বাংলাদেশ নিয়ে শহিদুলের মিথ্যাচার ও বিভ্রান্ত প্রজন্ম (পর্ব – ১)

Published : 12 August 2018, 12:58 PM
Updated : 12 August 2018, 12:58 PM

আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শহিদুল আলমকে গ্রেপ্তার করেছে সরকার। বাসা থেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেছে। এমনকি তাকে গাড়িতে তোলার সময়ও তার সাথে দুর্ব্যবহার করতে দেখেছে মানুষ। স্বাভাবিক কারণেই সরকারের এমন আচরণ নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। ফুঁসে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। এর বিপরীতে আবার অনেকে এই আটককে 'জাস্টিফাই' করার চেষ্টা করছেন নানাভাবে।

কেউ রাজাকার সবুর খানের সাথে তার সম্পর্ককে টানছেন, তো কেউ মুক্তিযোদ্ধা চাচাতো ভাইয়ের কথা বলছেন। কেউ তার মা আনোয়ারা মনসুরের স্বাধীনতা পদক প্রাপ্তির কথা বলছেন, (যেটার সত্যতা পাওয়া যায়নি) কেউ বা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা একাত্তরের দিনগুলিতে তার মায়ের পাকিস্তান আর্মির সাথে যোগসাজসের প্রমাণ হাজির করছেন।

কেউ ২০১৩-তে তার ডেভিড বার্গম্যানের পক্ষে দাঁড়ানোর কথা বলছেন, যার বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিরোধী লবিস্ট হিসেবে' কাজ করার। কেউ আবার সেই সময় দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস এ তার লেখা শেয়ার করে শাহাবাগ আন্দোলনের পক্ষে তার অবস্থান প্রমাণ করতে চাইছেন।

এই প্রতিটি বিষয় নিয়েই অনেক কিছু বলার আছে। যদিও একজন মানুষের অন্যায়কে অন্যায় বলার জন্য তার অতীত পরিচয় টানার দরকার নেই, আবার এই গ্রেপ্তারের বিরোধিতা করতে তাকে মহান বানানোরও প্রয়োজন নেই।

তাই, এসব বিতর্কে না গিয়ে আমি শুধু বাংলাদেশের যেকোনও গণআন্দোলনে তার ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা এবং বাংলাদেশ নিয়ে নানা সময় মিথ্যাচার নিয়ে কিছু তথ্য উপাত্ত দেয়ার চেষ্টা করবো। এ যাবতকালে বাংলাদেশের সেরা দুটি গণজাগরণ যুদ্ধাপরাধীর বিচার এবং নিরাপদ সড়ক। দুইটা নিয়েই শহিদুল আলম নির্লজ্জ মিথ্যাচার করেছেন দেশের মানুষ ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার কাছে।

এই পর্বে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্ক টাইমস এ তার ছাপানো লেখায় মিথ্যাচারগুলো তুলে ধরা হলো-

মিথ্যা -১

প্রথমে আসি নিউইয়র্ক টাইমস এ 'আ ফরটি ইয়ার কোয়েস্ট ফর জাস্টিস' নিবন্ধে শহিদুল লিখেছেন,

Bangladesh's founding leader, Sheikh Mujibur Rahman, set up special tribunals to try the collaborators. Several thousand cases were filed, but the quest for justice was derailed in late 1973 when Sheikh Mujibur declared a general amnesty for the collaborators against whom trial had not yet been initiated.

তার এ লাইনগুলোর মানে দাঁড়ায়, শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধী বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করলেও ১৯৭৩ সালের সাধারণ ক্ষমার কারণে সেটি কক্ষচ্যুত হয়। এবং কয়েক হাজার মামলা হয়েছিলো মাত্র।

অর্থাৎ ২০১৩ এর আগে যুদ্ধাপরাধের কোন বিচার হয়নি এবং সেই না হওয়ার কারণও বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা।

আসুন দেখি ইতিহাস কি বলে।

১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দালাল আইন ১৯৭২ বা দ্য বাংলাদেশ কোলাবোরেটরস (স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল) অর্ডার ১৯৭২ প্রণয়ন করা হয়। সারাদেশে ট্রাইবুনাল গঠিত হয় ৭৩টি। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এই আইনের আওতায় ২ হাজার ৮৮৪টি মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয় ৭৫২ জনকে।

১৯৭৩ সালের ৩০ শে নভেম্বর যাদের বিরুদ্ধে কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই তাদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধু। সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার পরেও প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী কারাগারে বন্দি ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই বিচারকার্য অব্যাহত ছিল।

প্রমাণস্বরূপ, সেসময়ের কিছু পত্রিকার শিরোনাম-

দুইজন আলবদরের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড (দৈনিক ইত্তেফাক,  ০৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩); দালালীর দায়ে বরিশালে ১৪ জনের মৃত্যুদণ্ড (দৈনিক পূর্বদেশ, ০২ এপ্রিল ১৯৭৪); পাক দালালীর দায়ে দুজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড (দৈনিক সংবাদ ২০ এপ্রিল ১৯৭৫)।

মিথ্যা -২

এরপর শহীদুল আলম লিখেছেন-

Only in 2010 was a tribunal at last established to investigate the 1971 war crime.

এর মাধ্যমে তিনি ট্রাইব্যুনাল নিয়ে শুধু মিথ্যা তথ্য দিয়ে এবং শেখ মুজিবের সাধারণ ক্ষমাকে দায়ী করেই ক্ষান্ত হননি। আসলে দালাল আইনের কী হয়েছিলো এবং কে বন্ধ করেছিলো রাজাকার আলবদরদের বিচার সেটি সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। আসুন আবার ইতিহাস খুঁজি।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট শেখ মুজিব সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন এবং ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করে রাজাকার আলবদলের বিচার বন্ধ করে দেন। আটক অপরাধীরা তো অবশ্যই, এমনকি ২০ জন ফাঁসির আসামীসহ দণ্ডপ্রাপ্ত ৭৫২ জন রাজাকার আলবদরকে ছেড়ে দেয়া হয়। তাহলে যুদ্ধাপরাধীর বিচার 'ডিরেইলড' করেছিলেন কে? শেখ মুজিব? নাকি জিয়াউর রহমান?

মিথ্যা -৩

শহিদুল আলম লিখেছেন-

Bangladesh's original Constitution had four basic principles: nationalism, democracy, socialism and secularism. Military dictators replaced that with "absolute trust and faith in the Almighty Allah as the basis of all actions" in 1977, and made another change in 1988 that led to our once-secular nation's being redefined as an Islamist one. Martial law, amnesty and political deals allowed the collaborators to go free and Jamaat-e-Islami to gradually rejoin the political mainstream.

তাহলে কী দাঁড়ালো?  উনার ভাষ্যমতে, সামরিক আইন, বঙ্গবন্ধুর সাধারণ ক্ষমা এবং রাজনৈতিক ঐক্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীকে ফিরিয়ে আনে। কি নির্লজ্জ মিথ্যাচার! আসুন আবার সত্য খুঁজি।

বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশে জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করেছিলেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুসারে সাম্প্রদায়িক এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে জামায়েতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়।

এর বিপরীতে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দল বিধির আওতায় মওলানা আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ (আইডিএল) রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং জামায়াতে ইসলামীর সদস্যরা এর ব্যানারে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়। ১৯৭৯ সালে জিয়া সরকার ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে জামায়াতে ইসলামী আবার স্বনামে বাংলাদেশে রাজনীতি শুরু করে।

মজার ব্যাপার হলো, জামাতকে ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমার কোনও ভূমিকা না থাকলেও শহিদুল আলম তাই দাবী করেছেন।

অন্যদিকে ১৯৭৭ এবং ১৯৮৮ সালে কারা সংবিধান চেইঞ্জ করেছিলো সেই নামগুলো সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। অনেকটা ভাসুরের নাম মুখে না আনার মতো। আবার ১৯৭৯ সালে জিয়া সরকারের জামাতকে পুরোদমে পুনর্বাসনের কথাও চেপে গেছেন।

মিথ্যা – ৪

শহিদুল আলম লিখেছেন-

Years of kleptocratic rule, nepotism, corruption and abuse of power have eroded trust in government in Bangladesh. People feel that the system is so corrupt that change cannot possibly emerge in the electoral arena. That's why hundreds of thousands of Bangladeshis have gathered in the past month in a spontaneous movement that quickly spread across the country.

এই কথাগুলোরই পুণরাবৃত্তি করেছেন আবার শেষ প্যারায়। এটা নিয়ে আর কী বলবো? শাহাবাগ আন্দোলন কী নিয়ে ছিলো আপনারাই বলুন। হ্যা, অনেকেই দাবী তুলেছিলেন সরকারের নানা অনিয়ম নিয়েও শাহাবাগ সমাবেশ থেকে যেন প্রতিবাদ করা হয়। আর আমরা বলেছিলাম, আমরা আজ অংক পরীক্ষা দিতে এসেছি, অংক পরীক্ষাই দিবো। অন্য পরীক্ষা আরেকদিন দিবো। কী, মনে আছেতো আপনাদের?

মিথ্যা – ৫

আর্টিকেলের শেষ প্যারার আগের প্যারায় লিখেছেন-

Young kids baying for blood will make many justifiably uncomfortable. And no court should be forced to alter a verdict because of popular pressure.

ব্যস, এবার পুরো গণদাবিটাকেই বিতর্কিত করে ফেলা গেলো। এর ব্যাখ্যা আপনারাই বলুন, যারা শাহাবাগ আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। ঘুরে ফিরে এই একই কথাগুলো পাবেন সেইসময়ে ডেভিড বার্গম্যানের লেখায়, আমার দেশ পত্রিকায়, টোবি কাডম্যানের লেখাসহ জামায়াতি ঘরানার অনেকের লেখায়।

টোবি কাডম্যানকে মনে আছে তো? জামায়েত ইসলামীর উপদেষ্টা একজন আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ যিনি যুদ্ধাপরাধী বিচারের নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে মহা তৎপর ছিলেন।

একসময় এই তথ্যগুলো অধরা ছিলো। ২০১৩ সালে অমি রহমান পিয়ালসহ কলম যোদ্ধারা ইতিহাস খুঁড়ে বের করে এনেছিলেন সব সত্য। আপনারা চাইলে নিজেরাও জানতে পারেন সব।