দেশ কাঁপানো নয় দিন

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 9 August 2018, 12:13 PM
Updated : 9 August 2018, 12:13 PM

মার্কিন সাংবাদিক জন রিড ১৯১৭ সালের রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর লিখেছিলেন 'দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন' নামে একটি বই। বিপ্লবের কেন্দ্রস্থল পেত্রোগ্রাদে (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবার্গ) থেকে বিপ্লবের দশ দিনের বর্ণনা রিড তুলে ধরেছেন বইটিতে।বিপ্লবের বিশ্বব্যাপী আবেদনের গভীরতা বোঝাতে তিনি 'দুনিয়া কাঁপানো' শব্দযুগল ব্যবহার করেছেন।

রুশ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটেছিল বলশেভিক নামে পরিচিত দলের (যার বিপ্লবের পরে কমিউনিস্ট পার্টি নামকরণ করা হয়) নেতৃত্বে। এ বিপ্লবে মূলত অংশগ্রহণ করেছিল শ্রমিক, কৃষক এবং সেনাবাহিনী। বাস্তবতা ছিল সেনাবাহিনী বড় ভূমিকা না রাখলে এ 'দুনিয়া কাঁপানো বিপ্লব' আদৌ সফল হত কিনা সন্দেহ!

কিন্তু, বাংলাদেশে গত নয় দিনে যা ঘটে গেল তা শুধু দেশ কাঁপানোই নয়, বিশ্ব ইতিহাসেও প্রথম। স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থীরা যে একটি রাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়ে দিতে পারে তা প্রথমবারের মত প্রত্যক্ষ করল দেশবাসীর সাথে বিশ্ববাসীও।

নয়দিনে যারা রাস্তায় নেমে এসেছিল তাঁদের গড় বয়স ছিল ১৩ থেকে ১৮ এর মধ্যে। এমনকি ৮ থেকে ১০ বছরের ছেলে মেয়েদেরও রাস্তায় নেমে আসতে দেখা গেছে। তাঁরা শুধু সড়ক অব্যবস্থাপনা নয়, আমাদের সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেছে রাষ্ট্র এবং সরকারের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম আর দুর্নীতি। বাংলাদেশের ৪৭ বছরের ইতিহাসে সরকার, রাষ্ট্র এবং এর প্রশাসনের পচন গণমানুষের সামনে এমনভাবে উন্মুক্ত আর কখনো কেউ করে দেখাতে পারেনি।

তাঁরা এ পচন আমাদের সামনে শুধু উন্মোচনই নয় এর যে অবিলম্বে মেরামত করা দরকার তা বারবার নানা প্লাকার্ডে লিখে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রযন্ত্র মেরামত করবার জন্য ৪৭ বছর দীর্ঘ সময়। কিন্তু, এ দীর্ঘ সময়েও এর পরিচালনার দায়িত্বে যারা ছিলেন তাঁরা এর মেরামত করতে পারাতো দুরের কথা বরং দিন এর দিন একে নানাভাবে বিনষ্ট করেছেন।

স্কুলের শিক্ষার্থীরা কমপক্ষে দুইজন মন্ত্রী (তোফায়েল আহমেদ এবং আনোয়ার হোসেন মঞ্জু), একজন বিচারপতি, একজন সাংসদ, সচিব পদমর্যাদার একজন, একজন পৌরসভার মেয়র এবং পুলিশের একজন ডিআইজিসহ অনেক পুলিশের গাড়িকে লাইসেন্সবিহীন অবস্থায় ধরেছে। লাইসেন্সবিহীন অবস্থায় ধরা পড়েছে নির্বাচন কমিশনের গাড়িও।

এ তালিকায় এমনকি যুক্ত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের গাড়ি! সেখানে শিক্ষার্থীরা লিখে দিয়েছে- "প্রধানমন্ত্রী, লাইসেন্স কোথায়?" শিক্ষার্থীরা তাঁদেরকে এটাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে যারা একটা গাড়ি ঠিকমত আইন মেনে চালাতে জানে না, তাঁরা তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব কিভাবে সঠিকভাবে পালন করবে।

পুরো দেশটা এতদিন কিভাবে চলে আসছে এ থেকে তা সহজেই অনুমেয়। স্কুলের শিক্ষার্থীদের এ বিক্ষোভ যে শুধু দু'জন সহপাঠি হারাবার জন্য নয়, দিনে দিনে গড়ে উঠা অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতি, নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে ক্ষোভের বর্হিপ্রকাশ তা ক্ষমতার মসনদে যারা বসে আছে তাঁদের বুঝতে না পারারই কথা।

একটি দেশকে ঠিক করবার জন্য বা সুশাসন দেবার জন্য ৪৭ বছর কিন্তু অনেক লম্বা সময়। এদেশের মানুষ যতবার আশায় বুক বেঁধেছে, ততবারই তাঁদের আশা ভঙ্গ হয়েছে। এদের মানুষ শেষ আশান্বিত হয়ে উঠছিল ২০০৮ সালে। নির্বাচনের পূর্বে আওয়ামী লীগ যখন দেশকে দুর্নীতি মুক্ত করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করবে বলেছিল, মানুষ বিশ্বাস করেছিল।

মানুষ যে দল হিসাবে আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করে বিশ্বাস করেছিল তা নয়। জনগণ ভেবেছিল ১/১১ এর তিক্ত অভিজ্ঞতার পর রাজনৈতিক দলগুলি শিখবে, আর হয়ত ভুল পথে পা বাড়াবে না। এবার হয়ত দেশটা ক্রমান্বয়ে সঠিক পথে ফিরে আসবে। মানুষ বিএনপিকে ভোট না দিয়ে আওয়ামী লীগকে দিয়েছিল কারণ মানুষের কাছে বিএনপির শাসনকাল প্রতিভাত হয়েছিল হাওয়া ভবন কেন্দ্রিক ব্যাপক দুর্নীতি, জঙ্গিবাদের সাথে বিএনপির যোগাযোগ, ক্রস ফায়ারের নামে বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ড, অনিয়ম, অনাচার, সন্ত্রাস আর বিদ্যুৎহীনতার সময়কাল হিসাবে।

এসবের বিপরীতে আওয়ামী লীগ যখন উন্নয়নের রোডম্যাপ এবং দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলল, মানুষ আরেকবার দলটিকে সুযোগ দিতে চাইল। ভাবল, বিএনপির পরিণতি দেখে দলটি হয়ত শিখবে, এবার সত্যি হয়ত দেশকে কিছু দেবে। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠল বিএনপির দেখান পথ ধরেই আওয়ামী লীগ সরকার হাঁটছে।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবার পর অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলেন যেহেতু বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সব সময় সোচ্চার ছিল তাই হয়ত ক্ষমতায় এসে দলটি প্রথমেই 'বন্দুক যুদ্ধের' নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে উদ্যোগ নেবে। কিন্তু, কিছুদিনের মাঝেই জনগণের সামনে এ বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গেল যে, খালেদা জিয়ার দেখানো 'অপারেশন ক্লিন হার্টের' পথ ধরেই এ সরকার হাঁটবে। তার সাথে যোগ হল 'গুমের সংস্কৃতি'। বিষয়গুলো মানুষকে আতঙ্কিত করল, মানুষ আশা ভঙ্গ হল। মানুষ যে এ বিষয়গুলো পছন্দ করছে না সেটা আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব হয়ত বুঝতে পারেন নাই অথবা বুঝতে চান নাই।

আওয়ামী লীগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়ন বিষয়টার উপর জোর দিতে লাগল। তাঁরা ভাবলো উন্নয়ন হলেই জনগণ খুশি থাকবে, জনগণ তাঁদের সমর্থন করবে। কিন্তু, উন্নয়নের চেয়েও জনগণের আকাঙ্ক্ষার জায়গাটা ছিল সুশাসনের  উপর, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা যার প্রাথমিক পূর্ব শর্ত।

প্রায় দশ বছরের শাসনে আওয়ামী লীগ এ সুশাসন প্রতিষ্ঠার জায়গাটিতে অতীতের যেকোনও সরকারের মত সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। উন্নয়নের চেয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় দলটি যদি সর্বোচ্চ মনোযোগ দিত, তাহলে এ মুহুর্তে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্ষমতাসীন দল হিসাবে আসীন থাকত আওয়ামী লীগ। বস্তুত, জনগণের আকাঙ্ক্ষার এ বিষয়টি আওয়ামী লীগ এখনো বুঝে উঠতে পারেনি।

উন্নয়নের ক্ষেত্রেও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার ৭০ ভাগই দশ বছর পরে এসেও এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। যে সমস্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে তাও হয়েছে অত্যন্ত চড়া মূল্যে, বারবার প্রকল্প শেষ করবার মেয়াদ এবং অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে। জনগণের কাছে এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রতিভাত হয়েছে উন্নয়নের পাশাপাশি ক্ষমতাসীন দলের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের পকেট ভারী করবার মাধ্যম হিসাবে।

যথাসময়ে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারবার মূল কারণ অদক্ষতার পাশাপাশি ব্যাপক দুর্নীতি। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ জাতির কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল দেশকে সম্পূর্ণ দুর্নীতি মুক্ত এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের আলোকে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। দেখতে দেখতে প্রায় দশটি বছর পার হয়ে যাবার পর আজকে দেশের মানুষ হিসাব করতে শুরু করেছে আওয়ামী লীগ সেদিন কী বলেছিল আর আজ দেশ কোথায় দাঁড়িয়ে!

আজকে আওয়ামী লীগ সমর্থক থেকে শুরু করে দেশের কোন মানুষের মাঝে এমন ধারণা জন্মলাভ করে নাই যে গত দশ বছরে ক্রমান্বয়ে দুর্ণীতি কমে এসেছে। দেশের দলমত নির্বিশেষে যেকোনও মানুষের ধারণা হল দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। ব্যতিক্রমী দুই-চারজনকে বাদ দিলে মন্ত্রী, সাংসদ থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নানাবিধ দুর্নীতির সাথে যুক্ত নন সেটা খোদ দলের সমর্থকরাই মনে করেন না। সাধারণ জনগণের কাছে এ দশ বছরে এ সমস্ত ব্যক্তির শান, শওকত, প্রভাব, প্রতিপত্তি বৃদ্ধি অত্যন্ত নগ্নভাবে ধরা পরেছে। ব্যক্তিগত স্বার্থে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের রাষ্ট্র তথা প্রশাসন যন্ত্রের ব্যপক ব্যবহারে অনেক মানুষই আশাহত এবং ব্যথিত হয়েছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে মানুষ খুশি হলেও বিস্ময়ের সাথে জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে দলে দলে জামায়াত কর্মীদের আওয়ামী লীগে যোগদান। আওয়ামী লীগের অনেক কেন্দ্রীয় নেতা এবং মন্ত্রীও তাঁদেরকে বিভিন্ন যোগদান অনুষ্ঠানে ফুল দিয়ে দলে স্বাগত জানিয়েছেন। একদিকে জামায়াতকে কোণঠাসা করে, অপরদিকে চরম দক্ষিণপন্থী হেফাজতের সাথে দলটির সখ্যতা 'সেক্যুলার' বলে পরিচয় দিতে স্বাছন্দ্য বোধকারি আওয়ামী লীগের এক বিশাল সমর্থক গোষ্ঠীকে মানসিকভাবে দলটি থেকে বিছিন্ন করে ফেলেছে।

তবে, সবচেয়ে বেশি হতাশার জায়গা তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে না উঠায়। ২০০৮ সালে অনেকের মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল দেশ হয়তো এবার ক্রমান্বয়ে উদার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার দিকে এগোবে। বাংলাদেশের মত পৃথিবীর আর কোন দেশ একটি অন্তর্ভুক্তমূলক (Inclusive), উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য এত লড়াই, সংগ্রাম, আন্দোলন আর রক্তপাতের মধ্যে দিয়ে যায়নি।

সেই ১৯৪৭ সাল থেকেই এদেশের মানুষ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। তাই, ইতিহাসের প্রতিটা বাঁক পরিবর্তনে মানুষ আশায় বুক বেঁধেছে, এবার বুঝি দেশ গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করল। কিন্তু, প্রতিবারই তাঁকে হতাশ হতে হয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষের ট্রাজেডি হল দেশ স্বাধীন হবার প্রায় ৪৭ বছর পরেও একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের যে প্রাথমিক পূর্বশর্ত- অর্থাৎ, ক্ষমতাশীন দলের অধীনে নির্বাচন এবং সে নির্বাচনে ক্ষমতাশীন দলের পরাজয়- তা আজো পূরণ হয় নাই।

এ পূরণ  না হবার কারণ হল এদেশ যারা শাসন করেছেন তাঁদের চরম অগণতান্ত্রিক মনোবৃত্তি। ক্ষমতার বাইরে যখন তাঁরা থাকেন তখন তাঁরা এমনভাবে কথা বলেন যে শুনলে মনে হয় যে তাঁদের চেয়ে বড় গণতন্ত্রী বোধহয় আর কেউ নেই। আবার ক্ষমতাসীন হবার পর কাজে এবং কথায় তারাই হয়ে উঠেন সবচেয়ে বড় অগণতান্ত্রিক। দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে এখন পর্যন্ত এর ধারাবাহিকতায় কোন ছেদ পড়েনি।

গণতান্ত্রিক মানসিকতার আরেকটি বড় নিয়ামক হল দায়িত্বশীলতা। দায়িত্বশীলতার একটি বড় উপাদান হল দায়িত্ব পালনে ভুল বা অন্যায় হলে পদত্যাগ করা। যেকোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটাই হল সাধারণ রীতি। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হবার পর অদ্যাবধি কোনও মন্ত্রী কোনও চাপে না পড়ে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন এমন নজির নেই।

কিন্তু, এ ধরনের নজির তৈরি করবার সুযোগ এসছিল গত নয়দিনে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তোফায়েল আহমেদ এবং শাজাহান খানের সামনে। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পিতা মানিক মিঞা এবং তাঁর পত্রিকা ইত্তেফাক পাশ্চাত্যের আদলে উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিরন্তর সংগ্রাম করেছে। মঞ্জু সাহেব নিজেও পাশ্চাত্যের উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের একজন অনুরাগী। অথচ, তাঁর গাড়ি যখন লাইসেন্সবিহীন অবস্থায় পাওয়া গেল তিনি কিন্তু তখন পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক ধারা অনুসরণ করে পদত্যাগ করতে পারলেন না। যদি পারতেন তাহলে বাংলাদেশের ইতিহাসে নিজেকে স্থান করে নিতে পারতেন।

পদত্যাগ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন তোফায়েল আহমেদ নিজেও। ষাটের দশকে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেক্ষাপট রচনার নিয়ামক ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলবার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী তোফায়েল আহমেদের স্বাধীন বাংলাদেশে গৌরব করে বলবার মত তেমন ভূমিকা নেই। সমালোচকদের কাছে তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে যথাযথ প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করতে না পারা এবং ১/১১ সময়কালীন তাঁর ভূমিকা ইত্যাদি বিষয়ে সমালোচিত।

আর শাজাহান খান যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে সাথে সাথে পদত্যাগ করতেন তাহলে শুধু ইতিহাসে নিজেকে জায়গা করে নেয়া নয়, এতবড় প্রতিবাদী আন্দোলনই হয়ত দানা বেঁধে উঠত না। উপরন্তু এটি আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি জনমানসে একটি ইতিবাচক মনোবৃত্তি গড়ে উঠতে সাহায্য করত।

রাজনীতির বর্তমান সংকটটা হল এ ইতিবাচক মনোবৃত্তি জনগণের ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলির উপরেও নেই। যার ফলে ২০১৩ সাল থেকে এদেশে যতগুলি আন্দোলন গড়ে উঠেছে তার কোনটাই রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্বে গড়ে উঠে নাই। গণজাগরণসহ এ ধরনের আন্দোলন যখনই গড়ে উঠেছে তখন দলগুলোকে কিংকর্তব্যবিমূঢ়ের মতো অনেকটাই না বুঝে উঠতে পারবার ভূমিকায় দেখা গেছে।

রাজনৈতিক দলগুলির সাথে এর সহযোগী অঙ্গ ছাত্র সংগঠনগুলি উপরেও ছাত্র সমাজ আর আস্থা রাখতে পারছে না। ফলে, কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সবই হচ্ছে স্বতঃস্ফূর্ত নেতৃত্বে। এসব আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবার বদলে বরং ছাত্র সংগঠনগুলোকে এর অনুগামী হতে দেখা যাচ্ছে।

এ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠছে যে ছাত্র সংগঠন এবং রাজনৈতিক দলগুলো ছাত্র-জনতার আশা আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করতে পারছে না। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন সংযোজন। অতীতে সমস্ত আন্দোলন, সংগ্রাম রাজনৈতিক দল এবং ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতৃত্বে হয়েছে। কিন্ত, আস্তে আস্তে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, জনগণ তাদের প্রতি আস্থা হারাবার ফলে তারা আন্দোলন গড়ে তুলবার ক্ষমতা হারিয়েছে। ছাত্র-যুব সমাজ রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে না তাকিয়ে না থেকে নিজেরাই নিজেদের দাবি পূরণের আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছে।

সাম্প্রতিক এ ছাত্র গণজাগরণ থেকে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে মাদ্রসার নয়, মূলধারার শিক্ষা  প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরাই জাতির প্রয়োজনে যেকোনও আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলবার মূল নিয়ামক। হেফাজতের ঢাকা সমাবেশে সারা দেশ থেকে মাদ্রাসা ছাত্রদের সংগঠিত করে এনে জমায়েত করবার পর অনেকে ভাবতে শুরু করেছিলেন মাদ্রসা ছাত্ররাই বোধহয় ভবিষ্যতে আন্দোলন সংগ্রাম সংগঠনের মূল নিয়ামক হয়ে উঠবে। কিন্তু, বাস্তবতা হল মূলধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রছাত্রীদের তুলনামূলকভাবে ব্যক্তি চেতনা বিকাশের যে আপেক্ষিক পরিবেশ রয়েছে সেটা যতদিন মাদ্রসাগুলোতে গড়ে না উঠবে ততদিন পর্যন্ত জাতীয় প্রয়োজনে মাদ্রাসা ছাত্রদের নেতৃত্ব দিতে বা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যাবে না।

জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা এ আন্দোলন গড়ে তুললেও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ বিএনপি এবং জামায়াতের মাঝে এটা নিয়ে একটা চাপা উল্লাস পরিলক্ষিত হয়েছিল। নিজেরা আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি জামায়াত চেষ্টা করেছে এ আন্দোলনের উপর ভর করতে, এ আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে নিয়ে যেতে। এরই ধারাবাহিকতায় ছিল নানাবিধ গুজব ছড়ানোর মাধ্যমে আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে  প্রবাহিত করবার চেষ্টা করা। যেকোন আন্দোলনেই গুজবের বিষয়টা থাকলেও গুজব ছড়িয়ে অন্য বিষয়ের আন্দোলন যে নিজের ঘরে টানা যায় না বিএনপি জামায়াত সেটা এখনো বুঝে উঠতে পারেনি।

অন্যদিকে, আন্দোলনের মূল সারবস্তু বোঝার চেয়ে আওয়ামী লীগ জোর দিয়েছে গুজব, বিএনপি, জামায়াত ষড়যন্ত্র- এসব বিষয়ের উপর। এবং এর মোকাবেলা করবার জন্য—বিশেষত, যখন স্কুলের শিক্ষার্থীদের সমর্থনে বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ছাত্রছাত্রীরা রাস্তায় নেমে আসে, তখন  পুলিশের পাশাপাশি দলটিকে নির্ভর করতে দেখা গেছে পেটোয়া বাহিনীর উপর।

আওয়ামী লীগসহ ক্ষমতার বাইরের দলগুলো যে বিষয়টা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে সেটা হল এ আন্দোলনটা ছিল একটা প্রজন্মের আন্দোলন- যারা এতদিন ধরে চলে আসা অনিয়মের বিপরীতে একটা মৌলিক পরিবর্তন চাচ্ছে। প্রজন্মের এ ভাষা যদি তারা বুঝতে ব্যর্থ হয় তাহলে তারা এ প্রজন্মের কাছ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, যা তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যতকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলবে।

ছাত্রছাত্রীরা দাবি তুলেছে নিরাপদ সড়কের। ওবায়দুল কাদের দীর্ঘ সময় সড়কের দায়িত্বে থেকেও সড়ক নিরাপদ করতে পারেন নাই। এ সময় তিনি নিজে অনেকের লাইসেন্স চেক করেছেন,কিন্তু তিনি তাঁর সহকর্মী এবং রাষ্ট্রের উর্ধ্বতন ব্যক্তিরাই যে লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাচ্ছেন সেটা হয়তো বুঝতে পারেন নাই অথবা বুঝলেও তাঁদের গাড়ী চেক করে দেখবার সাহস করেন নাই।

অপরদিকে, নতুন প্রজন্ম যখন গাড়ি চেক করেছে, তাঁরা রাস্তার গাড়িটি কার সেটি না দেখে দেখেছে গাড়ির চালকের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে কিনা। অন্যদিকে, ওবায়দুল কাদের থেকে পুলিশ সবাই আগে দেখেছে গাড়িটি কার, তারপর সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁরা গাড়ির কাগজ দেখবেন কী দেখবেন না! বস্তুত, এ অসঙ্গতিতাই নতুন প্রজন্ম আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

ছাত্রছাত্রীরা যেটা করে দেখিয়েছে সেটা হল সুশাসনের উদাহারণ। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে এ সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। এ সুশাসন নিশ্চিত না করে শুধু ত্রুটিপূর্ণ একটি আইন পাশ করার মধ্য দিয়ে সড়ক নিরাপদ করা যাবে না।

সড়ক সেদিনই নিরাপদ হয়ে উঠবে যেদিন পুলিশকে মন্ত্রী, সাংসদ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের যেকোনও উর্ধ্বতন ব্যক্তি এবং তাঁদের জ্ঞাতি গোষ্ঠী আইন ভঙ্গ করলে গ্রেপ্তারসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবার ক্ষমতা দেয়া হবে। এর আগে যতই আইন পাশ এবং রাস্তা মেরামত করা হোক  না কেন সড়ক নিরাপদ হবে না। এ বিষয়টাই দেশ কাঁপিয়ে নতুন প্রজন্ম আমাদেরকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে।