ঘাতকরা নাকি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চায়নি!

Published : 14 August 2018, 02:31 PM
Updated : 14 August 2018, 02:31 PM

কিছুদিন আগে একজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কথা হচ্ছিল উনি একজন আওয়ামী লীগ নেতাও। কথা প্রসঙ্গে উনি জানালেন খুনিরা নাকি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চায়নি, পরিস্থিতির আকস্মিকতায় এটা ঘটেছে। যারা মনে এমন ধারণা পোষণ করে তারা বোকার স্বর্গেই বাস করেন। এখন পর্যন্ত সকল পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে যা পাওয়া যায়, তাতে এটা স্ফটিকস্বচ্ছ যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।

এখানে জড়িত ছিল আমলা, কুচক্রী রাজনীতিবিদ, সামরিক আমলা, অসাধু ব্যবসায়ী, আর জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এর বহু প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যাবে। এখানে চীনের সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে তার কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তারা সমর্থন দেয়নি। চীনের মতো একটা পরাশক্তির জন্য এটা ছিল আত্মসম্মানের উপর মারাত্মক আঘাত যে বাংলাদেশ তাদের বিরোধিতা সত্ত্বেও স্বাধীন হয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে, পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের চীনের সঙ্গে দ্বৈত নীতির কারণে মারাত্মক বিরোধ থাকলেও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলার সময়ে তাদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিরোধিতায়। আরও অনেক কারণ ও উদাহরণ আছে যা একটা নিবন্ধে পুরোপুরি উল্লেখ করে সম্ভব না।

আমরা সচরাচর বলে থাকি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড। আসলে কী এটা শুধু বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ছিল? আমার তা মনে হয় না, এই হত্যাকাণ্ড ছিল একটা শিশু রাষ্ট্রের নীতি আদর্শকে তথা বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে। এই হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল প্রগতিশীল বাংলাদেশকে হত্যা করে প্রতিক্রিয়াশীল বাংলাদেশ গঠনের উদ্দেশ্য। পাকিস্তানি আদলে একটা দেশ তৈরির উদ্দেশ্য। মূলত মুজিব দর্শন এবং বাংলাদেশকে হত্যার উদ্দেশ্যেই সেদিনের হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছিল। যেখানে প্রাণ দিয়েছিলেন প্রায় ২৫/২৬জন। মোটকথা যারা বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শকে দাবিয়ে রাখা যেত না তাদের কাউকেই সেদিন ছাড় দেয়নি খুনিচক্র এবং হত্যা পরিকল্পনাকারীরা।

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী লিখেছেন, "বঙ্গবন্ধু বললেন: বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়ায় ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে গেছে। এই বাস্তবতা নিক্সন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন মেনে নিতে পারছেনা। তারা চেয়েছিল পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে মিলিতভাবে তারা ভারত মহাসাগরে নৌঘাঁটি স্থাপন ও ভারতে সোভিয়েত প্রভাব হ্রাসে ব্যবহার করবে। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন মিলিত ভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা লাভে সাহায্য করায় তাদের এই পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে গেছে। পাকিস্তানের সাথে জয় লাভ করায় ভারত এশিয়ার সাব-সুপার পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। এটা আমেরিকা চীন কারোরই মনঃপূত না। পরাজিত ও দুর্বল পাকিস্তানকে দিয়ে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। এজন্য চীনকে সঙ্গে টানা হয়েছে। অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরে ডানপন্থী ও সাম্প্রদায়িক দলগুলোকে সাহায্য জুগিয়ে ইন্দিরা সরকারকে অপসারণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।" [তথ্যসূত্রঃ ইতিহাসের রক্ত পলাশ : পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর – আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী]

বঙ্গবন্ধুর কথা থেকে বোঝা যায় উনি নিজেও জানতেন উনার সরকারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত চলছে। জার্মানির ফুর্থে জন্মগ্রহনকারি পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তো লেগেই ছিল। এই নরকের কীটটা এখন আবার জার্মানির ফুর্থেই থাকে বলে জানি। ঠিক আমার পাশের শহরে অর্থাৎ নুরেনবার্গের পাশে।

১০ অগাস্ট এক বক্তৃতায় শাহরিয়ার কবির বলেছেন, "বঙ্গবন্ধুর চেতনা বলতে আমরা বুঝি তাঁর চার নীতিকে। আর এই চেতনার জন্যই তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে ইতিহাস থেকে তাঁর চেতনাকে মুছে ফেলা যেত না, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও মুছে ফেলা যেত না। বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার শুরু করেছিলেন সে বিচার বন্ধ করা যেত না এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে তো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশোধ নেয়া যেত না।"

"দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে যখন বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়ন করেন তখন জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা এই চারটি মূলনীতি ছিল। এই চারনীতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু অসংখ্যবার বলেছেন, আমরা শুধু একটি ভূখণ্ড বা পতাকার জন্য যুদ্ধ করিনি বরং কতগুলো মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুদ্ধ করেছি।"

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বদেশে পথে দিল্লীতে যাত্রা বিরতিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর সম্মানে এক বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। এই সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধী- উভয়ের বক্তব্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। সংক্ষিপ্ত এক বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মহান বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জনগণের উদ্দেশে বলেছিলেন- আমি আপনাদের তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আমার প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল, বাংলাদেশের শরণার্থীদের আমি সসম্মানে ফেরত পাঠাব। আমার দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে আমি সবরকম সহযোগিতা করব। আমার তৃতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল শেখ মুজিবকে আমি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের করে আনব। আমি আমার তিনটি প্রতিশ্রুতিই পূরণ করেছি। শেখ সাহেব তাঁর দেশের জনগণকে একটিই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দেবেন। তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্যে বলেছিলেন, আমাকে বলা হয়েছে ভারতের সঙ্গে আপনার কিসের এতো মিল? আমি বলেছি ভারতের সঙ্গে আমার মিল হচ্ছে নীতির মিল। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায়। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীও তাই বিশ্বাস করেন। আমাদের এই মিল হচ্ছে আদর্শের মিল, বিশ্বশান্তির জন্য।

সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু একই দিনে দেশে ফিরে রমনার বিশাল জনসমুদ্রে আবারও বলেছিলেন, 'বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনও ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।' এদিন তিনি তার ভাষণে ধর্ম নিরপেক্ষতার ওপর বেশি জোর দেন।

৭২-এর সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ধর্মপালন ও প্রচারের অবাধ স্বাধীনতা ছিল। বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর মুসলমানপ্রধান দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শের এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

বঙ্গবন্ধুর এই নীতি আদর্শ ভারতের সঙ্গে তাঁর আদর্শিক মিল ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সব কিছুই সেদিন বঙ্গবন্ধুর শত্রুদেরকে তটস্থ করে তুলেছিল। আর এই নীতি আদর্শই কাল হয়ে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু ডেকে এনেছিল। সেদিন থেকেই আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় ষড়যন্ত্রকারীরা তৎপর হয়ে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষ নীতি অবলম্বন করায় মধ্যপ্রাচ্য বঙ্গবন্ধুর উপর ক্ষেপে ছিল।  যেহেতু মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল সে ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পেছনে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বাভাবিক না। তুরস্কও বঙ্গবন্ধুর বিপক্ষে আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রচারনা চালিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে। ১৯৭১ এ পাকিস্তানকে অস্ত্র সাহায্য দিয়েছে তুরস্ক। বর্তমান অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের স্মৃতি অম্লান বইয়ে সে ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে। তুরস্কের বর্তমান কার্যকলাপও লজ্জাজনকভাবে বাংলাদেশের বিপক্ষে।

তারা জানত বঙ্গবন্ধুকে বাঁচিয়ে রেখে কোনওভাবেই তার আদর্শকে দমন করা যাবে না এই কারণেই তাদের উদ্দেশ্য ছিল সুনির্দিষ্টভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা এবং পরবর্তীতে যারা তার নীতি আদর্শকে বাস্তবায়ন করতে পারে এরকম সবাইকেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া এবং সেই কাজটাই সুচারুভাবে করেছে আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় খুনি চক্র মিলে।

আমার এই মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু হয়ত বলবেন বেগম ফজিলাতুন্নেছাকে মেরে তাদের কী লাভ ছিল! ঘাতকদের তালিকায় বঙ্গবন্ধুর পরেই উনার নামটা ছিল। কারণ বেগম মুজিব শুধু একজন গৃহবধূ ছিলেন না রাজনীতিতে যথেষ্ট পরিপক্ক ছিলেন, বঙ্গবন্ধু যখন জেলে ছিলেন তখন বিভিন্ন সময় উনি দলীয় নেতাদের সঙ্গে বসে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন এর প্রমাণ মেলে একটা ভিডিওচিত্রে। যারা ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাৎকারটা দেখেছেন তারা দেখে থাকবেন প্রমাণটা।

৮ অগাস্ট ২০১৭ সালে বঙ্গজননী শেখ ফজিলাতুন্নেছার জন্মদিনে স্মৃতিচারণে তাঁর সুযোগ্য কন্যা বর্তমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, "শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিবের মতো সাথী পেয়েছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার সংগ্রাম আর মুক্তিযুদ্ধে সফল হতে পেরেছিলেন। তিনি বলেন, শেখ ফজিলাতুন্নেসা এতসব অবদান জানতে পেরেই সম্ভবত ঘাতকরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল।"

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভয়েস অব আমেরিকার সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বলেন, ৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ৭ই মার্চ বক্তৃতার বিষয় নিয়ে বিস্তারিত কথা বলেছিলেন।  বঙ্গবন্ধু যখন এক তরফা স্বাধীনতার ঘোষণা (Unilateral Declaration of Independence) এর ধারণাটা পরিবারের সদস্যদের সামনে উপস্থাপন করলেন, তখন মহীয়সী বেগম ফজিলাতুন্নেসা বললেন, 'না, এটা তুমি করতে পারবে না। ছয় দফার মধ্যে দিয়ে তুমি বাঙালি হৃদয়ে যে স্থায়ী আসন বানিয়েছ, তোমার এ ঘোষণা তাদের কি ক্ষতির সম্মুখীন করবে-ভেবে দেখেছ? পাকিস্তানি আর্মি ওঁৎ পেতে বসে আছে তোমার এ ঘোষণার জন্য। ওরা এক তরফা স্বাধীনতার ঘোষণা শুনে তোমাকে তো মারবেই, তোমার প্রিয় বাঙালি জাতিকেও  শেষ করে দেবে।'

বেগম মুজিবের কথা শুনে বঙ্গবন্ধু নাকি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে পাইপ ধরালেন। তখনই তিনি একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণার ধারণা থেকে সরে এলেন। ভয়েস অব আমেরিকার সাথে শেখ হাসিনার সেদিনের স্মৃতিচারণা থেকে এ বিষয়টি নতুন করে বেরিয়ে এসেছে।

বেগম মুজিব না থাকলে শেখ মুজিব আজকের 'মহামানব মুজিব' হয়ে উঠতেন কি না, সন্দেহ। বেগম মুজিবের অনেক সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধু বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নিতেন। রাজনীতিবিদের সঙ্গে সংসার করতে করতে তিনি নিজেও পাকা রাজনীতিবিদ হয়ে উঠেছিলেন। এজন্যই ১৫ অগাস্ট উনাকে জীবন দিতে হয়েছে।

মোট কথা সেদিন যাঁদেরকে হত্যা করা হয়েছে প্রায় প্রত্যেকেই খুনিদের তালিকায় ছিলেন দু'একজন ছাড়া।  যাঁদের সেদিন খুন করা হয়েছে এরা বেঁচে থাকলে পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শ নিয়ে কাজ করতে পারত এইজন্যই তাদেরকে বাঁচতে দেয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধুর ভাই বলেছিলেন, "আমাকে কেন মারবেন আমি তো রাজনীতি করি না আমি ব্যবসা বাণিজ্য করে খাই।" কিন্তু তাঁকেও কোন ছাড় দেওয়া হয়নি, ছাড় দেওয়া হয়নি বঙ্গবন্ধুর শিশুপুত্র রাসেলকেও। খুনিদের ভয় ছিল বঙ্গবন্ধুর রক্ত ও তাঁর বংশধর নিয়ে আর বঙ্গবন্ধুর অনুসারী আত্মীয়-স্বজন এদের নিয়ে। তাঁদের কেউ বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে  সমস্যা হবে। এইজন্য শেখ মনি, আবদুর রব সেরনিয়াবত- কেউই রক্ষা পাননি এমনকি শেখ মনির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীও না। একই কারণে বঙ্গবন্ধুর দুই অন্তঃসত্ত্বা দুই পুত্রবধূকেও হত্যা করা হয়েছিল সেদিন। কারণ তারা বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে সন্তান প্রসব করলে এই সন্তানেরাও একদিন বঙ্গবন্ধুর আদর্শ নিয়ে কাজ করবে। এই ভয়েই তারা সেদিন তাঁদেরকে রেহাই দেয়নি যদিও তাঁদের কোন রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছিল না।

চার জাতীয় নেতা এঁরাও খুনিদের তালিকায় প্রথম থেকেই ছিলেন কিন্তু ১৫ অগাস্টে তাদেরকে হত্যা করা হয়নি অন্য কারণে, না হলে তাদেরকেও সেদিন ছাড় দেয়া হতো না। আপনারা ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারের কথা নিশ্চয় মনে করতে পারেন। সেখানে ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন-

ডেভিড ফ্রস্ট: তারা বলে, আপনি জানেন, আপনার মহান ক্ষমতা আছে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবার। আবার সেই পুরানো কথা- 'ক্ষমতা কলুষিত করে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা কলুষিত করে নিরঙ্কুশভাবে।' আপনি কীভাবে বন্ধ করবেন ক্ষমতার দূষণ?

শেখ মুজিবুর: আপনি জানেন যে যদি ইয়াহিয়ার মত একজন মানুষ দুর্ঘটনাক্রমে ক্ষমতায় আসে সে কলুষিত হতে পারে, কিন্তু যদি একজন মানুষ একটা পদ্ধতির মধ্য দিয়ে, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে, ভোগান্তির মধ্যে দিয়ে, লড়াই/যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে তাঁকে আপনি যত ক্ষমতায় দেন না কেন সে কলুষিত হবেনা। যতদূর পর্যন্ত আমার দল ও আমি নজরে রেখেছি, আমার সব নেতারা জেল খেটেছে, আমার সব নেতারা তাঁদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে, তাঁদের অনেকেই তাঁদের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছে। ২৪ বছর পর তাঁরা ক্ষমতা পেয়েছে। তাঁরা যদি নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পায়, দুর্নীতির কোনও সুযোগ সেখানে নেই, কারণ তারা একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসেছে। ইয়াহিয়া খান এবং অন্যান্যদের মত যারা, বর্বর বাহিনী এবং বন্দুকের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসেছে, তাদের মত না। আমার জনগোষ্ঠি বন্দুক দিয়ে ক্ষমতায় আসেনি। কিন্তু একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসেছে, একটা সংগ্রামের মাধ্যমে; শুধু তাই না, অনেক কিছু উৎসর্গ/বলিদান করেই তাঁরা স্বাধীনতা অর্জন করেছে এবং তাঁদের দেশের জন্য ও জনগনের জন্য ভালবাসা আছে। আমার নেতাদের উপর এবং আমার দলীয় কর্মীদের উপর আমার আস্থা আছে।

উপরের এই কথাগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসবিদরা মনে না রাখলেও খুনিরা মনে রেখে ছিল এবং তারা জানত যে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ অনুসারীরা তাদের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।  আপনারা জানেন বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার ২১ জন সদস্য খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েছিল। চার জাতীয় নেতার ক্ষেত্রে খুনিরা চেষ্টা করেছিল তাদেরকে চাপের মুখে রেখে, ভয় দেখিয়ে লোভ দেখিয়ে মোস্তাকের মন্ত্রিসভায় নিয়ে আসতে বা সে সরকারকে সমর্থন দিতে, কিন্তু তারা সফল হয়নি। তখন হত্যা পরিকল্পনাকারীরা খুনিদের দিয়ে তেসরা নভেম্বর চার জাতীয় নেতাকে জেলের মধ্যে হত্যা করায়।

শুধু চার জাতীয় নেতার মধ্যে নয় বঙ্গবন্ধুর পর হত্যা পরিকল্পনাকারীদের প্রথম লক্ষ্য ছিল তাজউদ্দিন আহমেদ নিচের কথাগুলোতে তার প্রমাণ পাবেনঃ

"১৯৭১ সালে মুজিব ইয়াহিয়ার বৈঠকের রুদ্ধশ্বাস দিনগুলোর কথা। ভুট্টো এসেছেন ঢাকায়। আমরা কজন সাংবাদিক তাঁর সাথে দেখা করার অনুমতি পেয়েছি। আমাদের বেশি কিছু বলতে চাইলেন না। আমাদের উপস্থিতি ভুলে গিয়ে তাঁর এক সহকর্মীকে উর্দুতে বলে উঠলেন: আলোচনা বৈঠকে আমি মুজিবকে ভয় পাইনা। ইমোশনাল অ্যাপ্রোচে মুজিবকে কাবু করা যায়। কিন্তু তাঁর পিছনে ফাইল-বগলে চুপচাপ যে 'নটোরিয়াস' লোকটি দাঁড়িয়ে থাকে তাকে কাবু করা শক্ত। দিস তাজউদ্দীন, আই টেল ইউ, উইল মাইট বি ইউর মেইন প্রবলেম।

আমি সঙ্গে সঙ্গে কথাটি নোট বুকে টুকে নিলাম। তখন বুঝতে পারিনি, কথাটি একদিন কত বড় ঐতিহাসিক সত্য হয়ে দাঁড়াবে।" [তথ্যসূত্রঃ ইতিহাসের রক্ত পলাশ : পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর – আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ]

তাজউদ্দীন আহমেদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহযোগী। তিনি ছাড়া বাংলাদেশের সৃষ্টি হত কিনা ভেবে দেখার বিষয়। কিন্তু তিনি কখনই বঙ্গবন্ধুকে ছাড়িয়ে নেতা হতে চাননি। ছায়ার মত বঙ্গবন্ধুর সাথে থেকে কাজ করে গেছেন। তাজউদ্দীন কে পাকিস্তানি শাসকেরাও ভয় পেতেন।

এরপর হত্যা পরিকল্পনাকারীদের পালের গোদা জুলফিকার আলী ভুট্টো তাজউদ্দীন আহমেদকে ভোলেনি। সে তার বাংলাদেশি এবং আন্তর্জাতিক চর দিয়ে প্রতিশোধটা ঠিকই নিয়েছে।

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ১৫ অগাস্ট যারা সরাসরি খুনে অংশ নিয়েছিল তাদের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেখানে খুনিদের স্বীকারোক্তি এখানে উদ্ধৃত হল-

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস: তোমরা মুজিবকে শোধরানোর জন্য চেষ্টা করেছিলে কিনা?

রশিদ: না, আমি কোনও চেষ্টা করিনি। কারণ আমি ছিলাম সেনাবাহিনীর জুনিয়র কর্মকর্তা আমার কোনও সুযোগ ছিল না তাকে সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার কথা বলা।

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস: এই পরিস্থিতিতে তুমি কি তাঁকে পদত্যাগ করতে বলতে পারতে না? নাকি এটা খুব জরুরি ছিল তাঁকে হত্যা করা?

রশিদ: তিনি ছিলেন সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দু।  তিনি একজন প্রশাসক ছিলেন না। তার চমৎকার ক্ষমতা ছিল জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার। তিনি জীবিত থাকলে আমাদের পক্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন হতো। কেননা তিনি ছিলেন অনেক অভিজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করতেন না।

অ্যান্থনি মাসকারেনহাস: এই কারণেই কি তোমরা তাঁকে হত্যা কর?

রশিদ: হ্যাঁ, এ কারণেই তাকে হত্যা করি। আমার তাকে মারতেই হত।

আব্দুল গাফফার চৌধুরী লিখেছেন, "মাইকেল বার্নস (বৃটিশ লেবার দলের এম.পি, বঙ্গবন্ধুর বন্ধু ছিলেন) আমাদের জানালেন ব্রিটিশ গোয়েন্দা বিভাগ একটি সূত্র জানতে পেরেছে জেলে বন্দী তাজউদ্দিন আহমেদসহ জাতীয় নেতাদের হত্যার একটা চেষ্টা চলছে। ব্রিটিশ সরকার সরাসরি এ ব্যাপারে কিছু করতে পারে না। তবে বাংলাদেশের কোন প্রতিনিধিত্ব স্থানীয় নেতা ব্রিটিশ সরকারকে এ ব্যাপারে অনুরোধ জানালে বিষয়টি পার্লামেন্টে উত্থাপন করে জেলে নেতাদের অবস্থা জানার জন্য বাংলাদেশের তৎকালীন সরকারের উপর চাপ দিতে পারে এবং জেলে বন্দি নেতাদের জন্য ব্যবস্থা করতে পারে। এ কথা শোনার পর আমরা ছুটে যাই অক্সফোর্ডে ড. কামাল হোসেনের কাছে। তিনি বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ছিলেন এবং ব্রিটেনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের খুবই পরিচিত। তার কথায় ব্রিটিশ সরকার গুরুত্ব দেবে। কিন্তু কামাল হোসেনের কাছে গিয়ে তাকে সব কথা জানাতেই তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, 'না, না, এসব গুজবে কান দেবেন না। আমরা এসব কথা বলাবলি করলে ওরা সত্যি সত্যি নেতাদের মেরে ফেলবে।" [তথ্যসূত্রঃ সময় এখন.কম ৩রা জুন ২০১৮।]

এরপরও কী আমার বয়োজ্যেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা বন্ধু বলবেন যে খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চায়নি?

আমি সকল মুক্তিযোদ্ধার প্রতি অনুরোধ রাখবো আপনাদের সবারই ভক্ত গুণগ্রাহী আছে। অতএব আপনারা যখন কিছু বলেন একটু ভেবেচিন্তে বলবেন। তা নাহলে আপনাদের এই মতবাদগুলো সংক্রামিত হতে থাকবে এবং তাতে খুনিদের অপরাধকে লঘু করে দেখা হবে। কিন্তু আমাদের কোনওভাবেই সে সুযোগ নেই।