গোরক্ষা এবং উত্তরপ্রদেশ ও প্রাইভেট সেনা

গৌতম রায়
Published : 8 August 2018, 03:24 PM
Updated : 8 August 2018, 03:24 PM

বিগত ২০১৬ সালের শুরুর দিক থেকেই স্বঘোষিত 'বাবা' নরসিংহানন্দ সরস্বতী প্রায় পনের হাজার লোকের একটি ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলেন, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন 'হিন্দু স্বভিমান সেনা' ।

এ প্রাইভেট আর্মির তথাকথিত কর্মকাণ্ড ব্যাপৃত ছিল উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলের দিকেই। ২০১৪ এর লোকসভা ভোটের পরে, অথচ উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটের আগে 'হিন্দু স্বভিমান সেনা' উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল দশনা, মিরাট এবং মজফফরনগরে প্রায় পঞ্চাশটি প্রশিক্ষণ শিবির সংগঠিত করে। সেসব প্রশিক্ষণ শিবিরগুলোতে কিশোর, কিশোরী এবং যুবক- যুবতীদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।

আট বছরের বালকদের পর্যন্ত লাঠি, পিস্তল এবং বন্দুক দিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। 'হিন্দু স্বভিমান সেনা'র প্রধান কর্মকর্তা ও স্বঘোষিত 'বাবা' নরসিংহানন্দ সরস্বতীর সদম্ভ ঘোষণা ছিল, তাঁর হিন্দুত্ববাদী সৈন্য জেগে উঠবে মুসলমানেরা আগামী ২০২০ নাগাদ ইসলামি রাষ্ট্র তৈরির সংকল্প প্রকাশ্যে আনলেই।আপাতত এই ব্যক্তিগত সেনাদলকে প্রায় গোটা উত্তরপ্রদেশেই নিয়োজিত করা হয়েছে তথাকথিত 'গো-রক্ষা'র দায়িত্ব দিয়ে।

'হিন্দু  স্বভিমান সেনা'কে সাধারণ মানুষের কাছে উপস্থাপন করা হচ্ছে 'ধর্ম সেনা' হিসেবে। একটি ইংরেজি দৈনিকে ২০১৬ সালেই এই তথাকথিত সেনাবাহিনীর অন্তর্গত শিশুসেনার সবিস্তার প্রতিবেদন প্রকাশ হয় (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ২০ জানুয়ারি, ২০১৬)। সে সময়েই গাজিয়াবাদ জেলার দশনার একটি মন্দিরে এই সংগঠনের প্রধান দপ্তর ছিল এবং সেখান থেকে তাদের কাজকর্ম চালাচ্ছিল।

তখন তাদের প্রায় পঞ্চাশটিরও বেশি প্রকাশ্য প্রশিক্ষণ শিবির সংবাদমাধ্যমের নজরে এসেছিল। এইসব শিবিরে আট বছরের বালিকার সশস্ত্র প্রশিক্ষণের কথাও তখন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়। আমাদের মনে রাখা দরকার উত্তরপ্রদেশের বিধানসভার ভোট তখন দরজায় কড়া নাড়ছিল। এখানেই প্রশ্ন জাগে, সে সময়ে উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় থাকা সমাজবাদী পার্টি পরিচালিত অখিলেশ সিং যাদব পরিচালিত রাজ্য সরকার তখন কী করছিলেন! এ তথাকথিত 'ধর্মসেনা', যার আড়ালে আরএসএস এর নিজস্ব নেটওয়ার্ক অনুযায়ী রাজনৈতিক হিন্দুদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ চলছিল, এদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কী কোনও গোয়েন্দা সূত্রে খবর অখিলেশ প্রশাসনের কাছে ছিল না? সেই সময়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে হিন্দু সেনার সচিত্র খবরাখবর প্রকাশ হয়।তাহলেও কেন নিশ্চুপ হয়ে বসে ছিলেন সেই সময়ের মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ সিং যাদব?

বস্তুতপক্ষে 'হিন্দু স্বভিমান সেনা'র আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা ২০১৬ সালে। তবে ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের অনেক আগে থেকে এই সশস্ত্র রাজনৈতিক হিন্দু সন্ত্রাসী সংগঠনটির নেটওয়ার্ক আরএসএস তাদের বিভিন্ন শাখা সংগঠনের ভিতর দিয়ে করতে শুরু করে দিয়েছিল।

দ্বিতীয় দফার ইউপিএ সরকারের আমলেই এই রাজনৈতিক হিন্দুদের সশস্ত্র প্রাইভেট সেনাবাহিনী গঠনের সলতে পাকাবার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছিল। নরসিংহানন্দ সরস্বতী উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে তার এই রাজনৈতিক হিন্দুদের সশস্ত্র প্রাইভেট সেনার আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠার আগে সংশ্লিষ্ট ভৌগোলিক এলাকায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে একটা দাঙ্গার পরিবেশ রচনা করে দিয়েছিলেন।মুজফফরনগরের দাঙ্গাতেও 'বাবা'টি পর্দার আড়াল থেকে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেন।

গত লোকসভা নির্বাচনের আগে বিভাজনের রাজনীতিকে তীব্র করে তুলতে আরএসএস এবং তাদের বিভিন্ন শাখা সংগঠন এবং রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই প্রসঙ্গে আমাদের বিস্ময় জাগে এই কারণে যে, নরসিংহানন্দ সরস্বতী যখন পর্দার আড়াল থেকে আরএসএস এর প্রত্যক্ষ মদদে রাজনৈতিক হিন্দুদের একটি সশস্ত্র প্রাইভেট সেনা গড়ে তোলার উদ্যোগ হিসেবে মুজফফরনগরে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা সংগঠিত করছেন এবং একই কীর্তি তিনি করে চলেছেন মেরঠের দাঙ্গার ক্ষেত্রেও, তখনও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন রয়েছে মনমোহন সিং এর নেতৃত্বে কংগ্রেসের দ্বিতীয় দফার ইউপিএ সরকার। আর উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় রয়েছে সমাজবাদী পার্টির নেতৃত্বে অখিলেশ সিং যাদবের সরকার।তাঁরা কী দিবানিদ্রায় মগ্ন ছিলেন?

২০১৬ সালে মীরাট শহরের মুজফফরনগর জেলার বিভিন্ন প্রান্তে  'হিন্দু স্বভিমান সেনা'র নানা কর্মকাণ্ড সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হতে থাকে। তখনও 'গরু' অগ্রাধিকার পেয়েছে, কিন্তু পরিস্থিতিটা এমন গরুময় ছিল না। গরুর থেকেও তখন মুসলিম আতঙ্ককে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার ভোটের নিরিখে গুরুত্বের দিক থেকে বেশি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল।

কারণ, এই রাজনৈতিক সশস্ত্র হিন্দু প্রাইভেট সেনাতে যাদেরই সংযুক্ত করা হচ্ছিল, তাদেরই একটা বড় অংশের হাত পেকেছিল কিন্তু ২০১৪ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে মুজফফরনগর ও মীরাটের দাঙ্গার ভিতর দিয়ে। সেইসব কর্মীদের প্রায়োগিকভাবে লোকসভা ভোটে বিজেপির বিজয় বৈজয়ন্তী দেখিয়ে বোঝানো হয়েছিল যে, দাঙ্গার ভিতর দিয়ে সামাজিক মেরুকরণ এবং বিভাজনের রাজনীতিকে জোরদার করা হলে কতোখানি নির্বাচনী সাফল্য আসে!

এই অভিজ্ঞতাকেই রাজনৈতিক হিন্দুদের সশস্ত্র প্রাইভেট সেনারা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার ভোটে প্রয়োগ করে বিজেপির এতোবড়ো সাফল্য এনে দেয়। স্বঘোষিত 'যোগী' আদিত্যনাথ ওরফে অজয় সিং বিশওয়াতের উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর তখতে বসার পর থেকে এই রাজনৈতিক হিন্দুদের সশস্ত্র প্রাইভেট সেনা সেরাজ্যে একটা ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। 'হিন্দু স্বভিমান সেনা'র বর্তমানে কায়েম করা অরাজকতার আগেও তারা যে সংস্কৃতির আমদানি ঘটিয়েছিল, সেই নোংরা সংস্কৃতিরই বলি হয়েছিলেন দাদরি গ্রামের শেখ আখলাখ।

অখিলেশ সিং যাদবের মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে সেই নারকীয় ঘটনা ঘটলেও ঘটনার পিছনে রাজনৈতিক হিন্দুদের সশস্ত্র প্রাইভেট সেনার একটা বড়ো রকমের ভূমিকা যে ছিল, সে কথা কোনো অবস্থাতেই অস্বীকার করা যায় না।

দাদরির শেখ আখলাখের সেই হৃদয় বিদারক ঘটনার প্রায় তিন বছর পরে উত্তরপ্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে হাপুর শহরের কাছে পিলখুয়া অঞ্চলে পবিত্র ইদল ফিতরের সময়ে প্রায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। গোটা অঞ্চলটিতে এই রাজনৈতিক হিন্দুদের সশস্ত্র প্রাইভেট সেনা এখন স্বঘোষিত গোরক্ষক হিসেবে নিজেরাই নিজেদের নিয়োগ করেছে। এই তথাকথিত গোরক্ষকদের দ্বারা কোয়াসিম নামক এক নিরীহ যুবকের উপরে চলে নির্মম গণপ্রহার।

গত জুন মাসের ১৮ তারিখে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে কিছু গবাদি পশু কেনার জন্যে বাড়ি থেকে বের হয় কোয়াসিম। তার ভাই সালেম জানিয়েছেন- বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর সকালে কোয়াসিম একটি ফোন পান। সেই ফোনে তাঁকে সকাল এগারোটা নাগাদ বাজেরা কুর্দ এলাকাতে আসতে বলা হয়। যে সময়টিতে কোয়াসিমকে বাজেরা কুর্দ এলাকাতে আসতে বলা হয়, সেই সময়েই গরুকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট এলাকাতে জোর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। গবাদি পশু কেনাবেচা করতে কিছু ব্যবসায়ী সেখানে জড়ো হওয়ার পরই এই গরুকেন্দ্রিক গুজব ছড়াতে শুরু করে। কোয়াসিম বাজেরা কুর্দ এলাকাতে পৌঁছানো মাত্রই তার উপর সমবেত জনতা সশস্ত্রভাবে চড়াও হয়।

"সেখানে জড়ো হওয়া সশস্ত্র লোকজন নৃশংসভাবে আমার ভাইকে হত্যা করে। তাঁকে হত্যা করার একমাত্র কারণ হলো যে, সে মুসলমান। এছাড়া তাঁকে হত্যা করার আর কোনো কারণ নেই",  দিল্লিতে এক সাংবাদিক সন্মেলনে এই অভিযোগ করেন কোয়াসিমের ভাই সালেম।

পঁচিশ জনের মতো সশস্ত্র রাজনৈতিক হিন্দু নৃশংসভাবে আক্রমণ করে কোয়াসিমকে। লাঠি, তলোয়ার ইত্যাদি দিয়ে উন্মত্ত জনতা যেভাবে কোয়াসিমের উপর আঘাত করে তাতে কার্যত তাঁর মৃত্যু হয়।এই হামলাকারীদের বেশিরভাগই ছিল অল্পবয়সী ছেলে। সব থেকে হৃদয়বিদারক ঘটনা হলো মারাত্মকভাবে আহত কোয়াসিম যখন প্রবল তৃষ্ণায় এক ফোঁটা জলের জন্যে হাহাকার করেছে, তখনও হামলাকারীদের থেকে চরম নিষ্ঠুর ব্যবহারই সে পেয়েছে। কোয়াসিমের মৃতদেহ বহুক্ষণ রাস্তায় পড়েছিল। অনেক পরে পুলিশ এসে মৃতদেহ উদ্ধার করে।

কোয়াসিমের নৃশংস হত্যাকে ঘিরে উত্তরপ্রদেশ সরকারের পুলিশের ভূমিকা আমাদের মনে করিয়ে দেয় গুজরাট গণহত্যার পরে সে রাজ্যের পুলিশের ভূমিকার কথা। অসহায় কোয়াসিমের উপর যখন রাজনৈতিক হিন্দুরা প্রায় ঘণ্টাখানেকেরও বেশি সময় ধরে অত্যাচার করছিল, সেই সময়ের ভিতরে কিন্তু পুলিশের টিকিটিরও সন্ধান ওখানে পাওয়া যায়নি। যদিও বাজেরা কুর্দের ঘটনাস্থল থেকে পুলিশ চৌকির খুব একটা দূরত্ব ছিল না।

কোয়াসিমের মৃত্যু সুনিশ্চিত হওয়ার পরই পুলিশ আসে।সব থেকে দুঃখের কথা এতোবড়ো একটা নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর বিরাট পুলিশ বাহিনীর পরিবর্তে বিক্ষিপ্তভাবে তিনজন পুলিশ আসে।কোয়াসিমের মৃতদেহ রাস্তার উপর থেকে সরানোর যে ছবি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তা আরও ভয়ঙ্কর। ওই ছবিতে দেখা যাচ্ছে, প্রধানত রাস্তার জনতা, যারা আসলে কোয়াসিমের হত্যাকারী, তারাই একপ্রকার চ্যাংদোলা করে কোয়াসিমের মৃতদেহ নিয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট ছবিতে দেখা যাচ্ছে তিনজন পুলিশ কর্মীকে। সম্ভবত একজন পুলিশ কর্মী ধরে আছে মৃতদেহের হাত। অপর একজন পুলিশ কর্মী অত্যন্ত নিস্পৃহ ভঙ্গিতে নিজের মোবাইল ফোনটি দেখছে এবং আর একজন পুলিশকর্মী সেই ১০-১২ জন লাশবহনকারীর আগে আগে চলেছে।

পাঠক, গুজরাট গণহত্যার পরে ২০০২ সালে ঠিক গোধরার নারকীয় ঘটনার পর আনসারী নামের এক যুবকের মৃতদেহ নিয়ে সেদিনের গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পুলিশের ছবিটাই মনে পড়ে যাচ্ছে না কি? এই ফটোগ্রাফটি সামাজিক গণমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়ার পর শেষ পর্যন্ত ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয় উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। কার্যত কোয়াসিমকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা হিসেবে উত্তরপ্রদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়- ঘটনার সময়ে কোনো অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ার ফলে বাধ্য হয়ে পুলিশকে ওই উপায় অবলম্বন করতে হয়।

গোটা ঘটনাক্রমের পিছনে আরএসএস এর নিজস্ব ব্যক্তিগত সশস্ত্র রাজনৈতিক হিন্দু ঠ্যাঙারে বাহিনী 'হিন্দু স্বভিমান সেনা'র ভূমিকা রয়েছে। উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল থেকে এরা এদের কর্মকাণ্ড শুরু করলেও এখন গোটা উত্তর প্রদেশকে ছাপিয়ে রাজস্থান, হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশেও এদের কর্মকাণ্ড ব্যাপৃত হতে শুরু করে দিয়েছে।

রাজস্থানসহ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটকে কেন্দ্র করে আরএসএস এর সংজ্ঞা অনুযায়ী সামাজিক প্রযুক্তির প্রচার, প্রসার এবং প্রয়োগ হলো এই রাজনৈতিক সশস্ত্র 'হিন্দু স্বভিমান সেনা'র আগামী দিনের লক্ষ্য। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে আরএসএস এর লক্ষ্যপূরণে, তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির পালে হাওয়া জোগাতে যে সামাজিক প্রযুক্তির পথ গোটা সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির ধরবে, সেখানে এই রাজনৈতিক সশস্ত্র হিন্দু প্রাইভেট সেনা একটি বড় রকমের ন্যক্কারজনক ভূমিকা থাকবে- একথা এখনই হলফ করে বলতে পারা যায়।