নক্ষত্রের রঙ, নারী ‘গণক’, দানব ও বামনদের কথা

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদীফারসীম মান্নান মোহাম্মদী
Published : 28 Oct 2013, 02:34 PM
Updated : 3 June 2012, 03:23 PM

আমাদের নারীরা কী পারেন না? তাঁরা দেশ চালান, বিরোধিতা করেন, কর্পোরেট চালান, উদ্যোক্তা হন, এমনকি এভারেস্টের চূড়াতেও ওঠেন। আমাদের নারীরা সরকারী চাকুরিতে উচ্চতম পদে আসীন আছেন, পুলিশে আছেন, মিলিটারিতে আছেন, সাহিত্যে আছেন, শিক্ষা-দীক্ষা, খেলাধূলায় আছেন। বিজ্ঞানেও আছেন। এমনকি জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রথম দিককার গবেষণাতেও তাঁরা ছিলেন-আছেন-থাকবেন। উনিশ শতকের শেষের দিকে যখন নাক্ষত্রিক আলোর বিশ্লেষণের মাধ্যমে নক্ষত্রের ভৌত-গঠন সম্পর্কে খোঁজখবর ও বৈজ্ঞানিক গবেষণা শুরু হয়, তখন কিছু স্বল্পশিক্ষিত নারী এই কাজে অসামান্য অবদান রাখেন। এটা আজ বিস্ময়ের ব্যাপার যে, পুরুষ সহকর্মির বেতনের চেয়েও কম বেতনে এইসব নারী 'কমপিউটার'রা যেসব কাজ করে গেছেন তার উপর ভিত্তি করেই আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের নাক্ষত্রিক শ্রেণিবিভাগ সম্ভব হয়েছে।

নক্ষত্রের সকল সালতামামি লুকনো থাকে তার আলোর ভেতর। নক্ষত্রের বিকিরিত আলোর ঢেউয়ের মধ্যে থাকে তার গঠন, ভর, দীপ্তি এই সব। নিউটন যখন সূর্যের আলোকে প্রিজমের মধ্য দিয়ে চালিয়ে সাতটি বর্ণের মিছিল দেখতে পেলেন, তখনি বোঝা গিয়েছিল যে দেখা আলোর একটা না দেখা রূপ আছে । আলো প্রকৃতপক্ষে এক ধরনের বিদ্যুত-চুম্বক তরঙ্গ। তরঙ্গের দৈর্ঘ্যের প্রকারভেদে আলোর রঙ বদলায়। রঙের এই সমাহারকেই বলে বর্ণালি, বিজ্ঞানের ভাষায় স্পেকট্রাম। এই বর্ণালিতে অতিক্ষুদ্র তরঙ্গের গামারশ্মি থেকে শুরু করে অতি বৃহৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রেডিও বিকিরণ অন্তর্ভুক্ত। এরই মাঝে একটা ক্ষুদ্র পরিসরে আমাদের দৃশ্যমান আলোর রঙগুলো অবস্থান করে। কাজেই আমরা যতটুকু দেখতে পারি তার বাইরেও আলোর একটি বিরাট পরিসর আছে যেখানে আমাদের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য আছে। আলোর বাইরে অন্যান্য তরঙ্গদৈর্ঘ্যে যে তথ্য থাকে সেটাকে পর্যবেক্ষণ করতে বিশেষ যন্ত্রের প্রয়োজন। কারণ, সাধারণ টেলিস্কোপ বা দূরবীক্ষণযন্ত্র কেবল দৃশ্যমান আলো ও তার আশপাশের তরঙ্গই ধরতে সক্ষম। কাজেই বর্ণালি পর্যবেক্ষণের প্রতি বিজ্ঞানীদের আগ্রহ থাকাই স্বাভাবিক।

১৮২০ থেকে ১৮৫০ সাল – এই চার দশকে বিভিন্ন পেশার বিজ্ঞানীরা (জ্যোতির্বিদ, পদার্থবিদ, রসায়নবিদ, চিত্রগ্রাহক, কাঁচ নির্মাতা প্রমুখ) বিবিধ বস্তুর বর্ণালি পর্যবেক্ষণে মেতে উঠলেন। পৃথিবীর বায়ুমন্ডল, বিভিন্ন রাসায়নিক মৌল, নানাবিধ জ্যোতিষ্কের বর্ণালি এই ধামাকায়ও সংগৃহীত হয়। এতোসব বর্ণালির বিশ্লেষণ সম্ভব হওয়ায় উনবিংশ শতকের শেষাবধি এসে নক্ষত্রের বর্ণভিত্তিক শ্রেণিবিভাগ সম্ভব হয়। বহুসংখ্যক পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিশ্লেষণের পর বিজ্ঞানীরা ঐ শ্রেণিবিভাগটি করতে সক্ষম হন। এইসব অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতেই বিশ শতকে এসে বিজ্ঞানীরা নক্ষত্রের বর্ণের ভিত্তিতে নক্ষত্রের জীবনচক্র, ভর, কাঠামো ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছেন।

বর্ণালি পর্যবেক্ষণে নিউটনের পর একটি মৌলিক কাজ করেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ফ্রনহোফার। তিনি দেখালেন চাঁদের প্রতিফলিত আলোতে সৌর বর্ণালির কালো রেখাগুলি দেখা যায়। তার মানে, জোছনা আসলে সূর্যেরই প্রতিফলিত আলো! এমনকি শুক্র ও মঙ্গল গ্রহের বর্ণালিতে ঐসব কালোরেখাগুলোর (মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রধান রেখার) দেখা মেলে। একই রকম কালো রেখা তিনি অন্য তারাতেও দেখেছিলেন, কিন্তু এসব রেখার উৎপত্তির ব্যাখ্যা তার অজানাই ছিল। ১৮২০-এর দশকে জন হের্শেল দেখান যে ধাতব লবণকে উত্তপ্ত করলে নিরবচ্ছিন্ন বিকিরণের পরিবর্তে আলাদা আলাদা উজ্জ্বল রেখা দেখায়। এসব রেখা একেক লবণের জন্য একেক তরঙ্গদৈর্ঘ্যে দেখা যায় এবং এসব রেখা দেখে মৌল সনাক্ত করা সম্ভব। অনেকটা আধুনিক বারকোডের মতো প্রতিটি মৌলের আলাদা নির্দিষ্ট নিঃসরণ বর্ণালি দেখা যায়। ক্যালিডোস্কোপের আবিষ্কারক ডেভিড ব্রুষ্টার দেখাতে সক্ষম হন যে, সৌর বর্ণালির কালো রেখা ও কালো ব্যান্ডের উপত্তি হয় পৃথিবীর বাতাবরণে শোষণের কারণে। তিনি দেখতে পেলেন, আকাশে সূর্যের অবস্থানের ওপরও ঐসব রেখার বৈশিষ্ট্য নির্ভর করে। যেমন সূর্য যখন দিগন্তের দিকে থাকে, তখন সূর্যালোককে বেশি পথ অতিক্রম করতে হয়। ফলে সূর্য খাড়া মাথার ওপর থাকলে যে অবস্থা হয় তার তুলনায় পূর্বোক্ত ক্ষেত্রে শোষণ বেশী হয়। ১৮৪৯ সালে লিওঁ ফুকো দেখালেন যে সূর্যের বিশোষণ রেখাকে আরও কালো করা যায় যদি ঐ আলোকে সোডিয়াম বাষ্পের মধ্য দিয়ে চালানো যায়। এই ফুকো সাহেব ১৮৪৫ সালে সূর্যের প্রথম আলোকচিত্র তোলেন। ফ্রনহোফারের পূর্বোক্ত ঐ কালো রেখাগুলিই ('ডি'-লাইনস) আবার সোডিয়ামের আলোতে উজ্জ্বল রেখা হিসেবে দেখা যায়। এভাবে ফুকো সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে উত্তপ্ত সোডিয়াম বাষ্প যেখানে উজ্জ্বল রেখা বিকিরণ (নিঃসরণ রেখা) করে, শীতল সোডিয়াম বাষ্প সেখানেই কালো শোষণ রেখা দেখায়।

১৮৫০-এর দশকে গুস্তাফ কার্শফ ও রবার্ট বুনসেন বস্তুর বিশুদ্ধিকরণের পদ্ধতি নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাদের কাজের মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারলেন প্রতিটি মৌলের আলাদা বর্ণালি রেখা আছে। বর্ণালির রেখা দেখেই মৌল চেনা সম্ভব। এভাবে কার্শফ ও বুনসেন সৌর-বর্ণালিতে বেশ কিছু জানা রাসায়নিক মৌলের অস্তিত্ব সনাক্ত করেন। এভাবে বর্ণালির রেখা দেখে মৌল সনাক্তকরণের পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি পায়।

ফ্লেমিংয়ের এই শ্রেণিকরণের সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে পিকেরিং বেশ কয়েকজন মহিলা কমপিউটার নিয়োগ দেন। হেনরি ড্রেপারের ভাগ্নী অ্যান্টোনিয়া মাউরিও নক্ষত্রের বর্ণালি বিশ্লেষণের কাজে যোগ দেন। তিনি নতুন করে শ্রেণিকরণ করেন এভাবে OBACDE…। ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত এই শ্রেণিকরণে মাউরি সাব-টাইপ বা উপবিভাগ হিসেবে a, b, c এবং ac অক্ষরগুলো যোগ করেন। যেসব নক্ষত্রে হাইড্রোজেনের চওড়া রেখা দেখা যায় তারা a ও b; কিন্তু চিকন রেখাদের জন্য c ও ac উপবিভাগ চিহ্নিত হয়। ফ্লেমিং ও মাউরির শ্রেণিকরণের বিবিধ দুর্বলতা দূর হয় ক্যাননের শ্রেণিকরণে।

অ্যানি জাম্প ক্যাননকে ফ্লেমিংয়ের দলে নিয়োগ দেয়া হয় ১৮৯৬ সালে । এরপর তিনি একক প্রচেষ্টায় দুই লক্ষাধিক নক্ষত্রের শ্রেণিকরণ লিপিবদ্ধ করেন নয় খন্ডের 'হেনরি ড্রেপার ক্যাটালগে' (১৯১৮ থেকে ১৯২৪ এর মধ্যে প্রকাশিত)। ১৯০১ সালেই ক্যানন উপরোক্ত দুই শ্রেণিকরণের দুর্বলতা বুঝে নতুন করে শ্রেণিকরণ করেন এভাবে – O, B, A, F, G, K ও M তারা। তিনি শ্রেণী অক্ষরের পাশে সংখ্যাও ব্যবহার করেন-যেমন B0, B1, B2 … থেকে… B8, B9 ইত্যাদি। বিশ শতকের শুরুর দিকে এভাবে নক্ষত্রের বর্ণালি শ্রেণিকরণের ফলে নক্ষত্রের অভ্যন্তরীণ জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান নিয়ে নতুন বৈজ্ঞানিক চিন্তার সূচনা সম্ভব হয়। নক্ষত্রকে কল্পনা ও মিথের জগৎ থেকে সরিয়ে একটি ভৌত বস্তু হিসেবে চিন্তা করা শুরু হয়। এই শ্রেণিকরণে 'উত্তপ্ততম থেকে শীতলতম' তারার একটা ধারা দেখা যায়। সেই আমলে মনে করা হয়েছিল, এই একই ধারায় এরা 'নবীনতম থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ' ধারাও নির্দেশ করে। সেটা অবশ্য ভুল ধারণা ছিল, কিন্তু একটা নক্ষত্রের নামের সাথে তার শ্রেণীটি বলা মাত্রই তার তাপমাত্রা সম্পর্কে একটা সঠিক ধারণা পাওয়া যায়। পদার্থবিদরা পরবর্তীতে দেখিয়েছেন, এই তাপমাত্রাই নক্ষত্রের অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে অনেক কিছু বলতে পারে।

ডেনিশ জ্যোতির্বিদ এজনার হের্ৎসপ্রুঙ একই রঙের (হলুদ, কমলা, লাল) নক্ষত্রদের দূরত্ব অনুযায়ী দুটি আলাদা ভাগ রাখলেন – কাছের তারা ও দূরের তারা। তিনি দেখলেন, একই রঙের দূরের তারার স্বকীয় উজ্জ্বলতা বেশী, কিন্তু কাছের তারার স্বকীয় উজ্জ্বলতা কম। উক্ত তিনটি রঙের তারাদের মধ্যে তিনি দেখলেন যে হলদেটে G-তারাদের গড় প্রকৃত গতি (proper motion) বেশী, অর্থাৎ এরা সূর্যের নিকটবর্তী। তিনি আরো দেখলেন, লাল তারাদের মধ্যে যাদের উজ্জ্বলতা কম তাদের প্রকৃত গতি বেশী, কাজেই তারাও সূর্যের নিকটবর্তী। কিন্তু এমন অনেক উজ্জ্বল লালচে তারা আছে, যাদের প্রকৃত গতি খুবই কম – অর্থাৎ তারা সূর্য থেকে অনেক দূরের নক্ষত্র। কিন্তু খটকা একটা বাধল বটে! উজ্জ্বলতম তারা কীভাবে দূরতম হয়? কাছের তারার উজ্জ্বলতা কি বেশী হবার কথা নয়? তাহলে? একই রকম উজ্জ্বল দুটি বস্তুর মধ্যে যেটি দূরবর্তী, আলোর ব্যস্ত-বর্গ নিয়ম অনুযায়ী তার উজ্জ্বলতা কম হবার কথা। তাহলে একই রকম লাল রঙের নক্ষত্রের মধ্যে যাদের উজ্জ্বলতা এবং দূরত্ব দুটোই বেশী, তাদের স্বকীয় উজ্জ্বলতা নিশ্চয়ই অত্যধিক বেশী হবে (সেইসব লাল নক্ষত্রের তুলনায়, যাদের উজ্জ্বলতা কম এবং যারা সূর্যের নিকটবর্তী)। তাহলে নক্ষত্রের রঙ (বা বর্ণালি) যদি তাপমাত্রার সূচক হয়, তবে সকল লাল নক্ষত্রের (দূরের হোক কিংবা কাছের) তাপমাত্রা সমান। সমান তাপমাত্রার দুটো নক্ষত্রের মধ্যে যদি একটির উজ্জ্বলতা অপরটির তুলনায় বেশী হয়, তহালে স্টেফান-বোলৎসমান সূত্রানুসারে উজ্জ্বলতর নক্ষত্রের আকৃতি কম উজ্জ্বল নক্ষত্রের তুলনায় অনেক অনেক বেশী হবে। এভাবে হের্ৎসপ্রুঙ সাহেব 'দানব' ও 'বামন' নক্ষত্রের অস্তিত্ব আবিষ্কার করলেন। তিনিই বোঝালেন যে, কোনো তারা অত্যধিক বড় বা দানবাকৃতির হতে পারে, আবার একই রঙের (অর্থাৎ একই তাপমাত্রার) অন্য কোনো তারা বামনাকৃতিরও হতে পারে। সত্যি বলতে কি, মাউরির উপবিভাগ ব্যবহার করে হের্ৎসপ্রুঙ দেখালেন যে বর্ণালি চওড়া বা চিকন হলে নক্ষত্র স্বকীয়ভাবে যথাক্রমে কম উজ্জ্বল ও বেশী উজ্জ্বল হবে। কাজেই একটি লালচে নক্ষত্রে যদি চিকন বর্ণালি রেখা (c-টাইপ) থাকে তবে সেটা অত্যধিক উজ্জ্বল, শীতল দানবাকৃতির নক্ষত্র। কিন্তু এই রঙের তারার বর্ণালিতে চওড়া রেখা থাকলে সেটি কম উজ্জ্বল, শীতল বামন তারা হবে। ১৯০৫ সালে হের্ৎসপ্রুঙ তাঁর এই আবিষ্কারের ব্যাপারে একটি পেপার (গবেষণা-প্রবন্ধ) লেখেন একটি অখ্যাত জার্নালে। তবে পরবর্তী বছরগুলোতো তিনি পিকেরিংকে চিঠি লিখে তারার শ্রেণিকরণে মাউরির সাব-টাইপ পুনরায় প্রচলনের অনুরোধ জানান। কিন্তু পিকেরিং তা কখনোই করেননি, কারণ তিনিই ক্যাননকে বলেছিলেন ওসব সাব-টাইপ বাদ দিতে।

১৯০২ সাল থেকে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি মানমন্দিরে নক্ষত্রের দূরত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন বিখ্যাত মার্কিন জ্যোতির্বিদ হেনরি নরিস রাসেল। ১৯১০ সাল নাগাদ তিনি প্রায় ৫২টি নক্ষত্রের লম্বন এবং দূরত্ব মাপতে পেরেছিলেন। পিকেরিংয়ের কাছ থেকে ঐসব নক্ষত্রের বর্ণালি পেয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, একই রঙের যেমন দানবাকৃতির তারাও আছে, তেমনি বামনাকৃতির তারাও আছে। রাসেল তাঁর এই আবিষ্কার নিয়ে ১৯১৩ সালে লন্ডনে র‌য়্যাল অ্যাস্ট্রোনমিকাল সোসাইটিতে বক্তৃতা দেন এবং পরে ১৯১৪ সালে 'নেচার' পত্রিকায় প্রকাশ করেন। নক্ষত্রের উজ্জ্বলতাকে বর্ণালির বিপরীতে প্লট করলে যে চিত্রটি পাওয়া যায় সেটি জ্যোতির্বিজ্ঞানে 'এইচ-আর ডায়াগ্রাম' বা 'হের্ৎসপ্রুঙ-রাসেল চিত্র' নামে পরিচিত। এই চিত্রের সাহায্যে নক্ষত্রের কেবল বর্ণালি দেখে তার পরম উজ্জ্বলতা এবং দূরত্ব বলে দেওয়া সম্ভব। এভাবে নক্ষত্রের জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে একটা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হলো। সেই সময়ে বামন তারাদের আপাত উজ্জ্বলতা মাপা যেত শুধু। তাদের দূরত্ব বা লম্বন পরিমাপ খুবই দূরূহ ছিল। কারণ ছোট তারাদের ততোধিক ক্ষুদ্র লম্বন মাপা খুবই কষ্টের কাজ ছিল, তাছাড়া এতে ভুলের হারও বেশী থাকত। কিন্তু এইচ-আর চিত্র থাকায় শুধু বর্ণালি থেকেই নক্ষত্রের দূরত্ব পরিমাপ সম্ভব হলো। শুধুই দূরত্ব নয়, নক্ষত্রের জীবনকালের বিভিন্ন পর্যায়ের ভৌত বিবর্তনও এইচ-আর চিত্রে সুন্দরভাবে দেখানো যায়। স্নাতক পর্যায়ের যেকোনো আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান পাঠ্যবইয়ে এইচ-আর চিত্রের সাহায্যে নক্ষত্রের বিভিন্ন পর্যায়ের বিবর্তন দেখানো থাকে এবং এটা স্নাতক পর্যায়ের পাঠ্যক্রমের অংশ। এইচ-আর চিত্র তাই এখন আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের এক অঙ্গাঙ্গী অংশ। আর এই হলো এইচ-আর চিত্রের তৈরি হবার গল্প, আর তার পেছনে নারী 'গণক'দের অবদানের 'পেছনের গল্প'।

আমাদের মেয়েরা জল-স্থল-অন্তরীক্ষে আজ সমানভাবে ব্যাপ্ত। তাঁরা আকাশে উড়ছেন, পানিতে দাপাচ্ছেন, সর্বোচ্চ পাহাড়ের চূড়ায় দেশের পতাকা বহন করেছেন, সরকারের উচ্চাসনে বসে দেশ চালাচ্ছেন, চিন্তার ইতিহাসে অবদান রাখছেন। সেদিন খুব বেশী দূরে নয় যে, বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায়ও তাঁরা আন্তর্জাতিক অবদান রাখবেন এইই দেশে বসেই।

তথ্যপঞ্জি
১/ ডেভিড ওয়েনট্রাব, 'হাউ ওল্ড ইজ দ্য ইউনিভার্স', প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০১১। ২/ ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী, 'জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞান পরিচিত', বাংলা একাডেমী, ২০০১। ৩/ ব্র্যাডলি ক্যারল ও ডেল অসলি, 'অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু মডার্ন অ্যাস্ট্রোফিজিক্স', পিয়ার্সন ও অ্যাডিসন-ওয়েসলি, ২০০৭, ২য় সংস্করণ। ৪/ এরিক চেইসন ও স্টিভ ম্যাকমিলান, 'অ্যাস্ট্রোনমি টুডে', অ্যাডিসন – ওয়েসলি, ২০১১, ৭ম সংস্করণ।

ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী: বিজ্ঞান গবেষক ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।