিজেকে উপস্থাপিত করতে পারা রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কম উল্লেখযোগ্য বিষয় নয়।

যে সময়কালে অটলবিহারি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার নেন, সেটি জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির পটভূমিকায় যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দক্ষিণপন্থার বিকাশের সেই প্রাথমিক লগ্নে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ভাষা- ধর্ম- বর্ণ- শ্রেণি নির্বিশেষে সংখ্যালঘুর অধিকার যখন ক্রমেই সঙ্কুচিত হতে শুরু করেছে- তেমন একটি সময়কালে অটলবিহারি দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে অভিষিক্ত হন।

তাঁর আগে কমিউনিস্ট নেতা জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়ার একটি সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। সেই সম্ভাবনা যদি বাস্তবায়িত হতো, তাহলে অটলবিহারির প্রধানমন্ত্রিত্বের বাস্তবতার পরিবেশ ও কতোখানি রচিত হতো- সেই হাইপথিটিকাল আলোচনায় প্রবেশ না করেও বলতে হয়- সংখ্যালঘুর কন্ঠস্বরকে অবদমিত করবার ক্ষেত্রে অটলবিহারির শাসনকাল চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

বিতর্কের কেন্দ্র বিন্দু থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে বিশুদ্ধ রাজনীতি চর্চার ভিতর দিয়ে নিজের রাজনৈতিক জীবনকে অতিবাহিত করবার একটা নিজস্ব আঙ্গিক জানতেন বাজপেয়ী।

ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংস ঘিরে আরএসএস বা তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে ঘিরে জোরদার বিতর্ক। বিতর্ক ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসেরকালের বেশিরভাগ বিজেপি নেতাদের ঘিরে। এই বিতর্কের শুরুর শুরু হলো বাজপেয়ীর অভিন্ন হৃদয়বন্ধু তথা একাধিকবার বিজেপির সভাপতির দায়িত্বপালন করা 'রথযাত্রা' খ্যাত লালকৃষ্ণ আডবাণীকে নিয়ে। অথচ ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাক্রমে তেমনভাবে আর দশজন আরএসএস- বিজেপি নেতার মতো আলোচিত হয় না অটলবিহারির নাম। মসজিদ ধ্বংসেরকালে ঘটনাস্থল থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে গিয়ে গিয়ে নিজেকে ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায় থেকে খানিকটা হলেও দূরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন বাজপেয়ী। এই রাজনৈতিক দূরদর্শিতা অটলবিহারি বাজপেয়ীর সামগ্রিক রাজনৈতিক জীবনে একটা খুব বড়ো রকমের 'টিআরপি'।এই 'টিআরপি'র জের বাজপেয়ীর গোটা রাজনৈতিক জীবনেই খুব ভালোভাবে ছিল।

অটলবিহারির তিন দফায় প্রায় সাড়ে ছয় বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বকালে তাঁর দল বিজেপির কখনোই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। তাই এনডিএ নামক নীতিবিহীন সুবিধাবাদী জোটের মাধ্যমে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বহু কৌশল অটলবিহারিকে বিভিন্ন সময়ে অবলম্বন করতে হয়েছে। সেইসব কৌশলগুলি অবলম্বনের ক্ষেত্রে দেশের প্রথম আরএসএসের স্বয়ংসেবক প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারিকে সঙ্ঘের নীতির প্রয়োগ ও রূপায়নের ক্ষেত্রে অনেক সংযমী হতে হয়েছে। তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্ব কালেই আমরা দেখেছি আরএসএসের নীতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে অটলজীর সতীর্থ লালকৃষ্ণ আডবাণীর নানা ধরনের অধৈর্য এবং উগ্রতা। পক্ষান্তরে সঙ্ঘের  আদর্শের প্রতি অবিচল আস্থা রেখে ও কোনো রকম উগ্রতার প্রকাশ না ঘটিয়ে সঙ্ঘের ভাবাদর্শের প্রচারে যে ভূমিকা পালন করে গিয়েছেন অটলবিহারি, তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বকালে রাজনীতির প্রেক্ষিতে তা যথেষ্টই অর্থবহ।

অটলবিহারির প্রধানমন্ত্রিত্বকালেই গুজরাট গণহত্যার মতো নারকীয় ঘটনা ঘটে। সেই সময়ে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে যে রাজধর্ম পালনের পরামর্শ দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন বাজপেয়ী – তা তাঁর পক্ষে কতোখানি রাজধর্ম পালনের অনুকূল হয়েছিল- এই প্রশ্ন কিন্তু শেষপর্যন্ত থেকেই যায়।

গুজরাটে গণহত্যার কালে যা ঘটেছিল, তাকে কেবলমাত্র রাজ্যগত ব্যাপার বলে এড়িয়ে যাওয়া কতোখানি যুক্তিসঙ্গত হয়েছিল তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে? গুজরাট গণহত্যা- জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতবর্ষের মর্যাদাকে যেভাবে ধুলোর সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল , তাকে রক্ষা করতে কি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অটলবিহারি বাজপেয়ী আদৌ কোনো দৃঢ় অবস্থান নিতে পারতেন না? গুজরাটের ঘটনাবলী আন্তর্জাতিক স্তরে তাঁর মাতা নিচু করে দিয়েছে- প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসে এই কথা অনেকবারই বাজপেয়ী প্রকাশ্যে বলেছিলেন। কিন্তু সেই নিচু মাথাকে আবার উঁচু করবার জন্যে তিনি আদৌ কোনো প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেন নি।

গুজরাট গণহত্যাকালে কেন্দ্রীয় সরকার যদি প্রকৃতপক্ষে কোনো দৃঢ় অবস্থান নিতেন- তাহলে ভারতবর্ষকে এতোখানি মর্যাদাকর অবস্থার ভিতরে পড়তে হতো না। সংখ্যালঘুর স্বার্থরক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে যদি বাজপেয়ী সরকার যথাযথ ভূমিকা তাঁদের দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছরের শাসনকালে পালন করতেন- তাহলেও হয়তো আজকের ভারতবর্ষে ধর্মীয়, ভাষাগত, শ্রেণি-বর্ণগত সংখ্যালঘুকে এতোখানি প্রান্তিক পরিস্থিতির ভিতরে পড়তে হতো না।

বাজপেয়ী একটা নরম হিন্দুত্বের তথাকথিত আবরণ রাখলেও তিনি কোনোদিন কোনো অবস্থাতেই আরএসএসের নির্দেশিকার বাইরে একটিও পদক্ষেপ ফেলেন নি। আরএসএসের প্রতি অটলবিহারির আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। সেই আনুগত্যকে তিনি কি বিরোধী নেতা হিসেবে, কি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে- সব সময়েই অত্যন্ত জোরালোভাবে পালন করে গিয়েছিলেন। জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতাতেও তিনি সঙ্ঘের রাজনীতিকে একটি মুহূর্তের জন্যেও ভুলে থাকতে পারেন নি।

সঙ্ঘের প্রতি তাঁর  এই সীমাহীন আনুগত্য একদিকে যেমন বাজপেয়ীর গ্রহণযোগ্যতা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পরিমণ্ডলে প্রশ্নাতীত করেছে , তেমন ই বাজপেয়ীর সবার উপরে আরএসএসের দর্শনের পটভূমিকে ঠাঁই দেওয়ার বিষয়টিকে তাঁকে ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের কাছে প্রচণ্ড পরিমানেই বিতর্কিত করেছে।বিতর্কিত হলেও সেই বিতর্কের মোকাবিলার মতো রাজনৈতিক পারদর্শিতা বাজপেয়ীর চিরদিনই ছিল।

ভারতের জাতীয় আন্দোলনে তাঁর ভূমিকাকে ঘিরে জোরদার বিতর্ক আছে। অতীতের যুক্তপ্রদেশ তথা আজকের উত্তরপ্রদেশের বটেশ্বর থানায় দেওয়া তাঁর স্বীকারোক্তি ঘিরে মারাত্মক রাজনৈতিক 'চাপান উতোর' আছে। জাতীয় আন্দোলনে বাজপেয়ী তাঁর এই নেতিবাচক ভূমিকা নিয়ে পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে আদৌ কোনো মন্তব্য না করলেও, প্রচার মাধ্যম এই ইস্যুটিকে নিয়ে তাঁকে কোনোদিন ছেড়ে কথা বলেনি। বস্তুত জাতীয় আন্দোলনে আর দশটা হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক নেতৃত্বের যেমন ভূমিকা, বাজপেয়ীর ভূমিকা তার থেকে কোনো আলাদা ছিল না। ফলে জাতীয় আন্দোলনের পর্যায়গুলি নিয়ে নিজের রাজনৈতিক জীবনে বাজপেয়ী স্বয়ং খুব একটা সোচ্চার আদৌ ছিলেন না। সেই নীরবতা তাঁর রাজনৈতিক পরিপক্কতারই একটা উৎকৃষ্ট উদাহরণ।