পাকিস্তানের নির্বাচন, সেনাবাহিনী এবং ইমরান খান

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 13 August 2018, 01:52 PM
Updated : 13 August 2018, 01:52 PM

শেষ পর্যন্ত যেটা মনে করা হচ্ছিল সেটাই হলো। নির্বাচনের আগেই সবার কাছে পরিস্কার হয়ে গিয়েছিল সেনাবাহিনীর পছন্দের ব্যক্তি ইমরান আহমাদ খান নিয়াজিই হতে যাচ্ছেন পাকিস্তানের পরবর্তী ওয়াজিরে আজম বা প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর দল তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) পেতে যাচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠতা। হয়েছেও তাই। আগামী ১৪ অগাস্ট স্বাধীনতা দিবসের তিনদিন পরে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেবেন।

নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই সেনাবাহিনী অত্যন্ত সক্রিয় ছিল যাতে তাদের পছন্দের ইমরান খান এবার সরকার গঠন করতে পারেন। সেনাবাহিনীর এককালীন সমর্থনপুষ্ট নওয়াজ শরিফের সাথে নানা প্রশ্নে মিলিটারি এলিটদের সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না বেশ অনেক দিন ধরে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কিছু বিষয়ে নওয়াজ সেনাবাহিনীকে পাশ কাটিয়ে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে চাচ্ছিলেন, যা আখেরে তাঁকে তাদের বিরাগভাজন করে তোলে।

নওয়াজকে রাজনীতি থেকে পুরো বিযুক্ত করবার প্রথম উদ্যোগ নেন সাবেক সামরিক শাসক জেনারেল পারভেজ মোশাররফ। এ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে তাঁকে প্রথমে বন্দি এবং পরে সৌদি আরবে নির্বাসনে পাঠানো হয়। কিন্তু, মোশাররফ পরবর্তী সময়ে সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতা করে ২০১৩ সালে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসতে সক্ষম হন নওয়াজ।

সেনাবাহিনীর সামনে সে মুহূর্তে আর কোনও বিকল্প না থাকবার ফলে নওয়াজকে মেনে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।তবে শুরু থেকেই সেনাবাহিনী সুযোগ খুঁজছিল কী করে তাঁকে চিরতরে রাজনীতি থেকে নির্বাসিত করা যায়।

ক্ষমতায় এলেও প্রথম থেকেই নানা বিষয়ে সেনাবাহিনীর সাথে সমস্যা হচ্ছিল নওয়াজের। তাই, নওয়াজকে সরিয়ে দেয়ার মাধ্যম হিসাবে সেনাবাহিনী সেই একই কৌশল নেয় যা আমাদের দেশে নিয়েছিল ১/১১ এর কুশীলবরা; অর্থাৎ, রাজনীতিবিদের দুর্নীতিগ্রস্ত আখ্যায়িত করে তাঁদেরকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা।

পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই সেনাবাহিনীর সাথে রাজনীতিবিদদের দ্বন্দ্বের বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠে। ঔপনিবেশিকোত্তর এ নতুন রাষ্ট্রে সামন্ত সমাজ জাত সেনা সদস্যরা নিজেদের এলিট ভাবতেন, যে ভাবনাটা স্বাধীনতার এত বছর পরেও তাঁদের মাঝে শুধু যে আছে তা নয় বরং নানাভাবে বিকশিত হয়েছে।

সামরিক অ্যাকাডেমিতে তাঁরা যখন প্রশিক্ষণ লাভ করেন, তখন প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে তাঁদের মনোজগতে এ ভাবনাটি গেঁথে দেয়া হয় যে সমাজের অন্যান্য অংশের চেয়ে তাঁরা হলেন সুপিরিয়র। তাঁদের এ ভাবনার কারণে সাধারণ জনগণকে নিচু চোখে দেখবার একটা প্রবনতা সেনা সদস্যদের মাঝে জন্ম নেয়। মিলিটারি এলিটদের পক্ষে যার ফলে রাজনীতিবিদদের নেতৃত্ব মেনে নেয়া মানসিকভাবে কঠিন হয়ে উঠে।

আর এটি না মানতে পারবার ফলেই তাদেরকে পাকিস্তানের ইতিহাসে বারবার সরাসরি হস্তক্ষেপ করে নিজেদেরকেই রাষ্ট্র পরিচালকের আসনে দেখতে পাওয়া যায়। আর যখন তাঁরা সরাসরি পরিচালকের আসনে থাকেন না, রাষ্ট্রের অন্যান্য স্টেক হোল্ডারদের তুলনায় কোটারি গ্রুপ হিসাবে শক্তিশালী অবস্থানে থাকায়, পিছন থেকে রাষ্ট্রের কলকাঠি নাড়তে দেখা যায় তাদের।

আর এ কলকাঠি নাড়ার সাথে যখনই কোনও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল অসহযোগিতা করেছে তখনই সেনাবাহিনী হয় সরাসরি হস্তক্ষেপ করে অথবা পরোক্ষ ভাবে চাপ দিয়ে তাদেরকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী নিজেদেরকে সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই রাষ্ট্রটির অভিভাবক শ্রেণি (Guardian class) মনে করে আসছে, যাদের মূল দায়িত্ব হল প্রতিরক্ষার চেয়ে রাজনীতিবিদরা ঠিকমত দেশ পরিচালনা করছে কিনা তার দেখভাল করা।

এ অভিভাবক শ্রেণির ধারণা তারা পেয়েছে তুরস্কের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে। কামাল আতাতুর্ক সাংবিধানিকভাবে তাদেরকে এ ক্ষমতা দিয়ে গিয়েছিলেন। যদি সেখানকার ক্ষমতাশীনরা আতাতুর্কের সেক্যুলার আদর্শ থেকে দেশকে বিচ্যুত করতে চায়, তাহলে সাংবিধানিকভাবে সেখানকার সেনাবাহিনীর অধিকার রয়েছে সে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা করার।

এরদোয়ান ক্ষমতায় আসবার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় আমরা তুরস্কের সেনাবাহিনীকে রাজনৈতিক ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে দেখি। কিন্তু, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে সাংবিধানিকভাবে সে অধিকার দেয়া না হলেও সেই ১৯৫৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তাদেরকে আমরা ক্রমাগত হস্তক্ষেপ করে যেতেই দেখছি।

পাকিস্তানের যেসময়টাতে সামরিক শাসনের মাধ্যমে সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল না, সেসময়টায় সেনাবাহিনীর ক্ষমতার পিছন থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টাকে অনেক বিশ্লেষক 'রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র' হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন। অর্থাৎ, তখন কিছুটা হলেও সরকার এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা পালন করতে পারে।

কিন্তু, নওয়াজ শরীফ তাঁর শেষ পর্বের প্রধানমন্ত্রী থাকবার অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর পূর্বের পর্বের সাথে তুলনা করে জেলে যাবার আগে বলেছেন, আগে যেটা ছিল 'রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র' তা এখন হয়েছে 'রাষ্ট্রের উপর রাষ্ট্র'। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনায় সেনাবাহিনীর একচ্ছত্র ক্ষমতার বিষয়টা স্পষ্ট করেছেন। অর্থাৎ, বর্তমানে পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোতে একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীর সেনাবাহিনীর ইচ্ছাধীন এক ধরনের পুতুল সরকার পরিচালনা করা ছাড়া খুব বেশি ভূমিকা পালন করবার সুযোগ নেই।

আর এ পুরোপুরি পুতুল না হতে চাওয়ার কারণেই সেনাবাহিনী নওয়াজকে চিরতরে রাজনীতি থেকে নির্বাসনে পাঠাবার উদ্যোগ নেয়। বাংলাদেশের ১/১১ এর সরকারের মত তারা নওয়াজের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে এবং আদালতকে তাঁর বিরুদ্ধে রায় দিতে বাধ্য করে; যার ফল হলো দশ বছরের জেল এবং রাজনীতিতে চিরতরে নিষিদ্ধ ঘোষণা । এ কথা অস্বীকার করার জো নেই যে নওয়াজ বা পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিগ্রস্ত নন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদের মতই তাঁরা গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।

কিন্তু, এ রাজনীতিবিদের প্রতি দুর্নীতির অভিযোগের তীর যেখান থেকে ছোঁড়া হচ্ছে; অর্থাৎ সেনাবাহিনী, তারাই হচ্ছে পাকিস্তানের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান। সেই ১৯৫৮ সাল থেকেই দেশটির সামরিক, বেসামরিক সব সরকারই সেনাবাহিনীকে নানা রকম সুবিধা দিয়ে হাতে রাখতে চেয়েছে। এর ফলশ্রুতিতে আজকে পাকিস্তানের বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসাবে দেখা যায় বিভিন্ন সেনা অফিসারকে।

এটি খুব অদ্ভুত বিষয় যে বিভিন্ন হাসপাতাল, কর্পোরেশন এমনকি কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যাদের দায়িত্বে থাকবার কথা, অর্থাৎ বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের, সেখানে বসানো হয়েছে সেনা অফিসারদের। এছাড়া সেনা কল্যাণ ট্রাস্ট স্থাপন করে সেনাবাহিনীকে দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে তারকাখচিত হোটেল পরিচালনার দায়িত্ব।

এসব নানা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্বে থাকবার ফলে দেশটির সেনাবাহিনী পরিণত হয়েছে একটি কর্পোরেট বাহিনীতে, যার নজির দুই /একটি উন্নয়িনশীল বিশ্বের দেশ ছাড়া আর কোথায়ও দেখা যায় না। এ বাহিনীর অনেকেই সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকে ব্যক্তি জীবনে পরিণত হয়েছেন নৈতিকতা বিবর্জিত, দুর্নীতিগ্রস্ত অফিসার হিসাবে।

এছাড়াও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে 'বৈধ'/অবৈধ নানা পন্থায় সেনাবাহিনী নিজেদের আর্থিক লাভের বিষয়টাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। উদাহারণস্বরুপ বলা যায় এবারের জাতীয় নির্বাচনে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে ৯০০ কোটি রুপি পারিশ্রমিক অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। ২০১৩ সালে তারা নিয়েছিল ৭৫ দশমিক ৮ কোটি রুপি এবং ২০০৮ সালে ১২ কোটি রুপি। অর্থাৎ, নির্বাচনে নিরাপত্তা দেবার বিষয়টাকেও তারা একটা বিজনেস ভেঞ্চারে পরিণত করেছে।

প্রতিষ্ঠান হিসাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দুটো বিষয় নিশ্চিত রাখতে চায়। এর একটা হল রাষ্ট্র ক্ষমতার উপর একচ্ছত্র আধিপত্য এবং অপরটি হল ব্যবসা, বাণিজ্য, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়ে যে অর্থনৈতিক সুবিধা তারা পেয়ে আসছে সেটি অব্যাহত রাখা।

তাই তারা সব সময় এমন ব্যক্তিকেই সরকার প্রধান হিসাবে দেখতে চায়, যে তাদের এ স্বার্থ বিনা প্রশ্নে সংরক্ষণ করবে। এরই অংশ হিসাবে তারা মনে করেছে ইমরান খান হবেন সেই ব্যক্তি যিনি সবার আগে বিনা বাক্য ব্যয়ে সেনা স্বার্থ দেখবেন এবং তাদের নির্দেশিত পথেই জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক নীতি পরিচালনা করবেন।

ইমরান খানের দলই যাতে জিতে আসে তার জন্য নির্বাচনের আগে সব ব্যবস্থাই করেছিল সেনাবাহিনী। নওয়াজ এর মুসলিম লীগ এবং বিলাওয়ালের পিপিপি এর অনেক নেতাকে ভয়ভীতি এবং আর্থিক প্রলোভন দেখিয়ে ইমরানের পিটিআইতে যোগদানে বাধ্য করা হয়, যাদের অনেকের নামেই রয়েছে দুর্নীতির নানা অভিযোগ।

সেনাবাহিনীর পাশাপাশি ইমরানও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও, এ দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদেরই তিনি সাদরে দলে বরণ করে নেন। এদের অনেকেই জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়লাভ করেছেন।

নির্বাচনে জয় লাভ করবার জন্য সেই একই কৌশল ইমরান খান অনুসরণ করেছেন, যা দেশটির রাজনীতিবিদরা করে আসছে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। কৌশলটি হল চতুরতার সাথে ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার।

দেশটির ইতিহাসে দিকে তাকালে দেখা যাবে, এখন পর্যন্ত যে সমস্ত রাজনীতিকরা চতুরতার সাথে ইসলামকে ব্যবহার করতে পেরেছেন এবং সাথে সেনা আশির্বাদ পেয়েছেন তাঁরা কখনো ব্যর্থ হন নাই। পাকিস্তানের এ বারের নির্বাচনেও তার ব্যতয় দেখা যায় নাই।

২৫ জুলাই অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে ইমরান খান নিজে পাঁচটি আসনে জয়ী হওয়াসহ জাতীয় পরিষদে তাঁর দল ১১৭ টি আসনে জয়ী হয়েছে। কারাবন্দি নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ (এন) পেয়েছে ৬৩টি আসন। আর জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাতি বিলওয়াল ভুট্টো ও জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জয়ী হয়েছে ৪৩টি আসনে।

প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও আশাতীত ভালো ফল করেছে ইমরানের পিটিআই। ইমরানের নিজের খাইবার পাখতুন খাওয়া প্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গতবারের চেয়ে ভালো ফল করছে দলটি। নওয়াজের ঘাঁটি বলে পরিচিত পাঞ্জাবে এবং পিপিপির ঘাঁটি বলে পরিচিত সিন্ধুতেও ভালো ফল করে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে পিটিআই।

নির্বাচনে আশাতীত ভালো করা পিটিআই ইমরান গঠন করেছিলেন ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৭ সালের নির্বাচনে সব কয়টি আসনে লড়ে সব কয়টি আসনেই জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল দলটির। ২০০২ সালের নির্বাচনে পেয়েছিল মোটে একটা আসন। ২০০৮ এ ইমরানের দল নির্বাচন বয়কট করে। ২০১৩ সালে দলটির আসন ছিল ৩৫।

নির্বাচন বর্জন না করলেও নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ করেছে মুসলিম লীগ (নওয়াজ), পিপিপি থেকে মুত্তাহিদা মজলিশ আমল (এমএমএ) পর্যন্ত। এই এমএমএ জোটের অন্তর্ভুক্ত হল জামায়াতে ইসলামী, জামায়াতে উলামায়ে ইসলাম (ফজল) সহ অন্যান্য 'ইসলামপন্থী' দল।

এবারের নির্বাচনে জামায়াতসহ 'ইসলামপন্থী' দলগুলোর চরম পরাজয় ঘটেছে। 'ইসলামপন্থী' জোট এমএমএ পেয়েছে মাত্র ১১ টি আসন। পাকিস্তানের নির্বাচন থেকে একটি বিষয় পরিস্কার হয়ে গেছে যে ১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত জামায়াতের কোনও ভবিষ্যত দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নেই।

তবে এবারের নির্বাচনে নতুন আরেকটি সুন্নি 'ইসলামপন্থী' রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব ঘটেছে। যারা সিন্ধু প্রদেশে দুটো আসন ছাড়া কোনও আসন জয় করতে না পারলেও জাতীয় পরিষদের অনেক আসনেই তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। দলটি হল তেহেরিক-ই-লাব্বায়েক পাকিস্তান। তবে, হাফিজ মোহাম্মদ সাইদের চরম উগ্রপন্থী লস্কর-ই-তাইয়েবা সহ অন্যান্য উগ্রপন্থী দলগুলোর নির্বাচনে চরম ভরাডুবি ঘটেছে।

১৯৪৭ সাল থেকে পাকিস্তানের ইতিহাসের দিকে তাকালে যে বিষয়টা দেখা যাবে সেটা হল পাকিস্তানের জনগণ সব সময় শরিয়াভিত্তিক 'ইসলামপন্থী' দলগুলোকে প্রত্যাখান করে এসেছে। তাঁদের পছন্দ ইমারান খান, নওয়াজ শরীফ বা জুলফিকার আলি ভুট্টোর মতো নেতৃত্ব, যাদের কাছে ইসলাম রয়েছে শুধু লিপ সার্ভিস বা মুখের কথায় এবং কিছু কাগুজে আইনে। আর যেটিকে তাঁরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং নারীদের অধিকার হরণের হাতিয়ার হিসাবেই শুধু ব্যবহার করবে।

এদিক বিবেচনায়, বাংলাদেশের একটি বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক মননের সাথে পাকিস্তানি জনগণের রাজনৈতিক মননের মিল পাওয়া যায়। তাই আমরা ইমরান খানকেও দেখি ব্লাসফেমি আইনকে সমর্থন করতে, নারীবাদের বিপক্ষে দাঁড়াতে, তালেবানদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে এবং কথায় কথায় ইসলামিক পরিশব্দ ব্যবহার করতে।

এমন একটি সময়ে ইমরান পাকিস্তানের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন, যখন দেশটি এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কটের দিকে এগোচ্ছে। স্বাধীনতার প্রায় ৭১ বছর পর ক্রমশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে থাকা দেশটিতে এই মুহূর্তে ফরেন কারেন্সির রিজার্ভ রয়েছে ১১ বিলিয়ন ডলারের মত (বাংলাদেশে ৩০ বিলিয়ন ডলারের উপরে)। অপরদিকে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হচ্ছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ, বাংলাদেশে যেটা ৭ দশমিক ৩ শতাংশ।

মানব উন্নয়নের সবগূলো সূচকেই দেশটি শুধু বাংলাদেশ থেকে পিছিয়েই নয়, বরং রয়েছে ভয়াবহ নাজুক অবস্থায়। শিশু মৃত্যুর হার বাংলাদেশে যেখানে ১ হাজারে ২৮.২ জন, পাকিস্তানে সেটা প্রায় ৫২ জন। দেশটির প্রায় ৪০ শতাংশ লোক দরিদ্র এবং ২১.০৪ শতাংশ লোক বাস করছে দরিদ্র সীমার নিচে।

এর পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন জাতিগত সমস্যা, বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, শিয়া-সুন্নি সম্প্রদায়ের মাঝে অবিশ্বাস, সন্দেহ এবং দাঙ্গা। বিভিন্ন ধর্মীয় সংখ্যালঘু যেমন হিন্দু, খ্রিস্টান এবং আহমেদিয়া জামাত (কাদিয়ানী)–যাদেরকে ভুট্টো ভোটের রাজনীতিতে সুবিধা পাবার জন্য অমুসলিম ঘোষণা করেছিলেন— রয়েছে চরম নিষ্পেষিত অবস্থায়। এছাড়া নারীদের অবস্থা অনেকটাই সেখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের মত।

তবে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে ইমরানকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখবার ক্ষেত্রে। তাঁকে সমঝোতা করে চলতে হবে বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম, পারমাণবিক শক্তিধর সেনবাহিনীর সাথে।

এ সেনবাহিনী চরম দুর্নীতিগ্রস্ত হলেও, বাংলাদেশের মত সেখানকার জনগণের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলবার তেমন অভিজ্ঞতা না থাকবার ফলে সেনাবাহিনী সম্পর্কে রয়েছে ইতিবাচক মনোবৃত্তি। রাজনীতিবিদের চেয়ে জনগণ সেখানে সেনবাহিনীকে অধিক বিশ্বাস করে।

এমতাবস্থায়, ইমরান যদি সেনাবাহিনীর সাথে সমঝোতা করে চলতে পারেন তাহলে তিনি হয়ত তাঁর টার্মের পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারবেন। আর যদি কোন কারণে এ সমঝোতায় ছেদ পড়ে তবে তাঁকেও হয়ত তাঁর পূর্বসুরি নওয়াজ শরীফের–যিনি একদা সেনাবাহিনীর প্রিয়পাত্র ছিলেন- বর্তমান পরিণতি বরণ করতে হতে পারে।